#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ষট্ চত্বারিংশ পর্ব (৪৬ পর্ব)
অপরূপার পিছু পিছু যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসে মৃত্তিকা। এখানে অপরূপা গাড়ি থেকে নামে, দুজন লোকের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা হয় এবং তাদেরকে একটা ব্যাগ দেয়৷ সবকিছুই ফোনে ভিডিও করে মৃত্তিকা।
এ সুযোগে মৃত্তিকা নেমে ভাড়া মিটিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে নেয়। একই গাড়ি বেশিক্ষণ পিছনে দেখলে সন্দেহ হতেই পারে।
অপরূপা এবারে একটা গলির ভিতর যায়। মৃত্তিকাও সিএনজি নিয়ে পিছু নেয়। কিছুক্ষণ পর সিএনজি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে পিছু নেয়া শুরু করে। সরু গলি এবং খানাখন্দে ভর্তি রাস্তা হওয়ায় গাড়ি খুব ধীরে চলছে।
মৃত্তিকার পিছু নিতে খুব একটা কষ্ট হলো না। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে গিয়ে একটা বাসার সামনে গাড়িটা থামে। মৃত্তিকা কয়েক বিল্ডিং পরে একটা বাসার গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে দেখে৷
অপরূপা ভিতরে চলে যায় আর ড্রাইভার গাড়িতেই থাকে। তারমানে অপরূপা আবারো বের হবে। আধঘন্টার মতো একই জায়গায় থাকে মৃত্তিকা, কিন্তু অপরূপার দেখা পায় না।
ফোনের কম্পন অনুভব করে চমকে উঠে মৃত্তিকা। ফোন বের করে ইমতিয়াজের নাম্বার দেখেও রিসিভ করে না। বাসায় গিয়েছে কিনা সেটা জানতেই বোধহয় কল করছে৷ একসময় কল কে°টে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন সুইচ অফ করে দেয় সে।
“চলো, এখন সোজা বাসায় যাবো।”
অপরূপার কন্ঠ শুনে মৃত্তিকা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সেদিকে তাকায়। অপরূপা আবারো গাড়িতে উঠে পড়েছে। সে চলে গেলে মৃত্তিকা ভিতরে যায়।
দোতলা বাড়ির নিচতলা সম্পূর্ণ অন্ধকার। বাড়িটা হয়তো এখনো নির্মাণাধীন, বাইরের ইটের স্তুপ তো সে কথাই জানান দিচ্ছে। অন্ধকারে দেখতে অসুবিধা হওয়ায় ফোন অন করতে বের করার সময় একটা গো°ঙা°নির মতো শব্দ পায়। মৃত্তিকা চমকে উঠে, চোখ বড়বড় করে আশেপাশে তাকায়। এতোক্ষণে ওর চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আবছাভাবে একটা দরজা দেখে সে।
সাবধানে হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে কান পাতে। কেউ ভিতরে গো°ঙা°চ্ছে। যতটুকু বুঝলো কোনো মেয়ে হবে৷ দরজায় তালা দেয়া আছে। মৃত্তিকার শরীরে লেগে তালা নড়ে শব্দ হয়৷
সিঁড়ির উপর থেকে কেউ বলে উঠে,
“কে?”
পুরুষ কন্ঠ, মৃত্তিকা সরে যায়। বাইরে থেকে নিয়ে আসা ইটটা হাতে শক্ত করে ধরে। কম বয়সী একটা লোক নেমে আসে। লোকটা এসেই লাইট জ্বালায়। মৃত্তিকা ইটটা নিজের পিছনে লুকিয়ে ফেলে।
লোকটা মৃত্তিকার দিকে একটা ক°ড়া বাক্য ছুড়ে বলল,
“কি সমস্যা? কি চাই?”
মৃত্তিকা কিছু বলার আগেই দরজার ওপার থেকে “উম, উম” কিছু শব্দ ভেসে আসে৷ লোকটা ধম°কের সুরে বলল,
“ওই চুপ।”
মৃত্তিকার দিকে ফিরে ওর পা থেকে মাথা অব্দি দেখে বলল,
“ম্যাম বেশ খুশিই হবেন।”
মৃত্তিকাকে ধরতে আসলে ইটটা দিয়ে লোকটার মাথায় আ°ঘাত করে। মাথা কপাল কে°টে ফেঁটে র°ক্ত পড়া শুরু হয়। পকেট হাতড়ে চাবি পায় সে। দরজা খুলেই সে একদফা হতভম্ব হয়ে যায়।
চারজন অল্পবয়সী মেয়ে হাতপা, মুখ বাধা অবস্থায় পড়ে আছে৷ তাদের এলোমেলো অর্ধ পোশাক জানান দিচ্ছে তাদের সাথে কি হয়েছে। গলায়, ঘাড়ে, বাহুতে আঘাতের চিহ্ন। কপাল, ঠোঁট ফুলে লাল হয়ে আছে।
মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি করে জানলার পর্দা খুলে এনে মেয়েগুলোকে ঢেকে দেয়। একে একে ওদের হাত-পা, মুখ খুলে।
মেয়েগুলো সদ্য চোখে দেখা বিড়াল ছানার মতো ভ°য়ে কুঁচকে যেতে থাকে। মৃত্তিকা দরজার দিকে তাকিয়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে,
“ওই মেয়েটা কে? একটু আগে যে এসেছিল?”
মেয়েগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। একজন মিনমিনে কন্ঠে বলে,
“অপরূপা।”
মৃত্তিকার আর কিছু বোঝার দরকার নেই। অপরূপা এসেছিল, তার মানে এসবের পেছনেও শাফিন আর মমতাজ বেগমেরই হাত আছে। তানজিম তো ওকে অপরূপার নামই বলেছিল।
মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অপরূপা আজ আর আসবে?”
“জানা নেই, তবে কাল আসবে।”
মৃত্তিকা রশি নিয়ে বাইরে যায়৷ একটু আগের লোকটা মেঝেতে পড়ে আছে, তার হাতপা বেঁধে রেখে বলে,
“আর কেউ আছে এখানে?”
“আরেকজন থাকতে পারে।”
মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখে না। ভিতরে এসে দেখে মেয়েগুলো এতোক্ষণে আশপাশ থেকে নিজেদের পোশাক নিয়ে পড়ে ফেলেছে।
মৃত্তিকা বলে,
“চলো।”
চারজনকে নিয়েই সে বেরিয়ে আসে। দ্রুত গতিতে হাঁটতে হাঁটতে মৃত্তিকা বলে,
“কোথায় যাবে তোমরা?”
মেয়েগুলোর মধ্যে একজন মাথা নেড়ে বলল,
“বাসায় যাবো।”
“আগে আমার সাথে আসো।”
মৃত্তিকা ওদেরকে নিয়ে শরীফের বাসায় যায়৷ যাত্রাবাড়ী থেকে সিএনজি করেই চলে আসে। স্টোররুমের দরজা খুলে ভিতরে এনে বলল,
“আপাতত একটু এখানে বসো।”
ওদের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করে সে৷ বিস্কুট, পাউরুটি, কলা আর পানি। ব্যস, এটুকুই গো°গ্রা°সে গিলছে ওরা৷ মৃত্তিকা ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে পড়ে ইমতিয়াজ কল করেছিল।
ফোন অন করে কলব্যাক করে সে। সাথে সাথেই রিসিভ হয়। ইমতিয়াজ জোরে ধমক দিয়ে বলে,
“কোথায় আছো তুমি? কান্ডজ্ঞান কি আছে? ফোন অফ কেন?”
মৃত্তিকা একটু নিচুস্বরে বলল,
“সরি, নেটওয়ার্ক ছিল না বোধহয়।”
ইমতিয়াজ একটু শান্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কোথায় আছো তুমি?”
“শপিংয়ে এসেছি।”
“ওকে, বাসায় ফিরে জানিয়ো।”
“হুম।”
মৃত্তিকা ফোন রাখে। ইমতিয়াজের ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে,
“মিউকো যাত্রাবাড়ী থেকে ধানমন্ডি শরীফ স্যারের বাসায় এসেছে।”
নাম্বারটা শরীফের স্পা°ই ফাহাদের। ইমতিয়াজই তাকে মৃত্তিকার খেয়াল রাখতে বলেছিল। ম্যাসেজটা দেখে ইমতিয়াজ নিজে নিজেই বলে,
“আমাকে লুকিয়ে কি করছো তুমি মৃত্তিকা?”
______________________________________
সন্ধ্যা সাতটা বেজেছে। সারাদিনে আহনাফ একবারের জন্যও বাইরে যায়নি। শুধুমাত্র ওই বন্ধ রুমে গেছে আর বাইরে এসেছে। সকালে জামিল আর আহনাফের মধ্যে হওয়া সব কথাই সারাহ্ শুনেছে। শাফিন ঠিক কতটা জঘন্য কাজ করেছে তা সারাহ্-র ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। নিজের ভাগ্নির দিকে কেউ কিভাবে কু°দৃষ্টি দেয়?
সকালের পর সারাদিনে তাদেরকে আর কিছুই খেতে দেয়নি আহনাফ। সারাহ্ ওকে ভ°য়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি।
চা বানিয়ে এনে আহনাফের সামনে রেখে বলে,
“নাস্তা করে নিন।”
আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি খেয়েছো?”
“এইতো খাবো।”
সারাহ্ও চা এনে ওর সাথে বসে। আহনাফ আজ একটু চুপচাপ আছে। সারাহ্ ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“আজ এতো শান্ত কেন?”
আহনাফ একটু হেসে বলল,
“প্রতিদিন তো শান্ত থাকতেই বলো।”
সারাহ্ মাথা তুলে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ কেমন যেন অনুভূতিহীন হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। সারাহ্ ওর গালে হাত দিয়ে বলে,
“আপনাকে শান্ত অবস্থায় আমার ভালো লাগে না।”
আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে ওর ওষ্ঠোধরকে আপন করে নিলো। সারাহ্ ওকে সরানোর চেষ্টা না করে বরং আরো কাছে নিয়ে আসে। প্রতি ছোঁয়ায় আহনাফ তাকে ক্রমেই পাগল করছে। সারাহ্-র হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যায়, মাটির কাপটা শব্দ করে পড়ে ভে°ঙে যায়। দুজনে চমকে সরে আসে।
সারাহ্ ছটফট করে বলে,
“আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
পাশের রুমে শব্দ হওয়ায় সারাহ্ থেমে যায়। আহনাফ উঠে সে রুমে যায়। গিয়েই দরজা বন্ধ করে সে। জামিল দরজায় ধা°ক্কা দিয়েছে বলেই শব্দটা হয়েছিল।
আহনাফ জামিলের বুকে লা°থি দিয়ে ফেলে বলল,
“কি সমস্যা?”
আহনাফ তার মুখের বাঁধন খুলে দেয়। জামিল বলে,
“আমি তো সব বলেছি। আমাকে তবুও কেন আ°টকে রেখেছো?”
আহনাফ ওর সামনে বসে বলল,
“সবটা তো বলোনি, বাবার প্রতি রাগ বুঝলাম। কিন্তু সারাহ্-র মায়ের সাথে কি? পুরোনো খু°নের রেশ? এটা তো হতে পারে না।”
“শাফিন সব করতে পারে।”
জামিলের নাকেমুখে জোরে থা°প্প°ড় দেয় আহনাফ। বলে,
“তোমার তার সাথে কি? তাহসিনার সাথে কি ছিল আর তাহমিনার সাথেই বা কি ছিল? রিপা আন্টি কি করেছিল?”
জামিল মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“শাফিনকেই জিজ্ঞাসা করে নাও।”
“কোথায় থাকে সে?”
জামিল ফিসফিস করে বলে,
“তোমার ঘাড়ের কাছে।”
মরিচের গুড়ার বক্সে এখনো কিছু অবশিষ্ট ছিল। আহনাফ রাগে সেখান থেকে এক খাবলা নিয়ে জামিলের চোখমুখে ছুড়ে ফেলে। জোর করে তার চোখ খুলে ভিতরে ঢু°কিয়ে দেয়৷ “আহ” করে চেঁচিয়ে উঠে সে।
আহনাফ তার মুখ জোর করে বেঁ°ধে দিয়ে বেরিয়ে আসে। আহনাফের হাত জ্বা°লাপো°ড়া করছে। ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেয় সে।
সারাহ্ ওর দিকে ভ°য়া°র্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
“কি করেছেন ভিতরে?”
আহনাফ উত্তর দেয় না। সে ক্রমাগত হাত ধুয়ে চলেছে। রাগে তার মাথা কাজ করা থামিয়ে দিয়েছে।
______________________________________
রাত আটটায় বাসায় আসে ইমতিয়াজ। সদর দরজার উপরে একটা চিরকুট লাগানো।
“নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলেন, আর লাইট জ্বা°লানো যাবে না।”
ইমতিয়াজ একটু হেসে কাগজটা পকেটে নিয়ে দরজা খুলে। ভিতরে অন্ধকার, দরজা বন্ধ করতেই তা আরো গাঢ় হলো।
মৃত্তিকা টেবিলের উপর রাখা মোমবাতি জ্বা°লিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে। বেনারসি শাড়ি পড়েছে, আঁচল দিয়ে ঘোমটা দিয়েছে সে। ঠোঁট গাঢ় লাল লিপস্টিক, চোখে মোটা কাজল। ইমতিয়াজ কাঁধের ব্যাগটা ফ্লোরে ফেলে দেয়। একটা ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।
মৃত্তিকা ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“সারপ্রাইজটা কেমন হলো?”
ইমতিয়াজ ভ্রূ উঁচিয়ে জোরপূর্বক হাসে। মৃত্তিকাকে কি কি ব°কা দিবে তা ভাবতে ভাবতেই বাসায় এসেছে সে। অথচ এখন কথাই বলছে না।
মৃত্তিকা ওর গালে হাত দেয়। মৃত্তিকা কাছে এসে ইমতিয়াজের গলায় ঠোঁট ডু°বায়।
মৃত্তিকা ফিসফিস করে বলল,
“এ সাজ আপনার জন্য ইমতিয়াজ। সাজটা নষ্ট করে দিন না আজ?”
অমায়িক আবেদন, আবেদনময়ীর আবেদনে সারা না দিয়ে কি উপায় আছে?
______________________________________
ভোরে নামাজ শেষে আহনাফ কোরআন তেলাওয়াত করছে। সারাহ্ পাশেই শুয়ে আছে৷ ঘুমাবে ঘুমাবে করেও তার ঘুম হচ্ছে না। আহনাফ ওর মাথায় হাত বুলায়।
সারাহ্ নিচুস্বরে বলে,
“একটু জোরে পড়ুন, আমি শুনবো।”
আহনাফ হেসে একটু জোরে জোরে তেলাওয়াত শুরু করে। সারাহ্ মনোযোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর আহনাফ কোরআন শরীফ রেখে উঠে যায়। সারাহ্ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকে।
জামিলের রুমে আসে, সাথে সেই চারটা রুটি। জামিলের অবস্থা ভ°য়া°বহ। চোখে সে কিছুই দেখছে না। রাতে জ্ঞা°ন হারিয়েছিল, তবে পানি দেয়ার পরই জ্ঞা°ন ফিরেছে।
আহনাফ কল করে ডা. সৌহার্দ্যকে। জামিলের কথা জানালে সৌহার্দ্য তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলে। আহনাফ এখন তার হাতের বাঁ°ধন খুলে জো°র করে রুটি খাইয়ে দেয়। পরিচিত একজনের সিএনজি করে কুমিল্লা মিশন হাসপাতালে নিয়ে আসে।
ডা. সৌহার্দ্য তাকে দেখে। আহনাফ তাকে সত্যটা জানায় না। বলে,
“কোনো এক শ°ত্রু এ কাজ করেছে।”
আহনাফ সর্বক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় জামিল কিছুই বলতে পারেনা। চুপচাপ তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।
সৌহার্দ্য সব দেখে জানায়,
“ডানচোখ একেবারেই অ°কেজো হয়ে গেছে। শুধু মরিচ দেয়নি, এখানে জোরে প্রেশার দিয়েছে। ভর্তি করাও, দেখি কি করা যায়।”
“ভর্তি ছাড়া আর কোনো উপায়?”
“না, ভর্তি করিয়ে নাও। চিকিৎসা একটু লম্বা হবে এটার।”
আহনাফ জামিলের দিকে তাকায়। মাথানিচু করে জামিলকে বলল,
“শুধু শুধু টাকা খরচের কোনো মানে দেখি না।”
______________________________________
সকাল এগারোটা ত্রিশ মিনিট, আজ থেকে পুরোদমে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়েছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকাকেও নিয়ে এসেছে। তবে মৃত্তিকা কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। ইমতিয়াজ দেখেও চুপ ছিল, ফাহাদকে পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছে।
মৃত্তিকার গন্তব্য যাত্রাবাড়ী, দুইঘন্টা পর এসে পৌঁছায়। রাস্তায় মাত্রাতিরিক্ত না হলেও মোটামুটি জ্যাম ছিল। গলির ভেতর প্রবেশ করতেই পেছনে ফাহাদকে খেয়াল করে মৃত্তিকা।
আজ মৃত্তিকা খালি হাতে আসেনি, শরীফের শোবার রুমের আলমারি থেকে পি°স্ত°লটা নিয়ে এসেছে। যদিও তা ওর ব্যাগে। পি°স্ত°ল চালাতে সে জানে না, তবে এটা দেখিয়ে যে ভ°য় দেখানো যাবে তা জানে।
বাসাটা কাছাকাছি এসে ফাহাদের দিকে পি°স্ত°ল তাক করে মৃত্তিকা। বলে,
“পিছু নিচ্ছো কেন?”
“আপনি কোথায় যান তা জানতে স্যার আমাকে পাঠিয়েছে।”
মৃত্তিকা পি°স্ত°লটা ব্যাগে রেখে বলল,
“দেখো তুমি আমার বাবার বেতনভুক্ত একজন কর্মচারী। সারা মাস আমাকে নজরবন্দী রেখে মাস শেষে কত টাকা বেতন পাও? দশ হাজার? বিশ হাজার? চল্লিশ হাজার? এর চেয়ে বেশি তো নয়?”
ফাহাদ ওর কথা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না। তবুও মাথা নাড়লো।
মৃত্তিকা হেসে বলে,
“বেতন দ্বিগুণ হবে। এক মাস আমার কথা মতো চলো, জাস্ট এক মাস। এই এক মাস তুমি তোমার স্যারকে আমার সম্পর্কে কোনো ইনফরমেশন দিতে পারবে না। রাজি?”
মৃত্তিকার অফারটা ভালো। ফাহাদের বেশ পছন্দ হয়। সে রাজি হয়ে যায়। মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলে,
“এখানেই কোথাও লুকিয়ে থাকো আর আমার ইশারার অপেক্ষা করো।”
কথা শেষে মৃত্তিকা বাসার ভিতরে প্রবেশ করে। গতকালকের সেই রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে অপরূপার। সময় গড়ায়, বিকেল চারটা বেজে যায়। কিন্তু অপরূপা আসে না। মৃত্তিকা ধরে নেয় অপরূপা আজ আসবে না।
এমনসময় দরজা খুলে ভেতরে আছে অপরূপা। মেয়েগুলো কেউ নেই, অপরূপা অবাক হয়। চোখ বড়বড় করে তাকায় সামনে বসে থাকা মৃত্তিকার দিকে। মৃত্তিকা শব্দ করে হেসে ওঠে বলে,
“গেম ইজ ওভার।”
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
সপ্তচত্বারিংশ পর্ব (৪৭ পর্ব)
বাসার কলিং বেল বাজলে মমতাজ বেগম দরজা খুলে দেন। সামিহা উনার দিকে এক বিশুদ্ধ হাসি ছুঁড়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছেন?”
মমতাজ বেগমও হেসে বলেন,
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি৷ তুমি কেমন আছো? (একটু থেমে) ভিতরে আসো।”
সামিহা ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলে,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ, আমিও ভালো আছি।”
সামিহা আশেপাশে তাকায়, বুঝতে পারে লুৎফর রহমান বোধহয় বাসায় নেই। সামিহা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
“তানজিম বাসায় আছে?”
“হ্যাঁ, ও ওর রুমে আছে। তুমি যাও।”
হাত দিয়ে তানজিমের রুম দেখায় মমতাজ বেগম।
সামিহা আবারো হেসে তানজিমের রুমে গিয়ে নক করে।
“দরজা খোলা।”
তানজিমের কন্ঠ পেয়ে সামিহা দরজা ঠেলে ভিতরে যায়।
অপ্রস্তুত চোখে সামিহাকে দেখে ভয়ে চমকে ওঠে তানজিম। সামিহা দুহাত দুদিকে দিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল,
“সারপ্রাইজ।”
তানজিম খুশি হয় না বরং ওকে ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“তুই এখানে কি করছিস?”
সামিহা হাত নামিয়ে সোজা হয়ে বলে,
“কি করব? তোকে দেখতে এসেছি।”
সামিহার বিষয়টা একটু খারাপ লাগে। ও সেই মতিঝিল থেকে কাকরাইল এসেছে তানজিমের সাথে দেখা করতে, অথচ তানজিম ওকে দেখে একবার হাসলোও না।
সামিহা বিছানার এককোণায় বসে। তানজিম বই পড়ছিল, বইটা পাশে দেখে উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।
সামিহা জিজ্ঞাসা করে,
“তোর শরীর কেমন আছে?”
“ভালো।”
ছোট করে খুব দ্রুত জবাব দেয় তানজিম।
সামিহা এবার একটু রাগ দেখিয়ে বলে,
“আমি আসলাম তোকে দেখতে, অথচ তুই আমাকে ন্যূনতম পাত্তা দিচ্ছিস না। কেন?”
তানজিমের কাছে কোনো উত্তর নেই। কিছুক্ষণ চঞ্চলভাবে নিজের চোখ এদিক-ওদিক নাই তারপর একটা মিথ্যা বলে বসে,
“আসলে আম্মু চায় না তুই আমার সাথে দেখা কর বা আমি তোর সাথে দেখা করি। তুই বুঝতে পারছিস?”
সামিহা অপলক তাকিয়ে রইলো। চোখে পানি ছলছল করছে, যেন এখনই কান্না করবে। তানজিম ওর অবস্থা দেখে। একটা কাশি দিয়ে একটু নিচুস্বরে বলে,
“কথাটা বুঝতে চেষ্টা কর। আম্মু আমাদের সম্পর্কটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। আবার সরাসরি তোকে বলতেও পারছে না (একটু থেমে) কিন্তু আমাকে বলেছে। বুঝেছিস তুই?”
সামিহা আর কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তানজিম তাকিয়ে থাকে ওর চলে যায় পথের দিকে। তানজিম ওকে এভাবে কষ্ট দিতে চায়নি, তবে ওর ভালোর জন্যই দিতে হয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাধা না মানা সামিহার চোখের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কান্নার মূল কারণ সে সংজ্ঞায়িত করছে না বা করতে চাইছে না।
______________________________________
“তুমি এখানের এড্রেস কোথায় পেয়েছো?”
অপরূপার কথায় মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এতোকিছু বলার সময় আমার নেই।”
অপরূপা হয়তো কাউকে ডাকতে চেয়েছে, তবে ওর গলা দিয়ে শব্দ বের হওয়ার আগেই মৃত্তিকা ওর গালে এক চ°ড় বসায়৷ অপরূপা সোজা হওয়ার আগে মৃত্তিকা ওর ঘাড় চে°পে ধরে মাথা দেয়ালের সাথে বেশ জোরে জোরে কয়েকবার ঠু°কে দেয়। কপাল ফে°টে র°ক্ত পড়া শুরু করে অপরূপার। মৃত্তিকা থামে না, ওর অন্য গালে চ°ড় বসিয়ে গলা চে°পে ওকে দেয়ালের সঙ্গে আটকে রাখে।
অপরুপাও দুহাতে মৃত্তিকার গলা চে°পে ধরতে চায়। তবে মৃত্তিকা ওর দুপায়ের হাটুতে জোরে লা°থি দেওয়ায় নিচে বসে পড়ে। মৃত্তিকা ওর গলা ছেড়ে দেয়।
অপরূপার দুহাত পিছনে নিয়ে টে°নে ধরে বলে,
“শাফিন তোর কি হয়?”
অপরূপা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলে,
“হাসবেন্ড।”
“কি?”
অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে বেশ জোরে কথাটা বলে মৃত্তিকা।
অপরূপা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী।”
মৃত্তিকা উপরের ঠোঁট উঁচিয়ে বেশ ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“এই আকাম কবে করছে আবার? (একটু থেমে) তবে ওর সব কুকর্ম সম্পর্কে তোর ধারণা আছে আশাকরি?”
অপরূপা জবাব দেয় না, মৃত্তিকাও জবাবের অপেক্ষা করে না।
মৃত্তিকা অপরূপার হাত বাধার জন্য আশেপাশে তেমন কিছু পায় না। তাই অপরূপা গায়ের ওড়না দিয়ে ওর হাত বেঁ°ধে দেয়। পা বাঁধার জন্য রুমের পর্দা কে°টে দুই টু°করো করে। শক্ত করে পা বেঁ°ধে বাইরে গিয়ে ফাহাদকে ডাকে।
ফাহাদকে ভিতরে এনে অপরূপার প্রতি ইশারা করে বলে,
“ওকে বাবার বাসা পর্যন্ত নিয়ে যাবে।”
ফাহাদ অবাক হয়। বাবা মেয়ে দুজনে কি মা°ফিয়া নাকি?- এমন একটা সন্দেহ তার জেগে ওঠে।
মৃত্তিকা নিজের হিজাব ঠিক করতে করতে বলে,
“কি বলেছি বুঝেছ?”
“জি।”
“গাড়ি আছে তোমার সাথে?”
“হ্যাঁ, আছে।”
মৃত্তিকা পর্দার বাকি অংশ দিয়ে অপরূপার মুখ শক্ত করে বেঁধে দেয়। ফাহাদকে বলে,
“ওকে গাড়িতে তোলো আমি আসছি।”
ফাহাদের শক্তপোক্ত শরীর। সে খুব সহজেই হ্যাংলা দেহের অপরূপাকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়। মৃত্তিকা পিছুপিছু সেখানে যায়।
অপরূপাকে গাড়ির সিটে বসাতে নিলে মৃত্তিকা বলে,
“এই কি করো?”
ফাহাদ মৃত্তিকার দিকে তাকায়। মৃত্তিকা গাড়ির ডেকের দিকে আঙুল দিয়ে বলে,
“ওকে ওখানে ঢু°কাও। এটা আমার বসার জায়গা।”
কথা শেষ করে মৃত্তিকা গাড়িতে উঠে যায়।
ফাহাদ মৃত্তিকার কথা মত অপরূপাকে গাড়ির ডেকে ঢুকিয়ে আটকে দেয়। অপরূপার নিরীহ চাহনি এক মুহূর্তের জন্য অপরূপা চোখের দিকে তাকাতে বাধ্য করে ওকে।
“কি হলো? গাড়ি কে চালাবে?”
মৃত্তিকার কথায় ফাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমিই চালাবো।”
“ওকে চালাও।”
ফাহাদ গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। উদ্দেশ্য ধানমন্ডিতে শরীফের বাসা।
______________________________________
সৌহার্দ্যের অনেক অনুরোধেও আহনাফ জামিলকে ভর্তি করায়নি। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষেই বাড়িতে নিয়ে চলে এসেছে। পিঠে ওয়াশ করে ওষুধ লাগানো হয়েছে৷ কোন কোন ওষুধ লাগিয়েছে তাও আহনাফ লিখে এনেছে।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চোখ পরিষ্কার করিয়ে এনেছে। ডানচোখে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। আবার দুইটা ড্রপ দিয়ে দিয়েছে৷
বাড়িতে আনার পর সারাহ্ জামিলের অবস্থা দেখে আ°ৎ°কে উঠে। আহনাফ যত দ্রুত সম্ভব জামিলকে রুমে বন্ধ করে দেয়।
সারাহ্ বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানে চলে আসে। তার প্রচন্ড বমি পাচ্ছে, আহনাফ যে এতটা হিং°স্র হতে পারে তা ওর কল্পনার বাইরে ছিল।
আহনাফ ওকে খুঁজতে খুঁজতে বাগানে চলে আসে। ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“কি হলো তুমি ওরকম করে দৌড়ে বেরিয়ে আসলে কেন?”
সারাহ্ একটু সরে যায়। আহনাফের দিকে না তাকিয়ে বলল,
“আপনি মার°তে পারতেন, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু এভাবে অ°ত্যা°চার করার মানে কি?”
আহনাফ ভ্রু উঁচিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“মারবো তো বলিনি ট°র্চা°র করব বলেছি। তুমি জানো না কত বড় অ°ন্যায় ওরা করেছে।”
সারাহ্ মাথা ঝাঁ°কিয়ে বলে,
“আমি শুনেছি। দরজার এপাশ থেকে ওপাশের সব কথাই শোনা যায়।”
আহনাফ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“তবে তো হলোই, বুঝতে পেরেছ কেন করেছি।”
সারাহ্ ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে,
“সকল মানুষ হেদায়েত পাবে না, এটাতো চির সত্য। এই পৃথিবীটা একটা পরীক্ষাক্ষেত্রে। এখানে কেউ হান্ড্রেট মার্কস পাবে, আবার কেউ নব্বই, কেউ বা তেত্রিশ পেয়ে কোনোরকম পাস করবে আর কেউ ফেল। কেউ কেউ শূন্য পাবে, কোনো নাম্বারই তুলতে পারবে না এরা। আপনি কাউকে হেদায়েত দিতে পারবেন না।”
আহনাফ কিছুক্ষণ গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর বলে,
“আমি কাউকে হেদায়েত দিতে পারবো না, আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ হেদায়েত দিতেও পারবে না। তবে যে অন্যায় ওরা করেছে তার জন্য এসব কিছুই না।”
সারাহ্ তাকিয়ে থাকে আহনাফের চোখের দিকে। আহনাফ বলে,
“শাফিন ছাড়া পেয়ে গেছে। ফাঁ°সির পরও, কবর দেয়ার পরও বেঁচে গেছে। বুঝতে পারছো কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ওরা।”
সারাহ্ চোখ বড় করে তাকায়, একটা ঢোক গিলে। আহনাফ নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে থাকে।
সারাহ্ আহনাফকে জড়িয়ে ধরে, আহনাফও তাকে আগলে নিলো। আহনাফের বুকে মাথা রেখে সারাহ্ বলল,
“মায়ের সাথে কি শ°ত্রুতা ওদের?”
“পুরোনো খু°নের রেশ থেকে শ°ত্রুতা এটা সবাই মানলেও আমি মানতে পারছি না। এখানে আরো অনেক কিছু আছে।”
সারাহ্ একটু চুপ করে থেকে বলে,
“মা কি আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছে?”
“অবশ্যই লুকাচ্ছে।”
______________________________________
রাতে বাসায় ফিরে ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে সরাসরি প্রশ্ন করে,
“আজ অফিস থেকে কোথায় গিয়েছিলে?”
মৃত্তিকা পড়ার টেবিল গোছাতে গোছাতে মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বলে,
“কোথাও না, বাসায় এসেছিলাম।”
ইমতিয়াজের সন্দেহ শেষ হয় না। তবে ফাহাদের কাছ থেকে কোনো যুতসই উত্তর না পেয়ে সে মৃত্তিকাকে আর তেমন কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে না।
মৃত্তিকা একটা বই এনে ইমতিয়াজের সামনে ধরে বলল,
“এ বইটা আপনি পড়েছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন লেগেছে?”
“ভালো।”
“আমিও পড়বো।”
“তোমার ইচ্ছা।”
মৃত্তিকা বইটা টেবিলে রেখে বলল,
“কাল সুরভি আপুকে দেখতে যাবো, অনেকদিন হলো রাঈদকে দেখি না।”
ইমতিয়াজ শার্ট খুলতে খুলতে বলল,
“যেও, কিন্তু আমি যেতে পারবো না।”
মৃত্তিকা জেদ করে বলল,
“না, যেতে হবে।”
“জেদ করে না, মৃত্তিকা।”
ইমতিয়াজ একটু থেমে থেকে আন্দাজে একটা ঢিল ছুড়ে বলল,
“কাল যাত্রাবাড়ী গিয়েছিলে কেন?”
মৃত্তিকা চমকে উঠে, ওর চোখমুখ দেখে ইমতিয়াজ কথার সত্যতা নিশ্চিত করে। আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। মৃত্তিকা কিছুক্ষণ ভেবে বুঝতে পারে এটা নিশ্চয়ই ওই ফাহাদের কাজ।
______________________________________
ইমতিয়াজ অফিসে গেলে মৃত্তিকা বেরিয়ে যায় ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে। বাসায় অপরূপাকে পাহারা দেওয়ার জন্য ফাহাদকে রেখে এসেছিল গতকাল।
আজ বাসায় এসেই মৃত্তিকা বুঝলো ফাহাদকে শরীফ কেন এত বিশ্বাস করে। সে ঠিকই সারারাত ধরে অপরূপার উপর নজর রাখছে। দরজা বাইরে থেকে তালা দেয়া ছিল। ফাহাদ ভিতরে এমনভাবে ছিল যে, ভিতরে কোনো মানুষ আছে কি নেই তা বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল।
মৃত্তিকা সোফায় বসে সামনে ফ্লোরে বসা অপরূপার দিকে তাকিয়ে ফাহাদকে বলে,
“বাসায় কোনো স্টোভ আছে?”
ফাহাদ রান্নাঘরের দিকে ইশারা করে বলল,
“রান্নাঘরে একটা আছে। (একটু থেমে) মানে দুই চুলা।”
মৃত্তিকা মাথায় হেলিয়ে বলে,
“সিলিন্ডারসহ নিয়ে এসো।”
ফাহাদ ওর কথা মতো কাজ করে। মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“এখন তুমি ঘুমাতে যাও। সারারাত জেগে ছিলে।”
“জি।”
বাধ্য শি°ষ্যের মতো ফাহাদ মাথা দুলিয়ে চলে গেল।
মৃত্তিকা চুলা চালিয়ে অপরূপাকে বলে,
“কেমন আছো?”
অপরূপা আড়চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকায়।
মৃত্তিকা হেসে উঠে দাঁড়ায়। একটা লোহার শি°ক ব্যাগ থেকে বের করে চুলায় সেটা গরম করতে করতে অপরূপাকে জিজ্ঞাসা করে,
“আর কে কে আছে এসবের মধ্যে?”
অপরূপা উত্তর দেয় না। মৃত্তিকা মনোযোগ দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শি°কটা গরম করছে। লোহা আ°গু°নে পু°ড়ছে, একটু একটু করে লাল হয়ে উঠছে। আশপাশটাও লোহার গরমের সাথে সাথে বেশ গরম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। অপরূপা একটু ঢোক গিলে শান্ত থাকে।
মৃত্তিকা হাসি হাসি মুখ করে বলে,
“বড়মনি মানে মমতাজ, ওই জেলার, তুমি, দুলাল, আহনাফের ছোট ফুপা আর কে কে আছে?”
অপরূপার উত্তর না পেয়ে মৃত্তিকা রেগে যায়। ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“আর কে আছে নাম বল।”
এবারেও অপরূপা চুপ। মৃত্তিকা শি°কটা এনে অপরূপার গলার কাছে ধরে বলে,
“কথা কি কানে যাচ্ছে না?”
“কানে গেলেও বলব মনে হয়?”
একটা গরম লোহার শি°ক গলার কাছে, অথচ মেয়েটা বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না। কতটা অদ্ভুত একটা বিষয়? ওর ডান বাহুতে ছ্যাঁ°কা লাগিয়ে দেয় মৃত্তিকা অপরুপা চেঁ°চিয়ে উঠে।
মৃত্তিকা কিড়মিড় করে বলে,
“সত্য বলো আর কে ছিল।”
অপরূপা ডানে বামে মাথা নাড়ায়, যার অর্থ সে বলবে না। শি°কটা আরেকটু জোরে চেপে ধরে মৃত্তিকা। ব্য°থায় চেঁচিয়ে উঠলো মুখ খুলে না অপরূপা।
______________________________________
“পরশুদিন কলেজের ছুটি শেষ। কি করবেন?”
সারাহ্-র কথায় স্বাভাবিক সুরে আহনাফ বলল,
“কি করবো? ক্লাস করাবো, ফিজিক্স পড়াবো।”
একটু থেমে আহনাফ দুষ্টুমি করে বলল,
“তুমি না হয় বড় বড় বিক্রিয়া আর জ°টিল জ°টিল পরীক্ষা করিয়ো।”
সারাহ্ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি সেটা বলছি না। এই লোকগুলোর কি হবে?”
আহনাফ মাথা নাড়ে। বলে,
“হবে কিছু একটা যখন হবে তখন দেখে নিও।”
সারাহ্ ওর হাত ধরে বলল,
“ওদের বাসায় রাখছেন, তার উপর এমন অ°ত্যা°চার চালাচ্ছেন। যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তখন? (একটু থেমে) আমি ওদের চিন্তা করছি না, আমি আপনার চিন্তা করছি। ওদের একজনের কিছু একটা হলে তার পুরো দায়ভার কিন্তু আপনার উপর আসবে।”
আহনাফ শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে বলল,
“আমি যা করছি জেনে-বুঝে, স°জ্ঞানে করছি। আমাকে বোকা ভেবো না।”
“আমি তা ভাবছি না। আমি জানি আপনি বুদ্ধিমান। যা করছেন ভেবে করছেন, তবে আমার চিন্তা হচ্ছে।”
আহনাফ ওর দুগালে হাত দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, তোমার এত যখন চিন্তা হচ্ছে, তবে ওদেরকে বাসার বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। এবারে খুশি তো?”
সারাহ্ ওর হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“খুশি।”
চলবে…..
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
অষ্টচত্বারিংশ পর্ব (৪৮ পর্ব)
মৃত্তিকা অনেকক্ষণ ধরে বেশ কয়েকবার গরম শি°কের ছ্যাঁ°কা দেয়ার পরও অপরূপা কিছুই বলে না। মৃত্তিকার রাগ তড়তড় করে বেড়ে গেল। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে যত রাগবে, ততই হার নিশ্চিত হবে।
অপরূপার ব্যাগ ঘে°টেঘু°টে মৃত্তিকা সি°গা°রেট আর একটা ড্রা°গের প্যাকেট পায়। সাদা পাউডারের মতো গুড়া জিনিসের প্যাকেটটা ফাহাদকে দেখিয়ে মৃত্তিকা নিশ্চিত হয় এটা সম্পর্কে। অর্থ যা দাঁড়ালো তা হচ্ছে অপরূপা একইসাথে ধুম°পা°য়ী আর মা°দ°কা°সক্ত।
চট করে একটা বুদ্ধি আসে মৃত্তিকার মাথায়। মা°দ°কাস°ক্ত মানুষকে অতিরিক্ত ড্রা°গ প্রয়োগ করে বা ড্রা°গ একেবারেই না দিয়ে কাবু করা সম্ভব। তবে অতিরিক্ত ড্রা°গে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকায় মৃত্তিকা তা করবে না। অপরূপা মরে গেলে শাফিন হাতছাড়া হবে।
মৃত্তিকা অপরূপার সামনে গিয়ে সি°গা°রেটের প্যাকেট থেকে একটা একটা করে সি°গা\রেট বের করতে থাকে।
অপরূপা ওকে দেখে বলল,
“তুমিও কি স্মো°ক করো?”
মৃত্তিকা বাঁকা হেসে বলে,
“না করলেও এখন তো করা যাবে? কি বলো?”
মৃত্তিকা মুখ বাঁকিয়ে বেশ ব্য°ঙ্গ করে অপরূপাকে বলে,
“মামানী।”
সবগুলো সি°গা°রেট একসাথে মুঠোবন্দি করে মৃত্তিকা। তারপর আ°গুন জ্বা°লায়। অপরূপা অবাক চোখে মৃত্তিকার কর্মকাণ্ড দেখছে।
সি°গা°রেট সবগুলো একসাথে জ্ব°লে উঠলে মৃত্তিকা ফুঁ দিয়ে আ°গুন নিভায়। অপরূপার হাত টে°নে ধরে তালুতে বসিয়ে দেয়। জ্বলন্ত সি°গা°রেটে ওর চামড়া পু°ড়ে, পো°ড়ার য°ন্ত্র°ণায় চিৎকার করে অপরূপা।
মৃত্তিকা থামেনা, বরঞ্চ সে সি°গা°রেটগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরো গভীর করে বসাতে থাকে। একসাথে বাধা পা দুটো নাড়তে থাকে অপরূপা। একটু নিস্তার পাওয়ার জন্য ছটফট করেছে
ওর অসহায়ত্ব দেখে মৃত্তিকার মায়া হয় না। আরো ক°ড়া ভাষায় বলে,
“এখন তো বলতেই পারো আর কে ছিল?”
“ডা. আরিফা।”
একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে আরিফার নামটা বলেই দেয় অপরূপা।
মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে সি°গা°রেটগুলো ফেলে দেয়। মমতাজের চিকিৎসা করেছিল এই আরিফা, একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। একজন ডাক্তার এতটা জ°ঘন্য কাজে কিভাবে যুক্ত হতে পারে? ভাবতেই অবাক লাগে ওর। আর মমতাজ বেগম? মেয়েদের মৃ°ত্যুর পর এমন শো°কে চলে যাওয়ার অভিনয় করেছিল, এতটাই গভীর আর নিখুঁত অভিনয় করেছিল যে কেউ বুঝতেই পারেনি সে আসলেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিল নাকি না?
______________________________________
তানজিম আজ বেশ কয়েকদিন পর বাসা থেকে বের হয়েছে। এসেছে মতিঝিল সামিহার বাসার কাছে। গতরাত থেকে সামিহাকে একের পর এক মেসেজ দিলেও কোনো উত্তর আসে না। কয়েকবার কল দিলেও সে রিসিভ করেনি।
বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আবারো কল দেয় ওকে, এবারেও কোনো সারা পায়নি। আরেকবার কল দিতেই সামিহা রিসিভ করে। তবে রিসিভ করেই একটা বড় ধ°ম°ক দেয়,
“তুই না আমার সাথে আর কথা বলবি না? তবে কল দিয়েছিস কেন?”
তানজিম ওর রাগের কারণ বুঝতে পারে। তাই বেশ শান্ত গলায় বলে,
“সামি, আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা কর…”
তানজিমের কথা শেষ হওয়ার আগেই সামিহা বলে,
“হ্যাঁ, যথেষ্ট বোঝার চেষ্টা করেছি। আর বোঝার চেষ্টা করেছি বলেই তোর সাথে আর কোনো কথা বলছি না।”
“একটু বাইরে আয়, আমি তোর বাসার সামনে।”
এই অসুস্থ শরীরে তানজিম ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। সামিহা ফোন না কে°টেই ছুটে বাইরে আসে। তানজিম ওদের বাসা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। সামিহা ধীর পায়ে ওর কাছে যায়।
সরাসরি প্রশ্ন করে,
“হ্যাঁ, বল কি বলবি? আমার হাতে বেশি সময় নেই।”
তানজিম একটু হেসে বলে,
“বেশি সময় চাইছি না, শুধু পাঁচ মিনিট।”
নিজের ফ্যামিলি সম্পর্কে কথা বলতে খুব কষ্ট হয় তানজিমের। তাই পারিবারিক খু°নের কথাটা গোপন থাকে। সামিহাকে এটা বলার মত সাহস কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই আসেনা তানজিমের।
সে সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণের কিছু কথা সামিহাকে শুনিয়ে দেয়,
“একটা কথা একটু বুঝিস। তুই এডাল্ট, আমিও এডাল্ট। তাই আমরা একসাথে ঘুরাঘুরি করলে, লোকে সম্পর্কটা অন্যভাবে নিবে এবং তা খুবই স্বাভাবিক। আম্মুর ক্ষেত্রেও বিষয়টা তাই হয়েছে। এতে আম্মুর দোষ দেওয়া যাবে না। (একটু থেমে) তবে কালকে ওভাবে আমার বাসায় গিয়েছিস, আবার আমার রুমে গিয়েছিলি। বিষয়টা একটু দৃষ্টিক°টু।”
“আমাদের সম্পর্কটা কি শুধুই বন্ধুত্বের? অন্য কিছুই কি নেই এখানে?”
সামিহার ইচ্ছা করছিল তানজিমকে এটা জিজ্ঞাসা করতে। তবে জিজ্ঞাসা কর হলো না। সে নিরবে তানজিমের প্রতিটা কথা শ্রোতার মতো শ্রবণ করছে।
তানজিম একটু চুপ থেকে আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“বন্ধুত্বটা বাসার বাহিরে পর্যন্তই থাকুক, আমাদের বাসায় এটা না যাক। ভার্সিটিতে একসাথে থাকি, একসাথে ঘুরতে যাই, কোনো সমস্যা নেই। তবে প্লিজ কোনোদিন আমার বাসায় আসিস না। প্রয়োজনে আমাকে কল করিস, আমি চলে আসব।”
“আমার তো সব সময় তোকে প্রয়োজন।”
এই কথাটা সামিহার মনের গহীনে থেকে যায়।
অপ্রকাশিত উপন্যাসের পাতায় যা খুঁজে পাওয়া যায়, তা কখনোই প্রকাশ করতে নেই। অনুভূতি প্রকাশ করলে পুরোনো হওয়ার ভয় পায় সামিহা।
ওকে চুপ থাকতে দেখে তানজিম বলে,
“তুই বুঝেছিস আমার কথা?”
সামিহা উপরে নিচে মাথা নাড়ে, যার অর্থ সে তানজিমের সব কথাই বুঝে নিয়েছে। তানজিম একটা মলিন হাসি দেয়। ওর নিরব আর্তনাদ কেবল ও জানে, আর জানে সৃষ্টিকর্তা।
______________________________________
দুইদিন পেরিয়েছে। জামিলকে সিআইডি অফিসার গালিবের কাছে হস্তান্তর করেছে আহনাফ। এছাড়া আর কোনো বিশ্বস্ত মানুষ সে খুঁজে পায়নি। শাফিন যেভাবে এতজনের মাঝখান থেকে উধাও হতে পেরেছে সেখানে এদের ওপরেও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও বিশ্বাস করতে হয়েছে তাকে।
জামিলের কাছ থেকে শাফিন সম্পর্কে কোন তথ্য আহনাফ পায়নি। অনেক চেষ্টা করেছে সে। তবে এটাও জানতে পারেনি নার্গিস পারভিনের সাথে শাফিনের শ°ত্রুতা ঠিক কোথায় এবং কি নিয়ে।
এখন গালিব পারলে ভালো আর না পারলে সারাহ্-র শত চিন্তার মাঝেও জামিলকে আবারও বাসায় এনেই তুলতে হবে। তবে এখানেও একটা দু°শ্চিন্তা থেকে যায়। যদি জামিলকে বাঁচাতে শাফিন এসে হাজির হয়? তবে এখানেও সারাহ্-র বি°পদ।
ক্লাস শেষে বেরিয়ে আহনাফ গালিবকে কল দেয়। গালিব রিসিভ করে, বেশ কিছুক্ষণ জামিলের ব্যাপারে কথা বলে কল রাখে সে।
তারপর আবারো কল দেয় ইমতিয়াজকে। ইমতিয়াজ অফিসের কাজে ব্যস্ত আজ তাই ফোন সাইলেন্ট মুডে করে রেখেছে। দুই-তিনবার কল আসলেও ইমতিয়াজ তা টের পায় না।
আহনাফ ফোন পকেটে রেখে দেয়। টিচার্স রুমে যাওয়ার সময় সারাহ্ কোথা থেকে যেন ছুটে এসে ওর হাত ধরে বলল,
“লাইব্রেরীতে যাবো, চলেন।”
আহনাফ আশেপাশে তাকায়। তারপর বলে, “এখন লাইব্রেরী?”
“হ্যাঁ, কিছুক্ষণ বই পড়বো। টানা তিনটা ক্লাস নিয়েছি।”
আঙুল উঁচিয়ে তিন দেখায় সারাহ্।
আহনাফ হেসে জিজ্ঞাসা করে,
“খুব টায়ার্ড?”
“অনেক।”
“তবে চলো।”
দুজনে লাইব্রেরীতে যায়। সারাহ্ গল্প উপন্যাসের বই খুঁজে বেড়াচ্ছে। আহনাফ পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“রসায়নের ম্যাডাম রস না খুঁজে সোজা খেজুর খুঁজতে শুরু করেছে।”
সারাহ্ কপাল কুঁচকে তাকায়। বলে,
“আমার অবস্থা আপনি কিভাবে বুঝবেন? আপনি জানেন আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়? এসব তো আপনি বুঝবেন না।”
“না, আমি তো কিছুই বুঝিনা।”
সারাহ্ আবারো বই খুঁজতে শুরু করে। আহনাফ বলে,
“আমি কি তোমার ছুটির ব্যবস্থা করব?”
“কিসের ছুটি?”
“কিসের আবার? মাতৃত্বকালীন ছুটি।”
সারাহ্ অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“পাগল হয়েছেন? এত তাড়াতাড়ি ছুটি দেয়? লোকে কি বলবে?”
“ওমা, লোকে কি বলবে মানে? লোকের কথা লোকে বলবে তোমার তাতে কি আসবে যাবে?”
“আপনি আস্ত পাগল।”
সারাহ্ চলে যেতে নিলে আহনাফ ওর হাত ধরে বলল,
“হুশ, আর কলেজে এসে কষ্ট করতে হবে না।”
আহনাফ সারাহ্-র কাছে চলে আসলে সারাহ্ বলে,
“দূরে থাকেন, এখানে যেকোনো সময় যেকোনো কেউ আসতে পারে।”
“এখন ক্লাসটাইম, সো কেউ আসবে না।”
আহনাফ আরো কাছে চলে আসে। সারাহ্ ওর বুকে ধা°ক্কা সরিয়ে বলে,
“কেউ দেখলে কে°লে°ঙ্কারি হবে।”
আহনাফ মাথা নুইয়ে ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“কিসের কে°লে°ঙ্কারি? তুমি আমার বাচ্চার মা।”
“বউ নই?”
আহনাফ হেসে উঠে বলল,
“না, বউ না। বউ হলে তো আর কে°লে°ঙ্কারির ভয় থাকতো না।”
“তবে এখানে কেন? কলেজের মাঠে চলেন। লজ্জা শরম তো নিজেরটা খুই°য়েছেন আবার আমারটাও।”
আহনাফ আলতোভাবে ওর কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
“ঐশী, তোমার লজ্জা কবে ছিল গো?”
সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে যায়৷ বই পড়ে মাথা ঠান্ডা করা তার আর হয়ে উঠে না। আহনাফ মাথানিচু করে হেসে উঠে৷
ভালোবাসার পুরোনো সংজ্ঞা নতুনরূপে জেনেছে সে। শান্ত, ভদ্র ছেলেটাকে অশান্ত সমুদ্রে পরিণত করার ক্ষমতা কেবল ভালোবাসারই আছে। আবার অশান্ত সমুদ্রের সু°নামিকে শান্ত করতেও ভালোবাসারই প্রয়োজন।
সারাহ্-র চোখে থাকা লজ্জা দেখে সে প্রতিদিন নতুন করে প্রেমে পড়ছে। এ প্রেমের কাব্য কি সারাহ্ জানে? থাকুক না সে কাব্য গোপনে। আহনাফের দেয়া লজ্জায় তার ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে উঠুক বারে বারে।
এমন সময় ইমতিয়াজ আহনাফকে কল দেয়। আহনাফ একটু ঘোরের মধ্যে ছিল ফোন বাজায় চমকে উঠে রিসিভ করে।
“কল দিয়েছিলে? সরি, আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম।”
“কোনো সমস্যা না। আসলে একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চাইছিলাম। সময় হবে?”
“হ্যাঁ, বলো।”
আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“আমার ছোট ফুপা, জামিল, উনি শাফিনের সাথে অনেক আগে থেকে ইনভলভ। উনি নিজ মুখেই স্বীকার করেছে তিনটা খু°নের সময় উনি সামনে ছিল। (একটু থেমে) এমনকি তাহসিনাকে (আবারো বিরতি নেয়) তাহুকে পি°টিয়েছিল উনি। তাহুর..”
বাকিটা আহনাফের বলা হয়ে উঠে না। বুকের কোথাও কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
ইমতিয়াজ ফোনটা শক্ত করে ধরে বলে,
“উনি কি এখন তোমার কাছে আছে?”
“ছিল কয়েকদিন, ধরেছিলাম, বেশ কয়েকদিন আটকে রেখেছিলাম। বেশ ট°র্চা°রও করেছিলাম। তবে ঐশীর নিরাপত্তার কথা ভেবে উনাকে সিআইডির হাতে তুলে দিয়েছি।”
ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে বলে,
“ভুল করেছো, চরম ভুল।”
“এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।”
“এখন কি সে ঢাকায়?”
“হ্যাঁ ঢাকায়। তোমাদের বাসার কাছাকাছি। সিআইডি হেড কোয়ার্টারে আছে।”
ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে। বলে,
“ঠিক আছে। আমি দেখছি।”
“জামিল একা নয় সাথে আরো তিনজন আছে মোট চারজন এসেছিল ঐশীকে তুলে নিয়ে যেতে।”
ইমতিয়াজের পাশে বসে মৃত্তিকা সব কথাই শুনেছে। হালকা করে মাথা নাড়ে সে। জামিলে হাতের কাছে পাওয়া গেছে, এটা একটা বড় সুযোগ।
______________________________________
অপরূপাকে গত দুই দিনে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে শাফিন। কিন্তু কোথাও পায়নি। অপরূপা কোথায় গেছে? কি অবস্থায় আছে? তা সে জানে না। জানার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।
যাত্রাবাড়ী গিয়ে দেখেছিল সেখানে মেয়েগুলো নেই। তার আগের দিন একজনের আহত হওয়ার খবর অপরূপা তাকে দিয়েছিল। তবে কেউ এই ঠিকানা পেয়েছে?
কে হতে পারে? সন্দেহের তী°রটা মৃত্তিকার দিকে যায়। তবে আরো একজন আছে যাকে শাফিন সন্দেহ করতে থাকে, সে হলো ইমতিয়াজ।
আজকের দিনটাও কে°টেছে, বিকাল গিয়ে সন্ধ্যা হলো। অপরূপার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মৃত্তিকার প্রতি রাগ তার বেড়েই যাচ্ছে।
রুমে বসে সি°গা°রেটের ধোঁয়া ছাড়ছে সে, এমনসময় ফোন বেজে উঠে। অপরূপা কল করেছে। হন্তদন্ত হয়ে রিসিভ করে শাফিন।
“হ্যালো।”
“অপরূপা, কোথায় আছো?”
ধ°ম°ক দিয়ে প্রশ্ন করে সে।
বিপরীত দিকে থেকে অপরূপার স্বাভাবিক কণ্ঠ ফিরে আসে,
“একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করেছি।”
“কি?”
শাফিনের কপাল কুঁচকায়।
“জামিল সিআইডির হাতে ধরা পড়েছে। যে পরিমাণ মা°র পড়ছে, তাতে হয়তো এ থেকে জেড সব বলে দেবে। (একটু থেমে) বিশেষ করে এডভোকেট বিথী যদি ধরা পড়ে, তবে বি°পদ বাড়বে।”
শাফিন মাথা নাড়ে। বলে,
“খবর কোথা থেকে পেয়েছো? সত্য না মিথ্যা?”
“পাকা খবর, আহনাফ তাকে ধরেছিল আর হস্তান্তর করেছে।”
“আহনাফ? তার মানে তুমি ঠিক সন্দেহ করেছিলে?”
“হ্যাঁ।”
শাফিন বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে, কিন্তু যুতসই কোনো বুদ্ধি পায় না। অপরূপা বলে,
“আমার কাছে খুব ভালো একটা প্ল্যান আছে।”
“তাড়াতাড়ি বলো।”
“জামিলকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিয়ে দাও। না থাকবে বাঁশ, আর না বাজবে বাঁশি।”
শাফিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“ইউ আর রাইট।”
কল রাখতেই মৃত্তিকা অপরূপার ফোনটা হাতে নেয়। এতক্ষণ মৃত্তিকার শেখানো বুলিগুলো আওড়ে গেছে সে।
ঘাড়ের কাছে চেপে ধরা একগুচ্ছ জ্ব°ল°ন্ত সি°গা°রেটের য°ন্ত্র°ণা থেকে বাঁচার জন্য আর খানিকটা ড্রা°গের আশায় এ কাজ করতে রাজি হয় অপরূপা। দুইদিন ধরে ড্রা°গ না পেয়ে সে অস্থির হয়ে উঠেছে আর সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে মৃত্তিকা।
মৃত্তিকা ফোনটা রেখে বলে,
“শাফিনকে আমি সহজে ধরবো না, খেলিয়ে ধরবো। কা°টা দিয়ে কিভাবে কা°টা তুলতে হয় তার শরীফের মেয়ে মিউকো ভালো করেই জানে।”
চলবে….