অতন্দ্রিলার রোদ পর্ব – ৬ ও ৭

0
672

অতন্দ্রিলার রোদ
পর্ব – ৬ ও ৭
লেখা : শঙ্খিনী

পর্ব ৬ : (বিবাহ)

পৃথিবীর বড় বড় নাট্যমঞ্চের মধ্যে অন্যতম বিয়ে বাড়ি। বিয়ে বাড়িতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এবং বৃহৎ থেকে বৃহত্তর সকল বিষয় নিয়ে নাটক হয়।
বিয়ে বাড়ির সবথেকে কমন নাটক হলো বর বা কনের পালিয়ে যাওয়া। কনে পালায় প্রেমিকের হাত ধরে, বর পালায় স্বপ্নের হাত ধরে। অতন্দ্রিলার কোনো প্রেমিক নেই, রোদের স্বপ্নগুলোও পূরণ হয়ে গেছে। তাই তাদের বিয়েতে এই নাটকটি হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
বিয়ে বাড়িতে আরও একটি কমন নাটক – এক মেয়েকে দেখিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। এই অন্য মেয়েটি হয় যাকে প্রথমে দেখানো হয়েছে তার জমজ বোন। অতন্দ্রিলার বিয়েতে এই নাটকেরও সম্ভবনা নেই।
বিয়ে বাড়িতে আরেক ধরনের মজার নাটক ঘটে ঠিক বিয়ে পড়ানোর পর পর। হঠাৎ পরিবারের মধ্য থেকে গুপ্ত প্রেমিক প্রেমিকার উত্থান ঘটে। প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরে কাজী সাহেবকে বলে, “কাজী সাহেব! আরেকটা বিয়ে পড়াতে হবে।”
অতন্দ্রিলার বিয়েতে এই নাটকটি হওয়ার কিঞ্চিৎ সম্ভবনা রয়েছে। মামাতো বোন টিকলি এবং খালাতো ভাই তিশানের ভাবভঙ্গি ভালো মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পরই এরা কানাকানি করছে।
অতন্দ্রিলা ভেবে রেখেছে, যদি সত্যিই এরা এই নাটকটি করে তাহলে সে কঠিন গলায় বলবে, “তোদেরকে ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হবে। দয়া করে আমার বিয়েটা নষ্ট করিস না!”

আজ অতন্দ্রিলা এবং রোদের বিয়ে। বাড়িতে বিরাট আয়োজন। আত্মীয় স্বজনেরা সবাই বিভিন্ন আজ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। শহর হল থেকে বাড়িতে এসেছে। সেও ছোটাছুটি করছে, তবে সেটা কোনো কারন ছাড়াই।

শায়লা দুদিন আগেই এ বাড়িতে এসেছেন। রান্নাবান্নার দায়িত্বটা তিনি এবং তার বোনেরা নিয়েছেন।
বাড়িতে অন্যরকম একটা খুশির বাতাস বইছে। এমন বাতাস অতন্দ্রিলার বাবা মায়ের ডিভোর্সের পর আর এ বাড়িতে বয়নি।

অতন্দ্রিলা ঠিক করেছে আজ সেও এক নাটক করবে, ভয়ংকর নাটক। তবে সেই ভয়ংকর নাটকের ফলাফল হবে অসাধারন।
নাটকের পরিচালক অতন্দ্রিলা, মুখ্য চরিত্র শায়লা এবং হামিদ সাহেব।
বিয়ের সময়ে “নইলে আমি কিন্তু বিয়ে করবোনা” এই বাক্যটি জাদুর মন্ত্রের মতো কাজ করে। বর কনে সুলভ থেকে দুর্লভ যেকোনো বস্তু পাওয়ার জন্যে এই বাক্যটি ব্যাবহার করে থাকে।
অতন্দ্রিলার নাটকে এ বাক্যটা প্রধান সংলাপ।

ভোর ৬ টা। বিয়ের বাড়ির সকলে ঘুম থেকে উঠে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। শায়লা রান্নাঘরে, হামিদ সাহেব বাগানে।
অতন্দ্রিলা দুজনকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে এল।
       শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, “কি আশ্চর্য! রান্নাঘরে আমার হাজারটা কাজ, এখানে নিয়ে এলি কেন?”
        হামিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “আমারও তো সেই একই কথা! কি ভেবেছিস কি হ্যাঁ? তোর কোনো কাজ নেই বলে অন্য কারোরই কোনো কাজ নেই?”
        অতন্দ্রিলা বলল, “তোমরা একটু শান্ত হয়ে বসবে প্লিজ!”

শায়লা বসলেন। তার থেকে একটু দূরে বসলেন হামিদ সাহেব।
          হামিদ সাহেব বললেন, “বসলাম! এখন বল তোর জরুরি কথা!”
           অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাবা মা দেখো, তোমাদের মধ্যে কি ঘটেছিল তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। তবে আমার ধারনা তোমরা নিতান্তই কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অভিমান করে আছো। আপার বিয়ে হয়ে গেছে। আমিও আজ চলে যাচ্ছি। শহর থাকে হলে। তোমরা এখন কি নিয়ে বাঁচবে? একা একা বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে?
          শায়লা বললেন, “কি বলতে চাচ্ছিস অত?”
          “বলতে চাচ্ছি যে এখন তোমরা দুজনেই দুজনের বেঁচে থাকার সম্বল। তাই তোমরা সবকিছু ভুলে আবার এক হও, নইলে কিন্তু আমি বিয়ে করবো না।”

কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যে। তারা এক হলেও অতন্দ্রিলা বিয়ে করবে, এক না হলেও বিয়ে করবে। কিন্তু বাবা মাকে এক করতে কথাটা বলতে তো কোনো ক্ষতি নেই।

শায়লা বুঝতে পারছেন না কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিৎ, হাসা উচিৎ নাকি রাগ করা উচিৎ।
         চোখে দু এক ফোঁটা অশ্রু নিয়ে বললেন, “সত্যিই করবিনা?”
         “অবশ্যই করবোনা।”
শায়লা হামিদ সাহেবের দিকে তাকালেন। হামিদ সাহেব কাঁদছেন। তার দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে খুশির অশ্রু।

        শায়লা কন্নামাখা কণ্ঠে বললেন, “তোমার মেয়ে কিন্তু তোমার মতই জেদী।”
        “কিন্তু তুমি কি করবে আমাকে ক্ষমা?”
         “করবো।”

অতন্দ্রিলা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
       চিৎকার করে বলল, “আপা! আমরা আর ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে নই!”

অতন্দ্রিলা হাসছে। দু গালে টোল পরেছে। হাসলে তার সৌন্দর্য কয়েক গুন বেড়ে যায়। কিন্তু খুব কম হাসে বলে এই সৌন্দর্য আড়ালে ঢাকা পরে যায়।

দুপুরের দিকে সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার ঘরে এল।
      গম্ভীর গলায় বলল, “তার মানে এই কাজটা তুই আগেও করতে পারতিস?”        
       “কোন কাজটা?”
       “এইযে বাবা মায়ের মিল করিয়ে দেওয়ার কাজটা!”
        “হ্যাঁ পারতাম তো।”
        “তাহলে করিসনি কেন? আজ করলি কেন?”
        “কারন হলো আজ আমি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। আজকের পর বাবা মায়ের ঝগড়া আমাকে আর সহ্য করতে হবে না।”
        “তোর ধারনা তারা এক হওয়ার পর আবার ঝগড়া করবে?”
         “অবশ্যই করবে।”
          সন্ধ্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উৎসাহ নিয়ে বলল, “এই এখন তো আর তাহলে তুই ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে না?”
          “না।”
          “তার মানে এখন আর এই ছেলেটাকে তোর বিয়েও করতে হবে না।”
          “আপা বাজে কথা বোলো না তো। যাও নিজের কাজ করো!”

বিকেলের দিকে ঘটলো আরেক নাটক।
অতন্দ্রিলাকে সাজাতে এসেছেন পার্লার থেকে।
হঠাৎ ঘরের সমস্ত লাইট ফ্যান বন্ধ হয়ে গেল!

      শহর দৌড়ে এসে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মেইন সুইচ নষ্ট হয়ে গেছে, আজকে ঠিক হবে না!”

হামিদ সাহেব চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছেন। একটু পরে অন্ধকার হয়ে আসবে, বাড়িতে এক ফোঁটাও আলো না থাকলে বিয়েই বা হবে কি করে আর মেহমানরা খাবেই বা কি করে।
শায়লা অন্ধকার নামার আগে রান্না শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।

        অতন্দ্রিলা সাজগোজ বাদ দিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি কি কিছু সহৃদয়বান ব্যক্তিবর্গের সাহায্য পেতে পারি?”
        অতন্দ্রিলার খালাতো বোন নীলা বলল, “কি বিষয়ে আপা?”
         “বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো হবে, আলো দিয়ে। ছাদে নতুন করে প্যান্ডেল করা হবে। কাজগুলো আমি একা করতে পারবোনা যে তা নয়, কিন্তু কাজগুলো একা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কেউ আমাকে সাহায্য করবে?”

অতন্দ্রিলাকে সাহায্য করতে পারে এমন সাতজন মানুষ পাওয়া গেল। শহর, সন্ধ্যা, নীলা, তিশান, টিকলি, হামিদ সাহেব এবং জরিনা।

প্রায় পাঁচ ছয়’শ মোমবাতি কিনে আনা হয়েছে। বাড়ির প্রতিটি কোণায় মোমবাতি জ্বালানো হচ্ছে। ডেকোরেটরের লোকজন ছাদে নতুন করে প্যান্ডেল করছেন।
ছাদটা সাজানো হয়েছে প্রদীপ দিয়ে। সাথে বেলি ফুল। বেলির ফুলের সুগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে।
মেহমানরা হতভম্ব। কনে সাজগোজ বাদ দিয়ে সজ্জাছে ঘর! তাও আবার মোমবাতি দিয়ে।

আলোর সমস্যা মিটে গেলেই আরেক সমস্যা হাজির। সেটা হলো গরম। ব্যাটারি চালিত টেবিল ফ্যান দিয়ে আপাতত কাজ চালান হচ্ছে। কিন্তু ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে কি হবে তা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন হামিদ সাহেব।
     যখনই ফ্যান চলতে দেখছেন তখনি বলছেন, “আহ্ ফ্যান চালাচ্ছো কেন? বরপক্ষ আসলে কি করবে? বিয়ে পড়ানোর সময় চার্জ ফুরিয়ে গেলে?”
      
তিন’শ মেহমান দাওয়াত করা হয়েছিল, কিন্তু ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বেশি মানুষ চলে এসেছে। খাবার কম পরে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। হোটেলে খবর দিয়ে রেখেছেন যাতে প্রয়োজনে খাবার দিয়ে যায়।

বর এল সাতটার দিকে। এবার মেহেমানরা খাওয়া দাওয়া শুরু করতে পারবেন।
বরযাত্রী তো বাড়ির সাজসজ্জা দেখে অবাক। তাদের ছাদে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বরকে দেখার জন্যে সকলের উৎসাহের সীমা নেই।

রোদের মনটা বিপর্যস্ত। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে। তবে তার মুখ দেখে ব্যাপারটা বোঝার উপায় নেই। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে, সকলকে সালাম দিচ্ছে, সবার সঙ্গে কথা বলছে।

কিছুক্ষণ পর বর কনে একসঙ্গে করা হলো।
অতন্দ্রিলাকে দেখাচ্ছে পুরনো দিনের কনেদের মত। যখন সাজ নয়, সৌন্দর্য ছিল কনেদের মুখ্য বিষয়।

রাত প্রায় একটা। বিয়ে বাড়ি এখন শান্ত। মেহেমানরা চলে গেছেন। অতন্দ্রিলা এখন যাবে রোদের বাড়িতে। শুরু হবে তার জীবনের নতুন অধ্যায়।

বিয়ে বাড়ির প্রচলিত নাটক – বিদায়ের সময় মা মেয়ের জড়িয়ে ধরে কান্না। কিন্তু শায়লা কাঁদছেন না। আর অতন্দ্রিলার কাঁদার অভ্যেস নেই।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

পর্ব : ৭ (বাসর)

বাসর হবে রোদের বাড়িতে। বাসর নিয়ে কম বয়সী মেয়েদের উৎসাহের সীমা নেই। এগার-বারো‌ বছর বয়সী একটা মেয়ে বাসর ঘরের খুঁটিনাটি সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অবশেষে অতন্দ্রিলাকে বাসর ঘরে রেখে যাওয়া হলো। ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। খাটে গাঢ় নীল রঙের চাদর বিছানো, গোলাপ এবং বেলি ফুল দিয়ে সাজানো।
খাটের ডান পাশের টেবিলে ফুলদানি, ফুলদানিতেও গোলাপের গুচ্ছ। লাল রঙের গোলাপ অতন্দ্রিলার পছন্দ নয়। তার পছন্দ কালো গোলাপ।
খাটের বাম পাশে আরেক টেবিল। সেখানে, পেস্তা বাদাম দেওয়া দুধের এক অদ্ভুত শরবত। শরবতটা যে রেখেছে তাকে এখন অতন্দ্রিলার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, “এক গ্লাস শরবত রেখেছেন কেন? জানেন যে ঘরে দুজন মানুষ থাকবে! দু গ্লাস রাখলে কি ক্ষতি হতো?”
অতন্দ্রিলার প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, কিন্তু শরবতটা কার জন্যে রাখা ব্যাপারটা নিশ্চিত না হয়ে খাওয়া যাচ্ছে না।
শরবতের পাশে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। এই জিনিসটাও অতন্দ্রিলার ভীষন অপছন্দের।
যে মিষ্টি রেখেছে তার উচিত ছিল মিষ্টির পাশাপাশি ঝাল কিছুও রাখা।

অতন্দ্রিলার তৃষ্ণা বেড়ে গেল। তাই সে এবার খাট থেকে উঠলো। ঘরের কোনায় প্রকাণ্ড এক উঁচু ধরনের টেবিল। এই টেবিলে অবশেষে পাওয়া গেল পানির জগ। অতন্দ্রিলা পানি খেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল।
অতন্দ্রিলার চোখ পড়ল এক বিশাল বুকশেলফের দিকে। এত বই এক জীবনে পড়ে শেষ করা যাবে কিনা এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছে তার।

বুকশেলফের বইগুলো সুন্দর করে সাজানো। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো একদিকে, রবীন্দ্রনাথের বইগুলো একদিকে এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইগুলো একদিকে। মজার ব্যাপার হলো বুকফেলফে এই তিনজন লেখক ছাড়া আর কারো বই নেই।
হয়তো এনারা রোদের প্রিয় লেখক। ইরার প্রিয় লেখকও হতে পারে।

বুকফেলফটা খোলাই ছিল। অতন্দ্রিলা একটা বই নিল, হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ হিমুর বিয়ে’। বইটি অতন্দ্রিলা সারা জীবনে ২৩ বার পড়েছে। কিন্তু প্রতিবারই পড়ার সময় নতুন মনে হয়।
অতন্দ্রিলা বইটা খাটে রাখল।

হঠাৎ চোখ পরল খাটের পেছনের দেয়ালে। ইনিই তাহলে ইরাবতী! তিনি দেখতে কিছুটা রাজারানীদের মত। অতন্দ্রিলা আরো ভালো করে দেখল। কে ইনি? বাংলা সিনেমার নায়িকা নন তো? না, না। বাংলা সিনেমার নায়িকারা এত রূপবতী হয় না!

এ বাড়িতে অতন্দ্রিলার বন্ধু হতে পারে এমন মানুষ নেই। ফিরোজা সুন্দর মনের মানুষ, তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কিনা এ বিষয়ে ক্ষীণ সন্দেহ আছে অতন্দ্রিলার। আর রোদ! রোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে বলে মনে হয় না।
বন্ধুত্ব হতে পারে এমন একজন মানুষকেই খুঁজে পেল অতন্দ্রিলা, সে হলো ইরা।

অতন্দ্রিলা ইরার ছবিটার সামনে দাড়িয়ে বলল, “বুবু, এতদিনে আমার নাম নিশ্চই শুনেছেন। তারপরও আবার বলছি, আমার নাম অতন্দ্রিলা। আমার সঙ্গে আপনার রোদের বিয়ে হয়েছে। তবে আপনি কিন্তু একদম চিন্তা করবেন না! আপনার রোদ আজীবন আপনারই থাকবে। তাকে আপনার থেকে কেড়ে নেওয়ার কোনো শখ আমার নেই। আর আমি কিন্তু আপনাকে বুবু ডাকবো। সিনেমায় দেখেছি, নায়কের দ্বিতীয় স্ত্রীরা প্রথম স্ত্রীকে বুবু বলে সম্বোধন করে।”

রোদ অতন্দ্রিলাকে বিয়ে করেছে অনিচ্ছায়, মায়ের কথা রাখতে। তাই বাসর ঘরেও খানিকটা দেরি করে আসবে। প্রথমে সে চাইবে অন্য ঘরে ঘুমাতে, পরে ফিরোজা অনেকক্ষণ ধরে অনুরোধ  করবেন। প্রথমে রাজি না থাকলেও পরে রাজি হয়ে আসবে বাসর ঘরে। 
অনেকটা সময়ের মামলা। অতন্দ্রিলার ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে পরতে, কিন্তু সেটা অভদ্রতা হবে। তাই ঘাপটি মেরে বসে বইটা পরছে। বইয়ের প্রথম পাতায় কলম দিয়ে গোটা গোটা করে লেখা, “রোদের মত ঝলমল রোদকে, ইরা”।
তারমানে বই পড়ার নেশাটা রোদের।

ঘন্টাখানেক পর দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। অতন্দ্রিলার নাকে এলো এক পারফিউমের গন্ধ। গন্ধটা পরিচিত মনে হচ্ছে।
এই একই গন্ধটা পেয়েছিল যখন রোদকে তার পাশে বসানো হয়েছিল। তাহলে অবশেষে মহাশয় এলেন।

রোদ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই
         অতন্দ্রিলা বইয়ের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “আপনি কিছু বলার আগে জানিয়ে রাখি, এ ঘরে কিন্তু গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে!”
         রোদ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “গোপন ক্যামেরা?”
          “শুধু ক্যামেরাই না সাউন্ড রেকর্ডারও আছে।”
           “তুমি জানলে কি করে?”
           “ওইযে একটা বাচ্চা মেয়ে ছোটাছুটি করতে, ওর মুখে শুনেছি। ক্যামেরা খাটের পেছনে, ফুলের আড়ালে। আর সাউন্ড রেকর্ডার খাটের নিচে। আপনি প্লিজ এগুলো বন্ধ করে দেবেন? আমি এখন বইটা রেখে উঠতে পারবো না।”
          রোদ ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার বন্ধ করতে করতে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে অতন্দ্রিলাকে বলল, “তুমি যখন আগে থেকেই জানতে তখন বন্ধ করলে না কেন?”
           “ইচ্ছে করেই বন্ধ করিনি। আপনাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আপনার বোনেরা কতটা অভদ্র।”
রোদ খানিকটা অবাক হলো। বাহ্! মেয়েটা তো বেশ ভালোই সত্য কথা বলতে পারে।
           
রোদ অতন্দ্রিলার সামনে এসে বসল। অতন্দ্রিলা মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে।
            রোদ শান্ত গলায় বলল, “তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার আছে।”
             “বলুন শুনছি।”
             “দেখো, আমাকে আমার মা জোড় করে বিয়ে দিয়েছেন। আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করিনি। তোমাকে কোনো রকম আশায় রাখতে চাই না বলে আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না।”
             অতন্দ্রিলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি কি আপনাকে বলেছি যে আপনার ভালোবাসা না পেলে আমি অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবো?”

রোদ চেয়েছিল অতন্দ্রিলাকে চমকে দিতে। অতন্দ্রিলা বেশ ভালোই চমকে ওঠে। কিন্তু ১ ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে রোদের সামনে চমকে না ওঠার অভিনয় করে। এটা অতন্দ্রিলার এক ধরনের খেলা।
চমকে ওঠার পাশাপাশি অতন্দ্রিলার বেশ রাগও হয়েছে। রাগ হওয়ার পেছনে যুক্তি আছে। অতন্দ্রিলা তার বাবার বাড়ি ছেড়ে, আজ প্রথম এ বাড়িতে এসেছ। প্রথম দিনেই রোদের উচিৎ হয়নি এত বড় একটা কথা তাকে বলা। দু তিন দিন সময় নিয়ে বলতে পারতো। এটা সাধারন ভদ্রতা।
অতন্দ্রিলার এত বড় একটা কথা স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করা মেনে নিতে পারছে না রোদ।
রোদ আশা করেছিল অতন্দ্রিলা কাঁদবে কিংবা হয়তো ভাঙচুর করবে।

        রোদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “না বলোনি।”
        “তাহলে?”
        “তাহলে কি?
         অতন্দ্রিলা বলল, “তাহলে আপনি এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন? আমি জানি আপনি আপনার স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসেন। আপনি তাকে আজীবন ভালো বেসে যাবেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিংবা আপত্তি থাকা উচিত নয়।”
         রোদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “উচিত নয়? তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো তো?”
          “বুঝতে না পারার কি আছে? বাংলাতেই  তো বললেন! আপনি ঘুমিয়ে পরতে পারেন, আমার জন্যে অপেক্ষা করে লাভ হবে না। আমি বইটা শেষ করেই ঘুমাবো।”

রোদ হতভম্ব হয়ে গেল। একটা মেয়ের বাসর ঘরে এমন কথা শুনে, এত সহজে কি করে তা মেনে নিলো! ইরা হলে তো এতক্ষণে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়ত।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে