অনুভবে
পর্ব-৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
এই মুগ্ধময় দৃশ্যের শোভা বাড়াচ্ছে সভ্যের গান,
“মেঘ সায়রে ভাসবো আবার তুমি আমি মিলে
স্বপ্ন তোমার রূপকথার
আমার স্বপ্ন তুমি
ও প্রিয়তমা, ও প্রিয়তমা তোমার স্বপ্নে বাঁচি আমি,
আমার হৃদমাঝারে কেবল তুমি…”
সভ্যের দৃষ্টি যেয়ে থামে ইনারার দিকে। সে রুমের দরজায় হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, “অবশেষে তাহলে তোমার ঘুম ভাঙলো। প্রায় এক ঘন্টা ধরে ঘুমাচ্ছ।”
সভ্যের এমন কথা হজম করতে কষ্ট হয় ইনারার, “আপনি কি আসলেই মানুষ না রোবট বলেন তো। মনে মায়া মমতা কিছু নেই? কোথায় বলবেন, ‘আমার গান বাজানোর কারণে তুমি ঘুম থেকে উঠে গেছ? আহারে! সরি। আমি তোমার ঘুম নষ্ট করতে চাই নি।’তা না বলে খোঁটা দিচ্ছেন? অনুভূতিহীন প্রাণী। আপনার জন্যই ঘুমে শেষ আমি। সকাল সাতটায় কে উঠে?”
“তোমার চাকরি লাগবে?”
“ভাবতে গেলে সকালে ঘুম থেকে উঠা স্বাস্থ্যের জন্য তো ভালো। ক’দিনেই অভ্যস্ত হয়ে যাব।”
“গুড, আসো এবার। আর একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের করবে না।”
সভ্য তার ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেল। পিছনে ইনারা ব্যঙ্গ করে তার পিছু এলো। দরজার কাছে এসে তার নিজের ব্যাকপ্যাকের কথা মনে পড়ে। সোফা থেকে তার ব্যাগ নিতে যেয়ে দেখে সেখানে একটি কম্বল। কম্বলটা তার উপর দেওয়া ছিলো। সভ্য দিয়েছে? তাহলে সে সবে তার ঘুম নিয়ে এত রুক্ষ ব্যবহার করল কেন? ইনারার সবে মাথায় এলো সভ্য তাকে চাইলেই বকা দিয়ে ঘুম থেকে উঠাতে পারতো। এভাবে তার জন্য অপেক্ষা করতো না। অর্থাৎ লোকটা এতও খারাপ না। মন থেকে খারাপও না। কেবল নিজেকে কঠিন দেখায়। কিন্তু কেন? সকলে বলে সভ্য একটা রহস্য। তার ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। তার মনে কি চলে কখনো কেউ জানতে পারে না। হঠাৎ ইনারার আগ্রহ বাড়ে। সে উৎসুক হয়ে বলে, “রহস্য যত ইনারার আগ্রহও ততই বেশি। ওই অসভ্যের খোঁজ তো এবার আমি নিব। আর জোহানের সাথে কি হয়েছে তাও জানবো। ডিটেকটিভ ইনারা মোড অন।”
“এই মিস বকবকানি কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?” সভ্য দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকে তাকে। অপেক্ষা করতে করতে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে তার। তার কন্ঠ শুনতেই ইনারা দৌড়ে আসে। সভ্য আবার বলে, “এত ধীরে ধীরে কাজ করে মানুষ? জলদি চলো।”
সভ্য নিচের গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে ইনারাকে বসতে বলে। সে স্বভাবতই গাড়ীর পিছনের সিটে যেয়ে বসে। সভ্য কাঠখোট্টা গলায় জিজ্ঞেস করে, “মহারাণীর মতো পিছনে বসেছ কেন? আমি কি তোমার ড্রাইভার?”
ইনারা খোঁটাটা ধরতে পারে না। সে উৎসুক গলায় বলে, “মহারাণী? আপনারও মনে হয় আমাকে রাজপরিবারের মেয়ের মতো দেখা যায়? আমার ফুপাও তাই বলে। সে আমাকে রাজকুমারী বলে ডাকে জানেন?”
সভ্য বিড়বিড় করে বলে, “কোন পাগল-ছাগলের পাল্লায় পরলাম আমি!”
সে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে, “তুমি যে মেয়ে তাই তো বুঝা যায় না, রাজকুমারী তো দূরের কথা। এখন সামনে এসে বসো। আমি তোমার ড্রাইভার না।”
ইনারা মুখ ফুলিয়ে মিনমিন করে বলে, “অসভ্য, রাক্ষস, বেয়াদবগিরির বাদশাহ। ব্যাঙের মতো মুখে যেন নিমপাতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।”
গাড়িতে ইনারা কথা বলেই যাচ্ছিলো এবং সভ্য কেবল বিরক্ত হচ্ছিলো। মেয়েটাকে চাকরি দেবার প্রধান দুটো কারণ ছিলো। এক, মেয়েটা কোনো দিক থেকেই তার জন্য পাগল নয় অর্থাৎ তাকে বিক্ষুব্ধ করার কোনো উপায় নেই। দুই, তার সাথে বেয়াদবিটা এক ধরনের অপরাধ। এই অপরাধের দণ্ড দেবার জন্য মেয়েটারকে কাছে রাখতে হলো। তবে হলো উল্টো, মেয়েটা তাকে বিরক্তও করছে এবং সকাল থেকে এত কথা বলে তার উপর একপ্রকার অত্যাচার করছে যেন। তাকেই দণ্ড দিচ্ছে।
অফিসের দরজার থেকে রিহার্সাল রুমে যাওয়া পর্যন্ত ইনারা অনেক গীতিকার এবং অভিনেতার দেখা পায়। তাদের দেখে উৎসুক হয়ে যায় ইনারা। এই কিছু মুহূর্তেই সে যে এত বিখ্যাত মানুষের দেখা পাবে তা কল্পনাও করেনি। বাচ্চাদের মত খুশি হয়ে যায় সে। রিহার্সাল রুমে যেয়ে সভ্যকে বলে, “বাপরে এত নামজাদা মানুষ একসাথে! আপনি প্রতিদিন তাদের সাথে দেখা করতে পারেন?”
“এই নামজাদা আবার কী?”
“আরে নামজাদা বুঝেন না? বিখ্যাতকে নামজাদা বলে। এত নামজাদা মানুষ একসাথে? কী ঝাক্কাস ব্যাপার।”
“এই ঝাক্কাস আবার কী?”
“আপনি মানুষ না অন্যকিছু বলেন তো? কোনো কথাই বুঝেন না আপনি। মাথাটা ছালাফালা করে দিলেন।”
“তুমি কী এইসব শব্দ কোনো ডিকশনারিতে পেয়েছ, না’কি নিজে বানিয়েছ।”
“ছিঃ ছিঃ পাঠ্য বই পড়ে কুল কিনারা খুঁজে পাই না আবার ডিকশনারি পড়তে যাব।”
সভ্য বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে। এই মেয়ের সাথে কথা বলা এবং নিজের মাথায় হাতুড়ি মারাটা ঠিক এক। অবশেষে তাকে বলতে হলো, “চুপচাপ সোফায় বসে থাকবে, একটা কথাও বললে বের করে দিব রুম থেকে।”
“তাহলে তো আমি সব নায়ক আর অভিনেতার সাথে দেখা করতে পারবো তাই না?”
“চাকরি থেকেও বের করে দিব।”
“আমি সোফায় চুপচাপ থাকছি।”
অনেকক্ষণ সোফায় চুপচাপ বসে থেকে ইনারা সভ্যকে দেখলো। এই বিশাল কক্ষে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। এমনও বাদ্যযন্ত্র রয়েছে যা সে আগে কখনো দেখে নি। এর মধ্যে সভ্য পিয়ানো এবং ভায়োলিন বাজানোর প্রাক্টিস করে। অন্যদিকে ইনারা বসে থাকে ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে। তার কিছুই ভালো লাগছে না। এভাবে চুপচাপ সে বসে থাকতে পারে না। অনেক সময় পরই দরজা খোলার শব্দ পেল ইনারা। দেখে ইরফান এবং সামি এসেছে। সামি রুমে ঢুকতেই তাকে জিজ্ঞেস করে, “আরে তুমি গতকালের মেয়েটা না যে চাকরির জন্য এসেছিলে? গতকালের কাহিনীর পরও সভ্য তোমাকে চাকরিতে রেখেছে, বাহ!”
“আপনারা সবসময় এই সময়তেই আসেন?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে উনি সকাল সকাল আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ঘোড়ার মতো ভাগাচ্ছে কেন?”
“তোমাকে মোটেও ঘোড়ার মতো দেখা যায় না। ছোট ইঁদুর যে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে না? ঠিক তার মতো দেখা যায়।” সভ্য তার চর্চা করতে করতেই বলল।
ইরফান এবং সামি দুইজনের ফিক করে হেসে দেয়। আর ইনারা মেজাজ খারাপ করে, “আর আপনাকে যেন কোনো স্বপ্নের রাজকুমারের মতো দেখা যায়।”
“একদম। মেয়েরা তাই বলে।”
“ব্যাঙ রাজকুমারের মতো দেখা যায়।”
সভ্য চোখ রাঙিয়ে তাকায় ইনারার দিকে, “কী বললে তুমি?”
“যা সত্যি তাই বলেছি। আপনি আমাকে বলতে পারেন, আমি পারবো না? একশোবার বলব। ব্যাঙের মতো দেখা যায়, ব্যাঙের মতো দেখা যায়, ব্যাঙের মতো দেখা যায়। আরও বলব। কী করবেন আপনি?”
ইরফান এবং সামি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে ইনারার দিকে। তারা আগে কখনো কাওকে সভ্যের সাথে এভাবে কথা বলতে দেখে নি। কেউ সাহস-ই করে নি।
“আমি জানতাম তুমি ওই ফাজিল মেয়েই যে কনসার্টে এসে পাগলামি করেছিলে।”
“তো আপনি এখন কি করবেন শুনি।”
“তোমাকে আমি…”
ইরফান দেখে পরিস্থিতিটা এখন আসলেই বিগড়ে যাচ্ছে। দুইজনের ঝগড়া থামার নামই নিচ্ছে না। সে সভ্যের পাশে যেয়ে তাকে থামায়। আর সামিকে বলে, “ও তো অফিসে নতুন এসেছে। ওকে অফিস দেখিয়ে আয়।”
“এখনই যাচ্ছি।”
সামি ইনারাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সভ্য রাগে কটমট করতে থাকে। ইরফান তাকে বলে, “ব্রো তুই এভাবে একটা মেয়ের সাথে তর্কাতর্কি করছিস? এটা শোভা দেয় তোকে?”
“মেয়ে? এইটা আস্তো এক চলাফেরা করা বিপত্তির ভাণ্ডার। সকাল থেকে আমার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। মাথা ব্যাথা হয়ে গেছে আমার।”
ইরফান মিটিমিটি হাসে কথাটায়, “তোর মাথা খারাপ করে দিয়েছে? মেয়েটা আসলেই এক জিনিস তাহলে।”
“খবরদার হাসবি না।”
“আচ্ছা ভাই, তুই শান্ত হ। প্রয়োজনে মেয়েটাকে চাকরি থেকে বের করে দে। এত কষ্ট করে রাখার প্রয়োজন কী?”
“মানে আমি হার মেনে যাব? সভ্য পরাজিত হবে এমন এক পাগল মেয়ের সামনে? অসম্ভব। ওই মেয়ের জীবন আমি হারাম করে ছাড়বো। আমাকে চেনে নি তো। আচ্ছা বাদ দে, ওকে আমি দেখে নিব। ঐশি কোথায়?”
ইরফান কিছুসময় চুপ থাকে। তারপর বলে, “ও কল দিয়েছিল। আসবে না।”
“এটা কী আবার মি. শাহেদ হকের কারণে?”
“আর কোন কারণে হতে পারে?”
সভ্য উঠে দাঁড়াতেই ইরফান জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছিস?”
“ঐশিকে নিয়ে আসতে।”
.
.
“এই রাক্ষসের সাথে থাকেন কীভাবে আপনারা? শয়তান, ফাজিল, অসভ্য একটা!” ইনারা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে। তার হাতে বার্গার। বড় এক কামড় দিয়ে আরও কিছুও বলে সে। তা বোঝা যায় না। কথা না বুঝলেও সামি বুঝতে পারে নিশ্চয়ই সভ্যকে বকছে সে। তাই সে তালে তাল মেলায়, “অসভ্য মানে ভীষণ রকমের অসভ্য। গতকাল কথাগুলো বলায় আমাকে একশোবার কান ধরে উঠবস করিয়ে আবার রাতে সালাদ দিলো খেতে। মানুষ এসব কীভাবে খায়?”
“আয়হায়, বলেন কি? সাহস কত বড় হয় ওই অসভ্যের। ওই অসভ্য থেকে এটাই আশা করা যায়। আপনি বার্গার খাবেন?”
“না, থাক। আমি জাঙ্কফুড এড়িয়ে চলি। সকালে কেবল ফ্রাঞ্চটোস্ট খাই এতটুকুই সারাদিনের একমাত্র মজাদার খাবার, নাহয় সারাদিন সালাদ আর প্রোটিন জাতীয় খাবার খেয়ে বাঁচতে হয়।”
“আয়হায় কেন?”
“বুঝলে এমন ইন্ডাস্ট্রিতে আছি যেখানে মানুষ কাওকে নিয়ে খারাপ কথা বলার ফ্রী লাইসেন্স পেয়ে যায়। তুমি সম্ভবত জানো, ব্যান্ড শুরু হবার প্রথম দিকে আমার স্বাস্থ্য অনেক বেশি ছিলো। একারণে অনেক সোশ্যাল মিডিয়াতে বুলিং করা হতো। সামনা-সামনিও। এসব দেখে মানসিক অশান্তি হতো। তাই ওই অশান্তি থেকে এই তেল মসলা ছাড়া খাবারই ভালো। আর জানো সভ্য মুখের উপর যত বাজে ব্যবহারই করুক না কেন, ও আমাদের ব্যান্ডের সবচেয়ে কেয়ারিং পার্সোন। ওর মনটা সবচেয়ে ভালো। আমাকেও ওই এই অশান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। এমনকি আমি জলদি ওজন কমানোর জন্য অনেক বাজে রাস্তা ব্যবহার করছিলাম। ওই আমাকে মনে করাল, আমি যেমন তেমনই পার্ফেক্ট। অন্যের কথার জন্য নয়, নিজের স্বাস্থ্যের জন্য যা ভালো তা করা উচিত।”
সামি’র প্রথম কথাগুলো শুনে ইনারার মন প্রথমে খারাপ হলেও শেষের কথাগুলো শুনে তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। তার মনে পড়ে সভ্য সকালে কীভাবে তাকে নাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলো। আবার ঘুমানোর পর তাকে ঘুম থেকে না উঠিয়ে তার জন্য অপেক্ষাও করেছিলো। সে বলে, “তা ঠিক সে এতটাও খারাপ না। আমাকেও সকালে নাস্তা বানিয়ে দিয়েছে। অনেক মজার ছিলো।”
“তাই না? ওর রান্না অসম্ভব মজার। আমাকে ডায়েট ফুড করে দেয় তাও মন চায় খেতেই থাকি।”
“তার আম্মু মনে হয় অনেক ভালো রান্না করে, তার থেকে শিখেছে তাই না?”
“ঠিক জানি না। আমি সভ্যের পরিবারের কারও সাথে দেখা করি নি।”
“বলেন কি? ছয় বছর হলো তাও না?”
“আমি তো পরে এসেছি। জোহান ওর সর্বপ্রথম বন্ধু। ওরাও আজ পর্যন্ত ওর পরিবার সম্পর্কে কিছু জানে না।”
“জোহান এবং সভ্য বন্ধু!” হতবাক হয় ইনারা, “তাহলে কী মিডিয়াতে যে বলে ওরা একে অপরকে দেখতে পারে না। সে খবর কি তা মিথ্যা?”
“ঠিক মিথ্যা বলা যায় না। ওরা সবার কাছের বন্ধু ছিলো কিন্তু দুইবছর পূর্বে হঠাৎ করে কি যেন হলো, একে অপরের চেহেরা দেখতেও নারাজ তারা। আমাদের ব্যান্ড তৈরি হবার পরপরই এমনটা হয়েছে। জোহানও এরপর অনেকটা পরিবর্তন হয়। ব্যক্তিগত জীবন পাশে রেখে এখনো কাজ করে একে অপরের সাথে, তবে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। বললে ঝগড়া ছাড়া কিছু হয় না।”
“নিশ্চিত ওই অসভ্য কিছু করেছে। জোহান এত ভালো, ও খারাপ কিছু বলতেই পারে না।”
একথায় সামি চুপ হয়ে যায়। কিছু বলে না। তাকে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখায়। তার ঠোঁটের হাসিটা কিছু মুহূর্ত আগের মতো নেই।
ইনারা বার্গারের সাথে একটা কাপকেক এবং কোক নিয়েছিলো, তা সে সামির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “একটা খেয়ে নিন। কেউ জানবে না। কি আছে জীবনে? বুড়াকালে যেয়ে আফসোস করতে হবে। মাঝেমধ্যে একটু মনমতো খেয়ে নিতে হয়।”
“তবুও আমার ডায়েট…” সামির কেক দেখেই মুখে পানি চলে আসে। সে করুণ দৃষ্টিতে কাপকেকের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “আমার ডায়েট কেককে এডজাস্ট করে নিবে। এতটাই মাইন্ড করবে না।”বলেই জলদি করে কেকটা নিয়ে খেতে শুরু করে।
কক্ষে ফিরে এসে সভ্যকে না দেখতে পেয়ে সামি তার কথা ইরফানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পায় সভ্য ঐশির কাছে গেছে। ইনারা তো মহাখুশি। কিছুক্ষণ শান্তিতে কাটাতে পারবে। কিন্তু তার শান্তি ছিলো খানিক সময়ের। কিছুক্ষণের মাঝেই সভ্য ফিরে আসে। ইরফান জিজ্ঞেস করে, ” ঐশি আসে নি?”
সভ্য ইনারাকে একটিবার আড়চোখে দেখে, “শরীর ভালো না। তাই দেখা করে নি।”
কেউ কিছু বলে না। ইনারা জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে ঐশি আপুর?”
“ঠান্ডা লেগেছে।” বলে সভ্য তার সোফায় যেয়ে বসে হাতে গিটার নেয়। গিটারের তার ঠিক করার সময় ইনারা বলে, “আপুর ছোটবেলা থেকেই অসুখ বেশি থাকে৷ কোল্ড এলার্জির কারণে তো প্রায়ই জ্বর ঠান্ডা থাকেই।”
সভ্য চমকে তাকায় ইনারার দিকে। ঐশির কোল্ড এলার্জির কথা খুব কম মানুষেরা জানে।
সামি বলে, “তাও উনি বসে বসে আইস্ক্রিম খাবে আর ঠান্ডা লাগাবে।”
“ভাই বোন দুইজনই একরকম। জোহানেরও চিংড়িতে এলার্জি কিন্তু তাও সে প্রতিদিন খেত। তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার যে।”
“আর তা তুমি কীভাবে জানো?” সভ্য জিজ্ঞেস করে। ইনারা হতবুদ্ধি হয়ে ফটফট করে পেটের সব কথা বলে দিলো অথচ এর পরিণাম কি হবে ভাবলো না। সে এক ঢোক গিলে। আমতা-আমতা করে বলে, “কী…কী জানবো?”
“ওদের এলার্জির কথা।”
“এ-এটা তো সবাই জানে।” ভীত সুরে বলে ইনারা। সভ্য ততটাই কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “না, এটা সবাই জানে না। খুব কাছের মানুষ ছাড়া কেউ-ই জানে না। তোমার ওদের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, তাহলে তুমি কীভাবে জানলে?”
চলবে…..
অনুভবে
পর্ব-৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সভ্য ততটাই কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “না, এটা সবাই জানে না। খুব কাছে মানুষ ছাড়া কেউ-ই জানে না। তোমার ওদের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, তাহলে তুমি কীভাবে জানলে?”
ইনারা পড়ে যায় দ্বিধায়। প্রথমদিনই কীভাবে ফেঁসে গেল সে। সভ্যের দৃষ্টিতে কেমন সন্দেহ সন্দেহ ভাব। এমন অপ্রস্তুত ব্যবহার করলে তার সন্দেহ বাড়বে। তাই জলদি করে একটি বুদ্ধি বের করে নেয় সে। অসংশয় নিয়ে বলে, “স্বাভাবিক সাইদ ভাইয়া ছাড়া কে বলবে। যেহেতু আমার জোহানকে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সেহেতু সাইদ ভাইয়া থেকে এই তথ্য বের করা স্বাভাবিক। আর ঐশি আপু জোহানের বোন তাই তারটাও জিজ্ঞেস করলাম। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।”
সভ্য কিছু না বলে তার কাজ শুরু করল। উওরে তাকে সন্তুষ্ট দেখা যাচ্ছে। তা দেখে শান্তির নিশ্বাস ফেলে ইনারা। এখন থেকে তার বুঝেশুনে কথা বলতে হবে।
সামি জিজ্ঞেস করে, “ঐশি তো জাহানের ছোট বোন। ঐশিকে আপু ডাকছ অথচ জোহানকে ভাইয়া ডাকছ না কেন?”
“ছিঃ! জামাইকে কেউ ভাই ডাকে না’কি! এসব কী বলেন?”
সামি হতবাক, “জোহান তোমার জামাই হলো কবে থেকে?”
“এখনো হয় নি ভবিষ্যতে হবে।”
সভ্য নিজের কাজের মাঝেই বলে, “স্বপ্ন দেখা ভালো কিন্তু এমন অবাস্তব স্বপ্ন দেখতে নেই।”
“আপনার জ্বলে কেন? নিজের ধান্দায় মন দেন তো।”
“ধান্দা আবার কী?” অবাক হয়ে সভ্য তাকায় ইনারার দিকে।
“আপনি ধান্দাও চিনেন না? আপনি কী সত্যিই এই পৃথিবীর মানুষ না এলিয়েন বলেন তো?”
সামি ফিক করে হেসে দিতেই সভ্য কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। সাথে সাথে সে চুপ করে সোজা হয়ে বসে। আর সভ্য ইনারাকে বলে, “আমার তৃষ্ণা লেগেছে। ক্যান্টিন থেকে কফি নিয়ে আসো।”
ইনারা কিছু না বলেই গেল কফি আনতে। কিন্তু তার ভাবনা অনুযায়ী এতটুকুতেই শেষ হয় না। ইনারা নিয়ে আসে সাধারণ কফি। সভ্য তাকে বকা দিয়ে ব্লাক কফি
আনতে আবার পাঠায়। ইনারা তার আদেশ পালনও করে। তার করতে হয়। এটা তার কাজ। কিন্তু সভ্য আবারও তার উপর রাগ দেখায়। কফিতে স্টিভিয়া দেয় নি বলে। সে আবার স্টিভিয়া আনতে গেলে আসতে আসতে সভ্যের কফি ঠান্ডা হতে যায় তাই তার আবারও পরিবর্তন করে আনতে হয়। অবশেষে যখন একদম সঠিক কফি সে সভ্যের সামনে এনে হাজির করে তখন সভ্য বলে, “কফি এমনি খেতে ভালো লাগছে না। একটি প্রোটিন বার নিয়ে আসো তো।”
এবার ইনারা রাগে ফেটে পড়ে, “এটা তো আপনি আগেও বলতে পারতেন। মাত্রই তো এলাম।”
“তখন আমার বলতে কষ্ট লাগছিলো।”
“আপনি এত খারাপ কেন?”
“তোমাকে কাজ করার জন্য চাকরিটা দিয়েছি তাই না? কাজ করো।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে আবার বের হয়। সামি বলে, “ভাই মেয়েটাকে ইচ্ছা করে এত কষ্ট দিচ্ছো কেন?”
“তোর এত খারাপ লাগলে ওর পরিবর্তে তোর সাথেও এমন করতে পারি।”
“না না, আমি কিছু বলি নি।”
সারাদিন এভাবেই ইনারাকে দিয়ে কাজ করতে থাকে সভ্য। এমনকি রাতে বাসায় যাবার সময়ও তাকে একগাদা ফাইল দিয়ে বলে, “এখানে কিছু কোম্পানির ফাইল আছে যারা আমাদের দিয়ে নিজের ব্যান্ডের বিজ্ঞাপন করাতে চায়। কিন্তু আমরা তো আর সব কোম্পানির জন্য কাজ করাতে পারি না। তাই প্রতিটি কোম্পানির সব খোঁজ করে এবং ফাইল পড়ে প্রতিটি কোম্পানির তথ্য আলাদা আলাদা কাগজে লিখে আমাকে জমা দিবে।”
“এটা তো আমার কাজ না।”
“তোমার কাজ আমাদের সাহায্য করা এবং আমাদের সব কথা মানা। এটা তার মধ্যেই পড়ে।”
কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটা ইনারার কাজের অধীনে পড়ে না। এমনকি ফাইলগুলোর কাজ আগেই শেষ। তবুও সভ্য ইনারাকে জ্বালানোর জন্য কাজগুলো দিচ্ছে। তা ইনারা না বুঝেই বলে, “আমি কাল সকাল পর্যন্ত এতকিছু কিভাবে করবো?”
“তা ঠিক। সকাল পর্যন্ত খুব কম সময় হয়ে যায় তাই না? কাল দুপুর পর্যন্ত সময় দিলাম। আর কাল সকাল সাতটার মধ্যে তোমাকে যেন জিমে দেখি আমি।”
“কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু পুরন্ত না, কাজ নিয়েছ তাহলে কাজ করো।”
বলে সে চলে গেল।
ইনারাও মেজাজ খারাপ করে বাসার জন্য রওনা দেয়। ফাইলগুলোর ওজনে সে উঠাতেও পারছে না এগুলো একরাতে শেষ করবে কীভাবে?
.
.
