অনিয়ন্ত্রিত মন পর্ব-০৬

0
970

#অনিয়ন্ত্রিত_মন
#jannat_Nur
#ষষ্ঠ_পর্ব

নতুন বউকে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী সবাই দেখতে আসলো। মরিয়মকে চোখের পানি লুকিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে হচ্ছে সবার সঙ্গে। মরিয়মের অনেক কষ্ট হচ্ছে সন্তানের জন্য তবুও কষ্ট লুকাতে হচ্ছে হাসির আড়ালে। কখন রাতটা পার হবে আর কখন সে তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিবে এই ভাবনা তার মনের ভেতর। সবাই মরিয়মকে দেখে অনেক পছন্দ করলো। রাতে তার শাশুড়ি মরিয়মকে ডেকে বলল।

” দেখো লুৎফর আগে থেকে বলেনি তোমার একটা বাচ্চা আছে, তুমি যে বিবাহিত এটাও আমরা জানতাম না। এখন জানার পরেও আমাদের কোন সমস্যা নেই কারণ আমার ছেলে বিবাহিত ছিল তার স্ত্রী মারা গিয়েছে। বাচ্চাটাকে মেনে নিতে পারবো না আমরা। তুমি কাল সকালে তোমাদের বাড়িতে যাবে, দুইদিন থেকে চলে এসো। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো তোমার ছেলেকে নিয়ে এখানে এসো না। সবার আগে আমাদের বংশের মান সম্মান, আমরা চাই না আমাদের মান সম্মান তোমার কারনে শেষ হয়ে যাক। এটা ভেবো না তোমার ছেলের দেখাশোনার দায়িত্ব নিবে না লুৎফর, তোমার ছেলের জন্য মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দিবে। আর তোমার ছেলে এতটা ছোট না দুই বছর হয়েছে এখন তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে। কয়েকদিন একটু কান্নাকাটি করবে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

” দুঃখিত আমি আপনার এই কথাটা মানতে পারলাম না। আপনার ছেলে আমাকে যা বলে বিয়ে করেছে তাই তাকে করতে হবে। আপনাদের বংশের মান ইজ্জত যাবে কিনা এটা আমার দেখার বিষয় না। আমার ছেলেকে নিয়ে আমি একসঙ্গে থাকবো এটা আমার শেষ কথা।

মরিয়মের জবাব শুনে তার জা চেঁচিয়ে বলল, তোমার সাহস কত বড় তুমি মায়ের মুখের উপর কথা বল? তুমি জানো এই বাড়িতে থাকতে হলে মায়ের কথা মেনে চলতে হয়।

” ভাবী এখানে সাহসের কথা আসছে কেন, একজন মা তার সন্তানকে ছাড়া থাকতে পারবে না এটা কি আপনারা বুঝতে পারছেন না। আর এমনটাও না আমি বিয়ের আগে রাজি হয়েছিলাম আমার ছেলেকে ছাড়া থাকবো, এখন আমার ছেলেকে আনার জন্য জোরাজুরি করছি। সে আমাকে বিয়ে করার আগে কথা দিয়েছে আমার ছেলেকে তার সঙ্গে রাখবে সে যদি তার কথা না রাখে আমি এখানে থাকতে পারবো না, সারা দুনিয়া একদিকে আর আমার সন্তান এক দিকে।

লুৎফরের মা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন তিনি অন্যের সন্তানকে এই বাড়িতে রেখে বড় করতে দিবে না। এই কারণে যদি তার ছেলে কোন প্রতিবাদ করতে চায় এমন ছেলেকে সে ছেলে হিসেবে পরিচয় দিবে না। মায়ের এমন কথা শুনে লুৎফর কোন জবাব দিল না সে শুধু মরিয়মকে বলল, তুমি ভেবোনা আমার উপর আস্থা রাখো। আমি আল্লাহর কাছে কত কান্নাকাটি করে সন্তান চেয়েছি একটা সন্তান আমি পাইনি, আর এখন আল্লাহ আমাকে তোমার মাধ্যমে পুত্র সন্তানের পিতা হওয়ার সৌভাগ্য দিয়েছে সেই সৌভাগ্য থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে নেব না। যদি আমি তোমার সন্তানকে কষ্ট দিয়ে তার কাছ থেকে তোমাকে আলাদা করে নেই হয়তো আর আমি কখনো বাবা হতে পারব না। কথাগুলো শুনে মরিয়ম ভরসা পেল, সে বুঝতে পারল লুৎফরকে সে যতটা খারাপ ভেবেছিল আসলে সে ততটা খারাপ নয়। পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করার জন্য মরিয়ম এবং লুৎফর এসে ডাইনিং টেবিলে বসলো। তাদেরকে দেখে সবার মুখ কেমন কালো হয়ে গেল, কেউ কোন কথা বলছে না। দুজনে যখন চুপচাপ খাচ্ছিল তখন আবিদ লুৎফরকে বলল।

” তোর বউ নাকি মায়ের মুখের উপর বলে দিয়েছে তার ছেলেকে বাড়িতে মেনে না নিলে সে বাড়িতে থাকবে না! এখন তুই কি সিদ্ধান্ত নিলি তুই কি তোর বউয়ের কথা মানবি নাকি মায়ের কথা রাখবি।

” মায়ের কথা রাখা প্রতিটা সন্তানের কর্তব্য কিন্তু সেই কথাটা যদি অন্যায় আবদার হয় তাহলে তো আর রাখা যায় না।

” তুই কি বলতে চাচ্ছিস অন্যের ছেলেকে এ বাড়িতে রাখতে চাইছে না এটা মায়ের অন্যায়?

” অবশ্যই অন্যায়, একটা অবুঝ শিশুকে আমি তার মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারব না আমার মায়ের কথা শুনে। আমি বিয়ের আগেই মরিয়মকে কথা দিয়েছি সে তার সন্তানকে নিয়ে আমার সঙ্গে থাকতে পারবে। এখন আমি আমার কথার বরখেলাপ করতে পারবো না।

” তুই কি ভাবছিস সংসারের খরচ তুই বেশি দেস বলেই তোর কথাই সব হবে? মা যা বলেছে তাই হবে। মায়ের কথার বাইরে যদি যাস তাহলে মা কি করতে পারে সেটা ভালো করেই জানিস।

” কি করবে তেজ্য করবে, যদি করতে চায় করে দিতে পারে। আমার এ ধন সম্পদের প্রতি কোন লোভ নেই। আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ সম্পদ দিয়েছে আমি যে বিজনেস করছি আল্লাহ চাইলে এ বিজনেস আরো বড় করে দিতে পারে। তোমাদের কোন কিছুর দরকার নেই আমার।

এতক্ষণ রহিমা বেগম চুপ করে ছিলেন, লুৎফরের কথায় সে অবাক হয়ে গিয়েছে। যে ছেলে কখনো মায়ের মুখের উপর কথা বলেনি সে ছেলে আজকে বলছে অন্যের সন্তানের জন্য সব কিছু করতে পারবে। রহিমা বেগম লুৎফরকে বলল, আমি তোকে আর কিছু বলতে চাই না শুধু একটা কথাই বলতে চাই যদি আমাদের সবার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে চাস তাহলে তোর বউকে একাই বাড়িতে নিয়ে আসবি। ওই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসবি না। আর যদি ভাবিস ওই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসবি তাহলে তোর বউয়ের এই বাড়িতে আসার দরকার নেই।

” আচ্ছা মা তোমার কথাটা আমার মনে থাকবে।

লুৎফর মরিয়মকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুমে চলে আসলো। মরিয়মকে বলল, তাড়াতাড়ি রেডি হতে। মরিয়ম সবকিছু গুছিয়ে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে শাশুড়ির রুমে আসলো বিদায় নেওয়ার জন্য।

” মা এখন আমরা যাচ্ছি।

” যাও, তবে যে কথাগুলো বলছি মনে রেখো, তোমার ছেলেকে নিয়ে কিন্তু এ বাড়ি আসবে না।

” আচ্ছা মনে থাকবে।

মরিয়ম তার বাড়িতে এসে রাইয়ানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। দুইদিন পরে মাকে দেখে দুই হাত দিয়ে গলায় জড়িয়ে ধরেছে রাইয়ান, আর দুই গালে অসংখ্য চুমু দিচ্ছে। মরিয়ম ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলল, বাবা তোকে আমি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, তোকে আর কষ্ট দেবো না। তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি যতদিন বেঁচে আছি তুই আমার সঙ্গেই থাকবি।

মরিয়মের কথা শুনে পপি বলল, তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন কি তোমার ছেলেকে মেনে নিয়েছে! তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে?

” না ভাবী, তারা আমার ছেলের কথা শুনে বলেছে তাকে নিয়ে যেন ওই বাড়িতে না যাই।

” তাহলে আর কি করবে তারা যখন রাজি হচ্ছে না আস্তে আস্তে সব মানিয়ে নিতে হবে।

” ভাবী তুমি কি বলছো আমি মানিয়ে নেব! আমার ছেলেকে ছাড়া আমি ওই বাড়িতে থাকব সেটা কখনো না।

সায়মা রুমের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, তারা যদি তোমার ছেলেকে না মেনে নেয় তাহলে তো তাকে ছাড়াই থাকতে হবে। নাকি আবার এই জামাইয়ের কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে চলে আসবে! এটা কিন্তু আমরা কেউ মেনে নেব না।

” আপনারা মেনে নেন বা না নেন আমার ছেলেকে ছাড়া আমি থাকবো না, আর এটা ভালো করে বুঝেছি আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারবো না। আমার ছেলেকে নিয়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাব, নাহয় মানুষের বাসায় কাজ করে আমার ছেলেকে বড় করব।

মরিয়মের মা এসে বলল এগুলো কি বলছিস, জামাই কিন্তু পাশের রুমে আছে এগুলো শুনলে কি বলবে।

” শুনলে শুনুক তাকে আমি বলে দিয়েছি আমার ছেলেকে সঙ্গে না রাখলে আমিও তার সঙ্গে থাকবো না।

” দেখুন আম্মা আপনার মেয়ে কি বলে এমন মেয়েকে নিয়ে আপনি কি করবেন, আমরা কিন্তু আর আপনার মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারব না।

” ভাবী আপনাদের চিন্তা করতে হবে না, মরিয়মের আর তার ছেলের দায়িত্ব আমার। সে আমার স্ত্রী আর তার সন্তান আমার সন্তান।

লুৎফরের কথা শুনে সবাই চমকে উঠল, লুৎফরের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মরিয়মের মা খুব খুশি হলো, আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া জানালো। লুৎফর পপি আর সায়মাকে উদ্দেশ্য করে বলল।

” আপনারা দুজন নারী, নারী হয়ে একজন নারীর কষ্ট কেন আপনারা বুঝেন না। একজন মায়ের কতটা কষ্ট হয় সন্তান ছাড়া থাকতে সেটা তো আপনাদের বোঝার কথা। কোথায় আমাকে বুঝিয়ে বলবেন আপনার ননদের ছেলেকে নিয়ে যেন কোন সমস্যা না করি। সেটা না করে এই অবুঝ বাচ্চাটাকে মা ছাড়া রাখতে বলছেন। আপনাদের মত মহিলাদের জন্যই সমাজে এত অশান্তি।

ননদের জামাইয়ের কাছ থেকে অপমানিত হয়ে চুপচাপ সায়মা ও পপি যার যার ঘরে চলে গেল। ফিরোজা বেগম লুৎফরকে বলল, বাবা তোমার কথা শুনে বুক থেকে পাথর নেমে গেল। কিন্তু শুনলাম তোমার বাড়িতে নাকি মেনে নিবে না তাহলে রাইয়ানকে নিয়ে মরিয়ম ওই বাড়িতে থাকবে কিভাবে?

” মা আমি ভেবেছি মরিয়মকে নিয়ে আলাদা থাকবো। আমার ব্যবসা তো শহরে করতে হয় সেখানে বাসা ভাড়া নেব। মরিয়ম এই কয়েকদিন এখানে থাক, আমি সবকিছু ঠিকঠাক করে মরিয়মকে শহরে নিয়ে যাব।

” বাবা এটা কেমন খারাপ দেখায় না! আমার মেয়ের জন্য তুমি তোমার পরিবারকে ছেড়ে দিবে। তারা তো কষ্ট পাবে অভিশাপ দিবে। তাদেরকে বুঝিয়ে আমার নাতিটাকে একসঙ্গে রাখা যায় না।

” এটা হবে না, আমার মা বলে দিয়েছে রাইয়ানকে সঙ্গে নিয়ে যেন ওই বাড়িতে না যাই। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে আমি আলাদা থাকবো। সত্যি কথা বলতে কি জানেন বিয়ের পাঁচ বছরে আমার কোন সন্তান হয়নি, সন্তানের জন্য আমার বুকে হাহাকার ছিল। যখন মামুন ভাইয়ের কাছ থেকে শুনতে পারলাম তার বোন ডিভোর্সি একটা বাচ্চা আছে। তখনই মরিয়মকে দেখার আগেই বাচ্চাটার কথা শুনে আমি বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে যাই। যে সন্তানের বাবা হওয়ার জন্য আমি মরিয়মকে বিয়ে করেছি সেই সন্তানকে কিভাবে পর করে দেই।

” এই বাবা হারা সন্তানটাকে বাবার আদর দিয়ে মানুষ করলে আল্লাহ তোমার অনেক ভালো করবে। তোমরা সুখে থেকো ভালো থেকো সব সময় এই দোয়াই করব।

” জ্বি আম্মা আমাদের জন্য দোয়া করবেন আমি যেন আমার কথা রাখতে পারি।

মরিয়ম খুশিতে কান্না করছে লুৎফরের কথা শুনে। সে বিশ্বাস করেনি তার ছেলেকে লুৎফর নিজের সন্তান বলে মেনে নিবে। এই মুহূর্তে মরিয়মের ইচ্ছা করছে লুৎফরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে, কিন্তু লজ্জায় সে সেটা পারছে না। মরিয়মের কোল থেকে রাইয়ানকে নিজের কোলে নিলো লুৎফর। প্রথমে রাইয়ান লুৎফরের কোলে যেতে চাইলো না। মরিয়ম যখন বলল এটা তোমার আব্বু হয় তোমার আব্বু তোমাকে অনেক আদর করবে। সঙ্গে সঙ্গে রাইয়ান লুৎফরের কোলে চলে আসলো। পরম মমতায় ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল লুৎফর। লুৎফর রাইয়ানকে বলল, আমাকে আব্বু বলে ডাক দাও তখনই আব্বু বলে ডেকে উঠলো রাইয়ান। এই দিনটার জন্যই এতটা বছর অপেক্ষা করছিল লুৎফর। আজকে তার অপেক্ষার পালা শেষ হলো। চোখে পানি এসে গিয়েছে তার, চোখের পানি মুছে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোকে আমি কখনো কষ্ট পেতে দেবো না অনেক বড় করবো তোকে। সবাই বলবে লুৎফরের ছেলে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে