#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
২৭.
অভ্র’র যত্নে এখন আমি পুরোপুরিই সুস্থ।ভার্সিটিতেও যাওয়া আসাও শুরু করেছি কিছুদিন হলো।কিন্তু তবুও অভ্র আমাকে নিয়ে তার সতর্কতা এক বিন্দুও কমতে দেন নি।ভার্সিটিতে রোজ নিজে গিয়ে দিয়ে আসেন আবার নিয়ে আসেন।যেমনটি একটি প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাকে রোজ দিয়ে যাওয়া,নিয়ে আসা হয়।
আমার এক্সিডেন্টের পর একা একা বাড়ি ফেরা তো আমার জন্য পুরোই নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।
আজ আমাদের ভার্সিটিতে একটু আগেই ছুটি দিয়ে দিলো।ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আমি হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের পশ্চিম দিকে চলে আসলাম।এদিকটায় আজ মানুষ জন বেশি চোখে পড়ছে না।দু একটি ফুচকার স্টল আছে।সেখানেই কেউ কেউ বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে আর খাচ্ছে।
মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠে মাথা উঁচু করে তাকালাম।আসিফ স্যার দাঁড়িয়ে আছেন।আমার সাথে ধাক্কা লাগায় স্যারের হাতের ফাইল খুলে সব কাগজপত্র পড়ে গেছে।স্যার হাঁটু মুড়ে বসে বসে সেসবই উঠাতে লাগলেন।আমিও বসে মাটি থেকে স্যারের কাগজ গুলো তুলতে সাহায্য করলাম।একটা কাগজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না।অবশেষে রাস্তার পাশে গজানো বড় বড় ঘাসের আড়াল থেকে আমিই উদ্ধার করে দিলাম।সব কাগজ তোলা হয়ে গেলে স্যার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘থ্যাংক ইউ অরু।আপনাকে কষ্ট দিলাম।’
‘না না স্যার কি বলছেন!এতে কষ্ট কি!ধন্যবাদ তো আমার আপনাকে বলা উচিত সেদিন কতো কষ্ট করে আপনি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।’
‘ইট’স মাই প্লেজার।আপনি এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়েছেন তো?’
‘জ্বি স্যার।একদম।’
‘ভার্সিটি তো ছুটি দিয়ে দিলো।এখন কি বাসায় যাবেন?’
‘জ্বি স্যার।একটু পরই যাবো।’
‘ফুচকা খাবেন?’
‘ফুচকা…না থাক খাবো না।’
‘না করছেন কেনো?আমি যতদূর জানি সব মেয়েরাই ফুচকার পাগল।আপনি একটু আগে আমার খুব দরকারি একটি কাগজ খুঁজে দিয়েছেন।এটা আমার ট্রিট হিসেবেই না হয় রাখুন।’
আমি আর না করলাম না।কি করে করবো!ফুচকার ব্যাপারে না করার মতো গুন অরু নামক সত্তার মধ্যেই নেই।তাছাড়া হাত ভাঙার পর থেকে এই অব্দি এখনও ফুচকা খাইনি।
একটি লাল চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।স্যারও এক প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে একটি ফোন কলে ব্যস্ত হয়ে সাইডে চলে গেলেন।ফুচকা পেতেই আমি উৎফুল্লিত হয়ে খেতে শুরু করে দিলাম।মুখে দিতেই প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো।আহ!কতদিন পর খেলাম।
আমার এই শান্তির মাঝে হঠাৎ অভ্র ক্ষিপ্ত মেজাজে এসে উদয় হলেন।এসেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘আমি এক ঘন্টা ধরে তোমাকে খুঁজে খুঁজে মরছি আর তুমি এখানে বসে বসে নিশ্চিন্তে ফুচকা খাচ্ছো।’
তার রাগ দেখে একটু ঢোক গিলে বললাম,
‘আমাকে একটা ফোন করতেন!’
‘তোমার ফোনটা একটু বের করে দেখো তো।’
ফোন বের করে দেখলাম অনেকগুলো মিসডকল।ফোন সাইলেন্ট থাকায় শুনতে পাই নি।বুঝে গেলাম তিনি আজ প্রচুর ক্ষেপে আছেন।নিশ্চয়ই ফোনে না পেয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।মুখ টেনে হাসার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাওয়ার মাঝেই হঠাৎ আসিফ স্যার এসে পড়লেন।অভ্রকে দেখে স্যার বললেন,
‘হায়!মিস্টার অভ্র,বোনকে নিতে এসেছেন?’
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘বোন?’
‘আপনি অরুর ভাই না?’
স্যারের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।অভ্র দাঁত চেপে বললেন,
‘আমি অরুর ভাই না হাজবেন্ড।’
‘ও..আই অ্যাম স্যরি।আমি সেদিন ভেবেছিলাম আপনি অরুর ভাই।’
অভ্র আর কিছু বললেন না।স্যারও আমার দিকে তাকিয়ে একটা স্মিত হাসি দিয়ে ফুচকার দাম মিটিয়ে চলে গেলেন।স্যারকে ফুচকার দাম মিটাতে দেখে অভ্র’র ভ্রু কুঁচকে গেলো।স্যার চলে যাওয়ার পর উনি বলে উঠলেন,
‘সে ফুচকার দাম মিটালো কেনো?’
আমি কিছু বলার আগেই ফুচকার স্টলে কাজ করা একটি বাচ্চা ছেলে বলে উঠলো,
‘হে এই আফা মনি রে ফুচকা খাওয়াইছে তাই।’
অভ্র’র মুখটা থমথমে হয়ে গেলো।পরিবেশটা সুবিধাজনক বলে ঠেকছে না।তাই আমিও কোনো কথা না বলে দ্রুত একের পর এক ফুচকা গিলতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,
‘তোমার বরের কি টাকা নেই না সামর্থ্য নেই যে তোমাকে অন্য কারো থেকে ফুচকা খেতে হয়!’
অভ্রকে দেখে বোঝা যাচ্ছে উনি ভীষণ ক্ষেপে গেছেন।আমি কিছু বললাম না শুধু মুখটা কাঁচুমাচু করে রেখে গপাগপ ফুচকা খেতে লাগলাম।এতে অভ্র আরো রেগে গেলেন।বললেন,
‘আমি তোমাকে কিছু বলছি আর তুমি সেই ফুচকাই খেয়ে যাচ্ছো!তুমি কতো ফুচকা খেতে পারো তা আমি আজ দেখবো।’
কথাটি বলেই উনি আরো এক প্লেট ফুচকা অর্ডার করলেন।এবং তাতে প্রচুর মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দিলেন।আমি তার পাশে গিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে বললাম,
‘একি কি করছেন!এতো ঝাল দিচ্ছেন কেনো?এতো ঝাল দিয়ে কে খাবে?’
‘কেনো তুমি খাবে।তুমি যদি আজ এই ফুচকা খেতে পারো তবে আমি কথা দিচ্ছি এর থেকে দ্বিগুণ ঝাল দিয়ে আমি ফুচকা খাবো।বাট আজ তোমাকে এই ফুচকা খেতেই হবে।’
তার কথা শুনে আমি করুণ মুখ করে ফেললাম।এতে অভ্র যেনো একটু খুশিই হলো।ফুচকার প্লেট হাতে নিয়ে বসে শুকনো মুখে একটা ফুচকা তুলে একটু একটু করে মুখের সামনে নিতে লাগলাম।উনি ঠোঁটের কোনায় একটি বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।ফুচকাটা মুখে দেওয়ার আগেই হঠাৎ আমার মুখভঙ্গি পাল্টে গেলো।ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি ফুটিয়ে আমি স্বাচ্ছন্দ্যেই ফুচকাটি মুখে পুরে খেতে লাগলাম।এরপর একের পর এক।এবার অভ্র’রও মুখের ভাব পরিবর্তন হলো।অবাক হয়ে আমার খাওয়া দেখতে লাগলেন।আমাকে শায়েস্তা করতে না পারার ক্ষোভে ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেছে।
উনি হয়তো ভেবেছিলেন আমি এতো ঝাল কিছুতেই খেতে পারবো না।একটু ঝাল লাগতেই চোখে নাকে পানি নিয়ে তার কাছে অনুনয় বিনয় করবো।কিন্তু মিস্টার অভ্র বোধহয় জানেন না অরু কি জিনিস!
আমি প্রচুর ঝাল খেতে পারি।ফুচকা আমি সবসময় ঝাল দিয়েই খাই।যদিও এই ফুচকায় তার চেয়েও ঝাল একটু বেশিই এবং খেতেও আমার একটু বেশি ঝালই লাগছে।তবুও যে মুখ হা হু! করে খেতে পারছি না তা না।আমি পুরো প্লেটই আরামে শেষ করে দিলাম।আমাকে শায়েস্তা করতে না পেরে নিজেই জব্দ হয়ে গিয়ে উনার মুখটা আরো থমথমে হয়ে গেছে।
উনি কোনো কথা না বলে আরেক প্লেট ফুচকা অর্ডার করে তাতে ইচ্ছেমতো শুকনো মরিচের গুঁড়া দিতে লাগলেন।আমার চাইতেও দ্বিগুণ।তার প্লেটে ফুচকা ঢাকা পড়ে শুধু মরিচের লাল রঙই ভেসে রয়েছে।আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম এতো ঝাল তিনি খাবেন কি করে!বাসায় দেখেছি উনি ঝাল একদমই খান না।তরকারিতে একটু ঝাল হলেই চেচাঁমেচি করেন।আর আজ উনি এতো ঝাল খাবেন!
অভ্র খুব শান্ত ভঙ্গিতে একটা ফুচকা মুখে দিলেন।তারপর আবার আরেকটা।একটু ঝালে শব্দ অব্দি করলেন না।মুখ পুরাই শক্ত আর শান্ত।আমার এসব ভালো লাগলো না। উদ্বিগ্ন মুখে বললাম,
‘অনেক হয়েছে,আপনাকে আর খেতে হবে না।প্লিজ এসব রাখুন।’
কিন্তু অভ্র আমার কোনো কথা শুনলো না।কোনো টু শব্দ না করেই শান্ত ভঙ্গিতে একে একে সবকয়টা ফুচকা শেষ করলো।তার মুখটা লাল হয়ে গেছে কিন্তু উনি কিছুই বলছেন না।আমি চিন্তিত মুখে তার পেছন পেছন যেতে লাগলাম।তার শান্ত ভাবটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলছে।
অভ্র চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো।আমিও তার পাশে বসে পড়লাম আর তাকে দেখতে লাগলাম।এক সেকেন্ড,দু সেকেন্ড,তিন সেকেন্ডের মাথায় উনি হঠাৎ জোড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।হাত পা নেড়ে নেড়ে মুখের ঝালে হা হু করতে লাগলেন।আমি দ্রুত গাড়ির পেছনের সিট থেকে পানির বোতল তুলে নিলাম।কিন্তু বোতল পুরো খালি,এক ফোঁটাও পানি নেই।উনার চোখ রক্তিম বর্ণ হয়ে আছে।সাদা শার্টের উপরে ফর্সা মুখটি পুরো লাল হয়ে গেছে,ঝালে উনি পাগলের মতো করছেন।উনাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এই মুহুর্তে নিজের মধ্যেই নেই।উনার এই অবস্থা দেখে আমি কিছুক্ষণ থমকে থেকে ধীরে ধীরে তার কাঁধে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাক দিলাম,
‘অভ্র!’
আর কিছু বলতে পারলাম না।কারণ উনি বলতে দিলেন না।আমার স্পর্শ পেয়েই উনি হঠাৎ তার ঠোঁট এগিয়ে এনে আমার কথা বলার পথ বন্ধ করে দিলেন।ঠোঁটে উনার ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে আমি পুরো স্থির হয়ে গেলাম।চোখ বড় বড় করে প্রচন্ড শক খেয়ে পুরো শরীর যেনো অবশ হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অভ্র ছিটকে দূরে সরে গেলো।আমরা দুজনের কেউই আর কারো সাথে নজর মেলাতে পারলাম না।লজ্জায় আমার মুখটা এবার লাল বর্ণ ধারণ করেছে।অভ্রও ভিষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে।দ্বিতীয় বার আমার দিকে আর আড়চোখেও তাকায়নি।বাকিটা রাস্তা আমরা কেউ কারো সাথে কথা বললাম না।পরিবেশটাই যেন কেমন হয়ে গেছে।দুজনেই গাড়ির মধ্যে পুরো জবুথবু হয়ে বসে রইলাম।
চলবে,