রাত দুটো বাজে। ইনারা কাজ করতে করতে হয়রান হয়ে গেছে। সাথে সে সভ্যের প্রতি প্রচুর পরিমাণ বিরক্ত। মাথা ব্যাথা করছে তার। জীবনে স্কুল কলেজের জন্যও রাত জেগে পড়ে নি সে। আর আজ তার রাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে। চা’য়ের বিশেষ প্রয়োজন তার। কিন্তু খালাজান ঘুমিয়ে গেছে। আর সে চা বানাতে পারে না। তাই রান্নাঘরে যেয়ে রেডিমেড ক্যাপিচিনো বানায় সে। আপাতত এটাই তার সম্বল। খানিক সময়ের বিরতি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় সে। আকাশটা আজ বেশ সুন্দর। মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। আসমানের বুকেতে এক বিশাল চন্দ্রিমার রাজত্ব। তার জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে চারপাশে। সে চন্দ্রিমার জ্যোৎস্নার বর্ষণ হচ্ছে তার উপর। সে মেঝেতে বসে পিঠ ঠেকায় দেয়ালে। তার ফোনে পঞ্চসুরের এক গান ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ বন্ধ করতেই হারিয়ে যায় অতীতের বেদনাময় মিষ্টি স্মৃতি সম্রাজ্যে।
দুইবছর পূর্বের কথা,
ইনারা প্রতিবছর তার মা’য়ের জন্মদিনে সিলেটের শ্রীমঙ্গল যায়। তার মা’য়ের পছন্দের স্থান। এগারো বছর পর্যন্ত তার মা’য়ের সাথে প্রতিটি জন্মদিনই সেখানেই কাটিয়েছে সে। এই রীতি সে ভঙ্গ করে না। প্রতিবছরই সে যায়। এক নির্দিষ্ট রিসোর্টে তাদের প্রতিবছর যাওয়া হয়। সেবারও সে গিয়েছিল রিসোর্টে। কিন্তু রিসোর্ট বুক করা ছিলো অন্য পরিবারের নামে। ইনারা চিন্তায় পড়ে যায়। তাহলে কী এইবার সে নিজের মা’য়ের পছন্দের জায়গায় তার জন্মদিন করতে পারবে না? এইবার কী সে প্রতিবছরের রীতি ভঙ্গ হয়ে যাবে? মন খারাপ হয়ে যায় ইনারার। কান্না আসে। সে আব্দুল চাচাকে বলে, “চাচা তাদের সাথে একটু কথা বলে দেখেন না, যেন আমাদের রুমটা দিয়ে দেয়। তারা আশেপাশের অন্য রিসোর্টে যেয়ে থাকুক। আপনি উনাদের টাকা দিয়ে দিয়েন। তাও বলেন।”
“চিন্তা করো না ইনুমণি, তুমি সেখানেই থাকবে। তারাও তোমার সাথে থাকবে। তারা আমাদের সাথেই।”
ইনারা কথাটা ধরতে পারে না। সে রিসোর্টে যায়। নক করতেই একটি মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে। তাকে দেখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তার চোখ ভিজে আসে। সাথে সাথে সে জড়িয়ে ধরে ইনারাকে। শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে।
ইনারা হতবাক। সে মহিলাটি কে চিনে নি। কেউ একজন হঠাৎ করে তাকে দেখে এভাবে কান্না করবে কেন? সে বুঝতে পারছে না। মহিলাকে তাকে ছেড়ে তার দুই গালে হাত রেখে কপালে একখানা চুমু খেলো। স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তোমার মাঝে আমি সারুর ছায়া দেখতে পাচ্ছি। একদম তেমন চোখ, ঠোঁট, চেহেরার গড়নও তেমন। মায়াবী।”
“আমি আপনাকে চিনলাম না। আর সারু কে?”
“তোমার মা। সাইয়ারা। আমি তোমার সৌমিতা আন্টি। তোমার মা’য়ের প্রিয় বান্ধবী। মনে পড়েছে?”
ইনারার মনে পরে। সে ছোট থাকতে দেখেছিলো সৌমিতাকে। তাদের সাথে অনেক ঘনিষ্ঠও ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে সে বিদেশ চলে যায়। কিন্তু তার মা সবসময়ই সৌমিতা আন্টির গল্প তাকে শুনাতো। এছাড়া আর দেখা হয় নি। তবুও কেন যেন ইনারা আবেগী হয়ে গেল। তার মা’য়ের অনুভূতিটা গাঢ় হয়ে গেছে। সৌমিতা আন্টিকে দেখে তার মা’য়ের কথা আরও মনে পড়ে তার। বুকের ভেতর কেমন বেদনা ছড়িয়ে যায়।
সৌমিতা আন্টি তাকে রিসোর্টের ভেতর নিয়ে প্রথম কথা এটাই জিজ্ঞেস করে, “তোমার আব্বা কী তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে?”
ইনারা অবাক হয়। প্রথমেই প্রশ্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। সে উওর দেবার পূর্বে কিছুক্ষণ ভাবে। তার বাবা কখনো তার কাছেই থাকে নি, না তার সাথে বাবার মতো ব্যবহার করেছে। তাহলে কীভাবে তার ব্যবহারের কথা জানায় সে। তবুও সে ছোট করে উওর দেয়, “করে।”
উওরটা শুনে যেন জানে জান আসে তার। ইনারা জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ এ কথাটা জিজ্ঞেস করছেন কেন আন্টি?”
“না মানে মা মারা গেলে তো বাবারা অনেক সময় দূর হয়ে যায় অথবা অন্য বিয়ে করে নেয় তাই বললাম। এমন কিছু হলে তুমি নির্দ্বিধায় আমার কাছে চলে আসবে। বুঝলে?”
ইনারার উওর দেবার পূর্বেই একটি ছেলের রুমে প্রবেশ করে, “মা আমার ফোনের চার্জার…. ”
ইনারা দেখে পাশের রুম থেকে একটি ছেলে বের হয়ে আসছে। ছেলেটা তাকে দেখেই চুপ হয়ে গেল। ছেলেটাকে কিছু চেনা লাগলো। হঠাৎ তার মনে পরে দুইদিন আগেই সুরভি তাকে একটি নতুন ব্যান্ডের পোস্টার দেখাচ্ছিলো। এর মধ্যে প্রথম সদস্য তিনি, কিন্তু তার নামটা মনে পরছে না। এমন সময় সৌমিতা আন্টি বলে, “জোহান ওর সাথে পরিচিত হ, আমার এক বান্ধবীর মেয়ে। নাম ইনারা।”
“হ্যালো।” জোহান হাসিমুখে বলে।
“আমি সম্ভবত আপনার পোস্টার দেখেছি। আপনি নতুন ব্যান্ডের সদস্য না?”
“বাহ আমি এখনই এত ফেমাস হয়ে গেলাম? মা দেখেছ তোমার ছেলের গান আসার আগেই মানুষ তাকে চেনা শুরু করেছে।”
“হ্যাঁ দেখেছি। এবার যা, আমাকে ওর সাথে গল্প করতে দে। তোর চার্জার নীল ব্যাগে আছে।”
“বাহ কথা বলার সঙ্গী পেয়ে আমাকেই ভুলে গেলে?” জোহান আবার ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার সাথে পরে কথা হচ্ছে তাহলে।”
জোহান যাবার পর সৌমিতা আন্টি তার হাত ধরে বলে, “তোমার বাবা কাওকে তোমার আসল পরিচয় দিতে মানা করেছে তাই জোহানকেও বলি নি যে তুমি সাইয়ারার মেয়ে।”
“ভালো করেছেন আন্টি।”
“তোমাকে কত দেখতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু দেশে আসাই হয় নি বলতে গেলে। আমেরিকায় ছিলাম। সেখানে বাচ্চাদের পড়াশোনাতেই ব্যস্ত ছিলাম। মাঝে একবার এসে তোমাদের আগের বাসায় গিয়েছিলাম জানতে পারি তোমরা শিফট করেছ। আগে তো আর আজকালকার মতো ফোন ছিলো না। তাই যোগাযোগ রাখাও সহজ ছিলো না এত। সাইয়ারা যে মারা গেছে তাও আমি খবরে জেনেছি। কেউ জানায়ও নি।” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৌমিতা আন্টি। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে, “কিন্তু এখন বাংলাদেশে এসে পড়েছি। আমার ছেলে মেয়ের গানের খুব শখ। ওদের জন্যই আসা। ওদের বাবার ছোট এক কোম্পানি আছে সেখান থেকেই ওদের ব্যান্ড আসছে। ওদের এক কাজিনও আছে ব্যান্ডে, নাম সামি। জোহানকে তো দেখলেই। আমার মেয়ে ঐশিও আছে। আর একজন আছে জোহানের বন্ধু। আগামী মাসেই প্রথম এলবাম আসবে। দেখতেই পারছো কত খুশি তারা। এখন থেকে তো আমরা দেশেই আছি ঢাকা যেতেই ঐশির সাথে দেখা করাব তোমাকে। ছোট বেলায় ওর সাথে অনেক খেলতে তুমি। আর দুইজনে মিলে জোহানকে জ্বলাতে। মনে আছে?”
ইনারা মাথা নাড়ায়। তার মনে নেই। তখন সে অনেক ছোট ছিলো পাঁচ অথবা ছয় বছরের হবে।
আরও অনেক সময় ধরে সৌমিতা তার সাথে গল্প করে। তারা সন্ধ্যায় একসাথে বাহিরেও যায়। সৌমিতা আন্টি তাকে অনেক আদর যত্ন করে খাইয়ে দেয়। কিন্তু তবুও সেদিন ইনারার মন অনেক খারাপ। এত বিশেষ দিনে তার মা সাথে নেই। সবকিছু আশেপাশে থাকতেও কেমন যেন শূন্যতা অনুভব হয় বুকেতে। খাবার শেষে ইনারা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখছিলো ছড়িয়ে থাকা একগুচ্ছ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। রাতের আঁধারে এই সৌন্দর্য যেন বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে তাকায় সে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার মা’য়ের এক ঝলক। বুক কাঁপে তার। ব্যাথা হয়। বিষণ্ণতায় দম আটকে আসে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায়। ছুঁয়ে দেখে সে স্থানটি। এখানে বসেই মা তার সাথে জন্মদিনের কেক কাটতো। সে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আজ কেমন স্মৃতির পাতায়।
হঠাৎ শব্দ শুনে সে। পিছনে তাকায়। দেখে জোহান বারান্দায় প্রবেশ করছে। তার ঠোঁটের মাঝে সিগারেট। তাকে দেখে জোহান যেন আকাশ থেকে পড়ে। হতবাক হয়ে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ঘাবড়ে তার সিগারেট পকেটে ভরে নেয়। তারপর অনুরোধ করে বলে, “প্লিজ মা’কে একথা জানিও না।”
“কোন কথা?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ইনারা।
“এই’যে সিগারেটের।”
“আমি কেন বলব?”
জোহান আমতা-আমতা করে বলে, “তাও ঠিক, বলে তুমি আর কি পাবে। তবুও বলে রাখলাম। মা জানলে অনেক বকা খাব।”
ইনারা স্বভাবতই চঞ্চল হলেও তার মা’য়ের সাথে জড়িত বিশেষ দিনগুলোতে আবেগী হয়ে যায়। তাই তখন কথা কম বলে। তাই উওর দেয় না সে জোহানকে।
আকস্মিকভাবে জোহান তার দিকে এগিয়ে এসে তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায়। মুখোমুখি হয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। আঙুল দিয়ে তার গাল মুছে দিয়ে বলে, “জানো তো সবার চোখে জল মানায় না। শুনেছি আজ তোমার মা’য়ের জন্মদিন। এদিনে উনাকে মনে করে তুমি কান্না করলে উনি কষ্ট পাবে না?”
ইনারা উওর দেয় না। দিতে পারে না। হঠাৎ জোহান তার এত কাছে আসায় সে যেন পাথর হয়ে গেছে। আজ প্রথম তার এত কাছে কোনো ছেলে এলো অথবা বলা যেতে পারে এই প্রথম সে কোনো ছেলের সাথে এমন একাকী কথা বলছে। ব্যাপারটা তার কাছে অকপটে। জোহানের ছোঁয়াতে কেমন যেন লজ্জায় মেখে গেল ইনারার কিশোরী মনটা।
জোহান উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার বলে, “আমার কাছে তোমার মন ভালো করার উপায় আছে। গান শুনবে? গান সকল উদাসীনতা দূর করে দেয়। শুনবে তো?”
ইনারা মাথা নাড়ায়। গান গাইতে শুরু করে জোহান,
“অবুঝ মনের ঠিকানা, তুমি কি হবে
মুগ্ধ আমার প্রেমে, জুড়িয়ে রবে
মুখে বলো না, কে তোমার অনুভবে
আমার চোখের মাঝে, তুমি যে কালো
স্বপ্ন ভুবন জুড়ে, তোমারি আলো….”
সম্পূর্ণ গান শোনার পর সত্যিই ইনারার মন আগের মতো খারাপ থাকে না। সে হাততালি দিয়ে বলে, “অস্থির ছিলো গানটা। একদম ঝাক্কাস।”
“ঝাক্কাস? এর অর্থ ভালো না?”
“অর্থ অনেক ভালো। আমি তো এবার আসলেই আপনার ফ্যান হয়ে গেলাম। আমি আপনার ব্যান্ডকে সাপোর্ট তো করবোই, আমার বান্ধবীদের দিয়েও করাব। না করলে তাদের খবর করে দিব।।”
জোহান ইনারার হাত ধরে খানিকটা ঝুঁকে বলে, “থ্যাঙ্কিউ ম্যাম। আপনাকে আমার প্রথম ফ্যান হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য।”
ইনারা হাসে। অনেকক্ষণ দুইজনের কথা হয়। গল্প করে দুইজনে মিলে। জোহানের আরেকটি গান শোনাবার কথা ইনারাকে। ইনারার ফরমায়েশ। এর পূর্বে দুইজনের চা’য়ের তৃষ্ণা পায়। ইনারা আব্দুলকে চা আনার জন্য বলতে বের হতেই দেখে দরজার বাহিরেই সৌমিতা আন্টি দাঁড়ানো। তাকে দেখে গাঢ় হাসেন তিনি। জিজ্ঞেস করে, “খুব ভালো কথোপকথন হচ্ছে তোমাদের মাঝে দেখছি।”
“উনি অসম্ভব সুন্দর গান শুনায়। আমাকে বলেছে আমি যতক্ষণ বলবো ততক্ষণই গান শুনাবে। আমি অনেক এক্সাইটেড। আপনিও আমাদের সাথে এসে আড্ডায় যুক্ত হন।”
“না, তোমরা দুইজনই সময় কাটাও।”
“আব্দুল চাচাকে চা আনতে বলতাম। আপনার জন্যও বলবো?”
তার জন্যও মানা করে সৌমিতা। তবে সে তার সাথে যায়। আব্দুল চাচা চা’য়ের জন্য বাহিরে গেলে হঠাৎ সৌমিতা জিজ্ঞেস করে, “জোহানকে কেমন লেগেছে তোমার?”
“ভালোই।”
“ভালো বলতে কেমন ভালো?”
“মানে আন্টি বুঝলাম না।”
“আমার সাথে আসো।”
সৌমিতা আন্টি ইনারাকে নিজের সাথে নিয়ে যায় তার রুমে। সেখানে যেয়ে ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করে ইনারার হাতে দেয়।
“এটা কীসের কাগজ আন্টি?” ইনারা জিজ্ঞেস করে। তার কন্ঠে কৌতুহল।
“আমাকে লেখা তোমার মা’য়ের শেষ চিঠি এবং আমার কাছে দাবি করা তার শেষ ইচ্ছা।”
“ইচ্ছা? কী ইচ্ছা?”
“সাইয়ারা চাইতো তোমার ও জোহানের বিয়ে হোক এবং তুমি আমার ঘরের বউ হও।”
চলবে…..