#অনপেখিত
পর্ব_৫
লিখা: Sidratul Muntaz
ঘড়িতে রাত এগারোটা। বিছানার দুই প্রান্তে শুয়ে আছে দু’জন। মেহেক আর ফারদিন। ফারদিনের হাতে মোবাইল ফোন। মেহেকের চোখে ঘুম নেই। সে আঁড়চোখে দেখার চেষ্টা করছে ফারদিন মোবাইলে কি করে? ফারদিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই ফোনের স্ক্রিন আড়াল করে ফেলল। মেহেক হঠাৎ ফারদিনের দিকে ঘুরে বলে উঠলো,” আচ্ছা, আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?”
ফারদিন কড়া দৃষ্টিতে তাকালো৷ মেহেকের চেহারায় মহা উৎসাহ দেখে ফারদিন পাশ কাটানো গলায় উত্তর দিল,” না।”
” মিথ্যে বলছেন কেন? আমি জানি আছে।”
” তোমার সাথে মিথ্যে কেন বলবো?”
” আরে, বউয়ের সাথে তো মানুষ মিথ্যে কথাই বলে। গার্লফ্রন্ড থাকলেও কি আপনি তা স্বীকার করবেন?”
” জানোই যখন স্বীকার করবো না তাহলে জিজ্ঞেস করলে কেন?”
” এমনি। মন চাইলো হঠাৎ। ”
” তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?”
” না। তবে একজন প্রেমিক ছিল।”
” বয়ফ্রেন্ড আর প্রেমিক আলাদা নাকি?”
” আলাদাই তো। বয়ফ্রেন্ড মানে যার সাথে আমি প্রেম করেছি। আর প্রেমিক মানে যার সাথে প্রেম হতে হতেও হয়নি। কিন্তু মনে মনে দু’জনই পছন্দ করতাম।”
” তাই?”
” হুম।”
ফারদিন মনে মনে ভাবলো, তাহলে তারও একটা প্রেমিকা আছে৷ কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। মেহেক উদাসীন কণ্ঠে বলল,” জানেন সে আমাদের গ্রামেরই ছেলে। নাম মুহিবুল ইসলাম। আমি ডাকতাম মুহিব ভাই। তার বাবার একটা ফার্মেসী আছে। সেই ফার্মেসীতে রিচার্জ, বিকাশ সবকিছু করা যায়। ক্যান্ডি, টফিও পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে আম্মার ফোনে রিচার্জ করার জন্য আর বিকাশে কাউকে টাকা পাঠানোর জন্য অথবা আমার পিচ্চি কাজিনদের জন্য টফি কিনতে আমিই মুহিব ভাইয়ের দোকানে যেতাম। তিনি আমাকে অযথা দাঁড় করিয়ে রাখতেন। সব কাস্টমার বিদায় করার পর আমাকে জিজ্ঞেস করতেন,” কি খবর মেহু?” আমি হেসে বলতাম,” ভালো মুহিব ভাই। আপনি কেমন আছেন?” তখন তিনি কি বলতেন জানেন? এতোক্ষণ ভালো ছিলেন না৷ আমাকে দেখে ভালো হয়ে গেছেন। আমি নাকি উনার নাপা এক্সট্রা। হাহাহা।”
ফারদিন বিরসমুখে বলল,” বাহ, ভালোই তো চলছিল। প্রেম করলে না কেন?”
” কিভাবে করবো? আব্বা জেনে গিয়েছিল তো। তারপরই আমার বিয়ে ঠিক করলেন। আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল।”
” এখনও কি তোমার মুহিব ভাইয়ের কথা মনে পড়ে? ফিরে যেতে চাও?”
” ছি, না, না। পাগল নাকি?”
মেহেক এমনভাবে মুখ কুচকালো যেন ফারদিন সবচেয়ে জঘন্যতম কথাটি বলে ফেলেছে।
” আব্বা যেদিন আমার বিয়ে ঠিক করেছেন সেদিন থেকেই মুহিব ভাই ডিলিট। আমি ঠিক করেছি প্রেম-টেম সব বিয়ের পরেই করবো। একেবারে নিজের বরের সাথে। মনে মনে তো আমি আপনাকেই ভালোবেসেছি।”
ফারদিন অস্বস্তিতে মুখ সামনের দিকে ঘুরিয়ে নিল। মেয়েটা কি ওর সাথে ফাজলামি করছে নাকি সত্যি বলছে? ঠিক ঠাওর করতে পারছে না ফারদিন। একটু পর বলল,
” আমাকে তো তুমি দেখোইনি। না দেখেই ভালোবেসে ফেললে?”
মেহেক মুখ টিপে হাসলো। ফারদিন তো আর জানে না মেহেক লুকিয়ে লুকিয়ে আগেই ফারদিনকে দেখে নিয়েছিল। যেদিন ফারদিন তাদের বাড়ি এসেছিল সেদিনই। তখন থেকেই ফারদিনকে নিয়ে মেহেকের স্বপ্ন দেখা শুরু। আর ফারদিন যে তাকে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছে এটাও সে জানে। কিন্তু মাইশা আপু বিয়ের পর স্বামীকে বশে রাখার ১০১টা পদ্ধতি মেহেককে শিখিয়ে দিয়েছে৷ মেহেক প্রতিদিন একটা একটা করে প্রয়োগ করবে৷ তারপর একদিন ফারদিনও মেহেকের প্রেমে পাগল হয়ে যাবে। এজন্যই তো সে ফারদিনকে নির্ভয়ে বিয়ে করেছে। ফারদিন বলল,
” আচ্ছা মেহেক, তুমি কি আমেরিকা গিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাও নাকি বাংলাদেশেই থাকতে চাও?”
” আপনি যেখানে থাকবেন আমিও সেখানেই থাকবো। কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হবো মানে?”
” বিয়ে হয়ে গেছে বলে কি লেখাপড়াও শেষ? ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হবে না?”
মেহেকের এতোক্ষণে মনে পড়লো। ফারদিন তো জানে মেহেক এইচএসসি পাশ। কিন্তু সত্যিটা হলো মেহেক জীবনে কলেজের গন্ডিও পেরোয়নি। সে কি করে ভার্সিটিতে ভর্তি হবে? লেগে গেল না প্যাঁচ! এই কথা ফারদিনকে এখন জানানো যাবে না। তাহলে হয়তো বিয়েটাই ভেঙে যাবে। আগে ফারদিন ওর উপর কিছুটা দূর্বল হোক। তারপর আস্তে-ধীরে জানালেই চলবে। মানুষটাকে এতোটাও নিষ্ঠুর মনে হয় না যে শুধু লেখাপড়ার জন্য মেহেককে ছেড়ে চলে যাবে। মেহেক প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,” আচ্ছা এইসব আলোচনা পরে। আগে আপনি বলুন তো, আমাদের বৌভাত কবে হচ্ছে? আম্মা বলেছে বৌভাতের পরদিন আপনাকে নিয়ে আমাদের গ্রামে যেতে।”
” আমার মা-বাবাকে আমেরিকা থেকে আসতে দাও৷ উনারা আসলেই রিসিপশন হবে।”
” উনারা কবে আসবে?”
” মিনিমাম এক সপ্তাহ পর।”
মেহেক মাথায় হাত দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
” ও আল্লাহ, এখনও তো অনেক দেরি তাহলে।”
ফারদিন অন্যদিকে কাত হয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল,” কিছু করার নেই। ঘুমাও।”
মেহেক লক্ষ্য করল ফারদিন মোবাইলটা মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। মেহেকও শুয়ে পড়ল। এখন শুধু অপেক্ষা। সে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরই মেহেক মোবাইলটা চেক করবে। তাহলেই জানা যাবে বেটার গার্লফ্রেন্ড আছে কি নেই। মনে তো হয় কমপক্ষে সাত-আটটা গার্লফ্রেন্ড আছে। কি সুন্দর নায়কের মতো চেহারা। এরই যদি গার্লফ্রেন্ড না থাকে তাহলে পৃথিবীর কোনো পুরুষেরই গার্লফ্রেন্ড থাকার কথা না। প্রায় আধঘন্টা পর মেহেক মৃদু কণ্ঠে ডাকল,” শুনছেন। এইযে, শুনছেন?”
নাহ, কোনো জবাব নেই। মেহেক বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে ফারদিনের কাছে গেল। মোবাইলটা ঠিক ওর মাথার কাছে। মেহেক আরও একবার ডাকল,” প্রাণনাথ! শুনছেন? ও প্রাণনাথ!”
কোনো সাড়া নেই। মেহেক মনে মনে আনন্দে নেচে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে ফেলল। তারপর এক ছুটে বারান্দায় চলে এলো। এখনও বুক ধুকপুক করছে। দ্রুতহাতে মোবাইলের লক খুলল। সে আগে থেকেই এই ফোনের লক জানে। ফারদিনকে কয়েকবার লক খুলতে দেখেছে সে। সর্বপ্রথম হোয়াটসঅ্যাপ চেক করল। বেশিরভাগ বিদেশী নাম্বার। মেহেক এতোটাই মোবাইলে মগ্ন ছিল যে ফারদিন কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি। ফারদিন মনোযোগ আকর্ষণের জন্য হালকা কাশল। মেহেকের টনক নড়লো না। ভ্রু কুচকে সে মোবাইল দেখায় ব্যস্ত। ফারদিন বলল,” মেহেক, কি করছো তুমি?”
” দেখছি।”
মনোযোগী মেহেক উত্তর দিল বেখেয়ালে। ফারদিন বলল,” কি দেখছো?”
এইবার মেহেক কোনো উত্তর দিল না। একটু পর হঠাৎ কি মনে করে ফারদিনের দিকে তাকাল। আর তাকিয়েই চমকে উঠল। এতো বেশি চমকে উঠল যে চিৎকার দিয়ে মোবাইল ফেলেই দৌড়ে পালালো। ফারদিন মেঝে থেকে মোবাইলটা কুড়িয়ে নিল। গ্লাস প্রটেক্টর ফেটে গেছে। কেমন বিরক্ত লাগে!
আজকে বাড়িতে ফারদিন আর মেহেক ছাড়া কেউ নেই। এখন বেলা বারোটা। ফাহিম এই সময় অফিসে থাকে। তিশা দাদুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। ফারদিন ঘুম থেকেই উঠেনি। কলিংবেল চাপলো কেউ। মেহেক দরজা খুলতেই দেখল ফকফকে সাদা চামড়ার একটি সুন্দরী মেয়ে। গায়ে চেক শার্ট, ব্ল্যাক জিন্স, ব্লন্ড হেয়ার, মুখে চুইংগাম। মেহেক ভ্রু কুচকে কতক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
” কি চাই?”
” ফারদিন আছে?”
মেহেকের মাথায় বাজ পড়লো যেন। কে এই সুন্দরী? ফারদিনকে কেন খুঁজছে? মেহেক প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,” আপনি কে?”
” আমি ফারদিনের ফ্রেন্ড। আমেরিকা থেকে এসেছি। ফারদিনের সাথে দেখা করা যাবে?”
মেহেকের রীতিমতো মাথা ঘুরতে লাগল। এই সুন্দরী আমেরিকা থেকে এসেছে শুধু ফারদিনের সাথে দেখা করার জন্য? মতলবটা কি মেয়ের? মেহেক মেয়েটাকে আর কিছু না বলেই দৌড়ে রান্নাঘরে চলে এলো। লিয়াকে বলল,” লিয়া শোনো, কে জানি তোমার ছোটভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছে। একটু দেখো তো তুমি চেনো কি না?”
লিয়া বাহিরে এসে দেখল মেয়েটা দরজা আটকে সোফায় বসে পড়েছে৷ পায়ের উপর পা রেখে দুলাচ্ছে। লিয়া এসে বলল,” চিনি না ভাবী। কে এটা?”
” তুমিও চেনো না? ঠিকাছে, তোমার ছোটভাইকে ডাকি। সে-ই বলবে কে এই মেয়ে।”
মেহেক ফারদিনের ঘরে যেতেই দেখল ফারদিন আয়নায় দাঁড়িয়ে ফিটফাট হচ্ছে। নতুন শার্ট পড়েছে৷ শার্টের হাতা ঠিক করছে। চুল গোছাচ্ছে। মেহেককে দেখেই জিজ্ঞেস করল,” কিছু বলবে?”
” আপনার সাথে কে যেন দেখা করতে এসেছে।”
ফারদিনের মুখে হাসি ফুটল,” ওয়াও, সুজি চলে এসেছে? তুমি ওকে এই ঘরে পাঠিয়ে দাও। আর লিয়াকে বলো আমাদের জন্য দুইকাপ কফি বানিয়ে আনতে।”
মেহেকের মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলতে শুরু করল। কে এই মেয়ে? যার সাথে দেখা করার জন্য তার স্বামীর এতো উৎসাহ! মেহেক ড্রয়িংরুমে গিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বলল,” ফারদিন আপনাকে যেতে বলেছে।”
এই কথা বলে সে আর পেছনে তাকালো না৷ রান্নাঘরে চলে এলো। লিয়াকে কফি বানানোর ব্যাপারে কিছুই বলল না। ওই মেয়ের জন্য মেহেক নিজের হাতেই কফি বানালো। আর এমন কফি বানালো যেন মেয়ে সারাজীবন কফির স্বাদ মনে রাখে। কফি বানানোর কাজ শেষ করে মেহেক ফারদিনের বেডরুমে যেতেই দেখলো সুজি নামের মেয়েটা কাঁদছে। ফারদিন ওর দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দিল। মেহেককে দেখেই মেয়েটা অন্যদিকে ঘুরে মুখ লুকালো। ফারদিন অপ্রস্তুতভাবে বলল,
” সুজি, এইতো এটা মেহেক। আমার ওয়াইফ।”
মেয়েটার সামনে ফারদিন তাকে ওয়াইফ বলে পরিচয় দেওয়ায় মেহেকের অদ্ভুত ভালো লাগল। সে খুশি মনে ফারদিনকে কফি দিল৷ ফারদিন বলল,” থ্যাংকস। সুজিকেও দাও।”
মেহেক সুজির কাছে কফি নিয়ে যেতেই সুজি একটা অদ্ভুত কান্ড করল। কফি মগ নিয়ে মেহেকের মুখে ছুড়ে মারল। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ফারদিন হতভম্ব। মেহেকের কাছে এসে বলল,” তুমি ঠিকাছো মেহেক?”
এইদিকে মেহেকের চোখ-মুখ জ্বলে-পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। কফিতে সে ইচ্ছেমতো মরিচের গুঁড়া মিশিয়েছিল।
চলবে