অনুভবে পর্ব-৩৪+৩৫

0
490

অনুভবে
পর্ব-৩৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারার কোনো উওর না পেয়ে আবারও জোহান বলল, “তোমার সমস্যা হলে থাক। মা’য়ের মন অনেক খারাপ ছিলো তো। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। আচ্ছা যাই হোক, তুমি ব্যস্ত হলে আর কি করার? তাহলে ফোন রাখছি।”
“এক মিনিট দাঁড়ান। আমি আসব।”
“বলছ কি? তাহলে তুমি সময় ও লোকেশন বলে দিলে আমি তোমাকে নিতে আসব।”
“আচ্ছা মেসেজ করে দিব। ফোন রাখলাম।”

ইনারা কল কেটে দিয়ে পাশে রাখল। তারপর তার পকেট থেকে সভ্যের লেখা গানের কাগজটা বের করে। উপুড় হয়ে শুয়ে বারবার সে লেখাগুলো পড়ে। তবুও তার মন ভরে না।
.
.
ইনারা যাবার পরপরই সামি সভ্যকে খুঁজতে থাকে। সভ্য কিচেনে সবার জন্য কফি বানাচ্ছিল। সামি এসে পিছন থেকে উঁচু স্বরে বলে, “ভাই কি ছিলো এটা?”
ভয় পেয়ে যায় সভ্য। বুকে হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে, সামির মাথায় টোকা মেরে বলে, “স্বাভাবিকভাবে কোনো কথা বলতে পারিস না, তাই না? গলায় মাইক ফিট করা না’কি?”
“উফফ ব্রো, এত জোস সিন দেখে কি উৎসুকভাব দাবায় রাখা যায় না’কি? বল না কি হয়েছিলো গতরাতে? ডিটেইলস-এ বল।”
“কি হবে?”
“আই মিন এত সকাল সকাল ইনারা তোর বাসায়, তোর পোশাক পরা, কিছু তো চলছে তোদের মাঝে। আমাকে বলবি না?”
“গতরাতে কেউ ওর কোল্ড ড্রিংক-এ এলকাহোল মিশিয়ে দিয়েছিলো।”
“বলিস কি!”
“পার্টিতে কোনো তামাশা করলে ওর জন্য সমস্যা হতো। আর ওর বাসার ঠিকানা ছিলো না। তাই বাসায় নিয়ে এনেছিলাম।”
“এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! ইনারা এমনিতেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠে নি। এর উপর কোল্ড ড্রিংক এ মিশিয়ে! অর্থাৎ ওর ক্ষতি করার জন্য কাজটা করেছিলো। ভবিষ্যতেও এমনটা করতে পারে।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছিল। এই মাত্র সাইদকে কল দিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে বলেছি। সে ওয়েটারকে পেলেও তার থেকে বের করানো যাবে কাজটা কে করেছিলো। তার সুখের সময়ের উল্টো গণনা শুরু হয়ে গেছে। আচ্ছা এসব বাদ দে, তুই কোন কথা বলতে এসেছিলি তখন।”

সামি গম্ভীরমুখী হয়ে পাশের তাকে হেলান দিয়ে বলে, “জোহানকে নিয়ে। ও গতকাল ইনারার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। গতকাল ওকে দেখার পর জেদ ধরেছে কিছুতেই ছাড়বে না। এবার কেবল তোর উপর জেদ করে না, আসলেই মনে হলো ও ইনারার প্রতি সিরিয়াস। কয়েকমাস আগে তাকে এক কনসার্টে দেখে প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকেই ওর খোঁজ নিচ্ছে। ওকে দেখে এতদিন কিছুটা চিনতে পারলেও ও বিশ্বাস করতে চাইছিলো না যে ইনারার মতো অগুছালো মেয়ের প্রেমে সে পরেছে। কিন্তু গতকাল তাকে দেখ….”
সভ্য তার কথা কেটে বলল, “বুঝতে পেরেছি। ব্যাপার না।”
“তোর চিন্তা হচ্ছে না?”
সভ্য সামির দিকে তাকিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে উওর দিলো, “যদি ইনারার আমাকে ভালোবাসতে হয় তাহলে এ পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে আটকাতে পারবে না, আর যদি ওর আমাকে ভালো বাসতে না হয় তাহলে আমি হাজারো জোর করেও ওর হৃদয়ে আমার জন্য অনুভূতি জাগ্রত করতে পারব না। তাই আমি আমারটা চেষ্টা করতে থাকব, বাকিটা নিয়তি এবং ওর অনুভূতি।”
সে সামির হাতে একটি কফির মগ দিয়ে আবার বলল, “তুইও বেশি চিন্তা করিস না।”
সভ্য বাকি কফির মগ একটা ট্রে-তে নিয়ে যেতে নেয় তখনই সামি বলে,
“সবটা নিয়তির উপর ছেড়ে দিলে তো হয় না ভাই। জোহান সহজে ওকে ছেড়ে দিবে না।”
“ভালোবাসা হয়তো অমৃত হয়, নয়তো বিষ। দেখি কার ভাগ্যে অমৃত পরে আর কার ভাগ্যে বিষ।”
.
.
রান্নাঘর থেকে ড্রইংরুমে যেয়ে সকলে মিলে কিছুসময় আড্ডা দিলো। এরপর ইরফান এবং সামি গেল তাদের এপার্টমেন্টে চলে যায়। আজ তাদের জোহানের বাসায় যাবার কথা। তারা দুইজন তৈরি হতেই গেছে। ঐশি সভ্যকে একা পেয়ে তার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “একটা অনুরোধ করব রাখবি?”
“এভাবে বলছিস কেন? আমি তোর কোনো আবদার মানা করি না’কি?”
“আজ বাসায় চল না।”
সাথে সাথে সভ্যের মুখটা মলিন হয়ে গেল। সে ঐশির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় এবং বলে, “তুই জানিস ঐশি শেষবার যখন আমি তোদের বাসায় গিয়েছিলাম সেদিন কি হয়েছিলো। জোহান আমার অপমান করেছিলো। আমার উপর হাত তুলেছিলো। আমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে সেদিনই হারিয়েছিলাম। কীভাবে আবার সে একই স্থানে যাই যেখানে আমি নিজের সম্মান ও বন্ধু দুটোই হারিয়েছি।”
“সেদিনের চারবছর হয়ে গেছে সভ্য। আর সেটা আমারও বাসা, কেবল জোহান ভাইয়ের না। জোহান ভাই তো আসেও না। মাসে একবার এসে মুখ দেখিয়ে চলে যায়। গতকাল ভাই মা’কে পার্টিতে এনেছিল। অথচ এর পরিণাম মা’য়ের ভোগ করতে হয়েছে।”
“আন্টির? আন্টির কী হয়েছে?” অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল সভ্য।
“গতরাতে ঘরে বড়সড় ঝগড়া হয়েছে। মা পার্টিতে গিয়েছিল বলে। জানি মা সাদাসিধা ভাবেই চলাফেরা করে। বাবা মা’য়ের উপর আরোপ লাগিয়েছে যে তার পোশাকের ধরণের কারণে এত বড় বড় খ্যাতিমান ব্যাক্তিদের সামনে তার সম্মান ডুবেছে। এমনকি তার উপর হাতও তুলেছে।”
“হাত তুলেছে? আমি এখনই তার সাথে কথা বলছি। তার এত সাহস কীভাবে হয় তা আমিও দেখতে চাই।”
সভ্য ফোন করে ঐশির বাবাকে কল দেবার জন্য। কিন্তু ঐশি থামিয়ে দেয়, “তুই উনাকে কল দিস না। পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। তুই আজ প্লিজ বাসায় চল। মা তোকে কাল দেখে যা খুশি হয়েছে তা উনার চোখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল। মা’য়ের জন্য হলেও চল। তার মন একটু হলেও ভালো হয়ে যাবে। জোহান ভাই নেই। তাই কোনো সমস্যা হবে না। প্লিজ। মা’য়ের জন্য। জোহান ভাই থাকবে না।”
.
.
জোহান গাড়ির আয়নাতে নিজের চুল ঠিক করছিলো। আজ সকালেই তার মা’য়ের সাথে কথা হবার পর তার কন্ঠটা উদাসীন শুনাল। ব্যাস, ইনারার সাথে দেখা করবার আরেকটি অজুহাত পেয়ে গেল সে। সে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলল, “যে করেই হোক এ ক’দিনের ভুল তার শোধরাতেই হবে। গাঁধার মতো ইনারাকে নিজের থেকে নিজে দূরে সরিয়ে সভ্যের দিকে ঠেলে দিলি। কত সুন্দর করে আগে তোর আগেপিছে ঘুরতো। জোহান বলতে পাগল ছিলো। ওই দীপার জন্য সব নষ্ট করে দিলি। ধ্যুর! তোর কারণেই এখন সভ্যের বেশি কাছে চলে গেছে সে। এখন ইনারাকে সব সময় নিজের দখলে নিতে হবে যেন সভ্যের সাথে কথা বলার সুযোগই না পায়। যথাসম্ভব দূরে রাখতে হবে।”

জোহান ইনারার অপেক্ষা করতে থাকে। তার বাসার সামনে যায় নি। ইনারা ঠিকানাই দেয় নি। এক গলিতে অপেক্ষা করছিলো। কিছুসময় পর এলো ইনারা। তার পরনে আগের মতো গেঞ্জি আর টাউজার। তাকে দেখতেই মুখ বানায় জোহান। সে ভেবেছিল গতকালের পর একটু তো জ্ঞান হয়েছে মেয়েটার। কোন মেয়ে সকলের কাছে নিজের রূপের এত প্রশংসা শুনে পরেরদিন এই অবস্থায় আসে!

পরক্ষণেই জোহান নিজেকে বুঝায়। একবার ইনারাকে তার কাবুতে করে নিলে তার যেমন ইচ্ছা হবে ইনারাকে তেমন ভাবেই সাজিয়ে রাখতে পারবে সে। তাই নিজের চিন্তা নিয়ন্ত্রণে রেখে ইনারাকে হাসিমুখে বলে, “তোমাকে কি বেশি বিরক্ত করলাম?”
“উঁহু।”
“তারপর গতকালের পার্টি কেমন লেগেছে তোমার?”
“খারাপ না।”
“কী ব্যাপার তোমার কী শরীর খারাপ? সারাক্ষণ হাসিখুশিতে মেতে থাকা মেয়ের মুখে আজ কোনো কথা নেই।”
“এমনিতেই ভালো লাগছে না। আমি একটু চোখ বন্ধ করলাম। ঠিকানায় পৌঁছালে উঠিয়ে দিয়েন।”
ইনারার এভাবে কথা বলায় একটু কষ্ট পেল।জোহান। আগে কত বকবক করতো তার আগেপিছে ঘুরে। আর এখন! এখন তো তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তবে সে কিছু বলল না। গাড়ি স্টার্ট করল।

কিছুসময়ের মধ্যেই তারা পৌঁছে যায় জোহানদের বাড়িতে। জোহান তো মনে মনে অনেক খুশি। আজ ইনারার সাথে কেবল সে সময় কাটাতে পারবে। সভ্য তাদের আশেপাশেও আসবে না। সে বাড়িতে ঢুকার সময় ইনারাকে বলল, “আব্বুর সাথে তোমার দেখা হয় নি তাই না? ছোটবেলায় যখন সাইয়ারা আন্টি এবং আম্মু বান্ধবী ছিলেন, তখন সম্ভবত তোমাকে চিনতো। এখন তো এত বড় হয়ে গেছ। চিনবেও না। কিন্তু আমি নিশ্চিত অনেক খুশি হবে তোমাকে দেখে। তুমি মা আর সাইয়ারা আন্টির একসাথে ছবি দেখেছ? আম্মুর এলবামে আছে।”
“সত্যি? মা’য়ের ছবি আছে আন্টির কাছে।”
ইনারা উৎসুক গলায় বলে। তার মা’য়ের সাথে জড়িত সকল ঘটনার প্রতিই তার অতি আগ্রহ।

জোহানও ইনারার সাথে কথা বলার বাহানা পেয়ে অনেক খুশি হয়। সে একের পর এক সৌমিতা আন্টির সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজতেই থাকে। সেখানে এসে দেখে বৈঠক বসেছে খাবারের টেবিলে।

ঐশি সবাইকে খাবার টেবিলে সকলের সাথে কথা বলছিলো। এমন সময় সে জোহানকে দেখে খুশিতে উঠে দাঁড়ায়, “ভাইয়া তুমি!”
আজ অনেকদিন পর জোহান তাদের বাড়িতে এসেছে। তাই খুব খুশি হয় ঐশি। নিশ্চয়ই মা আজ আনন্দে আত্নহারা হবেন। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে সভ্যের কথা। সে ভীত দৃষ্টিতে তাকায় তার সামনের চেয়ারে বসা সভ্যের দিকে।

সভ্য জোহানের কথা শুনে পিছনে ফিরে তাকায়। তার সাথে ইনারাকে দেখে চক্ষু কপালে তুলে নেয়। তারপর বিরক্ত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

জোহান সভ্যকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। এতবছর ধরে সভ্য একবারও তার বাসায় আসে নি। আজই আসতে হলো তাকে! তাকে দেখেই রাগে সে নিজের হাতের মুঠো বন্ধ করে নিলো। কিন্তু ইনারার সামনে নিজের ইমেজ খারাপ করার ভয়ে কিছু বলল না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। এর মধ্যে সামি দৌড়ে এসে ইনারার সামনে এসে দাঁড়ায়, “আরে পার্টনার তুমি এখানে?”
“জোহান বলেছিল আন্টির মন খারাপ তাই… ”
“তুমি আম্মুকে চিনো?” ঐশি প্রশ্ন করে। অবাক হয়ে। ইনারার পূর্বেই তার কথার উওর দেয়, “গতকাল রাতে আম্মুর সাথে দেখা হয়। আম্মু অনেক পছন্দ করেছিলো ওকে।”
“তা তো করারই কথা। কত কিউট ইনারা।”
জোহান ইনারার দিকে ঝুঁকে মৃদুস্বরে বলে, “ওকে সত্যিটা বললে ওর পেটে থাকবে না। তাই মিথ্যা বললাম।”

“এই’যে সভ্য তোর প্রিয় ঝাল গরুর মাংস এবং খিচুড়ি তৈরি। দেখ তো আগের মতো স্বাদ আছে না’কি?” সৌমিতা আন্টি হাতে বড় এক বাটি খাবার নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে কথা বলছি। সে ইনারাকে দেখতেই টেবিলে বাটি রেখে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তাকে দেখে খুশিতে আত্নহারা সে।
সামি বলে, “মামী ওকে আদর করতে করতে তো খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। আর আমার পেটে ইঁদুররা লুডু খেলতে খেলতে বোর হয়ে গেছে। খেতে হবে তো, নাইলে ওদের টাইমপাস হবে কীভাবে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ইনু আসো। আজ সভ্যের পছন্দের খাবার রান্না করেছি। যদি জানতাম তুমি আসবে তাহলে তোমার পছন্দের রান্নাও করতাম।”

সামি ইনারার হাত ধরে তাকে নিয়ে যেয়ে বসায় সভ্যের পাশের চেয়ারে। আর বলে, “মামী আপনার দুই বিশেষ মেহমানকে পরিবেশন করতে সহজ হবে।”
ইনারা আড়চোখে তাকায় সভ্যের দিকে। অথচ লোকটা তার দিকে একবারও তাকাল না।
“ভাব কী! ভাবে যেন মরে যাচ্ছে। সকালে কত সুন্দর করে কথা বলছিলো, আর এখন যেন চিনেই না। চিনবে কি করে তার প্রিয় ঐশি তো সামনে বসে। হনুমানের নাতিটার ভাব এমন যেন কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী। ফালতু! উফফ ইনু সে তোকে পাত্তা না দিলে তোর এত রাগ লাগছে কেন? বাদ দে তো।” মনে মনে ভাবলো ইনারা। ভেংচি কেটে নিজেও ভাব নিয়ে অন্যদিকে তাকায়। দেখে জোহান ঐশির পাশের চেয়ারটায় এসে বসেছে। ইচ্ছা করেই সে জোহানকে বলল, “থ্যাঙ্কিউ জোহান, আপনি না বললে তো আমি আন্টির হাতের খাবার খেতেই পারতাম না।”
“আমি উলটো সরি। আগে বললে হয়তো পাচক ভালো কিছু রান্না করতাম। আমি জানতাম না এসব রান্না করা হবে আজ। বাহির থেকে কিছু আনাই?”
“আরে না। এসব তো আমার অনেক পছন্দের খাবার। ঘ্রাণ পেয়েই মুখে পানির সাগর ভাসছে। আমার তো তর সইছে না। আন্টি একটু আঁচার হবে? টক টক ঝাল ঝাল আঁচার।”
সৌমিতার জোহানের কথা শুনে মন খাবার হলেও ইনারার কথায় সে খুশিগলায় বলে, “আমি এখনই আনছি।”

জোহান আবারও ইনারাকে ইম্প্রেস করার জন্য বলল, “তোমার জন্য আমি কেকও অর্ডার দিয়েছি। ম্যাংগো ফ্লেভার।”
সভ্য একবারও আশেপাশে তাকায় না। সে খাবার নিজের পাতে বাড়তে বাড়তে বলে, “ওর ব্লু-বেরি ফ্লেভার ফেভারিট।”
এই অল্পকিছু শব্দতেই জোহানের চোখেমুখে পরাজিত ভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। সে খানিকটা দেবে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি ইনারা?”
ইনারা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়, “আমার ম্যাংগো ফ্লেভার কেক পছন্দ না।”
জোহান অকারণেই লজ্জিত হয়। টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি এখনই অর্ডার চেঞ্জ করে আসি।”
“প্রয়োজন নেই…”
এর আগেই জোহান চলে যায়। সামি খাবার মুখে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “গেইম অন। সভ্য- এক। জোহান- শূণ্য।”

ইনারা মিষ্টি হেসে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্যের তার পছন্দের কেকে ফ্লেভারও মনে আছে জেনে কেমন খুশি লাগছে তার। এত ছোট একটি বিষয়েও তার এত খুশি কাগছে কেন সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
হঠাৎ সভ্য তার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “বলেছিলাম বাসায় গেছ বলেজানাতে। ভুলে গেছ? কল তো দূরের কথা, মেসেজেরও রিপ্লাই দেও নি।”
সভ্যের তাকানোর সাথে সাথেই সে চোখ ফিরিয়ে নিজের মুখ লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে। যেন সভ্য তার কোনো চুরি ধরে নিয়েছে।
সে নিজেকে সংযত করে গলা পরিষ্কার করে উত্তর দেয়, “মাথা ধরে ছিলো তাই মনে নেই।”
“জোহানের সাথে তোমার প্ল্যান তৈরি হয় এখানে আসতে মাথা ব্যাথা করেনি?”
“তো আপনার তো জোহানের সাথে তুমুল ঝগড়া। আপনি এখানে কী করছেন?”
“এটা কেবল জোহানের বাড়ি না।”
“হ্যাঁ আপনার প্রিয় ঐশিও তো থাকে।”
“তুমি এত ত্যাড়া উওর দিতে পারো কিভাবে বুঝি না। জিজ্ঞেস করেছি এক কথা ওই কথার ঘুরিয়ে-মুড়িয়ে আরেক কথা বের করে দিচ্ছ।”
“তো জোহানের সাথে আমি এখানে এসেছি আপনার জ্বলে কেন? নিজের চরকায় তেল দিন। মানে নিজের পেটে খাবার দিন।”
“তুমি..”
সভ্যের সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ইনারা ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিলো। খাবার নিয়ে নিজের মতো খেতে থাকল সে। এমন সময় জোহান আসে। এবং সে জোহানকে বলে, “আপনিও না অকারণে আমার জন্য কষ্ট নিচ্ছেন। কি দরকার ছিল কেকের অর্ডার চেঞ্জ করার।”
“তুমি আমাদের মেহমান। এটা তো আমার দায়িত্ব।”
“থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। সো সুইট অফ ইউ।”

ইনারা এমন নরম সুরে কথা বল শুনে সভ্যের কাশি এসে পড়লো। সে জলদি একগ্লাস পানি খেয়ে বিড়বিড় করে বলল, “গতকাল আমি একে নিয়ে গতরাতে এত দৌড়াদৌড়ি করলাম, এত খেয়াল রাখলাম, রাত ভরে ওর ময়লা করা সম্পূর্ণ ঘর পরিষ্কার করলাম, আবার সকাল সকাল নাস্তাও বানিয়ে দিলাম। তারপরও আমার জন্য মুখ থেকে একটা থ্যাঙ্কিউও বের হবে। আর জোহানের জন্য মিষ্টি ঝরছে যেন। আমার সাথে কথা বলতেই যে সে তেঁতুল গাছের রাণী হয়ে যায়। তার মুখে কটু বার্তাই ঝরে।”

সৌমিতা আন্টি আমের আঁচারের বয়াম এনে দেয়। ইনারা সবার আগে আঁচার মুখে দেয়। সে লাফিয়ে উঠে। তার টক খাবার অনেক ভালো লাগে। খাবারের প্লেট এক পাশে রেখে সে আঁচারই খেতে শুরু করে আর সৌমিতা আন্টিকে বলে, “আন্টি…আন্টি এটা বেস্ট। এ পুরো বয়াম তো আমিই এক বসাতেই শেষ করে দিব। এসব খাবারের জন্য তো আর পেটে জায়গা হবে না।”
“সে কি এত আঁচার একসাথে কেউ খায়? আমি তোমাকে বাসার জন্য দিয়ে দিব। মামনী এখন ভালো মেয়ের মতো খাবার খাও।”

সভ্য মাঝখানে বাঁধা দিয়ে বলে, “বাদ দেন তো আন্টি। যার মুখ সারাক্ষণ তেঁতো হয়ে থাকে তার আর আঁচার খেলে কি হবে।”
ইনারা রেগে যায় সভ্যের কথায়, “আমার মুখ তেঁতো? আপনার মুখ দিয়ে তো সারাদিন রসগোল্লা ঝরে ঝরে পড়ে। নিজের মুখ সারাক্ষণ পেঁচার মতো গোমরা করে রাখেন আর আসছেন আমাকে এসব বলতে?”
“ওহ হ্যালো, তোমার মুখ হবে পেঁচার মতো। গোল টোল একদম সেরকম।”
“পেঁচার মতো? আমার মুখ পেঁচার মতো। তাহলে আপনি চেহেরা মিলিয়ে নিয়েন দেখে একদম ব্যাঙ আর শেয়ালের মিশ্রণ।”
“আর তোমার মাথায় তো গোবরের সাথে ব্রেনের মিশ্রণটাও নেই। সম্পূর্ণ গোবর ভরা। তার কী?”
“এইসব আমার ডায়লগ। আপনি চুরি করলেন কেন? লজ্জা লাগে না? আরেকটা শব্দ বের করলে এই আঁচার সব আপনার মাথায় ঢেলে দিব তারপর বলতে পারবেন না আমি সতর্কবার্তা দেয় নি।”
“পারো তো এসব। ভালো কোনো গুণ তো নেই।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ নিজে তো কতগুণে গুণান্বিত। সারাক্ষণ শেয়ালের সরদারের মতো কান্ড করতে থাকে আমার সাথে। যত্তসব আমাকে খাটানোর বুদ্ধি।”

সৌমিতা আন্টি দুইজনের এমন ঝগড়া দেখে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “করছোটা কি তোমরা? এসব কী কথাবার্তা!”
ইনারা তার আঁচারের বয়াম নিয়ে উঠে সৌমিতা আন্টির কাছে যেয়ে বলে, “চলেন তো আন্টি। এখানে এক মুহূর্ত থাকলে এই আঁচারের বয়াম দিয়েই তার মাথা ফাটিয়ে দিব। উনার হঠাৎ কি হয় কে জানে এই ভালো, এই খারাপ।”
ইনারা সৌমিতা আন্টিকে নিয়ে যাবার সময় সভ্য বলে, “কোথায় যাচ্ছ?”
“জাহান্নামে। কেন এখানেও আসবেন?””
“না, একাই যাও। আর সাবধানে যেও।”
“আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও হবে।”
“তোমাকে নিয়ে চিন্তা কে করছে? জাহান্নামে যাবার পথে যারা তোমাকে দেখে ভয় পাবে তাদের জন্য চিন্তা হচ্ছে।”
ইনারা থেমে যায়। রাগে কটমট করতে করতে সভ্যের দিকে তাকিয়ে রাগে ক্ষোভে জোরে মেঝেতে লাথি মারলো। আবার সৌমিতা আন্টিকে বলল, “চলেন তো আন্টি।”

চলবে…..

অনুভবে
পর্ব-৩৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“ইশশ ছেলেটার সাথে এত ঝগড়া করলে কেন? এক আঁচার নিয়ে এত ঝগড়া করে মানুষ?” সৌমিতা আন্টি ইনারার পাশে বসে বলে। তারা বসে আছে ব্যাকইয়ার্ড-এ। আন্টি সবে যেয়ে ইনারার মা এবং তার একটি এলবাম নিয়ে এসে বসেছে। ইনারাও বলে, “আন্টি একদম ওই ব্যাঙের সাইড নিবেন না। কী বলল শুনলেন? আমাকে দেখে না’কি মানুষ ভয় পাবে। আমার মতো কিউট মেয়ের নামে এমন বদনাম করে। ভাবতে পারেন?”

সৌমিতা আন্টি হাসেন। ইনারার কথা থেকে তার মুখের ভাব বেশি মজার ছিলো তার কাছে। সে হেসে বলে,, “তুমি আর তোমার কথা! একদম আলাদা কিন্তু আমি সভ্যকে দেখে অবাক হলাম।”
“ওই ব্যাঙের ছাতার আবার কী হলো?”
“এসব বলে না। আমি অবাক হয়েছি কারণ এত বছরে অনেক পাল্টেছে ও। আগে কখনো ওর এমন ব্যবহার দেখি নি। জোহান, সামি এবং ঐশি অনেক দুষ্টুমি করতো। কিন্তু সভ্য এসবের মাঝে কখনো ছিলো না।”
“ধ্যুর এখনও নাই। ওই হনুমানটার মুখ সবসময় পেঁচার মতো ফুলিয়ে রাখে।”
“আহা এসব কি কথা! সভ্যের নামে কী বলছ এসব! ছেলেটার জন্য সারা দেশের মেয়ে পাগল আর তুমি তাকে হনুমান, পেঁচা বানিয়ে দিলে। একদম হ্যান্ডসাম আমার ছেলেটা।”
“এহ হয়েছে। দেশের মেয়েগুলোর টেস্ট খারাপ। এতে আর কী করার!”
কথাটা বলে ইনারা সোজা হয়ে বসল। তার মনে পরে গতকাল রাতের কথা। নেভি ব্লু রঙের স্যুট পরে ছিলো সে। তাকে অসম্ভব আকর্ষণীয় লাগছিলো। তার কথা মনে পড়তেই ইনারা নিজ অজান্তেই লজ্জা পেয়ে গেল।

সৌমিতা আন্টি এলবামটি খুলে বলল, “এই’যে সারু আর আমার ছবি। কত পুরনো ছবি! আজও ছবিগুলো দেখলে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে। কীভাবে আমরা একত্রে স্কুল জীবন পেরিয়েছি। কলেজ জীবন পাড় করেছি। দিনগুলোতে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। আজকালকার জীবন আধুনিক জীবনে তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। আর সে সম্পর্কগুলোর মাঝের শান্তিও।”

ইনারা এলবাম হাতে নিয়ে নম্র দৃষ্টিতে তাকায় ছবিগুলোর দিকে। তার মা’কে দেখে আবেগী হয়ে যায় সে। তার চোখ ভেজা হলেও ঠোঁটে হাসি আঁকা। সে মুচকি হেসে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আন্টি সময় বদলাতে পারে। সম্পর্কের মিষ্টি ভাবটা নয়। আমারও এমন দুইটা বন্ধু-বান্ধব আছে যাদের মাঝে আমি শান্তি খুঁজে পাই। সময় বদলে যেতে পারে কিন্তু মানুষের অনুভূতি তো বদলায় না। ইশশ আন্টি আপনারা কী সুন্দর ছিলেন!”
“বিশেষ করে তোমার মা। সকলে পাগল ছিলো ওর জন্য। তুমিও একদম তোমার মা’য়ের মতো হয়েছিস দেখতে। তোমার বাবা সবসময় চাইতো তুমি যেন দেখতে সারুর মতো হও। কিন্তু আবার ভয়ও পেত।”
“ভয় কেন?”
“সারু ওর সৌন্দর্যের জন্য যত ভালোবাসা পেয়েছে তার থেকে বেশি অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। তোমার বাবা কখনো চায় নি তুমি এমন কষ্ট সহ্য করো। তবুও চাইতেন তুমি যেন তোমার মা’য়ের ছায়া হও। তোমার বাবা অনেক ভালোবাসতেন সারুকে। আর তোমাকেও।” সৌমিতা আন্টি শক্ত করে হাত ধরলেন ইনারার। আবার বললেন, “কিন্তু তার থেকেও বেশি তোমাকে। তোমার মাঝে তার জান ছিলো। আমার এখনো মনে আছে, তোমার যখন একবছর পরে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিলে। অনেক বেশি ব্যাথা পাও নি। কিন্তু দুলাভাই ঘর মাথায় তুলে নিয়েছিলো। তিনটা ডাক্তার বাসায় এনেছিলো তোমাকে দেখার জন্য। সবাই জানাল তুমি ঠিকাছ। কিন্তু তার শান্তি নেই। সারু তো ত্যক্ত হয়ে উঠেছিলো। দুইজনের মাঝে তোমাকে নিয়ে যা খুনসুটি চলতো। তোমার বাবা একবার বাসায় এলে সহজে তোমাকে সারুর কাছে দিতোই না। সারাক্ষণ নিজের বুকের ভেতর ভরে রাখতো।”

কথাগুলো শুনে ইনারার ভালো লাগার কথা কিন্তু তার এসব কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বাবা তাকে এতটা ভালোবাসতো! তাহলে সে ভালোবাসা কেন মা’য়ের সাথেই হারিয়ে গেল? সেদিন কবে আসবে যখন তার বাবা আবারও তাকে সেভাবেই আপন করে নিবে। সেভাবেই ভালোবাসবে।

ভাবনার ঘোর ভাঙে তার যখন তার হাত থেকে এলবামটা টান দিয়ে নেয় সামি। সে সামির দিকে তাকায়। সামি চক্ষু দুটো বড় বড় করে বলে, “মামী এটা অভিনেত্রী সাইয়ারা না? মা বলেছিলো আপনারা দুইজন ভালো বান্ধবী ছিলেন কিন্তু আগে কখনো আপনাদের ছবি একত্রে দেখি নি। এতবছরে আপনি আমাদের দেখান নি, ইনারাকে একদিনে দেখাচ্ছেন? এটা কিন্তু ঠিক না।”
সৌমিতা আন্টি আড়চোখে তাকায় ইনারার দিকে। ইশারায় কিছু একটা বলে। ইনারা সামিকে উওর দেয়, “আরে পার্টনার আন্টির সাথে কথায় কথায় শুনলাম যে অভিনেত্রী সাইয়ারা উনার বান্ধবী ছিলেন। তাই আমিই জিজ্ঞেস করলাম কোনো ছবি আছে না’কি!”
ঐশিও সামির পাশে বসে এলবাম দেখতে শুরু করে। বলে, “আমার ঝাপসা দুই একটা স্মৃতি মনে পড়ে মাঝেমধ্যে। যখন বিদেশে যাই তখন অনেক ছোট ছিলাম তাই না মা?”
“হ্যাঁ।”

ঐশি কিছু একটা মনে করে একবার এলবামের দিকে তাকায়, আবার ইনারার দিকে তাকায়। সে হেসে বলে, “আরে ইনারা তোমাকে তো অনেকটা সাইয়ারা আন্টির মতো দেখায়। এতদিন খেয়াল করিনি। বিশেষ করে এখানে যে আন্টির কিশোরী দিনের ছবি আছে এর সাথে অনেকটা মিলে।”
কথাটা শুনে কাশি চলে আসে ইনারার। সে ঘাবড়ে যায়, “ব…বলেন কী? সে তো কত সুন্দর ছিলো। আর আমি কোথায়?”
জোহান পাশে এসে বসে ইনারার। বলে, “তুমি কোন অংশ দিয়ে কম সুন্দর? কেবল তোমার ড্রেসাপ চেঞ্জ করলেই দেশের কতগুলো অভিনেত্রী, মডেল তোমার কাছে পানিভাত। আমি তোমাকে বলতাম যে তোমার মডেলিং ট্রাই করা উচিত। তুমি চাইলে আমি আব্বুর সাথে কথা বলতে পারি। গতকাল তোমাকে পার্টিতে দেখার পর অনেকেই তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। আমাদের কোম্পানিতে যোগ করতে পারো।”

“ইনারার অভিনেত্রী হবার ইচ্ছা আছে, মডেল না।” সভ্য ইফরানের সাথে রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে। সে আরও যোগ করে, “এছাড়া ওর এখনো আঠারো বছরই হয় নি। ও প্রথমে নিজের দায়িত্ব নেওয়া শিখুক তারপর নাহয় ও নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিবে।”
“আপনার কি মনে হয় আমি নিজের দায়িত্ব নিতে পারি না?” ইনারা মুখ ফুলিয়ে বলে।
“এমনিতেই একটুখানি তুমি। ইন্দুরনীর মতো পিচ্চি। হাঁটতে গেলে এক মিনিটে দশবার নিচে পরো, সকালে কাজে আসতে হাজার বাহানা তোমার, নিজের একটাও কাজ করতে পারো না। আরও কোনো কিছু বলব?”
সামি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিড়বিড় করে বলে, “সভ্য দুই। জোহান এখনো শূন্য।”

ইনারা সভ্যের কথা শুনে দ্রুত উঠে বলে, “আন্টি আমি আঁচার রেখে আসছি। খাওয়া শেষ।”
“আরে কিছুই তো খেলে না। আসো আমি খাইয়ে দেই।”
ইনারা সভ্যের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই সভ্য তার মাথার ক্লিপ খুলে দেয়। সাথে সাথে ইনারার সোনালি আভার চুলগুলো পিঠ ছড়িয়ে গেল। সে বিরক্ত হয়ে তাকায় সভ্যের দিকে, “কী সমস্যা আপনার? আমাকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে আপনার? আপনি আসলে… আসলে একটা শয়তানের হাড্ডি। কেউ আমার চুলে হাত দেক, আমার পছন্দ না। আপনাকে দেখে নিব আমি।”
“ভালো করে দেখে নেও।”
“উফফ ধ্যুর ভাল্লাগে না আর।”
বিরক্ত হয়ে ইনারা বাচ্চাদের মতো কান্না করার ভাব করে সামির পাশে বসে পরে। সভ্য হাসে তার কান্ড দেখে।
সৌমিতা আন্টি বলে, “তুমি বসো আমি তোমার জন্য খাবার আনছি। খাইয়েও দিব।”

ঐশি সভ্যের হাসি দেখে চক্ষু কপালে তুলে নেয়, “ব্রো তুই এভাবে হাসছিস? কত বছর হলো তোকে এভাবে হাসতে দেখি নি। কী জাদু হলো?”
সামি উঠে দৌড়ে সভ্যের পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে, “ওরা কি জানে প্রেমের জাদু চলে গেছে তোর উপর।”
সভ্য তার পেটে কনুই মারে, “চুপ কর।”

ঐশি টেবিলে আরও এলবাম দেখতে পেয়ে একটা তার কোলে নিয়ে বসে। এটা তাদের অস্ট্রেলিয়া থাকার সময়ের এলবাম। এলবামটা দেখে তার ঠোঁটে একগাল হাসি এঁকে উঠে। সে বলে, “এটা কতদিন পর দেখলাম। দেখ দেখ সভ্য, আমি, জোহান ভাই সবাই আছি।”
ঐশি সভ্যের হাত ধরে তাকে জোহানের পাশে বসায়। তারপর এলবাম দেখিয়ে বলে, “দেখ ভাই এটা ছবিটা তখনের যখন প্রথম সভ্যের সাথে আমার দেখা করাতে এনেছিলে।”
“কিন্তু তুই এভাবে মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?”
“থাকব না? তুমি সভ্যের সামনে আমার কত মজা উড়িয়েছিলে। সভ্যের সাথে দেখা হবার প্রথমদিনই আমার সম্মানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলে। আমার সব মনে আছে।”
জোহান হাসে, “করব না? ওকে দেখতেই তুই যেভাবে হা করে তাকিয়ে ছিলি।”
“তো তখন সভ্য দেখতে এত কিউট ছিলো আমার কি দোষ?”

ঐশির মুখে সভ্যকে নিয়ে এ কথা শুনে ইনারা চোখ মুখ কুঁচকে নেয়, “কী ঢঙ! কিউট দেখে তার হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে।” ইনারা ভেংচি কেটে গালে হাত রেখে তাদের কথোপকথন শুনতে থাকলো।

সভ্য হেসে বলে, “জোহান আমাকে যেভাবে ধরে বেঁধে বাসায় এনেছিলো। আর আনতেই তোরা দুইজন ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিলি। দুইটাই কী পাগল ছিলি!”
জোহান কথার বিরোধ করে বলে, “একদম আমি ধরে বেঁধে আনি নি। নিজেও আসার জন্য মনে মনে লাফাচ্ছিলি। কিন্তু তোর মনের কথা তো মুখে আসবে না। তোর এটাটিউড কমে যেত না? তোকে রোবট থেকে মানুষ করতে আমার যে খাটুনি গেছে। আর সেদিন ওর মুখ দেখিস নি? মজা না উড়িয়ে উপায় ছিলো। আমার এখনো মনে পড়লে হাসি পায়। তুইও সেদিন ওর মুখ দেখে মিটিমিটি অনেক হেসেছিলি। একদম মিথ্যা বলবি না। নাইলে মিস্টার এলেক্সের সে বোরিং ভাষণ এখনো রেকর্ড করা আছে আমার কাছে। চেয়ারে বেঁধে শুনাব।”
“ভাই ওগুলো ভাষণ না, টর্চার। তোর মনে নেই একদিন ক্লাস বাঙ্ক মেরে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলি আমাকে। টানা তিনঘণ্টা কিসব শুনাল। আজও ভাবলে মাথা ঘুরায়।”
“এরপরেরদিন যে উনার সাথে কি করেছিলাম মনে নেই?”
“আমি ভুললেও উনার ভুলার উপায় নেই। আজও মনে হয় সেদিনের দুঃস্বপ্ন আসে উনার।”
দুইজনে কথার তালে হারিয়ে গেল পুরনো সে দিনে। হাসতে হাসতে দুইজনে হাই-ফাইভ দিতে নেয় তখনই থেমে যায়। কিছু অস্বস্তিকর ভাব ছড়িয়ে যায় আসেপাশে। তারা দুইজনে হাত সরিয়ে নেয়। দেখে আশেপাশের সকলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। জোহান সেখান থেকে উঠে যেতে নিলেই ইনারা দৌড়ে এসে সোফার সামনের টেবিলে এসে বসে। তার হাত ধরে একটানে তাকে বসায়। সভ্যের হাত ধরে দুইজনের হাত মিলিয়ে দিয়ে বলে, “আমিও এবার একটা ভাষণ দেই।”
গলা পরিষ্কার করে নেয় ইনারা, “হারিয়ে যাওয়া সময় ফিরে পাবার উপায় নেই। এই সময়গুলো চলে গেলেও হারিয়ে যাবে। তাই ছটফট করে রাগ অভিমান ভুলে নতুন করে পুরাতন বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনেন দেখি। কী আছে এই জীবনে?”

সভ্য কপাল কুঁচকে নেয়, “এতটুকু তোমার ভাষণ।”
“আবার জিগায়? এত গভীরতা সহকারে কথা ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।”
“আহারে কী প্রেশার গেল এতটুকু ব্রেনের উপর তাই না?”
“একদম।” হাফ ছাড়ে ইনারা। পরক্ষণেই সে বুঝতে পারে সভ্য মজা নিচ্ছে তার সাথে, “আপনি আমার মজা উড়াচ্ছেন?”
“না আমার এত সাহস! আপনার মতো মহাজ্ঞানী মানুষের সাথে আমি মজা করব?”
ইনারা কিছুক্ষণ একটানা বকতে চাইলো সভ্যকে। কিন্তু কি বলবে খুঁজে পেল না। সে বাচ্চাদের মতো হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আই হেইট ইউ এত্তগুলা।”

“জোহান…” ভারী কন্ঠ ভেসে এলো ব্যাকইয়ার্ড এর দরজা থেকে। ইনারা দেখে কন্ঠটা শোনার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল। সভ্য ছাড়া। সে পিছনে ফিরে দেখে মিঃ হক এসেছে। সে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। সালাম দেয় মিঃ হককে। কিন্তু তিনি সালামের উওর দেন না। উলটো ইনারার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়েই তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত যাচাই করল। আর মুখ বানিয়ে জোহানকে বলল, “এখনই আমার রুমে আসো।”
“জ্বি বাবা।”

জোহান যাবার পরপরই ঐশি উঠে দাঁড়ায়, “বাবা আসছে, আমি রুমে দৌড় দেই।”
সামিও উঠে দাঁড়ায়, “আমি মামীকে জানিয়ে আসি।”
সে যেতে নিয়ে আবার ফিরে আসে। সভ্য এবং ইনারাকে দুইজনকে একসাথে রেখে যাবার ভালো এক সময়। সে ইরফানকেও ধরে নিয়ে যায়।

ইনারা হতভম্ব। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে হতবাক হয়ে বলে, “সবাই ভূত দেখার মতো দৌড় দিলো কেন? আর আংকেল আমার দিকে এভাবে তাকাল কেন?”
সভ্য ছোট এক নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। সে জানে মিঃ হক কত ছোট মানসিকতার মানুষ। সে ইনারার ড্রেসাপ দেখে এভাবে তাকিয়েছিলো এবং জোহানকেও সম্ভবত একারণে ডেকেছে। কিন্তু এ কথা বলে তো ইনারাকে কষ্ট দিতে পারে না সে। তাই সে ইনারার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা আঁচার তার বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছে নিলো। আর বলল, “এভাবে খেয়েছ যেন শেষ না করলে অন্যকেউ ছিনিয়ে নিবে। রাক্ষসীর মতো কেউ খায়?”
“আপনার আজ কি হয়েছে বলুন তো। আমার ইজ্জতের বারোটা বাজাচ্ছেন কোন দুঃখে?”
“আমি কি করলাম?”
“এহ কিছু জানে না। আসার পর থেকে আমাকে পাগল করে ছেড়েছেন আর এখন মনে হয় ভাঁজা মাছ উলটে খেতে পারে না।”
“এখানে ভাঁজা মাছ কোথা থেকে এলো? আর তুমি…তুমিই বা কেন জোহানের সাথে এখানে এসেছ?”
“আমার ইচ্ছা আমি যেখানে যাই। আপনার থেকে পারমিশন নিতে হবে না’কি?”
“একদিনে তোমার জোহানের সাথে এত খাতির হয়ে গেল যে তার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছ!”
“আমি যার সাথেই ঘুরে বেড়াই আপনার জ্বলে কেন?”

সভ্য রাগে ভুল কিছু একটা বলে ফেলতে পারে। স্বীকার করে নিতে পারে ইনারার প্রতি তার অনুভূতি। কিন্তু এখন সঠিক সময় নয়। তাই সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু ইনারা তো এভাবে চুপ করার মানুষ না। সে আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হলো এখন মুখে রসগোল্লা ভরে বসে আছেন কেন? বলেন। আর আপনি চুলে আর হাত দিবেন না। এমনিতেই চুল বাঁধতে কত সময় লাগে। বিরক্তি লাগে।”
“একদম তোমার চুলগুলো নিয়ে খারাপ কিছু বলবে না।”
“বাহরে এখন আমার নিজের চুল নিয়েও আপনার থেকে জিজ্ঞেস করতে হবে?”
“একদম করতে হবে?”
“আর তা কোন দুঃখে?”

সভ্য এক’পা এগিয়ে আসে ইনারার দিকে। তার চোখে চোখ রেখে আলতো করে তার সামনের চুলগুলো তে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “কারণ তোমায় খোলা চুলে দেখলে আমার এক গানের পঙক্তি মনে পড়ে। তোমার খোলা কেশের জাদুতে আমার প্রাণ জুড়ে, তোমার মাঝে হারাই আমি বারে বারে।”
ইনারা চমকে উঠে। এই সামান্য কিছু শব্দ তার ভেতরটা উলট-পালট করে দেয়। ইনারার রাগ অভিমান মুহূর্তে গলে যায়।

সভ্য ইনারার পিছনে দাঁড়িয়ে তার কেশে হাত বুলায়। তার ঘন কেশের বাহার আটকানোর জন্য কাঁধে স্পর্শ করতেই ইনারা কেঁপে উঠে। তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। সে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়।অনুভব করে সভ্যের তার দিকে ঝুঁকে আসাটা। অনুভব করে তার উষ্ণ নিশ্বাস তার কাঁধে এসে ছুঁয়ে যাওয়াটা। অনুভব করে সভ্যের এত কাছে থাকাটা। অবশেষে সভ্যের শব্দের মুগ্ধতা ছড়ায় তার হৃদয়ে, “আমি দেখে মন ভরেছি। অন্যকারো দেখার প্রয়োজন নেই। সকলের প্রাণ তোমার কেশে জুড়লে তো সমস্যা।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে