অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
596

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষোড়শ পর্ব

অনলাইন ক্লাস শেষে রুমেই বসে আছে আহনাফ। সারাহ্-র সাথে নিজের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে সে।

বিয়ে, নিকা, শাদি, বিবাহ- যে নামেই একে ডাকা হোক না কেন মূলত সবটাই এক। দুটো মানুষের মনের মিলন, আ°ত্মার মিলন, ভালোবাসার বন্ধন। পবিত্র এ সম্পর্কের ভালোবাসা নিয়ে কোরআনের অনেক ব্যাখ্যা জানা আছে আহনাফের৷

সারাহ্-র সাথে খারাপ ব্যবহারে সম্পর্ক শুরু করলেও দিনদিন সে একে স্বাভাবিক করে নিয়ে আসতে চেষ্টা চালাচ্ছে।

কিন্তু আজকে সারাহ্-র ঘটানো এমন অপ্রীতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ঘটনায় আহনাফ বি°র°ক্ত। প্রচন্ড রেগে আছে সে।

“ঐশী।”
জোর গলায় সারাহ্-কে ডাকে আহনাফ।

রুমে উঁকি দিয়ে সারাহ্ বলে,
“জি।”
“এদিকে এসো।”

সারাহ্ চুপচাপ ভিতরে যায়। আহনাফ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। সারাহ্ ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বোর্ডে ওসব কেন লিখেছো?”

সারাহ্ কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব দেখিয়ে বলল,
“দেখুন, জাস্ট একটা কথাই তো লিখেছি আর তো কিছু না আর…”

সারাহ্ কথার মাঝেই ধ°ম°ক দেয় আহনাফ।
“আমি একজন সিনিয়র টিচার সারাহ্। ওরা আমার স্টুডেন্ট, বন্ধু না।”

আহনাফের মুখ থেকে ঐশী নাম শুনেই সারাহ্ অভ্যস্ত। হঠাৎ করে সারাহ্ শুনে থতমত খায়। সে আসলে এমন কি বড় অপরাধ করেছে তা বুঝতে পারেনা। মাথানিচু করে ফেলে সারাহ্। আহনাফ বেরিয়ে যায়।

“এই লোক জীবনেও ভালো হবে না। কেমন খিটখিটে মেজাজের লোক।”

আপন মনে আহনাফকে ব°ক°তে থাকে সারাহ্। মুহূর্তের মধ্যেই হেসে উঠে সে। তবুও যে এই রাগি মানুষটাকেই ভালোবাসে সে।
______________________________________

পরদিন সকাল ৮ টা,
সামিহার জন্মদিন আজ। সামিহার নিজের কাছে দিনটা বেশ স্পেশাল। যদিও এখনো পর্যন্ত বাবা ছাড়া আর কেউ তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়নি। বিষয়টা বড় কিছু নয়, কারণ কখনোই এসবের জন্য ওর মা ওকে উৎসাহ দেয় না।

কালো আর লালের মিশ্রণের সুতির শাড়ি পড়েছে। ঘন চুলের মোটা বিনুনি একপাশে নিয়ে এসেছে। কালো ও লালের কাচের চুড়ি ডান হাতে পড়েছে আর বাম হাতে পড়েছে কালো ঘড়িটা। চোখের মোটা কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, যেন কোন বাঙালি বধু সদ্য স্বামীর বাড়ি এসেছে।

“মা, আমি যাচ্ছি।”
নার্গিস পারভিনের থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য। মেট্রোরেলে করে ভার্সিটিতে যেতে ও খুব একটা সময় লাগে না তার, মতিঝিল থেকে সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তানজিমকে ডিপার্টমেন্টের সামনে অপেক্ষা করতে বলে ইতোমধ্যে একটা মেসেজও করে দিয়েছে।

তানজিম ডিপার্টমেন্টের সামনের ফুটপাতে হাঁটছে৷ সামিহা যেহেতু বাইরে থাকতে বলেছে সুতরাং ভিতরে গেলে আজ একটা মা°ই°রও মাটিতে পড়বে না।

আর কারো মনে না থাকলেও তানজিমের ঠিকই ওর জন্মদিনের কথা মনে আছে। একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে অপেক্ষা করছে সামিহার জন্য। সাথে সাথে মনের মধ্যে সাহস যোগাচ্ছে আজ সামিহাকে সে মনের কথা বলবে৷

কিভাবে বলবে তা বারবার অনুশীলন করছে সে। হঠাৎ চোখ পড়ে ওর দিকে হেঁটে আসা সামিহার দিকে। শাড়ির কুঁচি একহাতে একটু উঁচু করে রেখেছে, অন্যহাতে আগলে রেখেছে আঁচলটা।

শাড়ি, চুড়িতে এমন এক অচেনা রূপে সামিহাকে দেখে তানজিমের হৃদপিণ্ড ব°ন্ধ হওয়ার যোগাড়।

সামিহা ওর সামনে এসে বলে,
“চল, চল।”

সামিহা ভিতরে চলে গেল। তানজিম এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বুকের বামপাশে হাত দিয়ে বলে,
“এখনো থামিসনি তবে, চলতেছিস?”

সামিহা ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“তানজিম, আয়।”
“আসি।”

তানজিম ওর পাশাপাশি হলে সামিহা বলে,
“ফুল কার জন্য?”
“এক পাগলীর জন্য।”

সামিহা হেসে বলে,
“ইশ, আজ প্রথমবার পাগলী না হওয়ার জন্য আফসোস হচ্ছে।”

সামিহা এগিয়ে গেল। তানজিম নিজে নিজেই বলে,
“ওফ, আমার পাগলী, এই দোকানের ফুল তোমাকে দেয়া যাবে না।”

ফুলগুলো রাস্তায় অবহেলায় ফেলে দিলো তানজিম। সামিহাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আজ নিজেই সারপ্রাইজ পেয়ে গেছে।

সামিহাকে কিভাবে কি বলবে, প্রায় সবই ভুলে গেছে তানজিম। তালগোল পাকিয়ে গেছে সব। ক্লাস শেষে বাইরে এসে রাস্তার মাঝের ব্যবধায়কে থাকা কাঠগোলাপের গাছ থেকে ফুল সংগ্রহ করতে থাকে তানজিম।

সামিহা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ওকে ডেকে বলে,
“তানজিম, কি করিস?”

তানজিম ফুলগুলো এনে সামিহার বেনিতে গেঁথে দেয়। সামিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তানজিম কাজ শেষে বলে,
“তোকে আজ মুগ্ধ হয়ে দেখেছি সামি। পুরো ক্লাস আমি মনোযোগ দিতে পারিনি। তুই বারবার আমাকে কেন এলোমেলো করছিস?”
______________________________________

কাল থেকে সারাহ্-র সাথে কোনো কথা বলেনি আহনাফ। সারাহ্ও এতোটা জোর করেনি। নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপচাপ ছিল সারাক্ষণ। বোর্ডের লেখাটা এভাবে আহনাফের লজ্জার কারণ হবে তা সারাহ্ বুঝেনি।

কলেজে দুজনে একসাথে এসেছে। তবুও পুরো রাস্তা নিরব ছিল। প্রথম পিরিয়ডে আহনাফের যেখানে ক্লাস ছিল আর দ্বিতীয় পিরিয়ডে সারাহ্-র সেখানেই ক্লাস আছে।

ক্লাসের দিকে যাওয়ার সময় আহনাফের সামনে পড়ে সে। মাথানিচু করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আহনাফ বলে,
“ঐশী, আজকে বাসায় যেতে দেরি হবে। ক্লাস শেষে মিটিং আছে। তুমি কি অপেক্ষা করবে?”

সারাহ্ ফিরে তাকিয়ে বলে,
“হুম, করবো।”

আহনাফ মুচকি হেসে হাত দিয়ে ওকে হাসতে ইশারা করে চলে যায়। মনের অজান্তেই হেসে দেয় সারাহ্।

ক্লাসে আজ রসায়ন দ্বিতীয় পত্রে ডু°ব দিয়েছে সে। জৈব রসায়নের কঠিন কঠিন বিক্রিয়া তু°ড়ি মে°রে সহজ করে দিলো সারাহ্। কঠিন বিষয় সহজ করে উপস্থাপন করার কারণেই সারাহ্-কে ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগই খুব পছন্দ করে।

ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় এক মেয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“মিস?”

সারাহ্ একটু হেসে বলল,
“মিস না বলে ম্যাডাম বলো।”

মেয়েটিও হেসে দেয়। ওদের ম্যাডাম যে এখন মিসেস হয়ে গেছে তা ওরাও জানে। সারাহ্ বলল,
“কি বলবে? বলো।”

মেয়েটি হাতের চকলেট সারাহ্-র দিকে এগিয়ে দেয়। মুখে বলে,
“আপনার জন্য ম্যাডাম।”
“থ্যাংক ইউ। (একটু থেমে) নাম কি তোমার?”
“মাহি।”

সারাহ্ মিষ্টি হাসে। মাহির গাল টে°নে দিয়ে চলে যায়।

সবকিছু এখন তুচ্ছ লাগছে আহনাফের সেই হাসি আর ইশারার কাছে। থাকুক তাহসিনা আহনাফের মনে, কিন্তু এককোনায় সারাহ্-র স্থান হোক।

কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় সে। ধীরে ধীরে মেঘ জমছে, যেকোনো সময় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
______________________________________

দুপুরের পর মৃত্তিকা বাসা থেকে বের হয়েছে৷ কাকরাইলে আসাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। মামের কবরের কাছে সময় কা°টাবে। উদ্দেশ্য সফল হলো, মামের কবরটা একবারের মতো দেখা হলো তার।

“মাম, তুমি তো জানো নিজের ইচ্ছার বি°রু°দ্ধে গিয়ে বিয়েটা করছি আমি। ওই লোকটা তোমাকে কষ্ট দিয়েছিল, তোমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছিল আর এখন আমারটাও শেষ করে দিয়েছে।”

গলা কান্নায় ভারি হয়ে আসে। খানিকক্ষণ থেমে আবারো বলল,
“ওই লোকটাকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না, তাকে কখনো বাবার মর্যাদা বা সম্মান দিতে পারবো না। কিন্তু সত্য হলো উনি আমার বাবা।”

একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্তিকা।
“আরেকজন মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে, ইমতিয়াজ। সে আমাকে বিন্দুমাত্র বুঝে না, কিন্তু জানো তো আমার জীবনের অপূর্ণতাগুলো একমাত্র সেই পূরণ করতে পারবে।”

মৃত্তিকা ফোন বের করে কলরবের সিভি বের করে বলে,
“কলরব, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। (একটু থামে) জানো মাম, ইমতিয়াজ আমার সাথে আর একবারের জন্যও কথা বলেনি। সেদিন শপিংমলে তাকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম। সে আমাকে কলও দেয় না আর আমি কল দিলে ফোন বন্ধ পাই।”

“আমার সিম নষ্ট হয়ে গেছে, তাই ফোন বন্ধ পেয়েছেন।”

মৃত্তিকা চমকে উঠে পিছনে ফিরে। ইমতিয়াজ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একটু হাসে। তারপর তাহমিনার কবরের কাছে চলে যায়। মৃত্তিকা কান্না ভেজা চোখে অপলক চেয়ে থাকে তার দিকে, যেন কোনো এক নে°শা তাকে পেয়ে বসেছে।

ইমতিয়াজ দোয়া শেষে বেরিয়ে গেল। মৃত্তিকা পিছুপিছু দৌড়ে গিয়ে বলে,
“দাঁড়ান।”

ইমতিয়াজ দাঁড়ায় না, তবে হাঁটার গতি একটু ধীর করে। মৃত্তিকা কাছে এসে বলে,
“অফিস নেই?”
“তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে।”
“ওহ, সিম নষ্ট বলে হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ কেন?”

ইমতিয়াজ থেমে বলে,
“আপনি আমার সাথে কি এমন জরুরি কথা বলবেন মৃত্তিকা?”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি কি কিছুই বুঝতে পারছেন না?”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে না বোঝায়। মৃত্তিকা চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলে,
“বিয়ের ব্যাপারটা বলতাম।”

ইমতিয়াজ ওর কাছে চলে আসে। একদম কাছাকাছি দুজনে। ইমতিয়াজ ভারি কন্ঠে বলল,
“আমাকে বিয়ের কথা বলতে পারছেন না বলে আমি আপনাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছি বুঝি?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে দুইপা পিছিয়ে যায়। কতক্ষণ ইমতিয়াজ তার পিছনে কখন থেকে ছিল কে জানে? মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে চলে যেতে যেতে একবার পিছনে ফিরে ইমতিয়াজকে দেখে। ইমতিয়াজ এখনো কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে ওর দিকে।
______________________________________

মাহির দেয়া চকলেটটা খেতে খেতে কলেজ মাঠের একপাশ ঘেঁষে হাঁটছে সারাহ্, মূলত আহনাফের জন্য অপেক্ষা করছে সে। আকাশটা আরো অন্ধকার হয়ে আসলো। সারাহ্ ঘড়ি দেখলো, তিনটা ত্রিশ বেজে গেছে।

“মানুষটা এখনো আসেনি।”

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। সারাহ্ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হে আল্লাহ্, তার মনে একটুখানি জায়গা দিও আমাকে।”

আহনাফ দৌড়ে এসে ওকে বলল,
“জলদি চলো বৃষ্টি নামছে।”

কথা শেষ করার আগেই ঝুম বৃষ্টি নেমে গেল। দুজনে জলদি গিয়ে উঠলো কলেজের বারান্দায়। আহনাফ শার্ট, ব্লেজার ঝারতে ঝারতে বলল,
“দূর, অ°সময়ের বৃষ্টিই ভালো লাগে না।”
“বৃষ্টিকে গা°লি দিতে নেই। এটা রহমত।”

আহনাফ সারাহ্-র দিকে তাকালো। সারাহ্ মুচকি হেসে বলল,
“অ°সময় নয় তো এটা, আমরাই বের হতে দেরি করেছি।”

আহনাফ হাত বাড়িয়ে ওর ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা চকলেট সরিয়ে বলল,
“ম্যাডাম চকলেট খাচ্ছে তাও মুখ ভরিয়ে?”

সারাহ্ খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। তারপর আহনাফের হাতে চকলেটটা দিয়ে নিজে চলে গেল মাঠে। দুহাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করলো। খোলা বারান্দার পিলারের সাথে হেলান দিয়ে আহনাফ ওকে দেখছে। থ্রিপিজটা ভিজে শরীরের সাথে লে°প্টে লেগেছে, সারাহ্ খেয়াল করেনি এসব।

আহনাফ এগিয়ে এসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে গেল একটা ক্লাসে। উঁচু বেঞ্চে বসিয়ে বলল,
“বাইরে যাবে না।”

হঠাৎ ওর এমন কাজে হতবাক সারাহ্। আহনাফ ব্লেজার খুলে সারাহ্-র উপর দিয়ে দিলো। ওর কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আবেদনময়ী হয়ে সবার কাছে ধরা দিও না।”

আহনাফ বাইরে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলো। বাকি স্যারেরা চলে যাচ্ছে। আহনাফকে দেখে বলল,
“স্যার, যাবেন না?”
“যাবো, একজন আসবে তাকে নিয়ে যাবো।”
“আচ্ছা স্যার, আসি।”
“জি।”

স্যাররা আসছে দেখেই সারাহ্কে সকলের আড়ালে এনেছে আহনাফ। সারাহ্ ব্লেজারটা গায়ে দিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালো। আহনাফ ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর আহনাফ ভিতরে আসলো।
“এখন বাসায় যাবে কিভাবে?”

সারাহ্ কিছু বলতে নিলেই কারেন্ট চলে যায়। দুজনেই চমকে উঠে। আহনাফ ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে দেয়। সারাহ্ ওড়না দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে আবৃত করছে। আহনাফ ফোনটা পাশে রেখে সারাহ্-র হাত সরিয়ে ওড়নাটা নিজেই ওর শরীরে দিয়ে দিলো।

সারাহ্ অপলক তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আহনাফও দেখলো ওকে। বলল,
“কি দেখো?”

সারাহ্ চমকে উঠলো। এ কেমন বেরসিক মানুষ। আহনাফ বেঞ্চের দুপাশে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। সারাহ্কে যেন মাঝে ব°ন্ধি করেছে।

“ঐশী, তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউর বলেই আমি জানি। কিন্তু আমাকে বিয়ে করার সময় তোমার বুদ্ধিটা বোধহয় ঠিকমতো কাজ করেনি।”

সারাহ্ অন্যদিকে তাকালো। আহনাফ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“তোমাকে এতোভাবে ইশারা দিলাম কিন্তু তুমি বুঝলে না আমি কি বোঝাতে চেয়েছি।”
“আমি বুঝেছিলাম।”

সারাহ্ নেমে দাঁড়ালো। আহনাফ একটু সরে এসে বলল,
“তবে জীবনটা কেন নষ্ট করেছো?”

সারাহ্ কিছু বলল না। হৃদয়ের গোপন কথা গোপনে রইলো, আহনাফ বুঝলো কিনা জানা নেই। সারাহ্ বেরিয়ে আসতে নিলে আহনাফ ওকে কাছে টে°নে আনলো। শুধু কাছে না, দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।

বেশ কিছুক্ষণ পর আহনাফ সারাহ্-র মুখটা উপরে তুলে বলল,
“সবকিছু অন্যরকম হতে পারতো আর হয়েছেও তাই।”

ভেজা ঠোঁটে শক্ত পুরুষের ভারী ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করলো সারাহ্। সরে আসতে চেয়েও সরে আসতে পারলো না, আহনাফ যে তাকে একহাতে জড়িয়ে রেখেছে। আহনাফের শার্টের কলার খা°ম°চে ধরেছে, প্রত্যেকটা সেকেন্ডে নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে সারাহ্-র।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তদশ পর্ব

মাগরিবের নামাজের পর সুরভির রুমে যায় মৃত্তিকা। সুরভি চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা, ওর স্বামী কাউসার আহমেদ দেশের বাইরে থাকেন। তাই তো এ অবস্থায় সুরভিকে বাসায় নিয়ে এসেছেন শাফিন সাহেব।

“আপু, আসবো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসো।”

মৃত্তিকা ভিতরে গিয়ে বিছানার একপাশে বসে। সুরভি ইন্দুবালা ভাতের হোটেল নামে একটা বই পড়ছিল। বইটা পাশে রেখে মৃত্তিকাকে বলল,
“মামের সাথে কথা বলে এসেছো?”

মৃত্তিকা আলতো হেসে বলে,
“হুম, ওখানে না গেলেও আমি মামের সাথে সবসময় কথা বলি।”

সুরভির কাছ থেকে বইটা নিয়ে পাতা উল্টায় মৃত্তিকা। সুরভি সেদিকে একটু তাকিয়ে বলে,
“বাংলা উপন্যাস পড়েছো কখনো?”

মৃত্তিকা একটু ভেবে বলে,
“চোখের বালি নামে একটা বই ছিল মামের কাছে, ওইটা পড়েছি।”

সুরভি হেসে বলল,
“বাংলা সাহিত্যে শুধু ডু°ব দাও, ভা°সিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সেই নিবে। (একটু থেমে) চা খাবো, একটু বানিয়ে আনতে পারবা?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।”

মৃত্তিকা দ্রুত পায়ে উঠে রান্নাঘরে যায়। চা বসিয়ে দিয়ে গুড়াদুধের কন্টেইনারটা হাতে নিয়ে শুনতে পায় একটা কন্ঠ। ভালো করে কান পাতে, কন্ঠটা মমতাজ বেগমের।

সব ছেড়েছুড়ে ড্রইংরুমে এসে দেখে মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমান মাত্রই বাসায় এসেছে। বড়মণিকে দেখেই মৃত্তিকা জড়িয়ে ধরে। কাঁদোকাঁদো মৃত্তিকাকে আদর করেন মমতাজ বেগম, কপালের স্নেহের পরশ এঁকে দেন।

সুরভিও বেরিয়ে আসে।
“সব আদর মিউকোর আর আমি ফ°ক্কা?”

মমতাজ বেগম হেসে ওকেও আদর করে। তানজিমও এসেছে উনাদের পৌঁছে দিতে, সে থাকবে না। তাই একটু তাড়া দিচ্ছে।

মৃত্তিকা তানজিমকে টেনে বাসার বাইরে নিয়ে গেল,
“ইমতিয়াজের নাম্বার আছে তোমার কাছে?”

তানজিম চোখ বড় করে তাকায়। ইমতিয়াজকে সবসময় “তোমার ইমতিয়াজ ভাইয়া” বলে মৃত্তিকা, সেখানে আজ সোজা ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার ছটফটানি দেখে তানজিমের মনে হলো ইমতিয়াজের নাম্বারটা এই মুহূর্তে ওর জীবন বাঁচাবে৷

“নাম্বার দেও।”

মৃত্তিকার কথায় তানজিম চো°য়া°ল শক্ত করে বলে,
“আমার কাছে উনার নাম্বার নেই।”

মৃত্তিকা তানজিমের চেহারার দিকে তাকায়। ছেলেটা মৃত্তিকার চেয়ে প্রায় ৪-৫ বছরের ছোট হবে, এই ছেলে মৃত্তিকাকে চোখ রা°ঙাচ্ছে।

তানজিম বলল,
“আমার বোন হয়তো এই পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তার শূণ্যস্থান তোমাকে দিয়ে পূরণ হবে না।”
“কিসব বলছো তুমি, তানজিম?”

তানজিমের চোখমুখ, কপাল কুঁচকে আসে।
“বুঝো না তুমি আপু? ইমতিয়াজ ভাইয়াকে তুমি কোন নজরে দেখো তা আর কেউ নোটিশ না করলেও আমি করেছি। যা করছো খারাপ হচ্ছে। তুমি অন্যকারো বাগদত্তা আর ভাইয়া বিবাহিত।”

মৃত্তিকা চুপ থাকে। ওর চঞ্চল চোখের দৃষ্টি যার বোঝার সে না বুঝলেও তানজিম ঠিকই বুঝেছে।

ভিতরে যাওয়ার আগে তানজিম বলে,
“তাহমিনা আপু বেঁচে থাকলেও কি তুমি এমনটাই করতে? লজ্জা হওয়া উচিত তোমার।”

তানজিম ভিতরে চলে গেছে। সত্যি মৃত্তিকার লজ্জা কমে গেছে। শান্ত, ভদ্র মেয়েটা একটা বিবাহিত ছেলের প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছে। তানজিম তো ঠিকই বলেছে তাহমিনা থাকলে কি করতো সে? সবটা মেনে নিতো, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু তাহমিনা যে নেই আর প্রকৃতি তো শূণ্যস্থান রাখে না।
______________________________________

আহনাফ-সারাহ্ বাসায় এসেছে কিছুক্ষণ আগে। সারাহ্ ফ্রেশ হয়ে এসে প্রতিদিনের মতোই দেখে খাবার তৈরি। আহনাফ ওর অপেক্ষা না করে খাবার গরম করে ফেলে। সারাহ্ ভেজা কাপড় বারান্দায় মেলে দেয়। বাইরে এখনো বৃষ্টি পড়ছে।

আহনাফের দিকে বারবার তাকাচ্ছে আর লজ্জায় কুঁচকে যাচ্ছে সে। আহনাফ বিষয়টা খেয়াল করেনি। সে স্বাভাবিকভাবে ফ্রেশ হয়ে আসে।

“ঐশী, খাবে না? চলো।”

আহনাফের প্রশ্নে সারাহ্ কিছু না বলে রুমে এসে চুল ঝা°ড়তে থাকে। আহনাফ ওকে একটু দেখে ডাইনিং এ চলে যায়।

ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসতেই কল এলো আফরোজার। আহনাফ বি°র°ক্তি নিয়ে রিসিভ করে,
“হুম।”
“কেমন আছিস, আহনাফ?”
“ভালো।”
“সারাহ্ কেমন আছে?”
“ভালো।”
“সারাহ্ কোথায়? কি করে?”
“রুমে।”

আহনাফ একশব্দে ছোট ছোট করে উত্তর দিচ্ছে। আফরোজা বুঝে তার ভাই এখন কোনো কারণে তার উপর রেগে আছে।

একটু খারাপ লাগলেও কন্ঠ নরম করে সে,
“আহনাফ, কি হয়েছে?”

আহনাফ উঠে বাসার বাইরে চলে যায়। সারাহ্ মাত্রই ডাইনিং এ এসে আহনাফকে বাইরে যেতে দেখে ডাক দিতে নিয়েও ডাক দেয় না।

মেইন দরজার বাইরে গিয়ে আহনাফ বলে,
“র°ক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো, হ্যাঁ তোমাদের কথাই বলছি। তোমরা এক ছটাক আমাকে বুঝো না আর বাইরের একটা মেয়েকে দিয়ে গেছো আমাকে বোঝার জন্য।”

“বাইরের একটা মেয়ে” কথাটা সারাহ্ বুঝতে পারে। আহনাফ যে ওকেই বোঝাচ্ছে, নাহলে আর কাউকে তো এখানে দিয়ে যায়নি। সারাহ্ দরজার কাছে চলে যায়।

“আহনাফ, তুই কি সারাহ্-র সাথে মিসবিহেভ করিস? কিছু উল্টাপাল্টা বলিস ওকে?”

একটু চুপ থেকে আহনাফ বিপরীত পাশের কথাটা শুনে, আফরোজার কথা সারাহ্ না শুনলেও আহনাফের কথা ঠিকই শুনে।

“না, ওই মেয়েকে আমি কি বলবো? দোষ তো আমার যে এই রাগের মাথায় বিয়েটা করেছি। মেয়েটার জীবনটা জেনেবুঝে নষ্ট করছি। (একটু থামে) সম্পর্ক? তার কাছে এখন আমরা পারফেক্ট হাসবেন্ড-ওয়াইফ। আমি যেভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করবো, মানুষ আমাকে সেভাবেই বুঝবে।”

চমকে উঠলো সারাহ্। আহনাফ নিজের একটা মি°থ্যা রূপ ওকে দেখাচ্ছে। যে রূপে ওর মনে হচ্ছে আহনাফ ওকে ভালোবাসে, প্রচন্ড রকম ভালোবাসে।

সারাহ্ দরজার পাশ থেকে সরে রুমে আসে। আহনাফকে ও এখনো বুঝতে পারেনি। আহনাফ ঠিক বলে ওকে কেউ বুঝে না।

কিছুক্ষণ আগের লজ্জাটা উধাও হলো তার। মেকি মূহুর্তেগুলো মনে রাখতেই চাচ্ছে না সারাহ্। সারাহ্ মজবুত নারীর মতো নিজেকে বোঝাতে থাকে বারবার।

আহনাফ এখনো ফোনে কথা বলছে,
“রাগের মাথায় বিয়ে করি আর যেভাবেই করি না কেন বিয়ে হয়েছে আর এটা আমি অস্বীকার করতে পারবো না। নিজের স্ত্রীকে আগলে রাখতে হয় তা আমি জানি। (একটু থেমে) কিন্তু এই আগলে রাখায় ভালোবাসাও থাকতে হয়।”

আফরোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“কি কম আছে সারাহ্-র মধ্যে?”

আহনাফ বি°র°ক্ত হয়। বলল,
“কম আছে। সবকিছুতে অতিরিক্ত বুঝে সে, বাড়াবাড়ি করে। যখন আমি যেরকম চাই সেরকম কিছুই হয় না। আবার…”

আহনাফ থেমে যায়। সারাহ্ তাকে প্রতি মূহুর্তে আর্কষণ করে। একটা অব্যক্ত, বেনামি সম্পর্কের টা°নে যেন বারবার সে সারাহ্-র দিকে যায়। একে সে ভালোবাসা বলতে নারাজ।

আফরোজা বলে,
“আবার কি?”
“কিছু না।”

আহনাফ কল কে°টে ফোন সাইলেন্ট করে দেয়। কে দোষী, কে নির্দোষ আর এসব নিয়ে এখন আর ভাবনার সময় নেই।

আহনাফ এসে সারাহ্-কে ডাকে,
“কি হলো? এখনো খেতে আসোনি?”

সারাহ্ চমকে উঠে বলে,
“আসছি।”

খেতে বসে আবারো সে আড়চোখে আহনাফকে দেখে। আহনাফ নিরবে খাচ্ছে। সারাহ্ ঠিকমতো খেতে পারছে না। ওর মনে হচ্ছে আহনাফ ওকে ঠকাচ্ছে, অভিনয় করছে ওর সাথে।

“কি হয়েছে, ঐশী? খাচ্ছো না কেন?”

সারাহ্ মাথানিচু করে খেতে খেতে বলে,
“এইতো শুরু করেছি।”

এইযে মাত্রই সারাহ্ও পেরেছে নিজেকে লুকাতে, নিজের মিথ্যা চেহারা দেখাতে। কিন্তু এই মিথ্যা চেহারা নিয়ে সংসার কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবে সারাহ্? চিন্তায় পড়ে সে।
______________________________________

একসপ্তাহ পেরিয়ে গেল। কলরব নিয়ম করে প্রতিদিন মৃত্তিকাকে কল দেয়, এটাসেটা কথা বলে। আজ একদম দেখা করতে চলে এসেছে। এই বিষয়গুলো মৃত্তিকার কাছে একটু অস্বস্থির।

মামী দেলোয়ারার সাথে কথা বলছে কলরব। মৃত্তিকাকে তৈরি হতে বলেছে, দুজনে শপিংয়ে যাবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে, মনের বিরুদ্ধে গিয়েই তৈরি হলো সে।

ড্রইংরুমে আসতেই দেলোয়ারা আদুরে কন্ঠে বললেন,
“মাশাল্লাহ, মিউকো। কি সুন্দর লাগছে।”

মৃত্তিকা মাথানেড়ে জোরপূর্বক মুচকি হাসে। কলরব ওর দিকে তাকায়। মৃত্তিকা মাথানিচু করে।

সকাল ১০ টায় কলরবের সাথে বের হয় মৃত্তিকা। কলরবের নিজের গাড়ি আছে, সেটাতে করেই যাচ্ছে ওরা। এসি গাড়ি, ঘন্টার পর ঘন্টার জ্যামে যেখানে অস্বস্তি কম হবে। তবুও এসব বিলাসিতা ভালো লাগছে না মৃত্তিকার। ইমতিয়াজের মতো সাদাসিধা জীবন ওর ভালো লাগে। অতিরিক্ত চাওয়া নেই ওর।

শপিংমলে পৌঁছে কলরব ওকে বলে,
“একটু দাঁড়াও, আমি গাড়িটা পার্ক করে আসি।”

সরাসরি তুমি করে ডাকায় মৃত্তিকার অস্বস্তির পরিমাণ বাড়ে। তবুও মাথানেড়ে সম্মতি জানায়।

কলরব গাড়ি রেখে এসে বলে,
“চলো, আগে কোথায় যাবে? শাড়ির দোকানে?”
“চলুন।”

হাঁটতে হাঁটতে কলরব বলল,
“তুমি এতো চুপচাপ কেন? একটু কথা বলে ফ্রি হও।”
“দুনিয়ায় সকল মানুষ একরকম হয় না। ভিন্ন কিছু মানুষ থাকে, সেরকম ভিন্ন মানুষ আমি।”

কলরব শব্দ করে হেসে বলল,
“ইতালিতে এমনভাবেই থাকতে? বয়ফ্রেন্ডের সাথেও এমনই ছিলে?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে। ইতালিতে থাকতে হলে কি বয়ফ্রেন্ড থাকাটা বাধ্যতামূলক? একজন শিক্ষিত মানুষ এমন নিচু চিন্তা কিভাবে করতে পারে বুঝতে পারে না মৃত্তিকা।

“আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল না।”

কলরব আবারো হাসলো। বলল,
“বিদেশের বয়ফ্রেন্ড বিডিতে আসবে না। সো, নো টেনশন। (একটু থেমে) আমারো গফ ছিল, কয়েকমাস লিভ ইন রিলেশনশিপে ছিলাম। দ্যাটস নরমাল।”

মৃত্তিকা চোখ ছোট করে তাকায়। এমনভাবে কথাটা বলল যেন লিভ ইন রিলেশনশিপ খুবই সহজলভ্য বিষয়। কলরবের আচরণ খারাপ লাগে তার, কেমন যেন প্লে°বয় টাইপ আচরণ। এই ছেলের সাথে সারাজীবন কিভাবে কাটানো যেতে পারে?

ওদের থেকে কিছুদূরে শরীফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা। একবার কলরবের দিকে তাকিয়ে দ্রুত একটা দোকানে চলে যায়। পিছন ফিরে আবারো শরীফকে দেখে একটা ঢোক গিলে।
______________________________________

কলেজে আজ পিঠা উৎসব হচ্ছে। অক্টোবরের এই সময়টা পিঠা উৎসবের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। কলেজের মাঠে প্যান্ডেল করে সারি সারি পিঠার পশরা সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন রকমের পিঠা।

কয়েকদিন ধরেই সারাহ্-র মন মানসিকতা বা শরীর কোনোটাই ভালো নেই। দূর থেকেই এসব দেখছে সে। অতিরিক্ত টেনশনের ফলে তার র°ক্ত°চাপ কমেছে, সাথে বমি বমি ভাব হচ্ছে। পিঠার ঘ্রাণে সারা কলেজ মৌ মৌ করলেও সারাহ্-র বমি পাচ্ছে এসব গ°ন্ধে।

কেমিস্ট্রির একজন সিনিয়র ম্যাডাম এসে বলল,
“আরে সারাহ্, এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে। চলো, কোনো একটা পিঠা খাবে।”

সারাহ্ মৃদু হেসে বলল,
“না ম্যাম, আমার ইচ্ছা নেই।”
“ওমা, কতশত পিঠা এখানে, ইচ্ছা নেই কেন?”
“এমনিই।”
“তুমি ইদানীং এমন গু°মো°ট কেন?”
“শরীর ভালো নয়।”
“ওহ।”

ম্যাডাম চলে গেলেন। সারাহ্ খানিক দূরে আহনাফকে এদিকে আসতে দেখে টিচার্স রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ায় পায়েও বেশ ভালোই ব্য°থা পেয়েছে।

আহনাফ দৌড়ে এসে ওকে ধরে বলে,
“ঐশী, কি হলো?”

কয়েকজন ম্যাডাম আর স্টুডেন্ট চলে আসায় আহনাফ ওকে কোলে তুলে একটা ক্লাসে নিয়ে যায়। বেঞ্চে শুইয়ে দিয়ে মুখে পানির ছিটা দিতেই সারাহ্-র জ্ঞান ফিরে।

কেমিস্ট্রির সেই ম্যাডাম এসে বলে,
“লাস্ট কয়েকদিন ওর এ অবস্থা ছিল। প্রেগন্যান্ট নাকি?”

“কি?”
আহনাফ একটু জোরেসোরেই কথাটা বলে।

আহনাফ সকলকে বলে,
“ভীড় কমান। সারাহ্ ম্যাডাম ঠিক আছে।”

ধীরে ধীরে ভীড় কমে। সবাই বেরিয়ে গেছে, রুমে আহনাফ আর সারাহ্ ছাড়া আর কেউ নেই।

সারাহ্ ধীরে ধীরে উঠে বসে। আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি বাসায় যাবো।”
“কি হয়েছে তোমার?”

সারাহ্ হিজাব টে°নে°টু°নে ঠিক করে বলল,
“প্রেশার ডাউন।”

আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
“তোমার আচরণে পরিবর্তন এসেছে, ঐশী। কলেজের ম্যাডামরাও নোটিশ করছে।”

সারাহ্ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বাসায় গিয়ে আমরা আমাদের পার্সোনাল কথাগুলো বলি? এটা কলেজ।”

আহনাফ মাথা নেড়ে ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়। সারাহ্ পানি পান করে বেরিয়ে যায়।

আহনাফ একটু চিন্তায় পড়ে। সারাহ্ যে কিছু নিয়ে অনবরত ভাবছে তা সে বুঝেছে। গভীরভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টাদশ পর্ব

বাসায় এসেও সারাহ্ মৌনতাকে বরণ করে রেখেছে। আহনাফ খেয়াল করেছে শেষ কয়েকদিনে ওর আচরণের পরিবর্তন। আহনাফকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে সে। খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করে না, অনেক দেরি করে ঘুমায়।

সারাহ্ বিছানায় শুয়ে পড়ে। আহনাফ এসে আরেকপাশে অর্ধ শুয়ে ওর মাথায় হাত রেখে ডাকে,
“ঐশী।”

সারাহ্ চুপ করে আছে, চোখ বন্ধ। নিজেকে সে যথেষ্ট শান্ত রেখেছে। ঝ°গ°ড়া, চেঁ°চামে°চি সে পছন্দ করে না আর আহনাফকে যদি কোনো প্রশ্ন করে তবে তাই হবে। সম্পর্কের এমন অবনতি সে চায় না।

আহনাফ আবারো ডাকে,
“ঐশী?”

সারাহ্ চোখ বন্ধ রেখেই বলে,
“আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দিন।”

আহনাফ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ো, আসো খাবে।”
“হাত সরান, আহনাফ।”

কড়া ভাষায় কথাটা বলে সারাহ্। আহনাফ হাত সরায়। এভাবে কখনো সারাহ্ কথা বলেনি। কি হলো এখন?

আহনাফ উঠে ডাইনিং এ চলে আসে। সারাহ্-র কথায় অপমানবোধ হচ্ছে আহনাফের। তাহসিনার ঘটনা শোনার পরও যে মেয়ে স্বাভাবিক ছিল, সে এমন কোন ঘটনায় বি°গড়ে গেল বুঝতে পারে না আহনাফ।

সময় ওদের এভাবেই কাটে। মাগরিবের পর সারাহ্ রুম গোছাচ্ছে। ঠিক এমনসময় আহনাফ গিয়ে বিছানায় বসে। এ সময় প্রতিদিন আহনাফ বই পড়ে, তবে আজ ব্যতিক্রম।

“ঐশী, রেগে আছো?”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
“না।”

ড্রেসিংটেবিলের উপরে থাকা হিজাব পিনগুলো গোছাতে শুরু করে। আহনাফ পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়ালো। হেসে বলল,
“এগুলো আবারো এলোমেলো হবে।”
“হোক।”

সারাহ্ চলে যেতে নিলে আহনাফ ওর হাত ধরে কাছে এনে বলল,
“কি হয়েছে? আমার কোনো ভুল? বলো তো।”

সারাহ্ হাতের দিকে তাকায়। আহনাফ হাত ছেড়ে ওর কোমড় জড়িয়ে কাছে আনে।

“বলো, নইলে ছাড়ছি না।”

সারাহ্ ছাড়াতে চাইছে না। কোনো চেষ্টা নেই, জো°রজবর°দ°স্তি করছে না। শান্ত একটা দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ বি°ভ্রা°ন্ত হয়, সারাহ্-র থেকে সরে আছে। মেয়েটা শান্ত থেকেও ওকে ঘা°য়েল করার ক্ষমতা রাখে।

সারাহ্ চলে গেল। নিজের ভুল নিজেই খুঁজতে লাগলো আহনাফ।
______________________________________

পরদিন সকাল ৭ টা বেজে ৪৫ মিনিট, ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছিল মৃত্তিকা। রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে শরীর খারাপ করছিল, ঠিক এ কারণেই এখন ঘুমানো।

ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে। কেউ ওকে স্বরণ করেছে। হাতে নিয়ে অচেনা একটা নাম্বার দেখে ইমতিয়াজ ভেবে রিসিভ করে।

“জি।”

মৃত্তিকার কথার জবাব এলো,
“কেমন আছো, মা?”

ইমতিয়াজ নয়, ফোনের অপরপাশে ওর বাবা ছিল। মৃত্তিকা হতাশ হয়, সাথে বি°র°ক্ত।

“কেন ফলো করেন আমাকে? আমি আপনার কি এমন কাজে লাগতে পারবো?”
“আমি ভালোবাসি তোমাকে।”

মৃত্তিকা জবাব দিলো না। এসব ভালোবাসাকে ঘৃ°ণা করে সে। যেসব ভালোবাসা পরিবার ভা°ঙে, সন্তানকে বাবার থেকে দূরে রাখে, সকলের কষ্টের কারণ হয়। সেসব কোনো ভালোবাসা হতেই পারে না।

দুদিকে থাকা স°মা°ধী নিরবতা মৃত্তিকা টুকরো করে বলল,
“আমার কল্পনায় সবসময় আমার একজন বাবা ছিল। সে বাবা আমাকে ভালোবাসতো, আমার মাকে ভালোবাসতো। সে বাবা আমার কান্নার সময় চোখ মুছে দিতো, আমাকে গল্প পড়ে শোনাতো, আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতো, আমার সঙ্গে খেলা করতো।”

মৃত্তিকা থামলে আবারো সেই পূর্ব নিরবতা বিরাজ করে। শীতল কণ্ঠে মৃত্তিকা বলে,
“কিন্তু আমার বাস্তবের বাবা আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন সব ধ্বং°স করেছে।”

কল কে°টে যায়। মৃত্তিকা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে৷ বাবা শিশুকালের স্বপ্ন যেভাবে শেষ করেছে, ঠিক সেভাবে ওর যৌবনকালের স্বপ্নও শেষ করছে। বাবার জন্যই নিজের ইচ্ছার বি°রু°দ্ধে একটা চরিত্রহীন ছেলেকে বিয়ে করতে হচ্ছে ওর।
______________________________________

নাস্তা তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল সারাহ্। আহনাফ এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।

“ঐশী, নাস্তা রেডি করেছো?”

সারাহ্-র কোনো সারাশব্দ পাওয়া গেল না। কিভাবে পাওয়া যাবে, সে তো বাসায়ই নেই।

“ঐশী, ঐশী।”
কয়েকবার ডেকেও সারাহ্-র কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আহনাফ রুমের বাইরে এসে দেখে টেবিলে নাস্তা আছে কিন্তু সারাহ্ কোথাও নেই।

সদর দরজার কাছে গিয়ে বুঝলো সারাহ্ বেরিয়ে গেছে, কারণ ওর জুতো জোড়াও নেই এখানে৷ আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এভাবে এড়িয়ে চলার মানে কি?

বাসায় তালা ঝুলিয়ে আহনাফও বের হয়। কলেজে পৌঁছে মাঠের আশেপাশেও সারাহ্-কে দেখে না। নিশ্চয়ই টিচার্স রুমে আছে।

আহনাফ সাত পাঁচ ভাবে না। সোজা টিচার্স রুমে চলে যায়। রুমের দরজায় গিয়ে ম্যাডামদের উদ্দেশ্যে একটা লম্বা সালাম দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”

দুই একজন ম্যাডাম সালামের জবাব দিলেন। আহনাফ চোখ বুলিয়ে কোথাও সারাহ্-কে না দেখে একজন ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কেমিস্ট্রির সারাহ্ ম্যাডাম আসেনি?”

আহনাফের প্রশ্ন যারা শুনেছে তাদের কয়েকজন হেসে দিলো। ম্যাডাম উত্তর দিলো,
“না, ও কি বাসায় নেই?”

আহনাফ থ°তমত খায়। বলল,
“ওকে, থ্যাংকস।”

ম্যাডামের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আহনাফ দ্রুত বেরিয়ে আসে। টিচার্স রুমে একটু হাসাহাসি এখনো চলছে। হয়তো কেউ কেউ এখন একটা গল্প বানানোর চেষ্টা করবে আহনাফ আর সারাহ্-কে নিয়ে।

মাঠের পাশে এসে দাঁড়ায় আহনাফ। ফোন বের করে সারাহ্-কে কল দেয়। একবার, দুবার, তিনবার রিসিভ হয় না। তরতর করে আহনাফের রাগ বাড়ে।

চোখ যায় কলেজের বড় গেইটের দিকে, সারাহ্ ভিতরে আসছে। আহনাফকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে উলটো পথে হাঁটা লাগালেও খুব একটা ফল হলো না। আহনাফ তাকে পাকড়াও করলো।

“কিসব হচ্ছে এসব ঐশী? কল রিসিভ করছো না কেন?”
“যখন কলের জন্য অপেক্ষা করতাম তখন দেন নাই, তাই এখন রিসিভ করি না।”
“স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের মতো বিহেভ করবা না। রাগ উঠতেছে আমার।”

সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে ব্য°ঙ্গসুরে বলল,
“ও, তাই নাকি? রাগ হচ্ছে? তো আর কি? পুরো কলেজের সামনে আমাকে কিস করেন। এতে তো আপনার রাগ কমে। হিজাবটা খুলবো নাকি?”

আহনাফ আশেপাশে তাকায়। অনেকে ওদেরকে দেখলেও কথা বোধহয় কেউই শুনছে না। মাঠে অনেক কোলাহল আছে।

আহনাফ নিচুস্বরে বলল,
“ঐশী, প্লিজ থামো।”

আহনাফ চলে যায়। সারাহ্-র নিরবতা অথবা তার কথা দুটোই ওকে আ°হ°ত করছে। সারাহ্ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সেও চলে যায় টিচার্স রুমে।

নিজের চেয়ারে বসতেই ওর পাশে বসা ম্যাডাম বললেন,
“স্যার তো এসে তোমাকে খুঁজে গেছে।”

সারাহ্ উনার দিকে তাকাতেই উনি বলেন,
“কোথায় ছিলে?”

সারাহ্ অপ্রস্তুত হয়। বলে,
“উনি ভাড়া দিচ্ছিলেন, তখন আমি ভিতরে চলে এসেছিলাম। মাঠের ওদিকে ছিলাম তাই খুঁজে পায়নি।”
“চোখে হারায়।”

ম্যাডামরা মিটিমিটি হাসলেও সারাহ্ নিচুস্বরে বলল,
“ঘেচু হারায়।”
______________________________________

টিএসসিতে এসেছে সামিহা ও তানজিম। মনমরা অবস্থায় বসে আছে তানজিম। সামিহা এটা ওটা বললেও “হু” ছাড়া আর কোনো জবাব দিচ্ছে না সে।

সামিহা তানজিমের হাত ধরে বলে,
“কি রে? কয়েকদিন ধরেই তোকে চুপচাপ দেখছি। কোনো সমস্যা?”

তানজিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সামিহা আবারো বলল,
“আন্টি ঠিক আছে?”
“আম্মু ভালো আছে। সমস্যা অন্যকিছু নিয়ে।”

সামিহা তানজিমের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কি?”
“মিউকোপু ইমতিয়াজ ভাইয়াকে পছন্দ করে।”
“আপুর না বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
সামিহা কপাল কুঁচকে কথাটা বলল।

তানজিম মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, হয়েছে। তবুও আমি খেয়াল করেছি সে ভাইয়ার প্রতি দুর্বল।”

সামিহা ঠোঁট উল্টায়৷ বলে,
“এই ইমতিয়াজ ভাইটা কে?”
“আমার বড় বোন তাহমিনা আপুর হাসবেন্ড।”

সামিহা “অ্যা” নামক একটা অদ্ভুত বিকৃত শব্দ উচ্চারণ করে। তানজিম বলে,
“উনার সাথে এই বিষয় নিয়ে আমার একদফা ঝ°গ°ড়াও হয়েছে। বাট আমার মনে হয়না উনি ভাইয়াকে ভুলে যাবেন।”

সামিহা বলে,
“ভালোবাসা তো ভুলে যাবার মতো কিছু নয় তানজিম। আর তাহমিনা আপু বেঁচে নেই, তাই ভাইয়াও একা। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ে অবশ্যই একটা ভালো অপশন।”

তানজিম সামিহার দিকে তাকালে সামিহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম মানুষ তো আর একা থাকতে পারে না।”

তানজিম একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে,
“হয়তো তুই ঠিক বলছিস। কিন্তু ভাইয়া মিউকোপুর সাথে সংসার করবে এটা আমি কোনো এক কারণে মানতে পারছি না।”

সামিহা তানজিমের হাত ধরে৷ আপাতত এই অস্থির মানুষটাকে শান্ত করার প্রয়োজন। বোনের প্রতি ভালোবাসা আছে, তাই বাস্তবতা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
______________________________________

বিকাল সাড়ে চারটা, বাসার সামনের রাস্তায় হাঁটছে মৃত্তিকা। চিন্তাহীনভাবে হাঁটছে সে। যার জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, তার আবার কিসের চিন্তা। যেটুকু চাওয়া ছিল, তাও এখন মাটিচাপা পড়ে গেছে।

কলরবের গাড়িটা একটু দূরে দেখতে পেয়ে থেমে যায় মৃত্তিকা। গাড়ির পাশেই কলরব দাঁড়ানো। বিদেশে চাকরি করা কলরব ছুটিতে দেশে এসেছে, তাই তার এখন প্রতিদিনই শুক্রবার।

কলরবের পাশের মানুষটাকে দেখে দুনিয়া এক জায়গায় স্থির হয় তার। এ যে ওর বাবা শরীফ। মৃত্তিকা পিছিয়ে যেতে নিলে কলরব ওকে ডাকে,
“হেই মিউকো, কাম হেয়ার।”

পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করলেও মৃত্তিকা পালায় না। বাবাকে নিয়ে কলরবের মুখোমুখি আজ নাহয় কাল হতেই হতো। মৃত্তিকা এগিয়ে যায়।

কলরব শরীফের দিকে ইশারা করে বলে,
“উনাকে চেনো?”

মৃত্তিকা হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। কেবলই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শরীফ পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে বলে,
“আমার মেয়ে আমাকে চিনবে না তা কি করে হয়?”
কথাটা বলেই শরীফ হেঁটে চলে যায়।

মৃত্তিকা একবার সেদিকে তাকিয়ে মাথানিচু করে। কলরব গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“মানে এতো বড় মিথ্যা কথা কেন? তুমি মিথ্যা বলেছো, তোমার মামা মিথ্যা বলেছে, তোমার খালু মিথ্যা বলেছে। মানে মিথ্যা আর মিথ্যা। ডিরেক্ট বললেই তো হতো তোমার মা আর বাবার বিয়ের আগেই তুমি হয়েছো।”

মৃত্তিকা চোখ পাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
“চুপ করেন, আমার মামকে নিয়ে কোনো বাজে কথা বলবেন না।”

কলরব কান চুলকে মাথা ঝে°ড়ে বলল,
“আহা, রেগে যাচ্ছো কেন? এসব নরমাল তো। (একটু ভেবে) কি যেন বলেছিলে তোমার বয়ফ্রেন্ড ছিল না?”

কলরব শব্দ করে হেসে বলল,
“না জানি এ শরীরে কতশত হাত পড়েছে। বাই দা ওয়ে, তোমার মা কি প্র°স্টি°টিউট ছিলো?”

কলরবের ডান গালে একটা চ°ড় পড়ে৷ ওর শেষের কথায় মৃত্তিকার মাথায় র°ক্ত চ°ড়েছে৷ শান্ত মেয়েটা ধীরে ধীরে হিং°স্র হয়ে গেছে। মামের নামে একটু বাজে কথা যে সহ্য করতে পারে না, সে এতো বড় কথা কিভাবে সহ্য করবে।

মাথা তুলার আগেই কলরবের বাম গালে আবারো একটা চ°ড় পড়ে। কিছু বলার আগেই ওকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মৃত্তিকা।

আঙ্গুল উঁচিয়ে চোখ রা°ঙিয়ে বলে,
“সবার জানা উচিত, কোথায় থামতে হয়। না জানলেই বি°পদ।”

কলরব উঠে বসে বলল,
“ঠিক করলে না এসব মিউকো?”
“চুপ, মামকে নিয়ে কথা বলে আপনি ঠিক করেছেন?”

কলরব দাঁড়িয়ে শার্ট ঝা°রতে ঝা°রতে বলল,
“তোমাকে বিয়ে করছি না আমি, এমন মেয়ে আমার যোগ্য নয়।”

মৃত্তিকা ভ্রূ উঁচিয়ে ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“ভাবটা এমন যেন আমি বউ সেজে বসে আছি। এমন চরিত্রহীন ছেলের থেকে নি°স্তার পেয়ে শান্তি লাগছে।”

মৃত্তিকা বাসায় চলে আসে। শরীফ রিপা বেগমের নামে উল্টাপাল্টা কথা ছড়ায় এটা মৃত্তিকা আগে থেকেই জানে। শরীফের পরিবার অর্থাৎ মৃত্তিকার দাদাবাড়ির সবার কাছে রিপা বেগমকে খল°নায়িকা বানিয়েছে শরীফ, বাইরের লোকের কাছেও নিজের সন্তানের মায়ের নামে খারাপ কথা বলতে তার ঠোঁটে আটকায় না।

রুমে এসে দরজা লাগিয়ে মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। নিজেকে এতোক্ষণ যতই শক্ত রাখুক না কেন বদ্ধ ঘরে, একাকিত্বে ওর কান্নারা এসে জুড়ে বসে। এ কান্না রিপা বেগম দেখলে হয়তো কলরবকে খু°ন করতো।

মৃত্তিকার কাছে আজ এমন কেউ নেই যে ওর চোখের পানি মুছে দিবে, যে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে নিষেধ করবে। মৃত্তিকার একাকিত্ব ঘু°চবে না।
______________________________________

আহনাফের আগেই বাসায় এসেছে সারাহ্। মিটিং থাকায় আহনাফের বের হতে দেরি হয় আর বেরিয়ে সে সারাহ্-কে দেখে না। বাসায় এসে ব্যাগটা সোফায় ছু°ড়ে ফেলে আহনাফ।

ডাইনিং এ কাজ করছে সারাহ্। আহনাফ গিয়ে একটা চেয়ার টেনে সারাহ্-কে বসিয়ে দিয়ে বলে,
“কি সমস্যা তোমার?”

সারাহ্ কিছুই হয়নি এমন একটা চেহারা করে তাকিয়ে আছে। আহনাফ ওর দিকে ঝুঁ°কে বলল,
“কি হয়েছে?”

সারাহ্-র এমন নরমাল চেহারা দেখে আহনাফের রাগটা বাড়ে। ধ°ম°কের সুরে বলল,
“কথা বলছো না কেন?”

সারাহ্ আহনাফের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। বলে,
“আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে নাকি চিন্তার অভিনয় করছেন?”

আহনাফ সারাহ্-র থুতনিতে হাত রেখে বলে,
“এসব কেন বলছো?”
“পারফেক্ট হাসবেন্ড হওয়ার অভিনয় করেছেন? ঠকিয়েছেন আমাকে।”

সারাহ্-র দুইগালে হাত দেয় আহনাফ। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“একটু শান্ত হও। আমি কখনোই পারফেক্ট হাসবেন্ড হতে পারবো না। হ্যাঁ, অভিনয় করেছি, কিন্তু সেটাও তোমার খুশির জন্য।”
“কেন?”

সারাহ্-র প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওর ডানগালে ঠোঁট ছোঁয়ায় আহনাফ। সারাহ্ উত্তরের আগ্রহ দেখিয়ে বলে,
“কেন অভিনয় করেছেন আহনাফ?”
“কথা বলো না প্লিজ। এতো উত্তর আমি দিতে পারবো না।”

সারাহ্-র নিরবতা আহনাফকে বুঝিয়ে দিয়েছে সারাহ্ ওর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উপনীত হয়েছে। এই মানুষকে অনুভূতিটুকু জানিয়ে দিলেই তা পুরোনো হয়ে যাবে। তার জানার আগ্রহ থাকুক আর আহনাফ অনুভূতি গোপন করতে থাকুক।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে