অনুভবে পর্ব-৩৬+৩৭

0
776

অনুভবে
পর্ব-৩৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“আমাদের কোম্পানিতে সামান্য চাকরি করে এমন মেয়েকে তুলে ঘরে নিয়ে এসেছ? তোমার থেকে এসব আশা করি নি জোহান। মেয়েদের মতো না কায়দা আছে, আর না মেয়েদের মতো পোশাক পরিধানের তেহজিব। কী হিসেবে ওকে আমার বাড়িতে আনতে পারো তুমি?” মিঃ হক জিজ্ঞেস করলেন। তার গলার স্বর শান্ত কিন্তু কন্ঠে কঠিন, রুক্ষ ভাব। সে হেলান চেয়ারে বসে একটি ফাইল দেখছিলেন। জোহানের উওর দেবার সময় না দিয়েই সে জিজ্ঞেস করলেন, “দীপার কি অবস্থা? গতকাল তো তুমি আমার করা পরিকল্পনা জলে ডুবিয়ে দিলে। আগামী সাপ্তাহে ওর সাথে তোমার কোনো খবরে আসতে হবে। তা কি আমি জানিয়ে দিব। তুমি আসতে পারো।”

চুপ করে থাকে জোহান। তার বাবার সাথে কথা বলার সাহস জোগাড় করে। তারপর বলল, “আমি ওর সাথে ব্রেকাপ করে ফেলেছি আব্বু।”
মিঃহক ফাইল থেকে মুখ তুলে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে। তার চোখেমুখে আক্রোশ স্পষ্ট। সে উঠে দাঁড়িয়ে ক্রোধিত স্বরে বলে, “পাগল হয়ে গেলে তুমি? আমি কতকিছু করছি যেন তুমি সবার উপরে থাকো। তোমাকে একটা সহজ কাজ দিয়েছিলাম। কেবল আমার কথা মেনে চলতে হতো। তাও পারলে না? কার অনুমতি নিয়ে ওর সাথে সম্পর্ক ভাঙলে এবং কেন ভাঙলে?”
“ইনারার জন্য। ইনারা ওই ব্যাকইয়ার্ডের মেয়েটা।”
“জ্বি।”
ক্ষেপে উঠলেন মিঃ হক, “তুমি পাগল হয়ে গেছ? মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তোমার? এই সামান্য একটা মেয়ের জন্য তুমি দীপাকে ছেড়ে দিলে? আমার অনুমতি ছাড়া তোমার সাহস হলো কিভাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার?’
জোহার মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়েছিল। ভয় পাচ্ছে সে। ভয়ে নিশ্বাস নেওয়াটাও দুষ্কর হয়ে গেছে তার জন্য। সে ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো, “ইনারা মুশতাক সাহেব এবং সাইয়ারা আন্টির মেয়ে আব্বু।”
“কী? কী বললে তুমি? সাইয়ারা এবং মুশতাকের মেয়ে?”
মাথা নাড়ায় জোহান। মুহূর্তও গড়ায় না। জোহানের বাবা জড়িয়ে ধরে তাকে। তাকে সাব্বাশি দিয়ে বলে, এতদিনে একটা কাজের কাজ করেছো তুমি। সাব্বাশ।
জোহান যতটা বিস্মিত। তার থেকে হাজার গুন বেশি খুশি। চোখেমুখে কেমন স্বস্তি বোধ ছড়িয়ে গেল। যতটা খুশি লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
“বাবা তুমি সত্যি খুশি হয়েছো?” জোহান অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল।
“হবো না? সাইয়ারার কত সম্পত্তি তা জানো? তার একমাত্র মেয়েই তো এত সম্পত্তির পাবে। আর মুশতাকেরও ভালোই সম্পত্তি আছে। সবটা পাবে ইনারা। এছাড়া যদি জনগণ একবার জানে তোমার বিয়ে অভিনেত্রী সাইয়ারার মেয়ের সাথে হয়েছে তাহলে কতদিক থেকে সুযোগ পাবে তুমি ভেবেছো?”
কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে জোহান, “কিন্তু বাবা আমি ওর সাথে বিয়ের কথা ভাবছিলাম না।”
“তাহলে ভাবো। আমি তোমাকে সবচেয়ে বড় হতে দেখতে চাই। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সাথে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও বড় এক তারকা হতে পারবে তুমি। মুশতাক এতে সহয়তা করতে পারবে।”
“বাবা আমি গান ছাড়া অন্য কিছু করার কথা কখনো ভাবি নি। এই অভিনয় আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আর গান আমার স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্খা, ভালোবাসা। আমি আমার গান ছেড়ে অন্যকিছু করার কথা ভাবতেও পারি না।”
“তাহলে ভাবতে শুরু করো। কারণ তোমার এখন এটা করতেই হবে। তুমি গানের দিক থেকে তো কখনোই প্রথম হবার যোগ্যতা রাখো না। সভ্য আছে এই ফিল্ডে। তাহলে অন্তত কোনো দিকে ওর থেকে এগিয়ে যেয়ে আমাকে গর্বিত করো।”
“কিন্তু আব্বু…”
“আমি কোন কিন্তু শুনতে চাই না। যাও এখন। আমি ম্যানেজারকে দিয়ে সব বুঝিয়ে দিব। আর ইনারাকে হাত থেকে যেতে দিবে না। তুমি যা করছ সব বন্ধ করে ওর দিকে ফোকাস করো। ও একবার তোমার হাতে আসুক তারপর তোমার যা মন চায় করতে পারো।”
জোহানের ঠোঁটের হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না। সে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে। রুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের রুমে যায়। তার ব্যাগ থেকে ঔষধ বের করে খেয়ে নেয়। তার হাত পা কাঁপছে। বুকের ভেতর কেমন ব্যাথা করছে তার। খুব অশান্তি লাগছে।
.
.
রাত বারোটা। সভ্য সোফার উপর বসে একটি ফাইল হাতে নিয়ে বসে ছিলো। তার সামনে দাঁড়ানো একটি কালো স্যুট প্যান্ট পরা লোক। সে বলছে, “নাম জিন্নাত ইনারা। উনার মা ছিলেন অভিনেত্রী সাইয়ারা এবং বাবা পরিচালক মুশতাক আবসার। এগারো বছর বয়সে সে তার মা’কে হারায়। এরপর থেকে তার ফুপা ফুপির তার বাসায় এসে থাকে। এবং তার মা’য়ের বিশস্ত একজন মহিলা তার খেয়াল রেখে এসেছেন ছোট থেকে। বাবার সাথে তেমন ভালো সম্পর্ক নেই। তার বাবা বাসায় খুব কম আসে। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। ছোটবেলা থেকে তার পরিচয় দেওয়াটা বারণ। তার অনেক বন্ধু-বান্ধব থাকলেও। কাছের বন্ধু কেবল দুইজন, সুরভি এবং প্রিয়। বাকি সব ডিটেইলস ফাইলে আছে এবং কিছু এখনো জোগাড় হচ্ছে।”
সভ্য ধ্যানমগ্ন হয়ে ফাইল দেখছে। তার মুখে বিশেষ কোনো ভাব নেই। সে ধ্যান সহকারে ফাইলটা পড়ছিলো সামনে দাঁড়ানো লোকটি আবার বলল, “এবং স্যার বড়সাহেব বলেছেন গান বাদে আপনার পড়াশোনার দিকেও ধ্যান দিতে। অভ্র স্যার তো কোম্পানি জয়েন করবেন না। তাই ভবিষ্যতে… ”
“ভবিষ্যতে আমারই নিজের শখ ছেড়ে তার কোম্পানিতে বসতে হবে? এমনটা হচ্ছে না। দাদুভাইকে জানিয়ে দিবেন।”
“বড়সাহেব আপনাকে গান ছাড়তে বলেন নি কিন্তু জানিয়েছেন কোম্পানিটা সামলানোও আপনার দায়িত্ব। নিজের আকাঙ্খা এবং দায়িত্ব দুটো একসাথে কীভাবে সামলাবেন আপনি জানেন। আর আপনাকে এটাও জানাতে বলেছে আগামী মাসে আপনার এক্সাম। আপনাকে অন্তত এক্সামের দুই সাপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়াতে যেতে হবে।”
“দাদুভাইও না জীবনটা ত্যানা ত্যানা করে দিলো।”
কথাটা শুনে সামনের লোকটা বড় বড় চোখ করে তাকায়, “সরি স্যার, আপনি কী বললেন?”
“কিছু না। আপনি যেতে পারেন।”
“ঠিকাছে স্যার।”

লোকটা যাবার পর সভ্য নিজেই বলে, “ইনারার প্রভাবটা আমার উপর একটু বেশিই পড়ছে।” সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাইলটার দিকে তাকায়। আবারও বলে, “তাহলে আমার সন্দেহ ঠিক হলো। আমি জানতাম ও মিথ্যা বলছে। আর আমার মিথ্যা সহ্য হয় না। কিন্তু কেন যেন ওর মিথ্যাতে আমার রাগ হচ্ছে না। যাক এবারের মতো মাফ করলাম। আর এটাও বুঝতে পারছি যে সৌমিতা আন্টি ইনারাকে এত আদর করছিল কেন। মিস জিন্নাত ইনারা তোমার সিক্রেট আমার কাছে সেইফ থাকলো। এবার দেখা যাক তুমি কখনো নিজের আসল পরিচয় আমাকে নিজ থেকে দেও না’কি! লুকানোটা বেশিদিনের জন্য সম্ভব নয়। কারণ তোমাকে সারাজীবন আমার সাথেই থাকতে হবে। সারাজীবন তো আর নিজের পরিচয় লুকাতে পারবেন না মেডাম।”
.
.
প্রায় একমাস কেটে যায়। শেষ রাতে সকলের একটা কনসার্ট হয়েছে চট্টগ্রামে। কনসার্টে জোহানের অভিনেতা হিসেবে কাজ করার কথাও প্রকাশ করা হয়েছে। যা সকলের জন্য বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো। কনসার্টটা হৈ-হুল্লোড় এর সাথে ভালো ভাবেই হয়েছে। তাই সকলে টায়ার্ড হয়ে ভোর রাতে ঘুমিয়েছে। তাই দেরিতেও উঠেছে। কিন্তু সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেল কিন্তু ইনারার খবর নেই। তাই সভ্য নিজে তাকে খুঁজতে গেল। এতদিন মেয়েটার অনেক খাটুনি গেছে। অসুস্থ না হয়ে পরে। কিন্তু সেখানে সে ইনারাকে পায় নি। তাই ইনারার রুমমেটকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে ইনারা সকাল সকালই বের হয়ে গেছে। কোথায় গেছে সে জানে না। সভ্যের একবার মনে হলো জোহানের সাথে যায় নি তো? জোহানও কনসার্ট শেষেই রওনা দিয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরে কথাটা মাথা থেকেই ঝেরে ফেলল। তার মনে হলো সে জোহানের সাথে যায় নি। আর তাদের বের হবার সময়ও ভিন্ন ছিলো। ইনারাকে ফোনে না পেয়ে অবশেষে সে সাইদের কাছে যায়। যেয়ে কথাটা খুলে বলতেই সাইদ কল করে সুরভিকে। কল শেষে সে সভ্যকে জানায়, “সুরভিকে অনেক জিজ্ঞেস করলাম। সে কিছুইতেই বলতে রাজি না।”
“তাই? আমাকে একটু ফোনটা দেও তো।”

সাইদ আবারও কল দিলো সুরভীকে।এবার সভ্যের হাতে ফোন ধরিয়ে দেয়। কয়েকটা রিং যায়। তারপর সুরভি কল ধরেই বলে, “উফফ ভাইয়া বললাম তো ইনারা কোথায় তা বলব না। তুমি আমাকে ঘুষ দিয়েও ওর ঠিকানা বের করতে পারবে না। আমার জানেমানের প্রতি আমার মীরজাফরগিরি করবো না। জ্বালিও না তো।”
“সুরভি, আমি সভ্য বলছি।”
সভ্যের নাম শুনতেই ফোনের ওপাশ থেকে সুরভির হাত থেকে ফোন নিচে পরে গেল। সে ড্যাবড্যাব করে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে জলদি করে ফোন উঠালো। আর অস্থির হয়ে বলল, “সভ্য…সভ্য… আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি ফোনে। আপনি আমার সাথে কথা বলছেন। আল্লাহ আমার হাত পা কাঁপছে। সত্যি আপনি?”
“হ্যাঁ আমি। তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি। কিন্তু তুমি একটু বলতে পারব ইনারা কোথায়? আসলে সকাল সকাল কাওকে না বলে চল গেল তো তাই চিন্তা হচ্ছিল।”
“যদিও ইনারা যদি জানে আমি আপনাকে ওর ঠিকানা দিয়েছি তাহলে আমার খুন করে ফেলবে। তবুও আপনার জন্য এতটুকু তো ত্যাগ করতেই পারি আপনি। আপনি আমার ফেভারিট গায়ক বলে কথা। ও শ্রীমঙ্গল এ গেছে। আগামীকাল আন্টির জন্মদিন। প্রতিবছর এ দিনটা ও সেখানেই পালন করে।”
“তুমি একটু কষ্ট করে ঠিকানাটা মেসেজ করবে? আর তোমার সাথে সেদিন ভালোভাবে কথা হয় নি। একদিন তোমার বন্ধু প্রিয়কে নিয়ে ইনারার সাথে এসো। সকলে একসাথে সময় কাটাব।”
“সত্যি? জানেন ভাইয়াকে এত বলি কিন্তু কখনো নিয়ে যায় নি। কিন্তু আপনি নিজে আমন্ত্রণ দিয়েছেন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
হাসে সভ্য। বলে, “তাহলে রাখি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। জলদি দেখা হবে।”
ফোন রাখার পর সে বিড়বিড় করে বলে, “দেখা তো হতেই হবে। আমার হবু শালী সাহেবা বলে কথা।”

“কী বললে?” সাইদ প্রশ্ন করে।
“কোথায়? কিছু না। সাইদ আমার একটা কাজ করো। শ্রী মঙ্গলের জন্য একটা গাড়ি ঠিক করো। আমি এখনই রওনা দিব।”
“শ্রী মঙ্গল! কেন?”
“আহা এত প্রশ্ন করো না। আর কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে জরুরী কাজে ঢাকায় গেছি। এখন আমি তৈরী হতে যাচ্ছি এসে যেন দেখি গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে।”
সভ্য চলে যায়। সাইদ তার যাওয়া দেখে অবাক হয়ে বলে, “আল্লাহ জানে ছেলেটার কি হয়েছে। আজকাল কেমন আজব ব্যবহার করছে!”
.
.
রাত্রির অন্ধকারের মাঝে চন্দ্রের মৃদু আলো ঝরে পরছে পৃথিবীর বুকে। সামনের প্রকৃতির সৌন্দর্য কেমন ধোঁয়াশা। সবে খাবার শেষে এককাপ গরম গরম চা নিয়ে বসেছে ইনারা। সামনে তাকিয়ে তার মা’য়ের স্মৃতিতে ডুব দিচ্ছে। তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো বেদনার দীর্ঘশ্বাস। বছরের এই দিনগুলোতে তার কেমন দম আটকে আসে। নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। সে কাঁদেও। এ রিসোর্টের রুমটায় বন্দী হয়ে খুব কাঁদে। বের হয় না। প্রতিবছরই তার এ রিসোর্টে আসা অথচ সে গত ছয় বছরে শ্রী মঙ্গলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবার সুযোগ পায় নি। বের হয়ে ঘুরার উদ্দেশ্যে। এই জায়গাটায় যে তার নিশ্বাস আটকে আসে। এতটুকু স্থান জুড়েই তার বেদনার খাঁচা। এ খাঁচা থেকে বের হতেই মুখে হাসি আঁকতে হয় তার। না সে কাওকে তার দুর্বলতা দেখাতে চায়, আর না আপন কাওকে কষ্ট দিতে চায়।

চা’য়ের কাপটা ঠোঁটের কাছে নিতেই দরজায় টোকা পরে। চা’য়ের কাপটা রেখে উঠে যেতে হয় তার। দরজা খুলতেই দেখে একটি লোক মুখে মাস্ক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা এতটা অবাক কান্ড ছিলো না। কিন্তু এই রাতে লোকটা সানগ্লাস লাগানো। সাথে মাথায় ক্যাপ। হঠাৎ তার সামনে কোনো অদ্ভুত প্রাণী এসে দাঁড়িয়েছে এম প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে চিৎকার করে উঠে ইনারা।

সভ্য দ্রুত এগিয়ে যেয়ে তার মুখ চেপে ধরে। এতে যেন ইনারা আরও বেশি আক্রমণাত্নক হয়ে যায়। সভ্যকে বলার সুযোগ না দিয়ে মারতে শুরু করে তাকে। সভ্য না পেরে বলে, “এই ইন্দুরনী থামবে তুমি?”
ইনারা থেমে যায়, “ইন্দুরনী? এই শব্দ আর কন্ঠ দুটোই চেনা চেনা লাগছে। এটা তো ব্যাঙেরছাতার কন্ঠ।”
সভ্য হাফ ছেড়ে বাঁচে। ইনারাকে ছেড়ে। মাস্ক এবং সানগ্লাস খুলে বলে, “নির্দয়া মহিলা, এভাবে কেউ মারে?”
ইনারা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। তার পা’য়ের পাতায় লাথি মেরে বলে, “আপনি ভূত সেজে আমার দরজায় কি করছেন?”
“স্যারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ভর্তা বানিয়ে দিলে।”
“রাত বেরাতে কে সানগ্লাস পরে? ভয় পাব না আমি?”
“এটা তোমার ভয় ছিলো? ভয়ে তো আমার অবস্থা খারাপ করে দিলে তুমি? আর আমি সানগ্লাস পরে ছিলাম যেন কেউ আমাকে না চিনে।”
“এসব বাদ দিয়ে বলেন আপনি এখানে কেন এলেন?”
“তুমি এই সম্পত্তি কিনে নিয়েছ না’কি? আসতে পারি না আমি?” বলে সভ্য রুমে ঢুকে পড়ে।
ইনারা পিছনে যায় তার, “আজব লোক তো আপনি? না জিজ্ঞেস করে রুমে ঢুকে পড়লেন?”
“দেখো ইনারা খুব খিদে পেয়েছে। আমার প্লেন ছাড়া জার্নি করার অভ্যাস নেই। খাবার এখানে আনতে বলেছি।”
“এখানে কেন?”
“তুমি আছো বলে। ওহ ভালো কথা, আমি তোমার প্রতিবেশি। এই রিসোর্টের জন্য।”
“তাহলে নিজের রুমে যেয়ে খান।”
“আমি এখানে খাব। কোনো সমস্যা?” কথাটা বেশ কঠিন গলায় বলে সভ্য। ইনারা তার এই স্বরকে খুব ভয় পায়। শুরু থেকেই। এমন সরু দৃষ্টি দেখেই যেন তার প্রাণ বেরিয়ে যায়। তাই ভয়ে সে কিছু বলে না। দ্রুত মাথা নাড়ায়।
“গুড। আমি হাত ধুঁয়ে আসছি। যেয়ে টেবিলে বসো।”

রিসোর্ট রুমে দুইটা ব্যালকনি আছে। পিছনের ব্যালকনিতে একটি পুলসাইট ভিউ আছে। পাশেই রাখা একটি টেবিল ও দুইটি চেয়ার। ইনারা সেখানে যেয়ে দাঁড়ায়। খাবার এসে পরে। সভ্য হাত মুখ ধুঁয়ে এসে বসে সামনে। আদেশের সুরে ইনারাকে বলে, “আমি জার্নি করে এসে টায়ার্ড হয়ে গেছি। খাইয়ে দেও।”
“কী মহাভারত উদ্ধার করে এসেছেন যে খাইয়েও দিতে হবে?”
“আমি তোমাকে এটা জিজ্ঞেস করেছি যে, তুমি যেখানে নিজের পরিবার চালানোর জন্য আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করছ সেখানে তুমি এই রিসোর্ট কীভাবে এফোর্ড করতে পারো?”
ইনারা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থেকে দ্রুত চেয়ার টেনে বসে যায়। বলে, “আরে আমি তো মজা করছিলাম। এখনই খাইয়ে দিচ্ছি। আপনি যা আদেশ করছেন তাই করছি। আলাদীনের জিনিই ভাবেন আমাকে।”
মুখে হাসি নিয়ে কথাগুলো বললেও মনে মনে হাজারো বকছিলো সভ্যকে।

সভ্য ইনারার চেয়ার এক টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে আনে। চমকে যায় ইনারা। আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতে দেখে সভ্যকে। সভ্য ঝুঁকে আসে তার দিকে। তার চোখে চোখ রেখে তার চুলের ক্লিপ খুলে দেয়। তার সোনালী চুলগুলো ঝরঝরে পিঠ ছড়িয়ে যায়।
ইনারা কিছুই বলে না। সভ্যের চোখ থেকে চোখই সরে না তার। সময় যেন থেমে গেছে। ধ্যান হারিয়ে গেছে। সে হারিয়ে আছে সভ্যের কাজলে নয়নে। সে আজও বুঝে না, কোনো পুরুষের নয়ন এত মায়াবী হয় কীভাবে?

সভ্য হাসে। ইনারার সাথে দৃষ্টি মিলনের প্রতিযোগিতায় সে স্বাচ্ছন্দ্যে হেরে গেছে। এই দৃষ্টিই যেন তাকে খুন করার জন্য যথেষ্ট।

ইনারার ঘোর ভাঙতেই সে নিজেকে সামলে নেয়। এমন বেহায়াভাবে সভ্যর দিকে তাকিয়ে থাকার মুহূর্ত লুকানোর জন্য বলে, “কী সমস্যা? হঠাৎ এভাবে টানলেন কেন?”
“দূরে থাকলে কষ্ট হবে না?”
“হুঁ?”
“আই মিন খাওয়াতে। একটা কাজও ঠিক মতো হয় না তো তোমার? দেখি এখন খাওয়াও।”
“নিজেকে আসলেই নবাবজাদা ভাবছে রাক্ষসটা।” বিড়বিড় করে বলে ইনারা।
সভ্য কাঠখোট্টা গলায় বলে, “বিড়বিড় করে বকা দিচ্ছ আমাকে?”
“ছিঃ ছিঃ আপনার মতো মহান মানুষকে আমি বকা দিতে পারি। দেখি বাবু হা করো। খাইয়ে দেই।”
“মশকরা করছো আমার সাথ? আমাকে বাবুর মতো দেখায়?”
“স্বভাব তো এমনই। বুড়ো ব্যাটাকে আমার হাতে খাইয়ে দিতে হয়।”
“মাত্র পঁচিশ বছর আমার। আমাকে কোন দিক থেকে বুড়ো দেখা যায়?”
“বুড়ো না বাবু না, কী বলবটা কি আপনাকে?”
“মিঃ হ্যান্ডসাম বলতে পারো।”
“ছিঃ ছিঃ এত বড় মিথ্যা আমি বলতেই পারি না।”
“দেশ বিদেশের হাজার মেয়ে আমার লুকস’এর উপর ফিদা।”
“সবগুলোর টেস্ট খারাপ।”
“তুমি…. চুপচাপ খাওয়াও তো।” অবশেষে হার মেনে কাঠখোট্টা গলায় বলল সভ্য। সে ছোটবেলা থেকে যখনই বাসায় যায় নিজের মা’য়ের হাতেই খাবার খেত। তার অন্যের হাত থেকে খাওয়াটা পছন্দ না। কিন্তু আজ একপ্রকার জোর করে ইনারাকে খাওয়াতে বলল। কেন সে জানে না। কিন্তু একপ্রকার ভালোলাগা কাজ করছে এই অনুভূতিতে। সে সম্পূর্ণ সময় জুড়ে কেবল তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। ইনারা বিড়বিড় করে তাকে কতগুলো বকা দিচ্ছিল। সে জানে। কিন্তু কিছু বলে না। ইনারার রাগ দেখে সে মজা পাচ্ছে। এভাবে রাগে মিষ্টি দেখায় তাকে।

খাবার শেষেও যায় না সভ্য। সে-ও কফি আনায়। এবং ইনারার জন্য আরেকটা গরম গরম চা আনানো হয়। দুইজনে বসে ব্যালকনির সিঁড়িতে। ইনারা এখনো ক্ষেপে আছে সভ্যের উপর। তার এখানে আসাটা তার মা’য়ের স্মৃতির সাথে সময় কাটানোর জন্য তার সাথে নয়। সভ্য কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, “কফি খেতে ভালো লাগছে না। টায়ার্ড লাগছে খুব। আগে একটু আরাম করে নেই।”
ইনারা তো খুশিই হয়। ভাবে এখন সভ্য যাবে তাহলে। কিন্তু সভ্য কাজ করলো উল্টো। ইনারার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। ইনারা তো হতবাক। সে জিজ্ঞেস করে, “কী হচ্ছে?”
“উফফ কানের কাছে চিল্লিও না তো। ক্লান্ত লাগছে খুব। একটু চুল টেনে দেও।”
“এহ আসছে নবাবজাদা। আসলে আলাদীনের জিনি পেয়েছেন না-কি? যে আপনি হুকুম করবেন আর আমি পূরণ করব।”
সভ্য উঠে বসে। উদাসীন মুখে বলে, “করবে না? আচ্ছা ঠিকাছে আমি নিজের রুমে যাই।”
“তাই যান।”
“বেশি আর কি হবে? মাথা ব্যাথা থেকে শরীর খারাপ লাগবে। ক্লান্তি থেকে দুর্বল লাগবে। অসুস্থ হয়ে যাবো। আর বেশি কি?”
এবার কথা শুনে চিন্তিত হয় ইনারা। সে সভ্যকে থামিয়ে বলে, “দাঁড়ান। আচ্ছা একটু শুতে পারেন। চুল টেনে দিচ্ছি। তবে বেশিক্ষণ না।”
সভ্য লুকিয়ে হাসে। যেয়ে আবার ইনারার কোলে মাথা রাখে। ইনারা চুল টেনে দিতে শুরু করে তার। ইনারার খোলা চুল তার মুখে এসে লাগছে। তার কেশের ঘ্রাণে অন্যদেশে হারিয়ে যাচ্ছে সে। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এমন সময় ইনারা জিজ্ঞেস করে, “ঘুমিয়ে গেছেন কী?”
সভ্য নড়ে না। কোনো শব্দও করে না। সাড়া না পেয়ে সে মেনে নেয় সভ্য ঘুমিয়েছে। এত ভালো সুযোগ কীভাবে হাতছাড়া করে সে। ঝুঁকে চোখ বন্ধ করে একখানা চুমু খায় সভ্যের কপালে। পরক্ষণে নিজের এই কাজে নিজেই লজ্জায় মেখে যায়। আবার তাকায় সভ্য উঠে যায় নি তো?

গতবার সে সভ্যকে চুমু দেবার সময় হুঁশে ছিলো না। সে অনুভূতিটাও মনে নেই তার। কিন্তু তার এই অনুভূতি অনুভব করতে পারছে সে। লজ্জা, খুশি, ভয় সবকিছুর মিশ্রণ এই অনুভূতি। এত সুন্দর অনুভূতি সে ভুলে যেতে পারে কীভাবে? যাক, এবারের অনুভূতি এই হৃদয়ের সিন্দুকে বন্দী করে রাখবে সে। আর এই অনুভূতির সাক্ষী থাকব এই জাদুময় রাত, রাতের অন্ধকার এবং এই রাতে ঝরে পরা চন্দ্রিমার জ্যোৎস্না।

চলবে…..

অনুভবে
পর্ব-৩৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারার কোলে মাথা রেখে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিলো সভ্যের মাঝে। ভালো লাগা কাজ করছিলো। শান্তি লাগছিলো। যা তার জীবনের শেষ কয়েক বছরে হারিয়ে গিয়েছিল। ইনারার কোলে মাথা রেখে তার নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শে নিদ্রার রাজ্যে হারিয়ে যায় সে।

ঠিক কতক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙে সঠিক জানে না সে। তবে আশেপাশের বাতি বন্ধ ছিলো। ঘুম ভাঙার পর সে খেয়াল করে ইনারার হাত এখনো তার চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। সে চমকে উঠে বসে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমাকে ঘুম থেকে উঠাও নি কেন? বেশি রাত হয়ে গেছে?”
ইনারা হাই তুলে ঘুমঘোর গলায় বলে, “আপনি ক্লান্ত ছিলেন তাই উঠায় নি? ভালো লাগছে এখন?”
সভ্যের খারাপ লাগতে শুরু করল। তার জন্য ইনারা না ঘুমিয়ে তার মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। তার মাথা ব্যাথা ছিলোই না। সে কেবল ইনারার কোলে মাথা রেখে তার হাতের ছোঁয়া অনুভব করতে চাচ্ছিল। এতে যে ইনারার এত কষ্ট হয়ে যাবে সে বুঝে নি। সে বলে, “হ্যাঁ ভালো লাগছে। আমি যাই তুমিও যেয়ে ঘুমিয়ে নেও।”

সভ্য যেতে নিলেই ইনারা তার হাত ধরে নেয়, “আপনার ক্লান্ত লাগছে?”
“না, আমি তো মাত্র ঘুম থেকেই উঠলাম। আর গাড়িতেও সারা রাস্তা ঘুমিয়েই এসেছি। আমার লাগবে কেন? তোমার তো লাগছে। তাই বলছি, ঘুমিয়ে যাও।”
“তাহলে একটু পাশে এসে বসুন।”
“তোমার চোখে মুখে ঘুম ঘুম ভাব। প্রোগ্রামের কারণে গত কয়দিন ঠিক মতো ঘুমাতে পারো নি তুমি।”
“বছরের ক’টি দিনে চোখ বন্ধ করলেই দুঃস্বপ্ন দেখি। সে রাতগুলোতে আমি ঘুমাই না। আজও এমন একটি রাত।”
সভ্যের বুকের ভেতর খানিকটা নড়ে উঠে। সে জানে, আজ ইনারার মা’য়ের জন্মদিন। এ নিয়েই কি ইনারার দুঃস্বপ্ন দেখা? প্রশ্নটা করল না সভ্য। চুপচাপ যেয়ে বসলো ইনারার পাশে।

কিছুক্ষণ পর ইনারা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে, “আজ আমার মা’য়ের জন্মদিন। তার এ জায়গাটা ভীষণ প্রিয় ছিলো।”
“তাই এখানে এসেছ?”
“হুম, প্রতিবছর আসি। এখানে মা’য়ের সাথে স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। জানেন আমার মা আর নেই।” ইনারা সভ্যের দিকে তাকিয়ে বলে। সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সাথে সাথে সে চোখ নামিয়ে নিলো। তার চোখে ভেসে থাকা জল লুকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সভ্য থেকে তা আর লুকাতে পারলো না। সভ্য তার গালে হাত রেখে উপরে উঠাল এবং বলল, “তোমার মা’য়ের জন্মদিনে এভাবে তোমার চোখেত মুক্তোর মতো মূল্যবান জল ভাসাবে? নট ফেয়ার। আমি নিশ্চিত তোমার মা যেখানেই হবে না কেন তোমার চোখের জল দেখলে তিনি অখুশি হতেন।”
কথাটা ইনারার কান্না কমায় না। উল্টো বাড়ায়। সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সভ্য ঘাবড়ে যায়, “তুমি দেখি আর কান্না বাড়িয়ে দিলে। আমি তো তোমার কান্না বাড়ানোর জন্য কথাটা বলি নি। আচ্ছা আই এম সরি, কান্না থামাও প্লিজ।”
ইনারা কান্না থামায় না। সভ্য আরও বলে। যখন আর লাভ হয় না তখন সে ইনারার বাহু ধরে তাকে বুকে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ” লক্ষ্মীটা প্লিজ কান্না থামাও। তোমায় কাঁদতে দেখলে আমার ভালো লাগে না।”
সে ভেবেছিলো ইনারা তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিবে। কিন্তু সে এমনটা করল না। তার বুকের মাঝেই লেপ্টে থেকে কাঁদতে থাকল।

ইনারার তার বুকের মাঝে থাকার সুখ এবং তার কান্নার ব্যাথা দুটোর মিশ্রণে অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিলো তার মাঝে। সভ্য কিছু বলে না। আলতো হাতে কেবল ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শান্ত হবার সময় দেয় তাকে। একসময় ইনারা শান্তও হয়ে যায়। তার কান্না বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু সভ্যের বুকের মাঝ থেকে উঠে না। কিছু সময় কাটে। ইনারা নড়াচড়া না অনুভব করতে পেরে এসব সভ্য উঠে দেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। মৃদু হাসে সে। ইনারাকে কোলে তুলে রুমে যেয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। উঠতে নিলেই খেয়াল করে মেয়েটা তার জ্যাকেট শক্ত করে ধরে আছে হাতের মুঠোয়। ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ইনারা নড়ে উঠে। তার ঘুম ভাঙতে চায় নি সভ্য। তাই তার পাশেই বসে যায়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তার ঘুমন্ত চেহেরার মুগ্ধতায় ডুবে যায়। আলতো করে একখানা চুমু খায় তার কপালে। আর আঙুলে পেঁচিয়ে তার চুলের সাথে খেলা করতে করতে বলে, “তোমার দুঃখ আমার ভাগ্যে নেবার সাধ্য আমার হলে নিমিষেই নিয়ে নিতাম। কিন্তু এর সাধ্য আমার নেই। তবে তোমাকে দুঃখবিলাস থেকে দূরে রাখার জন্য আমার যা করতে হয় আমি সব করব। তোমার চোখের জল যে আমার বুকে প্রচন্ড আঘাত করে প্রণয়ী।”
.
.
পর্দা সরানো জানালা থেকে। তাই জানালা ফাঁকে সকালের প্রথম মিষ্টি সোনালী রোদ্দুর এসে ঝরে পরছিলো ইনারার উপর। তার মুখে প্রায়ই গোলাপি আভা ছড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে তার গাল দুটোয়। এই সোনালী রোদ্দুরের ছোঁয়ায় তার এই আভা গাঢ় হয়ে উঠেছে। তার সোনালী চুলগুলো ‘আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তার এমন মিষ্টি আভা থেকে সভ্য এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারে না।

ইনারা মিটমিটিয়ে চোখ খুলতেই প্রথমে সভ্যের চেহেরা দেখতে পায়। প্রথমে ড্যাবড্যাব করে কিছু মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ইনারার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে না হেসে পারল না সে।

হুঁশ আসতেই একলাফে উঠে বসে ইনারা। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলে, “আপনি… আপনি এখানে কী করছেন?”
“আমাকে সবসময় আপনার কাছে পাবার ইচ্ছাটা পূরণ করবার বসে ছিলাম মহারাণী?”
“কী!”
সভ্য তার জ্যাকের দিকে ইশারা করে। ইনারা সাথে সাথে তার জ্যাকেট ছেড়ে উঠে বসে। দূরে সরে যেয়ে চোখ নামিয়ে মিনমিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি সারারাত আমার জন্য এখানে বসে ছিলেন?”
“এখন তোমাকে ঘুমের মাঝে এতটা শান্ত এবং নিষ্পাপ দেখাচ্ছিলো। এ ঘুম তো ভাঙতে পারি না। নাহয় সারাক্ষণ ডাইনীর মতো করে আমাকে জ্বালাও।”
ইনারা সরু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। রাগে নাক ফুলিয়ে কিছু বলতে নিবে তখনই সভ্য আবার বলে, “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব শান্তিতে ঘুমিয়েছ। তাই উঠানোর মতো দুঃসাহস করি নি।”
ইনারা সত্যিই অবাক হয়। প্রতি বছর তার মা’য়ের জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী এবং নিজের জন্মদিনে খুবই অশান্তি লাগে ইনারার। এসব দিনে তার মাকে সবচেয়ে বেশি মনে করে সে। এসব দিনে সে ঘুমাতে পারে না। তার হৃদয়ের দুঃখ তার দুঃস্বপ্নের রূপ নিয়ে নিদ্রায় হানা দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলে। তার মা’য়ের মৃতদেহের দুঃস্বপ্ন। এই দিনগুলোর আশেপাশের কিছু রাত তার কিছুতেই ঘুম আসে না। খুব অশান্তি লাগে। তাইতো গত দুইরাত সে না ঘুমিয়ে একটানা কাজ করেছে। এই কাজের কারণে সে নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছিলো। অথচ গতরাত কি শান্তিতে ঘুমাল সে। কতবছর এমন শান্তির ঘুম হয় নি তার। আচ্ছা সভ্য কী জাদু জানে? নাহয় কীভাবে সে গতরাতে এত শান্তিতে ঘুমায়? কীভাবে সে সভ্যের বুকের মাঝে এত শান্তি খুঁজে পায়?

সে এইসব ভাবনার জগতে হারিয়েই ছিলো তখনই সভ্য উঠে দাঁড়ায়। তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “সূর্যোদয়ের সৌন্দর্যতা নেই, তবে শুভ্র সকালের মুগ্ধতা এখনো আছে। আমার সাথে দেখতে যাবেন মহারাণী সাহেবা?”
লজ্জায় ইনারার গালদুটো আরও লালচে হয়ে আসে। সে সভ্যের সাথে চোখ মিলাতে পারে না। তবে হাত বাড়িয়ে সভ্যের হাত ধরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দুইজনে বের হয় রুমের থেকে। শুভ্র সকাল। আশেপাশে কেউ নেই তেমন। তাই সভ্য নিশ্চিন্তে মুখ খুলে হাঁটছে। আর আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে ইনারার দিকে। সে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। সভ্য জিজ্ঞেস করল, “গতরাতের কনসার্ট কেমন লেগেছে?”
“অস্থির, অসাধারণ। আমরা অনেকে ব্যাকস্টেজে ছিলাম না? আমরা সকলের কথা শুনেছি। সকলে পঞ্চসুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।”
“শুনে ভালো লাগলো। ওদের ভালোবাসা তো অনেক মূল্যবান।”
“তা ঠিক। দেখবেন আমিও একদিন এভাবে সবার ভালোবাসা পাব। এতজনের ভালোবাসা পেতে অনেক ভালো লাগে তাই না? নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। তাই না?”
“এটা ভুল নয়। কিন্তু এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াও আছে।”
“যেমন?”
“যেমন আমি চাইলেই কোথাও যেতে পারি না, পছন্দের কোনো কাজ করতে পারি না, আর…”
“আর?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সভ্য। এক ঢোক গিলে, “আর ভালোবাসার সাথে সাথে কত মানুষের ঘৃণার স্বীকার হতে হয়। যখন তুমি সফলতার শিকরে উঠবে তখন যেমন কতগুলো অজানা ভালোবাসার মানুষ পাবে এর সাথে ঈর্ষার কারণে আপন মানুষরাও পর হয়ে যায়। অতীতে যারা খুব ভালো বন্ধু ছিলো তারাও শত্রু হয়ে যায়।”

ইনারা বুঝতে পারে সভ্য জোহানকে নিয়ে কথা বলছে। সে ঠিক কি উওর দিবে বুঝতে পারে না। তাই কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলে, “দেখলাম কনসার্টে আপনার জন্য মেয়েরা ভালোই চিল্লাচিল্লি করছিলো। মনে হলো চিল্লিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলবে।”
সভ্য ফিক করে হেসে দেয় ইনারার কথা শুনে,”কেন তোমার হিংসা হচ্ছে?”
“আ…আমার হিংসা হবে কেন? ভাবছিলাম কোন জাদু করেছেন তাদের।”
সে ইনারার বাহু ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। তার চোখে চোখ রেখে বলে, “জাদুটা কী তোমার উপর চলেছে বলো তো?”
ঢোক গিলে ইনারা। সভ্যের চোখে চোখ রাখতেই যেন তার ভিতরের সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। নিশ্বাস হয়ে যায় দিশেহারা। তার নিজেকে ছন্নছাড়া করে দিতে মন চায়।

হঠাৎ করে এক লোক সভ্যকে ডাক দেয়। সাথে সাথে চমকে উঠে দুইজন। দূরে সরে যায়। লোকটা রিসোর্টের মালিক। সে একজন মহিলা এবং দুইজন বাচ্চা ছেলে নিয়েছে। লোকটা জানাল তারা সকলে সভ্যের অনেক বড় ভক্ত। তারা সভ্যকে দেখে উৎসুক হয়ে যায়। গতরাতে হয়তো সভ্যকে দেখে সে পরিবার নিয়ে এসেছে। ইনারা তাদের সভ্যের সাথে ছবি তুলে দিয়ে নিজে একটু দূরে যেয়ে দোলনায় বসে। তাদের একা সময় দেয়। দোলনায় দুলতে দুলতে সে তাকিয়ে রয় সভ্যের দিকে। গতরাত নিশ্চয়ই নির্ঘুম কেটেছে তার জন্য। আর এতদিনের কাজেও। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। অথচ এখনো কত হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। নিশ্চয়ই সে জাদু জানে। যে জাদুতে তার প্রতি মুগ্ধ না হওয়াটা অসম্ভব। সে দেখে সভ্য তার দিকেই তাকিয়েছে। সাথে সাথে সে চোখ সরিয়ে নিলো। আবার তাকাল। এখনো সভ্যের দৃষ্টি তার দিকে আটকানো। এবার সে চোখ সরাল না। দোলনার দঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। এক না বলা প্রতিযোগিতা চলল। যেখানে না কারও জয় আছে, আর না পরাজয়।

দুইজনে চা নাস্তা করে নিজের রুমে গেল ফ্রেশ হতে। ইনারা ফ্রেশ হয়ে নিয়ে তার ব্যাগ খুলে ড্রেস বের করার জন্য। তখনই তার চোখ পরে তার মা’য়ের নীল শাড়িটার উপর। নীলের উপর আকাশী রঙের কাজ। শাড়িটা সৌমিতা আন্টি তাকে দিলেন আসার আগে। তার কাছে মা’য়ের শেষ স্মৃতিটা না’কি এটাই। কেন যেন এটা এখানে নিয়ে এলো ইনারা। শাড়িটার ঘ্রাণ নিয়ে তার মা’য়ের কথা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু এবার তার চোখে জল নয়, ঠোঁটে হাসি এঁকে এলো। তার মনে পড়লো সভ্যের বলা গতরাতের কথা। সত্যিই তো মা কখনো তার চোখের জল সহ্য করতে পারতো না। কষ্ট পেত। তাহলে সে আজ এত বিশেষ দিনে তার মা’কে কষ্ট দিতে পারে কীভাবে?

দরজায় টোকা পরে। নিশ্চয়ই সভ্য। তার এতক্ষণে তৈরি হবার কথা ছিলো। সে দ্রুত যেয়ে দরজা খুলে। সভ্য তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “মেয়েরা যতই গেঞ্জি প্যান্ট পরুক না কেন তৈরি হতে তার দেরি হবেই।”
“তাহলে জানলে এত তাড়াহুড়ো করে এলেন কোন দুঃখে? এসেই যখন পরেছেন এসে বসুন।”
ইনারা সভ্যকে রেখে বাথরুমে গেল চেঞ্জ করতে এসে। এসে দেখে তার হাতে মা’য়ের শাড়ি। সে বলে,”এটা আমার আম্মুর শাড়ি সুন্দর না?”
কথাটা বলতে দেরি। সভ্যের তাকে ধরে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করাতে দেরি হয় না।

ইনারা হতবাক, “করছেনটা কী?”
সভ্য শাড়িটা ইনারার উপর জড়িয়ে বলে, “তোমাকেও সুন্দর লাগছে। আজ এটা পরে চলো না।” কেমন আবদারের সুরে বলল সে।
কিন্তু ইনারা তো কিছুতেই রাজি না।
“অসম্ভব। পাগল আপনি? আমি জীবনেও শাড়ি পরি নি। আর কোথায় যাব আমরা?”
“কেন ঘুরতে।”
“ঘুরতে? আমি কখনো এখানে আসলে ঘুরাঘুরি করি না।”
“আজকে করবে।”
“কেন?”
“কারণ আমি নিশ্চিত তোমার মা কখনো এটা চাইতো না যে তার মেয়ে তার কথা ভেবে চুপচাপ এখানে বন্দী হয়ে থাকবে। এ সুন্দর পৃথিবী ঘুরে দেখতে পারবে না। আজ তোমার মা’য়ের জন্মদিন তাই না? চলো আজ উনার জন্মদিন এই সুন্দর রাজ্যে পালন করি। আর তোমার শাড়ি পরলে তাকে অনুভবও করতে পারবে তুমি। মনে হবে সে সবসময় তোমার কাছে।”
“কিন্তু আমি শাড়ি পরতে পারি না।”
সভ্য ইনারাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল, “”আমি পরিয়ে দিব?”
ইনারা সভ্যের বুকে মেরে বলল, “ছিঃ! কী বলেন এসব?”
সভ্য হাসে, “মজা করছি। আমি এখনই আসি।” বলেই সভ্য বাহির দিকে দৌড়ে যায়। ইনারা উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছেন?”
“তোমার শাড়ি পরানোর ব্যবস্থা করতে।”
“আমি কখন বললাম আমি যাব?”
“তুমি যাবে আমি জানি।”
“কিন্তু আপনার তো সমস্যা হবে।”
সভ্য দাঁড়ায় দরজার কাছে, “লোকালয়ে আগামীকাল মাস্ক পরে যাব। চিন্তা করো না তোমাকে শাড়ি পরিয়ে আজ লোকদের সামনে নিয়ে যাচ্ছি না।” আবার বিড়বিড় করে বলল, “সেভাবে তোমাকে দেখার অধিকার কেবল আমারই আছে।”
বলেই এক দৌড় দিলো সে।

রিসোর্টের মালিকের স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলো সভ্য। সে ইনারাকে নিয়ে যায় শাড়ি পরানোর। তার বাসা রিসোর্টের সাথেই। এতটুকু সময় সভ্য বসে বসে কথা বলছিলো রিসোর্টের মালিকের সাথে তাদের বাড়িতেই। রিসোর্টের কিছু স্টাফ বাদে কেউ-ই তাকে দেখে নি এখানে। এবং সে সকলকে অনুরোধও করেছে কাওকে না জানাতে। এই দুইদিনের জন্য এই রিসোর্ট সে বুক করে নিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেও এখানে থাকা গেস্টরা চলে যাবে। তারপর তারা স্বাধীনভাবেই ঘুরতে পারবে। নাহলে এতক্ষণে সে বিশাল ঝামেলায় পড়তো।

লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে অতিষ্ঠ হয়ে পরেছিল সভ্য ইনারার অপেক্ষায়। তার তো তর সইছে না। মেয়েটা তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। খুবই বাজে পরীক্ষা। এখন তার খুবই বিরক্ত লাগছিলো। সে ক্লান্ত হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে কথা বলছিলো লোকটার সাথে। তবে তার দৃষ্টি আটকে আছে দরজার দিকে। সে দেখে দরজা থেকে বের হচ্ছে ইনারা। তার পরনে নীল শাড়ি, চোখে নীল কাজল মাখা, দুইহাত ভর্তি নীল চুরি, তার গাল দুটো লালচে, ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপ্সটিক দেওয়া। আর চুলে খোঁপা বাঁধা। তার দর্শনেই সভ্য যেন নিজের সামাল হারাল। দেয়াল থেকে কাঁধ পিছলে পরে যেতে নেয়। খুব কষ্টে সামলায় নিজেকে। তবুও যেন তার নিশ্বাস আটকে এলো। তার দৃষ্টি সরানো দায়। বেহায়ার মতো তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। আশেপাশের লোকদের কথাও তার মাথায় নেই। এর পূর্বে সে কখনো ইনারার রূপে পাগল হয় নি। কিন্তু আজ যেন ইনারা নামক নেশায় আসক্ত হয়ে গেছে। তার আশেপাশের বাতাস মাতাল হয়ে এলো।

মুখে কোনো কথা হয় না। কিন্তু সভ্যের এমন বেহায়া দৃষ্টির মাঝেই ইনারা প্রশংসা খুঁজে পায়। মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। লজ্জায় লালিমায় রঙে যায়। এর পূর্বে সে অন্যকারো জন্য এমন লজ্জা পেয়েছে বলে সন্দেহ। এমন নারীসুলভ আচরণও খুব কম করেছে সে। তার এসব পছন্দ না। কিন্তু আজ তার ইচ্ছা করছে সে প্রতিটা দিন এভাবে শাড়ি পরেই দাঁড়িয়ে থাকুক সভ্যের সামনে। আর সভ্য এমন বেহায়াভাবেই তাকিয়ে থাকুক তার দিকে। সে এভাবেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেক। তবুও সভ্য তার দৃষ্টি না সরায় তার থেকে। দেখতে থাকুক। এভাবে দেখতে দেখতে তার প্রেমে ভেসে যাক। তার হঠাৎ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো, “গায়ক সাহেব, আপনাকে চাওয়া হাজারো মেয়েদের মাঝেও কি আপনি এই সাধারণ মেয়েটির প্রেমে পড়তে পারবেন? কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও?”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে