অনুভবে
পর্ব-২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ইনারা বারবার পিছন দিকে তাকাচ্ছিলো। দেখছিলো রুমের ভেতর কেউ আসছে কি-না। সে সামনে সভ্যের দিকে তাকাতেই খেয়াল করে সে সভ্যের কাছে এসে পরেছে। একটু বেশিই কাছে। তার চোখ চোখ পড়ে তার। হয় প্রথম নয়নবন্ধন।
সাথে সাথে ইনারা পিছিয়ে যায়। নিজেই গলার স্বর উঁচু করে বলে, “আপনার লজ্জা লাগেনা? রুমে একটা মেয়ে থাকা সত্ত্বেও খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।” পরক্ষণেই সে আবার বিড়বিড় করে বলল, “ভবিষ্যতে যদি জোহানের সাথে আমার কিছু হয় তখন একথা জানলে কি ভাববে সে?”
“নিজে এসে আমার উপর চড়ে বসছিলে, আর এখন আমার উপর কথা বলছ। আর তোমাকে থাকতে কে বলেছে রুমে। তুমি ব্যাকস্টেজে কীভাবে আসলে? ভিআইপি পাস থাকলেও তো ভেতরে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করার আদব থাকে মানুষের। ভালো কথা, তোমার কাছে ভি-আই-পি পাস আছে তো?”
বিষয়টা এখন ইনারার বিপক্ষে যাচ্ছে। ইনারা মনে মনে বলে, “একদিকে সাইদ ভাইয়া, আর অন্যদিকে এই অসভ্য কাউয়া। তোর কোনো না কোনো তিকরাম লাগাতে হবে ইনু। কারও হাতে পরা যাবে না।”
ইনারা হঠাৎ কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, “আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন? কেউ একটা মেয়ের সাথে এমন রুক্ষ ভাবে কথা বলে। আমার কোমল হৃদয়টা…”
“তোমার কোমল হৃদয় মাই ফুট। তোমার মতো মেয়েদের অনেক দেখেছি। একবার দেখা করার জন্য সব জ্ঞান-বুদ্ধি ডাস্টবিনে ফেলে আসো। প্রাইভেসি শব্দটা হয়তো জীবনে শুনোও নি। ঠিকাছে তুমি আমার ফ্যান কিন্তু প্রাইভেসির খেয়াল তো রাখবে। তা নয়, বেহায়ার মতো রুমে ঢুকে আমাকে বলছ আমার লজ্জা নেই না’কি?” অনেকটা ধমক দিয়ে বলল সভ্য। কিন্তু ইনারা কম কিসের? সেও একই সুরে বলল, “ওহ প্লিজ নিজের ব্যাঙের মতো চেহেরা দেখছেন? আপনার পিছনে আমি পাগল হবো? অসভ্য একটা।”
“ইট’স সভ্য ওকে?” রুক্ষ গলায় বলে সভ্য, “আর তোমার ভি-আই-পি পাস দেখালে না? না’কি নেই?”
“থা-থাকবে না কেন? আমাকে দে-দেখতে কি মনে হয় আমি চোর? আমি চুরি করে এখানে আসবো?”
সভ্য ইনারার দিকে এগোল, “একদম মনে হয়।”
সভ্য যত এগোচ্ছিল ইনারা ততই পিছিয়ে যায়। একসময় ইনারার পিঠ ঠেকে যেন দরজায়। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সভ্যের শীতল দৃষ্টি দেখে তার গলায় যেন শব্দেরা জমাট বেঁধেছে।
সভ্য তার পকেটে হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে ইনারার মুখোমুখি হয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তীক্ষ্ণ হেসে বলে, “তুমি আমার সাথে দেখা করতে না আসলে এখানে কী করছ? হঠাৎ আমার রুমে? বাহিরে যার জন্য সিকিউরিটি ঘুরছে সে মানুষটা কী তুমি?”
“আপনি কী করে জানেন সিকিউরিটি পড়েছে কি-না?” “হাওয়ায় তীর মারলাম আরকি। লেগেও গেল। জানো কি তোমার ভাগ্য আজ কতটা খারাপ? অন্যকারো রুমে ঢুকলে বেঁচেও যেতে, কিন্তু আমার রুমে ঢুকে এতটা বেয়াদবি করার পর অসম্ভব। তুমি জানো সভ্যের সাথে এত বেয়াদবি করে কেউ কথা বলে রেহাই পায় না। এখন তুমিও পাবে না। জলদি আমাকে পাস দেখাও। এসে যদি তোমার শাস্তি খানিকটা কমে।”
ইনারা চিন্তা শেষ। এ কোথায় ফেঁসে গেল সে? সে মাথা নামিয়ে মিনমিনে গলায় বলে, “একটু দূরে যান। আমি দিচ্ছি।”
সভ্য দূরে যেতেই ইনারা ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে সভ্যকে দেয়। সভ্য কাগজটি হাতে নিয়ে বলে, “ভাবিনি আসলেই তোমার কাছে পাস থাকবে।” সে খাম খুলে কপাল কুঁচকে নেয়, “এখানে তো কিছু নেই।”
“জিনিবাবা পাস নিয়ে নিজের ল্যাম্পে ঘুমায়।” বলেই ইনারা দ্রুত দরজা পালাতে নেয় তখনই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। কিন্তু ইনারা দাঁড়ায় না। হাত ছাড়িয়ে চলে যায়। আর সভ্যের হাতে থেকে যায় কেবল ইনারার হাত থেকে বেরিয়ে আসা একটি রূপালী চুড়ি। সে চুড়িটি দেখে সভ্য বিরক্ত হয়ে বলে, “দোয়া করো কেবল যেন আর কখনো আমাদের দেখা না হয়, নয়তো-বা আজকের দিনটার জন্য সারাজীবন আফসোস করতে হবে তোমার।”
সভ্য চুড়িটি নিজের সোফার দিকে ছুঁড়ে ফেলে। শার্ট পরতে নিলেই আয়নায় তার চোখ পড়ে। নিজের মুখে হাত রেখে আয়নায় ভালো করে দেখে বলে, “কোন দিক থেকে আমার মুখ ব্যাঙের সাথে মিলে? নিশ্চিত মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে।”
ইনারা পালিয়ে কোনো একভাবে ব্যাকস্টেজের গেইটের কাছে এসে পড়েছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো প্রিয় এবং সুরভী। সেখানেই দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষা করছিলো তারা। তাকে দেখে সুরভী ছুটে আসে। পিছনে আসে প্রিয়ও। সুরভী জিজ্ঞেস করে, “তুই এখানে কি করছিস? জোহান তো বাহিরে সবাইকে অটোগ্রাফ দিচ্ছে। আর তুই হাপাচ্ছিস কেন?”
“ওই সাইদ ভাইয়া…সিকিউরিটি…মিস্টার অসভ্য… ”
“ভাই কি বলতে চাস সরাসরি বল। যা কইতাসোস আন্ডাও বুঝি না।” প্রিয় বলে।
“দাঁড়া নিশ্বাস নিয়ে নেই।” ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ওই আমি জোহানের রুমে ছিলাম না তখন সাঈদ ভাইয়া আমাকে দেখে নিয়েছিলো। এরপর ভি-আই-পি পাস চায়। না থাকায় সিকিউরিটি ডাকে। তাদের থেকে লুকানোর জন্য আমি ঢুকে পড়ি সভ্যের রুমে। সেখানেও তার সাথে একটু তর্কাতর্কি হয়ে যায়।”
“কী তুই সভ্য ভাইয়ের সাথে তর্কাতর্কি করছিস?” প্রিয় হতদম্ব হয়ে বলে। সুরভী বিরক্ত হয়ে তার মাথায় থাপড় মারে, “এখন এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, না সাইদ ভাইয়া ওকে দেখে নিয়েছে তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কোন গর্দভের জাতির সাথে ঘুরাঘুরি করি আমি?”
“ভাইয়া মেবি আমার চেহারা দেখে নি। ভালো করে দেখার পূর্বেই আমি মিলকা সিং এর মতো দৌড় মারছি।”
“আবারও সেভাবে দৌড় মারতে হবে।”
“পারতাম না। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আরাম করি একটু।”
“তোর আরাম হারাম করতে সিকিউরিটি কাকারা আসে। দৌড় মার।” বলেই প্রিয় দিলো এক দৌড়। ইনারা পিছনে ঘুরে সিকিউরিটিকে দেখে নিজেও দৌড় মারে। আবার সুরভির হাত ধরে বলে, “ব্রো তুই পালানোর জন্য ঈদের অপেক্ষা করতাসোস? তারা ধরতে পারলে টাকার না লাঠির বকশিস দিব।”
সুরভিকে নিয়ে আবার দৌড় দেয় সে। ইনারা যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে যাচ্ছিলো। আর বারবার পিছনে তাকাচ্ছিল সিকিউরিটির দিকে। এভাবে পিছনে তাকিয়ে দৌঁড়ানোর কারণে দরজার কাছে আসতেই হঠাৎ কেউ একজন তার হাত ধরে তাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে কাছে টেনে নেওয়ায়।জোহান তাকে ধরে আছে। জোহানকে একটা কাছাকাছি দেখার পর কিছু সময়ের জন্য যেন হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সে জগৎ ভুলে সেখানেই হারিয়ে গেল। আশেপাশে এত ঝামেলা চলছে, একবার ধরা খেলে সে যে কত বড় সমস্যায় পড়তে পারে তা সব ভুলে গেল। তার মস্তিষ্কে কেবল একটি নামই ঘুরছে, জোহান, জোহান এবং জোহান।
জোহান অটোগ্রাফ দিয়ে ভিতরে ঢুকে ছিলো এবং ব্রেকের পরের এন্ট্রি নিয়ে কথা বলছিল তার স্টাফের সাথে। হঠ্যাৎ সে দেখে একটি মেয়ে দ্রুত দৌড়ে আসছে। পিছনে তাকাচ্ছে বারবার। সে দেখলো মেয়েটা সামনে অনেকগুলো বড় স্টিলের বাক্স রাখা। মেয়েটা যেভাবে না দেখে দৌড়ে যাচ্ছে নিশ্চিত এগুলো যেয়ে ধাক্কা লাগতে পারে তার। আর তা হলে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। জোহান দ্রুত যেয়ে মেয়েটার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। মেয়েটার চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। সে কাজল মাখা দৃষ্টি দেখে এক মুহূর্তের জন্যও চমকে যায় জোহান। মৃদু আলোর মাঝে মেয়েটার যতটুকু দেখা পেয়েছে সে, ততটুকুকেই মোহিত হয় সে। সাদা পোশাকে শুভ্র পুষ্পের ন্যায় দেখাচ্ছিলো মেয়েটাকে। এত সুন্দর এবং মার্জিত মেয়ে খুব কম দেখেছে সে। বাহিরের এত শব্দের মাঝেও যেন মেয়েটার সৌন্দর্যে কিছু মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেল সে।
সুরভি এগিয়ে যেয়ে দেখে ইনারা আশেপাশে নেই। সে প্রিয়কে ধরে বলে, “ওই ঝামেলার ম্যাগনেট আবার কই গেল?”
“কীসের কী?”
“ইনু। ওই মেয়ে যেখানে থাকে সেখানে ঝামেলা থাকবেই।”
“আবার কই গেল মেয়েটা? শুন তুই নড়বি না। আমি ওকে নিয়ে আসি।”
প্রিয় আবার ভেতরে ঢুকেই দেখে ইনারাকে। সে জোহানের সাথে। তার পিছনেই সিকিউরিটির লোকেরা আসছে। সে বিড়বিড় করে বলে, “এই মেয়ে জোহানের সাথে দেখা করার জন্য এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়লো।”
সে দৌড়ে যেয়ে ইনারার হাত ধরে বলল, “গাঁধি একদিন নিজেও মরবি, আমাদেরও মারবি।” বলেই সে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগে।
ইনারা হতদ্ম্ব। কি হচ্ছে সে বুঝে উঠতে পারছে না। তার এই মুহূর্তটা একটা স্বপ্নের মতো লাগছে। সুন্দর স্বপ্ন। সে আসলেই জোহানের দেখা পেয়েছে? নিশ্চিত হবার জন্য সে আবারও পিছনে তাকায়। জোহানকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। তখনই সিকিউরিটিকে বলতে শুনে, “এদের ধরো, এরা অবৈধভাবে ঢুকেছে।”
ইনারা দাঁড়াতে চেয়েও আর দাঁড়ায় না। আরেকটিবার জোহানের দিকে তাকিয়ে প্রিয়’র সাথে কনসার্টের ভেতর চলে যায়। হারিয়ে যায় ভিড়ের মাঝে
জোহান সিকিউরিটিকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে মেয়েটার পিছনে যাচ্ছ কেন?”
“স্যার সাইদ স্যার বলেছে। আপনার রুমে ছিলো, তাও ভি-আই-পি পাস ছাড়া। স্যার পাস চাওয়ার পর এমন দৌড় দিলো। তাকে খুঁজতে খুঁজতে আমরাই হয়রান হয়ে গেলাম।”
জোহান হাসে খানিকটা। দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, “ভালোমতো খোঁজো। পেলে সোজা আমার কাছে নিয়ে আসবে। আর এই ব্যাপারে অন্যকাওকে জানানোর প্রয়োজন নেই। ওকে?”
“আপনি যা বলেন স্যার।”
সিকিউরিটি যাবার পর তার স্টাফের ছেলেটা জোহানকে জিজ্ঞেস করে, “স্যার আপনি অন্যকাওকে জানানোর জন্য না করলেন কেন? পাস ছাড়া কেউ ঢুকলে তাকে শাস্তি বা জরিমানা দেওয়া তো বাধ্যতামূলক। যেন ভবিষ্যতে এমন না হয়।”
জোহান সাথে সাথে উওর দিলো না। সে নিজের রুমে যেয়ে আরামে বসে তাকে জিজ্ঞেস করে, “মেয়েটা দেখতে কেমন?”
“হুঁ? আমি ভালো করে দেখতে পারি নি। একতো তার মুখ অন্যদিকে ছিলো, এর উপর আলোও তেমন ছিলো না। এত হাল্কা আলোতে কীভাবে দেখবো?”
” আমি দেখেছি। অসম্ভব সুন্দর সে। এমন রূপসীকে শাস্তি দেবার ভাবনাটাও অনুচিত। জানো, এমন নয় যে এমন রূপসী আমি আর জীবনে দেখি নি। অনেক দেখেছি। কিন্তু ওর মধ্যে অন্যরকম আকর্ষণ ছিলো। এমন আকর্ষণ আমি সহজে অনুভব করি না। তুমি কনসার্টে যাও। প্রয়োজনে সে সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলো। মেয়েটাকে আমি আবারও দেখতে চাই।”
“কিন্তু স্যার, হাজার হাজার মানুষ এসেছে। এদের মধ্যে কীভাবে খুঁজে পেয়ে পারি।”
জোহানের হাসিমুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সে কঠিন দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেটা তোমার কাজ। জোহান হকের না শোনার অভ্যাস নেই। আমার যা চাই, তা চাই। তা তুমি কীভাবে আনবে তা তোমার ব্যাপার। না পারলে তোমার জায়গায় নতুন কেউ চাকরি পেতে পারে, ব্যাপার না।”
চলবে…..
অনুভবে
পর্ব-৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
জোহানের হাসিমুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সে কঠিন দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেটা তোমার কাজ। জোহান হকের না শোনার অভ্যাস নেই। আমার যা চাই, তা চাই। তা তুমি কীভাবে আনবে তা তোমার ব্যাপার। না পারলে তোমার জায়গায় নতুন কেউ চাকরি পেতে পারে, ব্যাপার না।”
ছেলেটা এক ঢোক গিলে জোহানের কথায়। ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “আমি এখনই যাচ্ছি স্যার।”
.
.
সুরভী এবং ইনারা বাসায় এসে পড়ে জলদিই। ঘটনাটা ঘটার পরপরই কনসার্ট থেকে বেরিয়ে এসেছিল তারা। বাসায় জলদি আসার কারণে পরে আরেক বিপদে। তারা এক বান্ধবীর বিয়ের মিথ্যা কথা বলে বেরিয়েছিলো। জলদি আসায় হলো নানান জিজ্ঞাসাবাদ। ইনারার মাথা ব্যাথার কথা বলে তারা বেঁচে যায়। রুমে এসে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে শান্তির নিশ্বাস ফেলে দুইজন। সুরভী বলে, “একটুর জন্য বাঁচলাম আজ।”
“সব ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে ধরে বেঁধে কেন এত জলদি নিয়ে এলি? আমি আমার জোহানের গানও ভালো মতো শুনতে পারলাম না। কেশকন্যা, নীরব শহর, পাখি, আরও কত গান বাকি ছিলো। আমার সেকেন্ড ফেভারিট গান প্রেম নিবেদনও ছিলো।”
“তোর প্রেম নিবেদন হয়তো জেলে পাইতি, নয়তো লাঠি দিয়ে পিঠে। ছাগলের মহারাণী জীবন না থাকলে এই জোহান টোহান দিয়ে কী করবা?”
“ওই তোর দুলাভাই লাগে, সম্মান দিয়ে কথা বল।”
“ভাই সে তোকে মনেও রাখে নি। আর তুই বিয়ের স্বপ্ন সাজিয়ে বসে আছিস।”
“যখনই মুখ খুলবি অশুভ কথাই বের করবি।” ইনারা ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেয়ে তার গয়না খুলতে খুলতে বলল। সে আরও যোগ করে, “তুই তো তার মন এবং মস্তিষ্কে ঢুকে দেখে আসছিস।”
“এটা সাধারণ বিষয়। সে চাইলেই তোর খোঁজ নিতে পারতো। পারতো না?”
“বিরক্ত করিস না তো। আজ এমনিতেই আমি অনেক খুশি। জোহানকে এত কাছের থেকে দেখেছি আমি। সে আমার এতটা কাছে ছিলো। হায়, আমার হার্টবিট বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো যেন।”
“এটাই সারাজীবনের সান্ত্বনা হিসেবে রাখ।”
ইনারা ভেংচি কেটে আবারও তার আয়নায় তাকিয়ে নিজের গহনা খুলতে খুলতে বলল, “ও ভালো আব্বা আসছিলো আজ বাসায়। একটুখানি তর্কাতর্কি হবার পর সে আমাকে বলে, সে আমাকে আর কোনো হাতখরচ দিবে না। এমনকি ভার্সিটির খরচও না। একটা চাকরি খুঁজতে হবে।”
“কী? কিন্তু কেন?”
“আরে সে টাকা নিয়ে দেমাগ দেখাচ্ছিলো। বস্তির মানুষদের নিয়ে, আমার বন্ধুদের নিয়ে বাজে কথা বলেছে। এমনকি খালাজানের সাথে বেয়াদবি করে কথা বলছিলো। আমি উল্টো কথা বলায় তার গায়ে লাগলো আরকি। অহংকারে দাগ তো আর সে সহ্য করতে পারে না।”
“তুইও না! আংকেল এতমাস পর একদিন আসে কই একটু ভালোমতো গল্প করবি, উল্টো ঝগড়া করে আসিস।”
“যা সঠিক আমি তাই বলব। সামনে যে-ই হোক না কেন।”
“তুই যে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চেয়েছিলি তার ভর্তির জন্য অনেক টাকা লাগবে। কোন চাকরিতে এত টাকা পাবি তুই।”
“আরে ভার্সিটি মেটার করে না। পড়া ভালো হলেই হলো। তোর সাথেই ভর্তি হব নে।”
“কিন্তু তার টাকা কোথায় পাবি? আঠারো বছরও হয় নি তোর। এ বয়সে কোথায় ভালো চাকরি পাবি তুই?”
“সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। এখনো ভার্সিটির ভর্তির দুই তিনমাস বাকি। আমার থেকে বেশি তুই চিন্তা করছিস দেখি। কোনো চাকরি আছে না’কি সাঈদ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করিস তো। প্রিয়কেও তো উনিই চাকরি দিলো।”
আয়নাতে ইনারা খেয়াল করে সুরভির মুখের প্রতিক্রিয়া কেমন অন্যরকম। সে বিছানায় যেয়ে লাফিয়ে উঠে। সুরভির সামনে বসে সরু দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে, “তুই কি লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে?”
“আ..আমি? কোথা..য় না তো।”
ইনারার সন্দেহ বাড়ে। সে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, “এখন আমি নিশ্চিত কিছু একটা ঝামেলা আছে। সত্যি করে বল।”
“তুই-ই তো একটা ঝামেলা।”
“সুরভী…।”
সুরভী হার মেনে যায় সহজেই। সে জানে ইনারার কাছ থেকে কোনো কিছু লুকানো তার পক্ষে সম্ভব না। সে জোর করে হেসে বিনতি সুরে বলে, “প্লিজ মা আমাকে আর ফাঁসাবি না।”
“উফফ ঢঙ না করে বল তো।”
“আমি সাইদ ভাইয়াকে ফোনে কথা বলতে শুনেছিলাম একটা চাকরি নিয়ে।”
“কী চাকরি?”
“ফাইভ মেলোডির পার্সোনাল এসিস্ট্যান্টের জন্য।”
ইনারা পাশের থেকে বালিশ নিয়ে জোরে মারে সুরভির মুখে, “আর তুই আমাকে এখন বলছিস?”
“ভাই তুই এখন ভুলেই যা। তুই না’কি আজ সভ্যের সাথে ঝগড়া করে আসছিস। সে টিম লিডার, তোকে চাকরিতে রাখবে বলে মনে হয়? উল্টো আরও ঝামেলায় ফাঁসবি।”
“আমার জোহানের জন্য আমি শত ঝামেলা পাড় করে নিব। একবার ভাব, চাকরিটা হয়ে গেলে আমি সারাক্ষণ জোহানের সাথে থাকতে পারবো। ভেবেই তো আমার খুশিতে নাচতে মন চাচ্ছে।”
“ভাইয়া প্রিয়কে কোম্পানিতে চাকরি দেয় নি তোর ভয়ে। আর তোকে ওদের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে দিবে? ভুলে যা। ঝামেলার কারখানা তুই একটা। ভাইয়া তোকে কখনো চাকরিটা দিবে না। আর আমি ভাইয়াকে বলতে পারবো না। একতো মানবে না, এর উপর বকা খাব আলাদা।”
“তোকে মানাতে বলসে কে? আমার কাছে হুকুমের এক্কা আছে।”
“মানে?”
ইনারা উত্তর দেয় না। সে সোজা ফোন বের করে কল দেয় কাওকে। কিছুক্ষণ পর কল রিসিভ করে ফোনেট ওপাশ থেকে একটি ঘুমন্ত কন্ঠ ভেসে আসে,
“হ্যালো ইনু, এত রাতে কল দিচ্ছিস যে? সব ঠিক আছে?”
“আইজা আপি প্লিজ আমার একটা কাজ করবে? কেবল তুমিই পারবে। প্লিজ আপু, প্লিজ।”
“আচ্ছা আচ্ছা বল তো কি নিয়ে?”
“আগে প্রমিজ করো বাসায় কাওকে জানাবে না। কেবল তুমি আর আমি জানবো।”
“ঠিকাছে বাবা, ওয়াদা করছি।”
ইনারা চাকরির সব ব্যাপার খুলে বলল আইজাকে। সবটা শুনে আইজা বলে, “তাহলে আমি কীভাবে সাইদকে মানাতে পারি?”
“কারণ সে তোমার পিছনে লাটিমের মতো ঘুরঘুর করে। তুমি একবার মিষ্টি করে বললে আমার কাজ হয়ে যাবে।”
আইজা অনেকসময় কিছু বলে না। তারপর নরমসুরে উওর দেয়, “আচ্ছা, বলে দেখব।”
“ইশশ আপু এত লজ্জা পাওয়া লাগবে না।”
“আমি লজ্জা পাচ্ছি না।”
“তুমি লজ্জা পাচ্ছিলে। তার কারণেই এতক্ষণ চুপ করে ছিলে।”
“বেশি বুঝিস তুই। আমি ফোন রাখছি, ঘুম পাচ্ছে।”
বলেই আইজা ফোন রেখে দেয়। আর ইনারা বিছানার উপর উঠেই লাফাতে শুরু করে, “কাল পুরশুর মধ্যে আমার কাজ হয়ে যাবে।”
সুরভি মাথায় হাত রেখে বলে, “এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি কি করব?”
ইনারা সুরভীর হাত ধরে তাকেও নিজের সাথে নাচাতে থাকে।
.
.
“তোমাকে চাকরিটার কথা বলল কে?” সাইদ তার পাশে বসা ইনারাকে জিজ্ঞেস করে। সাইদ গাড়ি চালাচ্ছে এবং ইনারা চুপচাপ বসে আছে। যেন সে কথাই বলতে জানে না। সে মৃদুস্বরে চলে, “চাকরিটার কথা? আপনাকে ফোনে কথা বলতে শুনেছিলাম ভাইয়া।”
“আমাকে কী পাগল মনে মনে হয় যে তোমার সামনে আমি চাকরির কথা বলবো? সুরভী বলেছ তাই না?”
ইনারার ব্যবহার যেন মুহূর্তে পাল্টে গেল। সে গলা চড়িয়ে বলে, “বলেছে তো কী করবেন? একদম আইজা আপুকে কল করে বলে দিব।”
“কথায় কথায় আইজাকে কেন টেনে আনো। আমি কী বলেছি না’কি সুরভীকে কিছু বলব? আচ্ছা একটা কথা বলো, তুমি শিউর তো দুইদিন পূর্বে তোমরা বান্ধবীর বিয়েতে গেছ?”
“এখন আমার বিয়ের জন্য তো জোহানকে লাগবে। সে তো নেই। বান্ধবীর বিয়ে খেয়েই শখ মেটাই।”
সাইদ বিরক্তির নিশ্বাস বিড়বিড় করে বলে, “না ইনারা কোনো দিক থেকেই সেদিনের সাদা ড্রেস পরা মেয়েটা হতে পারে না। জোহান কখনো ওর মতো মেয়েকে তো পছন্দ করবে না। যাস্ট ইম্পসিবল। আমিই ভুল দেখেছি মনে হয়।”
“কী বিড়বিড় করছেন?” ইনারা ব্যাগ থেকে চিপ্সের প্যাকেট বের করে খেতে শুরু করে। মুখে খাবার নিয়েই কথাটা জিজ্ঞেস করে সে। খাচ্ছে কম, তার পরা হুডিতে ভরাচ্ছে বেশি। তা দেখে সাইদ বিরক্ত হয়ে বলল, “এভাবে কেউ চাকরির জন্য কথা বলতে যায়? সুন্দর করে মার্জিত হয়ে তো আসবে। কে বলবে তুমি আইজার বোন?”
“বলা লাগবে কেন? আমি তো তার বোনই।”
“শুনো জোহানকে দেখে লাফাবে না একদম। আর সেখানে যেয়ে ভালো ব্যবহার করবে, নাহয় আমি এরপর আর কিছু করতে পারবো না। বিশেষ করে সভ্য একবার মানা করলে আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব না।”
সভ্যের কথা শুনে ইনারা খাওয়া থামিয়ে দেয়। ভয়ে তাকায় সাইদের দিকে। ঢোক গিলে। সভ্য থেকে বাঁচার জন্য সে চশমা এবং ক্যাপ পরেছে। এখন সে তাকে না চিনতে পারলেই হলো। দৈনিক সে এত মানুষকে দেখে তাকে কি মনে রাখবে সে?
সাইদ গাড়ি পার্ক করে ইনারাকে নিয়ে যায় কোম্পানির ভেতর। ইনারা হতভম্ব। এমন বড় অফিস যে আগে দেখে নি। আর বাচ্চাদের মতো উৎসুক হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ করেই কারও সাথে ধাক্কা লাগে তার।
“ওই কোন বেয়াদব রে?” ইনারা বিরক্ত হয়ে মুখ তুলে তাকায়। কেউ একজন কালো জ্যাকেট পরা লম্বাটে লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। পিঠ করে। পিছনে ফিরতেই দেখতে পায় সভ্যকে। চাতক পাখির মতো তার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ নামিয়ে নিলো সে। নিজের ক্যাপ দিয়ে মুখ ঢাকার যথেষ্ট চেষ্টা করবে থাকে।
সাইদ চোখ রাঙিয়ে বলে, “ইনু এটা কীভাবে কথা বলছো?” তারপর সে সভ্যকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার সভ্য? আজ তোমার দেরি হলো? এ-তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।”
সভ্য তখনও সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ইনারার দিকে। তাকে ভালো করে দেখবার চেষ্টা করছিলো। সে কথা কঠিন গলাতেই উওর দিলো, “আমি সময়েই এসেছি। ক্যান্টিনে জুস নিতে গিয়েছিলাম।”
লিফট এলো। সবাই লিফটে উঠে। সাইদ একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। সভ্য কেবল শুনছে, কোনো উওর দিচ্ছে না। বিরক্ত হয় সে। এই মুহূর্তে তার ধ্যান কেবল তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। তাকে ভালো করে দেখার উপর। কিন্তু মেয়েটা যত পারছে তার মুখ লুকাচ্ছে। এতে তার সন্দেহ আরও বাড়ছে। কিন্তু সে কিছু বলে না। লিফট অষ্টম তলায় এসে থামতেই বেরিয়ে যায়। পিছনে সাইদও ইনারাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। সভ্যের পিছনে যায় রিহার্সাল রুমে।
সভ্য রুমে ঢুকে দেখে সামি এবং ঐশি গল্প করছে। আর ইরফান রুমের এককোণে বসে লিখছে।
“খুব ভালো রিহার্সাল চলছে দেখছি।”
সামি এবং ঐশি সভ্যের কন্ঠ শুনে সতর্ক হয়ে যায়। ঐশি ডায়েরি হাতে নিয়ে বলে, “আমরা তো পঙক্তি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তাই না সামি?”
“তো আর কি? এবার তো গান বের করে তুফান এনে দিব আমরা।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে সামিকে জুস দিয়ে নিজে অন্য সোফায় যেয়ে বসে। ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “বয়স কত?”
ইনারা থতমত খেয়ে যায়। আসতে প্রথমে কি এই প্রশ্ন করে কেউ?
“স-সতেরো। দুইমাসে আঠারোতে পরবে।”
সভ্য আড়চোখে তাকায় সাইদের দিকে, “এক পিচ্চি কে নিয়ে এসেছ কাজ করার জন্য?”
“এহ আমি পিচ্চি না।” ইনারা উচ্চ স্বরে বলে নিজেই বলে নিজেই জিহ্বায় কামড় দিলো। ইরফান রুমের অন্যকোণের থেকে বলে, “হয়তো কোনো প্রয়োজনে কাজ খুঁজতে হচ্ছে। কেউ তো আর বিনা প্রয়োজনে কাজ খুঁজতে আসে না।”
সামি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়, “কি বলিস এসব? প্রতিদিন কতজনে চাকরির জন্য আসে। কেবল আমাদের সাথে থাকবে বলে। আর সভ্য তাদের রিজেক্ট করে।” সে আবার ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “তো বলো আমাদের মাঝে কে তোমার সবচেয়ে পছন্দের।”
সাইদ ইনারার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, “সভ্যের নাম নেও।”
“ছিঃ! আমি অসভ্য নাম কেন নিব? আমি তো কেবল জোহানকে পছন্দ করি।”
“চাকরিটা সভ্যই কিন্তু দিবে।”
ইনারা সাথে সাথে হাসিমুখে উওর দিলো, “সভ্য।”
সভ্য তীক্ষ্ণ হাসে। প্রশ্ন করে, “তাই তাহলে আমার পছন্দের মিষ্টি কী?”
“মিষ্টি? উমম… সন্দেশ?”
“না।”
“চমচম।”
“আমার কোনো রকম মিষ্টি খাবারই সহ্য হয় না।”
“এইজন্যই মুখ দিয়ে কেবল কটু কথা বের হয়।” ইনারা কথাটা আস্তে বলতে চেয়েও পারলো না। বলার পর তার তা খেয়াল হলো। সামি এবং ঐশি কথাটা শুনেই ফিক করে হেসে দেয়। সাইদ নিজের কপালে হাত রেখে বলে, “নিজে তো চাকরি পাবেই না। আমার চাকরিটা উল্টো যাবে।”
সভ্য উঠে আসে ইনারার কাছে। সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “সাইদ যে সবে তোমায় শেখালো তা না, সত্যি বলো।”
“জোহান আমার পছন্দের এবং আপনাকে আমার দুই চোখে সহ্য হয় না।”
“চাকরিটা তোমার। কাল থেকেই জয়েন করতে পারো।”
“কী?” সকলে একসাথে বলে উঠে। কেবল ইরফান ছাড়া। সে এখনো রুমের এককোণে বসে তার কাজ করছে। ঐশি বলল, “এতটুকুই জিজ্ঞেস করার ছিলো তোর?”
“এখন সাইদ তো কোনো চোর ডাকাত নিয়ে আসবে না চাকরির জন্য তাই না? আর ওর কাজ কি? আমাদের সব কথা মানা, আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস এনে দেওয়া এবং সিডিউল মনে করিয়ে দেওয়া। এর জন্য আবার কীসের ডিগ্রি লাগবে?”
“তাহলে তুই ওর আসার আগে এতজনকে মানা করলি কেন?”
“কারণ আমি তাদের ফেভারিট ছিলাম। দেখেই লাফাতো। ওরা সারাক্ষণ আমার মাথা খেয়ে ফেলতো। প্রশংসা করতো। কাজের মাঝেও ডিস্টার্ব করতো। এ-সব অসহ্যকর। ও আমাকে পছন্দ করে না তাই ওকে চাকরিটা দিলাম। শেষ।”
“তোর এতটুকুই লাগতো?”
“হ্যাঁ।”
সাইদ বলে, “আমি তাহলে এখনই যেয়ে ওর কথা ডিপার্টমেন্টে জানিয়ে আসি আর বাকি কাজগুলোও শেষ করে আসছি।”
ইনারা এখনো হা করে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে তার সাথে। সে এত সহজে চাকরিটা পেয়ে যাবে কল্পনাও করে নি। সামি তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করায় তার ঘোর ভাঙে, “আচ্ছা তুমি সভ্যের চোখে চোখ রেখে কীভাবে বলতে পারলে সে তোমার অপছন্দ? ছয় বছর ধরে ওকে চিনি, এত সাহস তো আমারও নেই।”
“এতে সমস্যার কী আছে? তার দিকে তাকাবেন, ফুরুৎ করে বলে দিবেন।”
সামি গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে, “তাকাও একবার এই মহান পুরুষটার দিকে। তোমার কথা শুনে যদি মনে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে কাঁচা গিলে খাবে। ভূতেরাও ভয় পেয়ে লাফায় পালাবে এভাবে তাকায়। আর তোমার ভয় লাগে নি কীভাবে সম্ভব?”
“আপনি মাত্র তাকে মহান পুরুষ বলে তার ইজ্জত মেরে দিলেন।” ইনারা হেসে সামিকে হাই-ফাই দিলো। সামিও তার গম্ভীরভাব ছেড়ে ইনারার সাথে তার মতো করে কথা বলা শুরু করে, “আমি সবসময় এমনই করি। সরাসরি বলে কে সাপের সামনে যেয়ে নাগিন ডান্স করবে?”
“ধ্যুর ওই অসভ্যের কথা বাদ দেন। আপনাকে আমার ভালো লাগছে। জোহানের পর আপনিই এখন আমার ফেভারিট।”
“অসভ্য! ওহ সভ্যের নাম অসভ্য? আরে ব্যাপারটা তো এত বছরেও মাথায় আসে নি। ঐশি দেখ ও কত অস্থির নাম….” ঐশির দিকে তাকাতে যেয়ে সামির চোখ যায় সভ্যের উপর। তার ধ্যানই ছিলো না সভ্য এই রুমে। সভ্য গিটার হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তার তাকানো দেখেই সামি’র গলা শুকিয়ে গেল। সে তার ব্যাগ নিয়ে বলল, “আমা…আমাকে শহিদ ভাই ডাকছিলো। ঐশি আমার সাথে আয়।”
সামি ঐশির হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতে শুরু করে। তখনই ঐশি বলে, “পরে হলেও শাস্তি তো পাবিই। পালিয়ে লাভ কী?”
“এখন সামনে থাকলে আসলেই কাঁচা খেয়ে ফেলবে।”
ইরফানও মৃদু হেসে উঠে, “আমি ওদের দেখে আসি।”
এই মুহূর্তে কক্ষে কেবল আছে ইনারা এবং সভ্য। ইনারারও এখন হাল্কা ভয় লাগতে শুরু করে। সে এক হাতের আঙুল দিকে অন্যহাতের আঙুল দিয়ে খেলছিলো।
বিড়বিড় করে বলল, “ইনুর বাচ্চা মুখে তোর কিছু আটকায় না তাই না? উনি তো ব্যান্ড-মেট উনাকে রাগ দেখিয়ে ছেড়ে দিবে। তোকে তো চাকরি থেকে ছুঁ মন্তর করে দিবে। এর আগেই তুই-ই ছুঁ মন্তর হয়ে যা।”
আমতা-আমতা করে বলে, “আ-আমিও সাইদ ভাইয়ার কাছে যাই।”
সে দৌড়ে যেতে নেয়। দরজা পর্যন্ত যেতেই সভ্য বলে, “কোথায় যাচ্ছ? কাজ করবে ঠিকই কিন্তু কখন করবে, কীভাবে করবে জানবে না? এদিকে আসো।”
ইনারা না চাওয়া সত্ত্বেও সভ্যের সামনে যায়। সভ্য একটিট ডায়েরির পৃষ্ঠায় কিছু লিখে ইনারাকে দেয়, “আগামীকাল এই জায়গায় সময়মতো এসে পরবে।”
“সকাল সাড়ে ছয়টা? এসময় তো মুরগীরাও কুকুরুক্কু করে না? আমার তো ঘুমাতে যাওয়ার সময়। আর পাশে জিম কেন লেখা? কোন ছাগলে সকাল ছয়টা উঠে জিমে যায়?”
“এখন তুমি তো আমাকে সেদিন শার্টলেস দেখেছিলে।এত ভালো ভিউ পেলে তুমি। এই বডি বানানোর জন্য পরিশ্রমও করতে হয়।”
ইনারার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। তার গাল দুটোও লালচে হয়ে যায় সেদিনের কথা ভেবে। সে ঢোক গিলে তাকায় সভ্যের দিকে, “মানে আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?”
সভ্য ইনারার ক্যাপটা খুলতেই ইনারার পিঠ ছড়িয়ে গেল তার স্বর্ণোজ্জ্বল কেশ। সভ্য হঠাৎ করে তার দিকে এগিয়ে আসতেই খানিকটা ঘাবড়ে যায় ইনারা। সে-ও পিছনের দিকে ঝুঁকে বলে, “আর আপনি কি করছেন?”
সভ্য ইনারার পিঠে হাত রেখে তাকে থামায়। ঝুঁকে তার কানের কাছে মুখ নিতেই যেন জমে যায় ইনারা। স্থির হয়ে যায়। সভ্য বলে, “তুমি আসলেই ভেবেছিলে কেবল চশমা এবং ক্যাপ পরলে আমি তোমায় চিনতে পারবো না? সেদিন আমি বলেছিলাম না, সভ্যের সাথে বেয়াদবির পরিণাম ভীষণ খারাপ হয়। চাকরিটা তো তুমি পেয়ে গেছ কিন্তু বুঝেশুনে করবার সিদ্ধান্ত নিও, নাহয় পরে অনুতাপ করলেও পরিবর্তন করতে পারবে না। আজকেই নিজের শান্তিকে বিদায় জানিয়ে রেখো। সভ্যের সাথে বেয়াদবি করে কেউ এত সহজে ছাড় পায় না। আর তা তুমি খুব জলদিই বুঝে যাবে।”
চলবে…..