#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ত্রয়োদশ পর্ব
“এসব কি করেছেন, আহনাফ?”
“ডোন্ট কল মি আহনাফ।”
বাসায় ফিরেই আহনাফকে প্রশ্ন করে সারাহ্। পুরো রাস্তা কথা বলার কোনো সুযোগই দেয়নি। আহনাফের ধ°ম°ক খেয়ে একটু থতমত খেয়ে যায়।
আহনাফ ফ্রেশ হতে চলে গেল। সারাহ্ সোফায় বসে পড়ে। লোকটাকে এখনো সে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন করে সে? মানসিক সমস্যা আছে কোনো? নাকি শুধুই ওর সাথে এমনটা করে?
আহনাফ ফিরে এসে সারাহ্-র গা ঘে°ষে বসে। সারাহ্ সরে নিলে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“কি বলছিলে?”
সারাহ্ ভয় পায়। সেই অ°প্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি সে চায় না। আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে ওর হিজাবটা খুলে নেয়। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“ছেলেটার প্রতি খুব দরদ হচ্ছে?”
আহনাফ আচরণ ভালো ঠেকলো না। সারাহ্ ঢোক গিলে বলে,
“ওর বাবা-মাকে ডাকবে, খুব খারাপ একটা ব্যাপার হবে না?”
“না।”
আহনাফ চলে যেতে নিলে সারাহ্ একটু জোরেই বলে,
“তাহসিনাকে ভালোবাসেন তো আমাকে নিয়ে এতো ভাবেন কেন?”
আহনাফ হাত মু°ষ্টি°ব°দ্ধ করে নিজের পায়েই দুবার আঘাত করে। তারপর দ্রুত সারাহ্-র কাছে এসে ওকে একহাতে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে আরেকহাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে ক°ড়া ভাষায় বলে,
“চুপ, গলা উঁচিয়ে কথা বলবে না।”
সারাহ্ কন্ঠ নামিয়ে খুব তাড়াহুড়ো করে বলে,
“মিথ্যা তো বলছিনা আমি? তাহসিনা কে বলছেন না, কোথায় আছে তাও বলছেন না। আবার আমার প্রতি পুরো অধিকার কেন খাটাচ্ছেন? আমি কি…”
আহনাফ ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। সারাহ্-কে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বলে,
“এসব তুমি বুঝবে না, ঐশী।”
আহনাফ গিয়ে সোফায় বসে। সারাহ্ এখনো একই স্থানে স্থির। আহনাফ ওকে পাশে বসতে ইশারা করে। সারাহ্ তাই করলো।
আহনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আর একটা দিন অপেক্ষা করো, তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিবো। (একটু থেমে) কাল বিকেলে ঢাকা যাবো, তৈরি থেকো।”
আহনাফ চলে যেতে নিলে সারাহ্ বলল,
“তাহসিনা কি ঢাকায় থাকে?”
আহনাফ জবাব দিলো না। ফিরেও তাকালো না ওর দিকে। ওর ভাবে মনে হতে পারে সারাহ্-র কথা সে শুনেই নি।
আহনাফ তো জানে তাহসিনা কোথায়। তাহসিনা যে এখন বড্ড একা, আহনাফ এখন সঙ্গী পেতে নিয়েছে। এটা জানলে কি তাহসিনা কষ্ট পাবে না?
______________________________________
বিকাল চারটা, নিজের রুমে অঘোরে ঘুমাচ্ছে মৃত্তিকা। সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছে, দুপুরের খাবারও বাইরে খেয়েছে। মমতাজ বেগম আজ বেশ ভালোই কথা বলেছেন৷ হয়তো একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন উনি।
এলোমেলো চুলগুলো মৃত্তিকার চোখমুখের উপর পড়ে আছে। পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরে খুব আরামের সাথে ঘুমাচ্ছে।
“মৃত্তিকা?”
চেনা একটা কন্ঠ অচেনাভাবে শুনে মৃত্তিকা। এতো নরম সুরে সে কেন ডাকছে তাকে?
আবারো সেই কন্ঠ,
“মৃত্তিকা?”
“আমাকে মিউকো বলেন না কেন?”
“সে যে আমার বিড়াল।”
“আর আমি?”
“তুমি হয়তো অনেককিছু, নয়তো কিছুই নও।”
মৃত্তিকা চোখ খুলে। উঠে বসে আশেপাশে তাকায়, রুমে কেউ নেই। তবে কি সে স্বপ্ন দেখছিলো?
মৃত্তিকা ফিক করে হেসে দেয়। ইমতিয়াজের কন্ঠ শুনতে ওর এতোই সুখ লাগে যে ঘুমের ঘোরেও সেই কন্ঠ শুনছে।
চুলগুলো খোঁপা করে নেয় মৃত্তিকা। আয়নার দিকে চোখ পড়ে। মৃত্তিকা নিজের চেহারা দেখে হেসে বলে,
“এক বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়েছিস তুই। পাগল হয়ে গেছিস? সে পুরুষের মনের কোণেও স্থান নেই তোর। ভুলে যা।”
নিজেই নিজেকে ব°কছে। হাসি পায় ওর। ঘুম আর হবে না। স্কার্ফটা মাথায় জড়িয়ে বেরিয়ে যায় মৃত্তিকা। যদিও আজকের আকাশটা একটু অন্ধকার, তবুও সে হাঁটতে বের হলো।
কিছুটা রাস্তা পেরিয়ে যায় গো°র°স্থানের কাছে। বাইরে লাগানো বোর্ডটার দিকে একটু তাকিয়ে লোহার গেইট ঠেলে ভিতরে ঢুকে। সকলে নিশ্চুপ নিরব, মৃত্তিকা গিয়ে রিপা বেগমের কবরের কাছে দাঁড়ায়।
“মাম।”
কণ্ঠনালি চি°ড়ে বের হয় এই ডাক।
সূরা ফাতিহা পড়লো, দোয়া করলো মামের জন্য। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। হঠাৎ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরা শুরু হয়। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে৷ তবুও মৃত্তিকা একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
ওর মাথার উপর একটা ছাতা আসলো। মৃত্তিকা চমকে উঠে৷ এখন এখানে কে এসে উপস্থিত হলো। পাশে তাকিয়ে বাবাকে দেখে ভয় পেল মৃত্তিকা।
“আপনি এখানে?”
শরীফ মেয়ের গালে হাত দিয়ে স্নেহের পরশ দিতে চাইলেও মৃত্তিকা তা প্র°ত্যা°খ্যা°ন করে। মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
“এসব আহ্লাদের প্রয়োজন নেই আমার।”
শরীফ বলল,
“বাইরে এসো। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। এতো না আগলে রাখতে চেয়েছিল তোমাকে, কোথায় সে?”
মৃত্তিকা কিছু না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। অ°মানুষের সাথে চিৎকার করে কোনো ফায়দা নেই। এরা পড়াশুনা করে ডাক্তার হয়, কিন্তু নৈতিকতার বড্ড অভাব।
মৃত্তিকা বাইরে চলে আসে। বৃষ্টির আঁচ কিছুটা কমে গেছে। ভিজে ভিজেই হাঁটতে থাকে সে। শরীফ এসে ওর পাশাপাশি হয়ে বলে,
“বাবার সাথে থাকবে এতে কি সমস্যা তোমার?”
মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,
“ওই বাবা কোথায় ছিল আমার ছেলেবেলায়? যখন আমি বাবার স্নেহ খুঁজতাম তখন কোথায় ছিল? আমার শৈশব ধ্বং°স করেও শান্তি হয়নি আপনার?”
“সেসব তোমার মায়ের জন্য হয়েছে।”
শরীফকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে মৃত্তিকা বলে,
“খবরদার আমার মাকে নিয়ে আর একটা শব্দ বলবেন তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
শরীফ মেয়ের গালে চ°ড় দিয়ে বলে,
“মায়ের মতোই হয়েছো, বে°প°রোয়া। সময় থাকতে বদলে যাও। নাহলে তোমার মায়ের সংসার জুটেনি আর তোমারও জুটবে না। একা থাকবে, ঠিক আমার মতো।”
একটু থেমে শরীফ নরম কন্ঠে বলে,
“মা, আমার সাথে চলো। আমি ভালোবাসি তোমাকে। আমার ভালোবাসা বোঝো না তুমি?”
“এসব আপনার ভালোবাসা? কথা না শুনলেই মা°র°বেন আর অ°ত্যা°চার করেন, এটা ভালোবাসা?”
“তুমি আজও আমাকে বুঝলে না।”
শরীফ চলে গেল। মৃত্তিকা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে সে? যাবে কোথায়? কাকে বোঝাবে ওর মনের কথা? কে আছে ওর? উত্তর একটাই, কেউ নেই ওর।
______________________________________
সন্ধ্যা ৭ টা, আহনাফ টেবিলে কিছু একটা পড়ছে। সারাহ্ একবার এসে চা দিয়ে গেল, একবার এসে বিস্কুট দিয়ে গেল। কিন্তু কোনোবারেই আহনাফ কোনো কথা বলল না।
সারাহ্ আরেকবার রুমে উঁকি দিলো। আহনাফকে ব্যস্ত দেখে ও ড্রইংরুমে চলে গেল। কল দিলো সামিহাকে। কাল যে ওরা বাসায় যাবে তা আগেই জানানো হয়েছে। নতুন জামাই বলে কথা, আয়োজন তো হবেই।
“আপু।”
“কি করিস?”
“তেমন কিছু না, আবার অনেক কিছু।”
“মানে?”
সামিহা হেসে বলল,
“পিঠা বানাচ্ছি, মুগপা°ক্কন আর চন্দ্রপুলি। তুমি তো সোয়ামী নিয়ে এসেই খা°লা°শ, য°ন্ত্র°ণা তো সব আমার।”
“ওমা, এসব কেমন কথা? তোর বিয়ের পরও তো এমন হবে।”
“অসম্ভব।”
চেঁচিয়ে বলে সামিহা।
“কেন রে?”
“আমি বিয়ে করে এখান থেকে কোত্থাও যাবো না, দরকার হলে জামাই এখানে থাকবে।”
“দেখা যাবে।”
সারাহ্ হো হো করে হেসে উঠলো। মেয়েরা একটা বয়সে বলে আমি কোথাও যাবো না, বাবা-মায়ের সাথে থাকবো। কিন্তু বাস্তবতা হলো তাদেরকে যেতে হয়, সেদিন আর এসব কথার কোনো মূল্যই থাকে না।
আহনাফ ড্রইংরুমে এসে টিভি ছেড়ে বসে। সারাহ্-র দিকে তাকালে সারাহ্ আর কিছু না বলেই ফোন রেখে দেয়।
“ব্যাগ গুছিয়েছো?”
আহনাফের কথায় সারাহ্ ডানেবামে মাথা নাড়ে। আহনাফ আবারো খেলা দেখতে ব্যস্ত হয়। সারাহ্ টিভির দিকে তাকায়। ক্রিকেট খেলা সে খুব একটা বুঝে না, ফুটবলেই তার যত আগ্রহ।
আহনাফ বলল,
“তুমি ফোনে কথা বলছিলে। বলতে পারো, সমস্যা নেই।”
সারাহ্ জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে,
“কাল ক্লাস করবেন না?”
“ক্লাস নেই কালকে।”
“কলেজ যাবেন?”
“হুম, ওই ছেলের বাবা আসবে।”
সারাহ্ এসে ওর পাশে বসে বলল,
“ছোটমানুষ ওই ছেলে, বুঝেনি এতোকিছু হবে। আপনাকেও তো এক মেয়ে প্রপোজ করেছিল, আমি কি এতো কাহিনী করেছি?”
আহনাফ পা গু°টিয়ে বসে বলল,
“আমি আর তুমি কি এক?”
“না, আসলে..”
আহনাফ ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“তবে? আমি কি করবো না করবো তা কি তুমি ঠিক করবে?”
রিমোটটা ছু°ড়ে ফেলে আহনাফ চলে যায়। সারাহ্ কিছুই বলে না। এ সম্পর্ক কি এভাবেই চলবে। ঝগড়া, রাগ আর ভ°য়ের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক স্থায়ী হয়?
______________________________________
সকাল ৮ টা, তানজিমকে কল করে সামিহা জানালো সে ভার্সিটিতে যাবে না। কারণ আজ বাসায় সারাহ্ আসবে। তানজিমকে ভার্সিটিতে যেতেই হবে, কারণ আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস। বাদ দিলে নোটগুলো পাবে না।
তানজিম বের হওয়ার সময় মৃত্তিকাকে তৈরি হতে দেখে বলে,
“আপু কোথাও যাবে?”
“হ্যাঁ, যাবো।”
“কোথায়?”
“এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবো।”
“এত সকালে?”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” বলে বেরিয়ে যায়।
তানজিমও বের হয়। মৃত্তিকা ওকে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার ইমতিয়াজ ভাইয়া কোথায় থাকে?”
“এইতো কাছেই, মগবাজারের দিকে উনার বাসা।”
“ও” বলে মৃত্তিকা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে।
তানজিম নিজের রাস্তায় যায়। আজকে ক্লাসটা বোরিং যাবে। সামিহা নেই, মানে ওর গল্প করার আর দুষ্টুমির সঙ্গিনী নেই।
পান্থপথের কাছে বান্ধুবীর বাসায় আসে মৃত্তিকা। বিশেষ কোনো কারণ নেই, শুধুমাত্র বাংলাদেশের চাকরির অবস্থা জানার জন্যই এখানে আসা। ওর যেকোনো একটা চাকরি হলেই হবে, সে হোক বিশ-বাইশ হাজার টাকার। যার ভবিষ্যৎ নেই, তার টাকারও প্রয়োজন নেই।
______________________________________
বিকাল চারটায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আহনাফ-সারাহ্। সারাহ্ নিষেধ করায় ছেলেটি এবারের যাত্রায় ছেড়ে দেয় আহনাফ, তবে সতর্ক করে দেয়।
বাসে বসে আহনাফ জিজ্ঞাসা করলো,
“ব°মির অভ্যাস আছে?”
সারাহ্ মাথা নেড়ে বলে,
“না।”
আহনাফ অন্যদিকে তাকায়। সারাহ্ বলে,
“একটা প্রশ্ন করি? ভ°য় দেখাবেন না।”
আফনাফ ফিক করে হেসে দেয়।
“আমি কি ভূ°ত যে তোমাকে ভ°য় দেখাবো?”
“আপনা..(একটু থেমে) আপনি তাকালেই আমার ভ°য় করে।”
আহনাফ সরাসরি বলল,
“কি প্রশ্ন করবে তাই করো।”
“ব°কা দিয়েন না, ওকে?”
“আচ্ছা বলো।”
একটু বি°র°ক্ত হয়েই বলে আহনাফ।
“আসলে জানতে চাইছিলাম কালকের ওই ঘটনায় আপনার কি জে°লা°স ফিল হয়েছিল?”
আহনাফ মাথা নেড়ে হাসে।
“জে°লা°স? তাও ওইটুকু একটা বাচ্চার সাথে? কম করে হলেও বারো-তেরো বছরের ছোট হবে আমার থেকে। জে°লা°স বলতে যা বোঝো এটা তা নয়। এটাকে প্রতি°রক্ষামূলক হিং°সা বলে। বোঝো এসব?”
এসব বিষয়ে সারাহ্ নিতান্তই কাঁচা। তাই আর কথা বাড়ালো না চুপচাপ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
আহনাফ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সারাহ্ আবারো ওর দিকে তাকালো। তাহসিনা নামের কেউ আছে যাকে আহনাফ ভালোবাসে, প্রচন্ড ভালোবাসে। এই একটা ভাবনা সারাহ্-কে বড্ড বেশি পী°ড়া দিচ্ছে। তাহসিনা যে ভালোবাসা পাচ্ছে সেটা ও কেন পেতে পারে না?
ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয় ওদের। পুরো রাস্তা সারাহ্ নিরব থাকে। আহনাফ যে তাহসিনার সাথে দেখা করাবে ওকে। কিভাবে সহ্য করবে ও?
______________________________________
রাত আটটা, তানজিমদের বাসায় এসেছে মামা শাফিন ও মামী দেলোয়ারা। মৃত্তিকা উনাদেরকে আসতে বলেছে। শরীফের ব্যবহার নিয়ে আবারো সবার সাথে কথা বলছে মৃত্তিকা।
লুৎফর সাহেব ইমতিয়াজকেও খবর দিয়েছেন, যদিও তা মৃত্তিকা জানে না। ইমতিয়াজ মাত্রই এসেছে। মৃত্তিকা ডাইনিং এ বসে কথা বলছিলো ঘরের বড়দের সাথে।
“আসসালামু আলাইকুম।”
ইমতিয়াজ সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দেয়, সালামের উত্তর দেন উনারা। মৃত্তিকা আড়চোখে ওর দিকে তাকায়।
দেলোয়ারা বললেন,
“হাতমুখ ধুয়ে আসো বাবা।”
“জি, মামানী।”
পকেট থেকে ফোন আর অফিসের আইডি কার্ড বের করে টি টেবিলের উপর রেখে তানজিমের রুমে চলে যায় ইমতিয়াজ।
ইমতিয়াজ ফ্রেশ হয়ে আসতেই লুৎফর সাহেব ওকে বললেন,
“একটা বড় সমস্যায় আছে মিউকো, সমাধান নেই।”
ইমতিয়াজ সোফায় বসতে বসতে বলল,
“কি হয়েছে আবার বাবা?”
শাফিন সাহেব বললেন,
“মিউকোর বাবা, ওকে প্রতিদিন একই বিষয়ে য°ন্ত্র°ণা দিচ্ছে। গতকালকেও চ°ড় দিয়েছে ওকে, প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করে। এমন অবস্থা চললে কি হয়?”
ইমতিয়াজ তাকালো মৃত্তিকার দিকে, চোখদুটো এখনো ছটফট করছে কান্নার জন্য। মৃত্তিকা ওর দিকে তাকাতেই ও চোখ ফিরিয়ে নিলো।
দেলোয়ারা চায়ের জন্য উঠে গেলেন। মৃত্তিকাও সাথে গেল।
লুৎফর রহমান বলেন,
“এইটুকু বয়সে একটু শান্তিও পাচ্ছে না। কি করা যায়?”
ইমতিয়াজ একটু ভাবে। তারপর বলে,
“ওর বাবার থেকে ওকে দূরে থাকতে হবে। এনি হাউ।”
“এটাই তো সমস্যার, সব জায়গায় হাজির হয়। যদিও মিউকো সাহসী, তবুও কবে কি হয়ে যায় বলা যায় না।”
লুৎফর রহমানের কথায় সবাই সম্মত হলো।
শাফিন সাহেব বলেন,
“মিউকোর বিয়ে দিতে হবে। একমাত্র ওর হাসবেন্ডই পারবে ওকে ওই লোকের কাছ থেকে দূরে রাখতে।”
মৃত্তিকা চা এনে সবাইকে দেয়। ইমতিয়াজের সামনে নিয়ে কাপ রাখতেই ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, মৃত্তিকার বিয়েই এটার সমাধান হতে পারে। আপনারা পাত্র দেখেন, আয়োজন দায়িত্ব আমি আর তানজিম নিলাম।”
মৃত্তিকা একটু সরে এসে একটা নিরব দৃষ্টি দেয় ইমতিয়াজের দিকে। চোখদুটো বারবার বলছে,
“আমাকে তোমার করে নাও। আর কাউকে চাই না আমি। আমার জীবনের সেই সৈ°ন্য হয়ে যাও তুমি, যে প্রতিনিয়ত ঢা°ল-ত°লো°য়ার নিয়ে আমাকে রক্ষা করবে।”
ইমতিয়াজ ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। সকলে একমত হলো, মৃত্তিকার বিয়ের প্রয়োজন।
শাফিন সাহেব বললেন,
“মা মিউকো, কিছু মনে করো না। বিষয়গুলো এখন খুবই স্বাভাবিক। কাউকে কি পছন্দ করো বা ইতালিতে কারো সাথে সম্পর্ক ছিল?”
মৃত্তিকা মাথানিচু করে বলে,
“না। আপনারা যা ভালো বুঝেন, তাই করেন।”
মৃত্তিকা বে°প°রো°য়া নয়, যথেষ্ট শান্ত। সে কি করে বলবে আপনাদের বাড়ির জামাইকেই আমি ভালোবেসেছি। তাহমিনার স্বামী ইমতিয়াজ আমার স্বপ্নেও আসে। ছি, এ কথা বলা মানে পরিবারের সামনে ওর মামের সম্মান বিলীন করা। নিজের অনুভূতিকে ঘৃ°ণা করতে থাকে মৃত্তিকা।
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
চতুর্দশ পর্ব
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে বাসার সবাই আবারো কথা বলছে। মৃত্তিকার জন্য কেমন ছেলে চাই সেটাই এখানে মুখ্য বিষয়।
“মিউকো মা একজন এডুকেটেড মেয়ে। পিএইচডি ডিগ্রিও নিবে আশা করি। তো ওর জন্য একজন পারফেক্ট ছেলেই লাগবে। তাড়াহুড়ো করে যার তার হাতে ওকে তুলে দেয়া যাবে না।”
শাফিন সাহেব সত্যই বলেছেন। শিক্ষিত মেয়ের জন্য শিক্ষিত ছেলে না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে।
“তুমি ঠিক বলেছো, শাফিন।”
মমতাজ বেগম রুম থেকে বের হতে হতে বললেন। লুৎফর রহমান উনার দিকে ফিরে বললেন,
“তুমি এখানে?”
“কেন? আসতে পারবো না বুঝি?”
অভিমানী সুরটা লুৎফর সাহেব বুঝলেন। ঘরে থেকে থেকে মানুষটা যে হাঁপিয়ে উঠেছেন। মমতাজ বেগম এসে ইমতিয়াজের পাশে বসলেন।
বড়রা সোফায় বসা। তানজিম আর মৃত্তিকা ডাইনিং এ চেয়ারে বসেছে।
দেলোয়ারা বললেন,
“কিন্তু বাবা মায়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে কি বলবেন? (একটু থেমে) না মানে, ডি°ভো°র্সের কথা তো বলা যাবে না।”
“না, ডি°ভো°র্স বলা লাগবে না। বাবা-মা নেই, মা°রা গেছে। মামার কাছে থেকেছে। থ্যাটস ইট, আর কিছু বলার দরকার নেই।”
শাফিনের কথায় সবাই সম্মত হলেও ইমতিয়াজ বলে,
“মামা, কিছু মনে করবেন না। একটা কথা বলি।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো।”
ইমতিয়াজ একবার মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবার কথা না বললে পরে তো ওর বাবার কথা জানতেই পারবে, উনি যেভাবে মৃত্তিকার আশেপাশে থাকে।”
শাফিনের মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়লো, ইমতিয়াজের কথা সত্য। মৃত্তিকার দৃষ্টি ইমতিয়াজের দিকে আর ইমতিয়াজ চেয়ে আছে ফ্লোরে অযত্নে পড়ে থাকা কার্পেটের দিকে।
“যদি বলি বাবা না উনি, মিথ্যা বলছে।”
শাফিনের কথায় মাথা নাড়লো ইমতিয়াজ। বলল,
“মামা, জানাজানি হলে উনার অবস্থাও খালামনির মতোই হবে।”
মমতাজ বেগম ঘাবড়ে গেলেন। রিপা বেগমের ঘাড় আর হাত-পায়ের অবস্থা উনি দেখেছিলেন। মমতাজ বেগম ইমতিয়াজের হাত ধরে বলল,
“কি করবো, বাবা?”
মমতাজ উনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“মা, শান্ত হন। আমাদের খুঁজতে হবে, সময় লাগবে। হয়তো এতোটা পারফেক্ট ছেলে পাওয়া যাবে না, তবে অসম্ভব নয় আশা করি। যে বিয়ে করবে, তাকে সবটা বলতেই হবে।”
লুৎফর রহমান সম্মতি জানালেন,
“আমিও ইমতিয়াজের সাথে একমত। সময় লাগবে, তাড়াহুড়ো করা যাবে না।”
“তবে তাই হোক। মৃত্তিকা কি বলো?”
শাফিন সাহেবের প্রশ্নে মৃত্তিকা মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলো। তারপর বলল,
“আমি জব করতে চাচ্ছিলাম।”
“কিছুদিন আপনার বাইরে না যাওয়াই ভালো হবে।”
কেউ কিছু বলার আগেই মাঝ থেকে কথাটা বলে ফেলে ইমতিয়াজ। সবাই ওর দিকে তাকালে বলে,
“ভুল বললাম?”
“না, ঠিকই বলেছো।”
অত:পর সবাই যার যার রুমে যায়। তানজিম এতোক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচে। বড়দের মাঝে সকলের ওর দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন সে কয়েকদিন আগেই কথা বলতে শিখেছে, এখন কেবল মাম্মা, পাপা বলে।
ইমতিয়াজ তানজিমের রুমে গেছে। মৃত্তিকা এসে ইমতিয়াজের আইডি কার্ড দেখে। অফিসে বেশ বড় পদে চাকরি করছে সে, পরিচালন অধিকর্তার নির্বাহী সহকারী। কোথায় সেই অফিস সেটাও দেখে নেয় সে।
টা°ন দিয়ে কার্ডটা নিয়ে নেয় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা একটু চমকে উঠে।
“এসব ভালো নয়, মৃত্তিকা।”
“সরি। (একটু থেমে) আমাকে মিউকো কেন ডাকেন না?”
“মিউকো যে আমার বিড়াল।”
মৃত্তিকা ইমতিয়াজের চেহারার দিকে তাকায়। সে শার্টের হাতা গুটাতে ব্যস্ত। মৃত্তিকার সেই স্বপ্নের জবাব। মৃত্তিকার আগ্রহ বাড়লো।
“আর আমি?”
মৃত্তিকার মিষ্টি প্রশ্নে ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলে,
“কি আপনি?”
“কিছু না।”
প্রশ্নটা ভে°ঙে করতে পারলো না মৃত্তিকা। আবারো সেই অনুভূতিরা জাগ্রত হচ্ছে। ইমতিয়াজ মমতাজ বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। মৃত্তিকার দিকে একবারের জন্যও তাকালো না। অথচ মৃত্তিকা বারবার ওর দৃষ্টির অপেক্ষায় চেয়ে থাকলো।
______________________________________
পরিবারের সবার সাথে রাতের খাবার শেষে ঘরে এসেছে সারাহ্-আহনাফ। এতোদিন পর পরিবারকে কাছে পেয়ে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে সারাহ্-র। তবে উলটো অনুভূতি হলো তাহসিনাকে দেখবে।
আহনাফ বিছানায় শুয়ে পড়েছে। সারাহ্ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে। আহনাফ একবার ওকে দেখে আবারো চোখ বন্ধ করে। বাসায় আসার পর শাড়ি পড়েছে সে৷ একটা অন্যরকম ভালো লাগা আছে সারাহ্-র আশেপাশে।
“ফয়েজ স্যার?”
সারাহ্-র হঠাৎ ডাকে চমকে উঠে আহনাফ৷ চোখ কুঁচকে বলে,
“কি সমস্যা?”
“কোথায় সমস্যা? আমি তো বললাম ফয়েজ স্যার। আপনাকে ডাকছি।”
আহনাফ উঠে বসে,
“ফয়েজ স্যার কেন? নাম ধরে ডাকবে না।”
সারাহ্ ওর দিকে ফিরে ব্য°ঙ্গসুরে বলে,
“কেন? আপনিও কি ওইসব বিশ্বাস করেন যে স্বামীর নাম ধরে ডাকলে অ°মঙ্গল হয়।”
আহনাফ হাসলো। উঠে বালিশ ঝে°ড়ে আবারো শুয়ে পড়ে। সারাহ্ জবাব না পেয়ে বলল,
“বলেন কি ডাকতে আপনাকে? আহনাফ নাকি ফয়েজ স্যার?”
“এগুলো ছাড়া অন্যকিছু।”
সারাহ্ লাইট নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় চলে আসে। শুতে শুতে বলে,
“জান, কলিজা, কিডনি ডাকি?”
“কি?”
আহনাফের ধ°ম°ক শুনে সারাহ্ হেসে অন্যদিকে ফিরে যায়। আহনাফ ওর কোমড়ে হাত দিতেই চমকে উঠে। সারাহ্-কে কাছে এনে ওর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে আহনাফ। এদিকে সারাহ্ ভ°য় পাচ্ছে, এবারে সে একে আর ভ°য় বলে সম্মোধন করলো না। এ লজ্জা, ও লজ্জা পায় আহনাফের স্পর্শ।
আহনাফের হাতের উপর হাত রাখতেই আহনাফ বলল,
“হুশ, ঘুমাও।”
“আহনাফ?”
সারাহ্ ঘাড়ের কাছে ঠোঁটের স্পর্শ পেল। হঠাৎ করে উঠে গিয়ে লাইট জ্বা°লালো। আহনাফ অন্যদিকে ফিরে গেছে। সারাহ্ লাইফ নিভিয়ে আবারো এসে শুয়ে পড়লো।
সারাহ্ বলল,
“আপনার সাথে থেকে থেকে আমিও অস্বাভাবিক আচরণ করছি।”
আহনাফ শব্দ করে হেসে ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“তুমি যে আগে থেকেই পাগল সেটা জানতে না বুঝি?”
“আমি মোটেও পাগল না।”
“পাগল না, ভুল বলেছি। তুমি আস্ত ছাগল, মাঠে ঘুরেফিরে যে ঘাস খায় ওই ছাগল।”
“খারাপ হবে বলছি, আহনাফ।”
“নাম ধরে ডাকলে তোমার খারাপ হবে।”
“একশবার ডাকবো। আহনাফ, আহনাফ, আহনাফ।”
বারবার “আহনাফ” বলে ডাকতে থাকে সারাহ্ আর সাথে থাকে দুষ্টুমির হাসি।
আহনাফ ওকে কাছে এনে গলায় আবারো চুম্বন করে। এবারে আর সেদিনের কাঠিন্য নেই, যেন কিছু স্নেহ আর অল্প ভালোবাসা মিলেমিশে আছে। আহনাফের চুলগুলোতে হাত রাখে সারাহ্। মেয়েটা যে বড্ড লাজুক, চোখ মেলাতে পারবে তো পরে?
______________________________________
ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদেই বসে আছে ইমতিয়াজ। একটা সিদ্ধান্তহীনতা তাকে অসম্ভব পোড়াচ্ছে। শুক্রবার সকাল হওয়ায় আজকে মসজিদে মানুষ কম। যা কয়েকজন ছিল তারাও নামাজ পড়ে চলে গেছে।
ইমতিয়াজ মোনাজাতে ব্যস্ত। নিজের মনের অবস্থা রব ছাড়া আর কাকে বোঝাবে সে। শ°য়°তা°নের প্র°রো°চনা থেকে বাঁচতে হলে তো রবের দিকেই আসতে হয়।
জীবনের এমন এক মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে যে না সে একা থাকতে পারছে আর না সে তাহমিনাকে ছাড়া কোনো সঙ্গী কল্পনা করতে পারছে। লোকে তো হাসবে যে স্ত্রীর মৃত্যুর দুইবছর পেরিয়ে গেলেই এখনো সে কেন একা? কিসের খাতিরে?
সাময়িকের জন্য মৃত্তিকাকে ভালো লাগলেও সে এটাকে শ°য়°তা°নের নিছক প্র°রো°চনা বা ন°ফ°সের বি°কৃ°ত চিন্তা মনে করছে। মাথায় ঘুরতে থাকা এসব কথা প্রাণ খুলে রবের দরবারে পেশ করে সে।
এদিকে মৃত্তিকার চিন্তায় মিশে গেছে ইমতিয়াজ। নিজের লজ্জা ভুলে সকলকে সেটা জানাতে চেয়েও জানাতে পারছে না। ইমতিয়াজ তাকে ভালো রাখবে, হয়তো ভালোও বাসবে। এই বিশ্বাস নিয়ে কাকে বলবে সে মনের ভালো লাগার কথা, নিজের স্বপ্নের পুরুষের কথা কাকে শোনাবে সে?
মসজিদ থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছে ইমতিয়াজ। আকাশে আলো ফুটে উঠছে। ফোন বেজে উঠে। পকেট থেকে বের করে মৃত্তিকার নাম্বার দেখে কপাল কুঁচকায়।
কোনো বি°পদের আশঙ্কায় দ্রুত রিসিভ করে,
“জ্বী, মৃত্তিকা।”
মৃত্তিকা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,
“একটা সাহায্য করতে পারবেন?”
“কি?”
“মামাকে জানাবেন আমি কাউকে পছন্দ করি, আমি তাকেই বিয়ে করতে চাই।”
ইমতিয়াজ হাঁটা থামিয়ে দেয়। একমুহূর্তের জন্য ওর মনে হলো মৃত্তিকা ওর কথাই বলছে৷
তবুও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“উনারা এসবকে খুব স্বাভাবিক মনে করে। আপনি সরাসরি বলুন, না হলে তানজিমকে বলুন।”
“তানজিম আমার ছোট, ওকে কিভাবে?”
“তবে আমি কেন বলবো?”
“কারণ আপনি জানেন সে কে?”
ইমতিয়াজ চুপ থাকে। সে কি আদৌতে জানে। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে ইমতিয়াজ বলল,
“আপনি যা বলছেন তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি।”
ইমতিয়াজ কল কে°টে দিলো। রাগটা বাড়তে থাকে। কার উপর রাগ হচ্ছে? নিজের উপর নাকি মৃত্তিকার উপর?
______________________________________
সকাল সাতটায় কাকরাইল গো°র°স্থানে আসে আহনাফ ও সারাহ্। সারাহ্ জানে ওরা তাহসিনার সাথে দেখা করতে এসেছে। গো°র°স্থানে প্রবেশের সময় সারাহ্ আশেপাশে তাকায়। তাহসিনা জীবিত নাকি মৃ°ত এ নিয়ে বি°ভ্রা°ন্তিতে পড়ে সে।
আহনাফ ওর হাত ধরে একটা কবরের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে,
“এখানেই আছে আমার তাহসিনা।”
সারাহ্ চমকে উঠে। তাহসিনা নেই এই পৃথিবীতে, অথচ তার ভালোবাসা নিয়ে কেউ বেঁচে আসে।
সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকিয়ে দেখে সে মোনাজাত করছে। সারাহ্-ও সূরা ফাতিহা পাঠ করলো। “আমিন” বলার সময় ওর চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ে। এ পানির কারণটা সে বুঝতে পারলো না।
আহনাফ বলে,
“বিয়ের দিন। পুরো রিসোর্ট সাজানো, গোছানো। সুন্দর করে লাইট লাগানো হয়েছে, ফুলের সুভাসে ভরে গেছে চারপাশ। নিজের পছন্দের সাদা শাড়ি পড়েছিল সে, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সাজে সজ্জিত হয়েছিল। (একটু থামে) কিন্তু সে সাজ নিয়ে আমার সামনে যখন এসেছিল, তখন তার নিশ্বাস বন্ধ। চোখ বুজেছিল সে।”
আহনাফের কন্ঠ কেঁপে উঠলো। সারাহ্ ওর দিকে একবার তাকায়, তারপর আবারো তাকায় কবরের দিকে।
“ওর সেই শাড়িটা লাল হয়ে গিয়েছিল। সেই বৃষ্টি ভেজা ভার্সিটির দিনগুলো। ওকে নিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার দিনগুলো এখন শুধুই আমার স্মৃতি।”
আহনাফ থামে। সারাহ্ এখনো স্ত°ব্ধ হয়ে আছে। বিয়ের দিন প্রেমিকার মৃ°ত্যু যে এই মানুষটা সহ্য করেছে এই অনেক।
“জন্ম, মৃ°ত্যু আর বিয়ে তো আমাদের হাতে নেই। তাইতো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সে চলে গেল আর তুমি এলে। হয়তো আমিও চলে যাবো আর তুমি থাকবে।”
আহনাফ বেরিয়ে যায়। সারাহ্ তাকিয়ে থাকে সমান হয়ে থাকা কবরের মাটির দিকে। এই কবর কাউকে ছাড়বে না। যেদিন আল্লাহ্-র হুকুম হবে, সেদিনটা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন যেতে আমাদের হবেই। স্বয়ং আল্লাহ্ ছাড়া নিয়তি কেউ খ°ন্ডা°তে পারবে না।
সারাহ্ বেরিয়ে আসে। আহনাফ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সারাহ্ ওর হাত ধরে।
“দুই দুইটা বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ আমার মনে হয় সেদিনও তাকে পাশে পেয়েছিলাম।”
আহনাফের চোখ বেয়ে পানি পড়তে নিলে সারাহ্ মুছে দিলো। আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার জীবনটা এভাবে ধ্বং°স করার অধিকার আমার নেই, তবুও করেছি।”
সারাহ্ ওর চোখের পানি মুছে দেয়।
“আপনিই তো বলেছেন এই বিয়ে আল্লাহ্-র ইচ্ছায় হয়েছে, তবে এটা ধ্বং°স কেন হবে? হয়তো এটা পরীক্ষা, আমার ধৈর্যের পরীক্ষা।”
কথাগুলো সারাহ্-র মনেই থাকে। আহনাফকে বলে না সে। আহনাফ কিভাবে নিবে বা কি ভাববে?
আহনাফ চুপ করে সারাহ্-র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। অন্য কেউ হলে প্রতিক্রিয়া কি হতো আহনাফ জানে না তবে সারাহ্ নিরবতাকে বরণ করেছে।
বাসায় ফিরে আসা অব্ধি কোনো কথা বলেনি সারাহ্। আহনাফও কোনো প্রশ্ন করেনি। সারাহ্ নিরব আছে, চুপচাপ, শান্ত।
বাসায় এসে হিজাব খুলছে সারাহ্। আহনাফ পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“ঐশী, তোমার প্রশ্নের উত্তরগুলো পেয়েছো? কেন তাহসিনাকে ভালোবেসেও তোমাকে বিয়ে করেছি?”
“হুম।”
ওর ছোট জবাবটা আহনাফের ঠিক পছন্দ হলো না। আবারো সুধালো,
“আর কোনো প্রশ্ন আছে?”
“না।”
সারাহ্ চলে গেল। আহনাফ ওর হাত ধরে বলে,
“খারাপ লাগছে তোমার আমি জানি। কিন্তু সত্যটা তো জানানোর প্রয়োজনও ছিল।”
সারাহ্ মুচকি হেসে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“আমি অন্য কারণে নিরব।”
“কি?”
আহনাফ কপাল কুঁচকায়।
সারাহ্ সরে যেতে নিয়েও সরতে পারে না। আহনাফ ওর হাত এখনো ধরে রেখেছে। সারাহ্ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে আহনাফ বলে,
“কারণ কি?”
সারাহ্ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“তাহসিনা আপুর মতো করে আমি আপনাকে বুঝতে পারবো না, তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে..”
সারাহ্ থেমে যেতেই আহনাফ চোখ ছোট করে। সারাহ্ মুচকি হেসে চলে যায়। আহনাফ তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। গতরাতের স্পর্শগুলো সজ্ঞানে করেছে আহনাফ, রাগ কিংবা প্রতি°হিং°সা থেকে নয়।
আহনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ওর দিকে। পাশাপাশি থাকা দুজন নর-নারীর মনে পবিত্র ভালোবাসা সৃষ্টি করুক মহান সৃষ্টিকর্তা। হালাল সম্পর্কগুলো যে একটু বেশিই সুন্দর।
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
পঞ্চদশ পর্ব
দুপুরের খাওয়াদাওয়া হয়েছে বহু আগে। সারাহ্ সামিহাকে সাথে নিয়ে খাবারের এলাহি আয়োজনের এঁ°টো বাসন পরিষ্কার করলো। এক জামাই আর এক মেয়ের জন্য এতো আয়োজন করেছে যেন আজকে আবারো মেয়ের বিয়ে৷
নার্গিস পারভিন এসে ওদেরকে তাড়া দিয়ে বললেন,
“একটু জলদি কর মায়েরা।”
সারাহ্ একটু বি°র°ক্তি নিয়েই বলে,
“আম্মু, এতো আয়োজন করা ঠিক হয়নি।”
“কেন ঠিক হয়নি?”
“অবশিষ্ট খাবারগুলো কি করবে? শুধু শুধু ওয়েস্ট হবে।”
সামিহা পাশ থেকে বলল,
“প্লেটে জমা খাবারগুলো কুকুরকে খাওয়াবো আর বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে আমি মাঝরাতে খাবো।”
সারাহ্ চোখ কুঁচকে বলে,
“ওগুলো কুকুরকে না দিয়ে তুই খেয়ে ফেল। মাঝরাতে কেউ এসব খায়? পাগল কোথাকার?”
“তুমি মস্ত বড় ছাগল।”
নার্গিস পারভিন মেয়েদের ঝগড়ায় বি°র°ক্ত হয়ে নিজকক্ষে চলে গেলেন।
সারাহ্ মুচকি হাসলো। প্লেটগুলো গুছিয়ে রেখে দ্রুত প্রস্থান করলো। সামিহা ভ্রূ উঁচিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে অদ্ভুত একটা চেহারা করে বলে,
“কি এমন বললাম যে হাসতে হবে? ছাগল বললে কেউ হাসে?”
সারাহ্ রুমে গিয়ে আহনাফকে তৈরি হতে দেখে বলে,
“কোথাও যাবেন নাকি?”
“হুম।”
“কোথায়?”
“নিউমার্কেট। (একটু থেমে) তোমার কিছু লাগবে?”
সারাহ্ এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“সবাই আমাকে ছাগল বলে কেন?”
আহনাফ দাঁত বের করে হেসে বলে,
“নি°র্ঘা°ত কোথাও ঘাস খাচ্ছিলে আর অনেকে দেখেছে।”
সারাহ্-র কপাল কুঁচকে গেল। আহনাফ একটু হেসে মুখটাকে আবার গম্ভীর করে বলে,
“ঐশী, তাহসিনার কথা শোনার পর এটা নিয়ে আর কিছুই তো বললে না। বরং অদ্ভুত একটা আচরণ শুরু করেছো।”
সারাহ্ একটু চমকায়। আহনাফ তার আচরণ খেয়াল করছে। সে শুনতে চাচ্ছে তাহসিনাকে নিয়ে সারাহ্ কি ভাবে।
“আর তো কিছু বলার নেই। যা জানার ছিল, জেনে গেছি। ব্যস।”
কথাটা বলে সারাহ্ বিছানায় গিয়ে বসে।
আহনাফ ঠিকঠাক মতো তৈরি হয়ে গলার কাছটায় পারফিউম দিয়ে সারাহ্-র কাছে এসে ওর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ এমনটা কথায় একটু চমকে উঠে সারাহ্। গালে হাত দিয়ে মাথানিচু করে সে। গতকাল থেকে আহনাফ এমনভাবে আচরণ করছে যেন ওরা শুরু থেকেই একে অপরকে ভালোবাসে।
সামিহা ডাইনিং এ কাজ করছে। আহনাফকে বেরিয়ে যেতে দেখে বলে,
“ভাইয়া কোথাও যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ, একটু কাজ আছে। সন্ধ্যার আগে চলে আসবো।”
“আচ্ছা।”
আহনাফ বেরিয়ে গেল। সামিহা রুমে এসে তানজিমকে কল করে।
“হ্যালো, তানজিম। আমি খুব রেগে আছি।”
তানজিম অবাক হয়।
“কেন রে?”
“তুই আমাকে ভুলে গেছিস। তোর ওই বড় আপু, কি যেন নাম, (একটু ভেবে) ওই মিউকো আসার পর তুই আমাকে ভুলে গেছিস।”
তানজিম শব্দ করে হেসে বলল,
“এখন তোকে মনে করার জন্য আমার কি করতে হবে তাই বল।”
“আজকে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে।”
তানজিম পাশে বসা মৃত্তিকার দিকে একবার তাকায়। তারপর বলে,
“আমি এখন মিউকোপুর সাথে একটু বাইরে যাচ্ছি। কাল তোকে নিয়ে..”
তানজিমের কথার মাঝেই সামিহা ধ°ম°ক দিয়ে উঠে,
“দেখেছিস তুই আমাকে ভুলে গেছিস। এখন তো আমি কেউ না, মিউকোপু সব। থাক তুই।”
“তুই হিং°সা করি না সামি।”
সামিহা ভেঙচি কে°টে ফোন রেখে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। কান্না পাচ্ছে তার, কিন্তু ও কাঁদছে দেখলে সারাহ্ একশো চারটা প্রশ্ন করবে।
তানজিম ফোন হাতে নিয়ে মৃত্তিকাকে বলে,
“আপু, তোমার আজকে বাইরে যাওয়াটা কি খুব ইম্পোর্টেন্ট?”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলে,
“কেন? যেতে পারবে না?”
“আসলে সামিহা ঘুরতে যেতে চাইছে।”
মৃত্তিকা মুচকি হেসে বলে,
“যাও তবে। আমি একা একা চলে যাবো। একটু শপিং করতাম আরকি, এইতো ফরচুনে যাবো।”
“কি কিনবে?”
“ট্রলি কিনতাম আর টুকটাক কিছু৷ কাল তো মামার বাসায় চলে যাবো, বড় ট্রলিটা নিতে চাচ্ছি না।”
তানজিম মাথানেড়ে বলে,
“বসুন্ধরায় যাবা?”
মৃত্তিকা একটু ভেবে বলল,
“ওকে, যাওয়া যায়।”
“তবে সামিহাকে ওখানে আসতে বলি। ঘুরাঘুরি আর শপিং সব হবে।”
তানজিম মৃত্তিকার অনুমতির অপেক্ষা না করে কল দিতে নিলে মৃত্তিকা বলল,
“বাজেট কম আমার, দেখিও সামিহা আবার এটাওটা চাইলে কিন্তু কিনা যাবে না।”
তানজিম হেসে বলল,
“ও এমন না, সমস্যা নেই।”
______________________________________
বিকাল সাড়ে চারটা, সামিহা আর সারাহ্ বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে চলে এসেছে। তানজিম এসে সারাহ্-কে দেখে সামিহাকে বলে,
“এটা কে?”
“আপু।”
সারাহ্ চোখ সরু করে ওদের দিকে তাকায়। তানজিম দাঁত কেলিয়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আপু, কেমন আছেন? আপনার হাসবেন্ড কেমন আছে?”
তানজিমের আচরণ আর তাড়াহুড়ায় সারাহ্-র মনে হলো সে একটা মানসিক রোগী। তবুও ভদ্রতা দেখিয়ে বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছি।”
“সামিহা চল।”
বলেই তানজিম হাঁটতে শুরু করে। সারাহ্ পিছুপিছু যায়। একটু দূরে গিয়ে মৃত্তিকার সাথে একত্র হলো ওরা। মৃত্তিকা কুশল বিনিময় করে। অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্তিকা আর সারাহ্-র গল্প জমে উঠে।
মৃত্তিকা ট্রলি ব্যাগ দেখছে। সারাহ্ আশেপাশে তাকিয়ে সামিহা কিংবা তানজিমকে না দেখে বলে,
“দুজন কোথায়?”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলে,
“দুজনে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছে।”
“কি?”
সারাহ্ চোখ কুঁচকালে, মৃত্তিকা হেসে অন্যদিকে যায়। সারাহ্ শপ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। একটা দোকানে সামিহাকে দেখে ওর দিয়ে এগিয়ে যায়।
মৃত্তিকার পাশে এসে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ।
“সকালে কি বলেছিলেন?”
মৃত্তিকা চমকে উঠে পাশে তাকায়। বলে,
“কি?”
“কি বলছিলেন? কাকে পছন্দ?”
মৃত্তিকা মাথানিচু করে সরে যায়। ব্যাগ দেখতে থাকে নিরবে। ইমতিয়াজ একটা ব্যাগ হাতে দিয়ে বলে,
“এটা কিনুন।”
মৃত্তিকা আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ফলো করছেন আমাকে?”
“আমি না অন্যকেউ।”
“কে?”
বাবা ছাড়া আর কেউ মৃত্তিকাকে ফলো করে বলে ওর জানা নেই। আশেপাশে তাকাতে নিলে বাধা দেয় ইমতিয়াজ।
“বারবার তাকালে সন্দেহ করবে।”
“কে আছে?”
ইমতিয়াজ ফোন বের করে কিছুক্ষণ আগে ওর তোলা ছবিটা দেখায়। মৃত্তিকার পাশ থেকে যখন সারাহ্ সরে গেল, তখন ওর বাবা ওর কাছে আসতে নিয়েছিল।
মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাবলিক প্লেসে উনি কখনোই আমার সাথে কথা বলেন না।”
“তাই তো পাশে আছি।”
মৃত্তিকা সামনের আয়নার দিকে তাকায়। ইমতিয়াজের প্রতিচ্ছবিটি দেখে বলে,
“এভাবেই সারাজীবন থেকে যান না কেন?”
এতোটাই মৃদুস্বরে কথাটা বলেছে যে ইমতিয়াজ শুনেনি। সারাহ্, তানজিম আর সামিহাকে এদিকে আসতে দেখে ইমতিয়াজ নিরবে সরে যায়। মৃত্তিকা ওর চলন দেখে। ইমতিয়াজ ওকে চায়, হয়তো ওর চেয়েও বেশি করে চায়। কিন্তু তা প্রকাশিত নয়।
______________________________________
এক মাস পর,
আজ মৃত্তিকাকে পাত্রপক্ষ থেকে দেখতে আসবে। উত্তরা মামার বাসায় চলে এসেছে প্রায় ২৫ দিন আগে। মামার অফিসের কোনো এক ব্যক্তির ছেলেই পাত্র। মৃত্তিকা ছেলের ছবি দেখেছে, নাম কলরব।
সন্ধ্যা সাতটায় এসেছে ওরা। মৃত্তিকাকে মোটামুটি একটা সাজ দিয়েছে ওর মামাতো বোন সুরভি। মৃত্তিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলো।
“আপু।”
আলতো কন্ঠে সুরভিকে ডাকলো মৃত্তিকা।
“জি, বলো।”
মৃত্তিকা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“বাবা মায়ের বিষয়ে কি বলেছে?”
“দুজনকেই মৃ°ত বলেছে।”
মৃত্তিকার ভিতরটা মো°চ°ড় দিয়ে উঠলো। সুরভি সোজা কথার মানুষ। যা বলছে ঠা°স ঠা°স করে বলবে। অর্ধেক কথা পেটে আর বাকিটা মুখে রাখবে না। পুরোটাই এক চো°টে বলে দেয়।
মৃত্তিকা আর কিছু বলল না। ওর বাবা জেনে ঠিক কি কি করবে তা ও বুঝতে পারছে না।
পাত্রের সামনে নেয়া হলো। কলরব বেশ সুদর্শন যুবক, প্রথম দেখায় যে কারো পছন্দ হতে বাধ্য৷ বয়সটা প্রায় মৃত্তিকার সমানই হবে। কলরবের সাথে ওর মা, বাবা, ছোট বোন এসেছে
মৃত্তিকাকে দেখে মুচকি হাসলো ওরা। বড়দের কথাবার্তা চলল অনেকক্ষণ।
______________________________________
কয়েকদিন ধরেই আহনাফ কলেজের কোনো একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছে, বিজ্ঞান মেলার কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের সাথে একটা সেশন করে। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
স্মার্ট বোর্ডে ক্লাস নিচ্ছে সে। পেইজ পরিবর্তন করে নতুন পেইজ যেতেই দেখে কালো পেইজে লাল, সাদা, নীলে একটা ইংরেজি বাক্য লেখা,
“My handsome Physics sir, Ahnaf Foyez, I’m waiting for your call.”
আহনাফ বাক্যটি দেখে দ্রুত বোর্ড পরিষ্কার করে। এ যে সারাহ্-র কাজ তা সে ভালোই বুঝেছে। দিনদিন মেয়েটার সাহস বাড়ছে। আহনাফকে ভয় পায় না। লজ্জায় নু°ই°য়ে গেলেও ভ°য় তাকে কাবু করে না।
আহনাফ ক্যামেরা থেকে দূরে সরে যায়। সারাহ্ এখানে নেই, হয়তো ড্রইংরুমে টিভি দেখছে। ছাত্রছাত্রীরা সবাই মোটামুটি স্যারকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। অনেকে হয়তো স্ক্রিনশট নিয়ে নিয়েছে আর কাল সেটা নিয়ে কলেজে আলোচনা চলবে।
আহনাফ ড্রইংরুমে গিয়ে সারাহ্-কে বলে,
“ক্লাস শেষে তোমার হচ্ছে সারাহ্। ফাজলামো বেশি শুরু করেছো।”
“আমি আবার কি করলাম?”
সারাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“বোর্ডে ওসব কে লিখেছে?”
ভ্রূ উঁচিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে আহনাফ।
সারাহ্ মুচকি হেসে বলে,
“পরশু লিখেছিলাম, কারণ আপনি আমাকে নিজে থেকে কল করেন না। (একটু থেমে) মাত্র আজকে এটা দেখেছেন?”
আহনাফ দাঁত কি°ড়°মি°ড়িয়ে বলে,
“বাড়াবাড়ি করেছো।”
______________________________________
কলরবের পরিবার মৃত্তিকাকে পছন্দ করেছে। না করার কোনো কারণ নেই। মেয়ে ভালো, শিক্ষিত, সুশীল। ছেলে লন্ডনে পড়াশুনা করেছে, মেয়ে ইতালিতে। ভালো মানাবে ওদের৷ আংটি পড়িয়ে গেল ওরা। প্রায় ১৫ দিন পর বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়ে গেছে।
মৃত্তিকা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাতের আকাশের কয়েকগুচ্ছ তারার পানে তাকিয়ে আছে সে। চাঁদ যে নেই, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে ওর সাথে লুকোচুরি খেলছে৷ ইমতিয়াজের সাথে দেখা হয়নি গত একমাস, ফোনেও কথা হয়নি।
একটা বে°সু°রো বী°ণা বাজতে লাগলো ওর মনে। দীর্ঘশ্বাসগুলো হতে লাগলো সেই সুর। নয়নের অশ্রুধারা বে°ই°মা°নি করলো, গড়িয়ে পড়লো না আজ। হৃদয়ে বাজতে থাকা লাবডাবের মাঝে একটা নাম উচ্চারিত হলো,
“ইমতিয়াজ।”
চলবে….