অতঃপর দুজনে একা পর্ব-১৮

0
1660

#অতঃপর দুজনে একা – [১৮]
লাবিবা ওয়াহিদ

—————————-
সময়টা যাচ্ছে খুবই দ্রুতগতিতে৷ এর মাঝে কেটে গেছে আরও এক মাস। প্রায় এক মাস-ই মাহবিন ছিলো আয়ন্তিদের পাশের ফ্ল্যাটটায়। দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, একজন আরেকজনের বাড়ি খাওয়া-দাওয়া হয়েছে৷ নুরুল আলম যখন শুনলেন মেয়ের জ্বরের কথা তখন থেকে দুই তিন বার মেয়ের বাড়ি এসেছেন। নিজের সাথে নিয়ে আসার জন্য জোর করেছেন। কিন্তু আয়ন্তি রাজি হয়নি। একদমই রাজি নয়। একসময় নুরুল আলম দোটানায় পরলেন। তখন স্ত্রী তার পাশে এসে বসলেন। নুরুল আলমের কুচকানো ভ্রু-দ্বয়ের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে থমথমে গলায় শুধালেন,
–“শুনেছেন, আমাদের নিলয়ের ঘরে নাতনি আসছে। ঘর আলো করে আসবে কিছুদিন বাদেই। আমাদের প্রথম প্রদীপ হিসেবে আসবে। যখন আমাদের নাতনিটা পৃথিবীর আলো দেখবে, সবকিছু বুঝতে শিখবে। তখন যদি তার বাবা-মাকে প্রশ্ন করা হয় তার দাদু-দাদী তাকে কতটা স্নেহ করেছে? তখন কেমন লাগবে বলুন তো? নিলয় এবং মেঘার মুখমন্ডলে থাকবে একরাশ হতাশা। তাদের হৃদয়ের সুপ্ত কোণে বেজে উঠবে,
“তোর দাদা-দাদী তোকে কখনো আদর করেনি রে৷ আমাদের কাউকে তাদের বসতিতে আশ্রয় দেয়নি।”
এরকম একটি বাস্তবতা আপনি বা আমি মানতে পারবো? আমি তো কখনোই পারবো না। কোন মানুষ পারবে? সবার-ই নাতি-নাতনীর সখ, ইচ্ছে হয়। আপনি কেন ব্যতিক্রম হলেন? ছেলেটা কী দোষ করেছে? আজ কী আমার পরিবারের চাইতেও আপনার ইগো বড়ো? ইগো করেছিলেন মনে নেই? সেই ইগোতে মেয়েকেও হারালেন। মেয়েটাকে কতদিন হলো একনজর দেখলাম না। আমার ভেতরের ক্ষ’ ত দেখতে পারছেন নিলয়ের আব্বু? ছেলেটা তো খারাপ কিছু করেনি। শুধু বিয়ে করেছে, আল্লাহ্’র ফরজ পালন করেছে৷ আপনি কোথায় ছেলে-বউকে আগলে নিবেন৷ তা না করে উল্টো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন।”

নুরুল আলম চুপটি করে শুনলেন। আয়েশা নুরুল আলমের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখতে পেয়ে হতাশ হলেন। হতাশার সাথে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রুম ত্যাগ করলেন।

–“মেঘা, একদম ভয় পাবে না। আমাদের বেবি সুস্থ। চিন্তার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ্ ভরসা।
–“হু, আল্লাহ্’র ভরসা। এখন কিছু তো খাওয়াও। আমার আর বেবিকে না খাইয়ে রাখার মানে কী? আল্টাসনোগ্রাফ তো হলোই।
–“খাবো তো। শুধু বাইরের স্ট্রিট ফুড খাওয়া যাবে না। ফ্রেশ ফল কিনব। তারপর খেতে খেতে বাসায় ফিরবা। কেমন?”

নিলয়ের প্রস্তাবে মেঘা মুখ বাঁকালো। নিলয় শব্দ করে হাসলো। যত দিন এগিয়ে আসছে, মেঘা দেখতেও তেমন গুলুমুলু আর সুন্দরী হয়ে যাচ্ছে৷ দু’জনেই হসপিটাল থেকে বের হচ্ছিলো। আজ মেঘার আল্ট্রাসনোগ্রাফি সহ বেশ কিছু চেকাপ ছিলো। রিপোর্ট আল্লাহ্’র রহমতে সব ঠিকঠাক। আগামী মাসে মেঘার ডেলিভারি ডেট পরেছে৷ নতুন অতিথির আগমন নিয়ে এই দম্পত্তির হাজারো ব্যস্ততা এবং স্বপ্ন। নিলয় গেটের বাহিরে আসতেই থমকে দাঁড়ালো। মেঘাও থমকে নিলয়ের দিকে তাকালো। চোখে-মুখে বিস্ময় ভর করছে। হয়তো সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি নিলয়ের হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোর কারণ। নিলয়ের দিকে তাকাতেই দেখলো নিলয় অবাকমিশ্রিত দৃষ্টিজোড়া সামনে নিবদ্ধ করে আছে। মেঘাও নিলয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। মুহূর্তে সে নিজেও ‘থ’ হয়ে গেলো। সামনে যে তার শ্বশুর মশাই। নিলয়ের বাবা। নুরুল আলম!

——————————
–“আমার কী মনে হয় জানিস? রিহাব তোকে পছন্দ করে।”

নীলা নাক সিটকালো। আয়ন্তি নীলার গাল টেনে দিয়ে বললো,
–“সিরিয়াস কথা বলছি, সিরিয়াসনেস নিয়ে শোন।”
নীলা বাধ্য মেয়ের মতো আয়ন্তির দিকে তাকালো। তাঁরা দু’জন এখন রিকশা করে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছে। আয়ন্তি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“বিশ্বাস কর, আমার এ জীবনে এত পাগল ছেলে কোথাও দেখিনি। তোর জন্যে যে কী পাগ’ লামী করছে সব কিছুতেই আমি সাক্ষী। ভার্সিটির সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, তোর পিছে পিছে আসা, তোকে হুটহাট প্রপোজ করা। সব কিছুই একদিকে ইঙ্গিত করছে। তোকে ভালোবাসে রিহাব। রিহাব বাইরের কেউ না, মাহবিনের-ই ছোট ভাই। তাহলে তুই কেন বারবার তার সাথে কথা-কাটাকাটি করিস? নিজের জীবন গুছাবি না? এভাবেই কী জীবন চলবে? জীবনের এক ধারাবাহিকতা আছে। সেই ধারাবাহিকতায় কত মানুষ আসবে, যাবে। এই বলে কিছুই থেমে থাকবে না। তাই বললাম তুই বিষয়টা নিয়ে ভাব। আমার মন অন্তত বলছে এবার কোনো গোলমাল হবে না।”
–“কিন্তু এগুলা ফ্লার্ট ছাড়া কিছুই না আয়ন্তি। শায়লা আপু প্রথমদিন-ই বলেছে রিহাব আমার সাথে ফ্লার্ট করছে, তাই যেন সিরিয়াস না নেই। আচ্ছা নিলাম না, নিতেও চাই না। বিদেশী অনুরাগ তার মধ্যে। আমি তোর মতো আর কোনো ওয়াসিফের খপ্পরে পরতে চাই না।”
–“যাচাই করতে কেউ বাঁধা দেয়নি। বিদেশী হলেই সবাই ওয়াসিফ হয়ে যায় না নীলু। কেউ কেউ আলাদা ধাচের রিহাবও হয়। তবুও বলবো সময় নে।”

নীলা আয়ন্তির কথাগুলো নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তবে ইদানীং নিলয়ের ছবিটা তাঁর ওয়ালপেপারে নেই। ছবিও নেই। কেন নেই, তা নীকার নিজেরও জানা নেই। রিহাবকে সে বিশ্বাস করে না। তবে এইটুকু উপলব্ধি করেছে রিহাব তার জীবনের রঙ পাল্টে দিয়েছে৷ রিহাবের উদ্ভট কান্ডগুলো তাকে নিলয়ের ঘোর থেকে টেনে বের করেছে। নিলয় নীলার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। প্রথম ভালোবাসার মানুষটি না চাইলেও সারাজীবন হৃদয়ের এক কোণায় থেকে যায়। এটা স্বাভাবিক। তবে নীলা নিলয়কে একদমই ভুলতে পারছিলো না। এখন উপলব্ধি করছে নিলয় এখন অন্যকারো স্বামী। সে এতই ভাবনায় বিভোর হয়ে পরেছিলো যে বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেনি। কারণ, জীবন নিলয়ের জন্যে বসে নেই। নিলয় তার অতীতে ছিলো। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

—————
বেশ কিছুক্ষণ ধরে একের পর এক কলিংবেল বেজেই চলেছে। দরজার বাহিরে অবস্থানরত ব্যক্তিটির যেন এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার মতো ধৈর্য নেই। বড্ড বেপরোয়া হয়ে আছে, তা কলিংবেল টেপার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে। মাহবিন ওই অবস্থায় চুপ করে কানে হেডফোন দিয়ে কথা বলছে। সোফায় বসেছে হেলান দিয়ে। বাহিরে যে একজন অপেক্ষা করছে এতে কোনারূপ ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন সে জানে দরজার ওপাশের ব্যক্তিটি কে? মাহবিন কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে নিরবে বসে আছে। মুহূর্তে-ই কলের অপর প্রান্তের মানুষটির কন্ঠস্বর শ্রবণ হলো।
–“এত কলিংবেল কে বাজাচ্ছে ভাইয়া? তুমি দরজা খুলছো না?”
–“কেউ না। তোরা দ্রুত আয়। আর কতটুকু পথ বাকি?”
–“এইতো প্রায় চলে এসেছে। পাঁচ মিনিট লাগবে।”

মাহবিন কল কেটে দিলো। ব্লুটুথ নামিয়ে হেলেদুলে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হলো। দরজা খোলার আগে আবার সে রিহাবকে কল দিয়ে পাওয়ার বাটন ক্লিক করলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দরজা খুললো। সঙ্গে সঙ্গেই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সোনিয়া। শাকিলও এসেছে। তবে সে বাইরে অবস্থান করছে। ভাব-ভঙ্গি এমন যেন সোনিয়ার মতো তাঁর তেমন তাড়া নেই। তবে তার মুখশ্রী বিষন্ন, ভয়াবহ। সোনিস অসম্ভব ফুঁসছে। ক্রোধে তার দেহ রিঁ রিঁ করছে। মুখ লাল। গতকাল অনেক কষ্টে মাহবিনের ঠিকানা বের করেছে। রিহাবের থেকে জেনেছে। মাহবিন পকেটে এক হাত রেখে দরজা থেকে সরে আসলো। সঙ্গে সঙ্গে শাকিলও প্রবেশ করলো। যেন মাহবিনের ভেতরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। আজ তাঁদের চেহারায় অন্যরকম সেই আমেজটা নেই। বর্তমানে তাঁদের মুখশ্রী যে কেউ-ই পরে ফেলবে৷ বুঝতে পারবে এই দম্পত্তি তাঁদের সর্বস্ব খুইয়েছে৷

সোনিয়া সময় বিলম্ব না করে হুংকার ছেড়ে উঠলো,
–“তুই আমার পেটের সন্তান হয়ে আমাদের রাস্তায় নামালি? এত দাপট দেখাস? বাপে মরসে, সম্পত্তির এক ভাগও দিলি না, যেখানে আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। শু**** বা**! তোরে জম্ম দেয়াই আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিলো। কেমনে পারলি এমন একটা কাজ করতে? বিবেকে বাঁধলো না?”

মাহবিন নিরবে শুনে গেলো। তার চেহারায় এক ফোঁটাও রাগ বা দুঃখ প্রকাশ পায়নি। বরং এই দিনটার জন্যই ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করেছে, কঠিন করেছে। আজ নিশ্চয়ই এই দু’মুখো বি’ ষের তেঁতো কথাবার্তা তার ধৈর্যশক্তিকে বিফলে ফেলবে না। অনেক পরিকল্পনার পর এই দিন এসেছে। কম বুদ্ধি ব্যয় করেনি এই দিনের জন্যে। মাহবিন হাসলো। সোনিয়ার কাঁটা গায়ে নুঁনের ছিঁটা দিতে ঘর কাঁপিয়ে হাসলো। হাসতে হাসতে চোখের কোণ ভিঁজে গেল। এ যেন বিজয়ের হাসি। আনন্দের হাসি। হাসতে হাসতে একসময় থামলো মাহবিন।
–“আপনাদের সাহস দেখে বড্ড অবাক হই। হাতে নেই এক আনাও, তাও অহংকার ভাঙ্গে না। এত টাকা-পয়সা দিয়ে কী হবে? আপনাদের সম্পত্তির ভাগ দিবো-ই বা কেন? আপনার সাথে তো আমার বাবার ডিভোর্স হয়েছে সেই ছোটবেলাতেই। তাহলে এত কাহিনী করার কী মানে? কাজে পারেন না দেখে কথায় লাগতে আসছেন, বাহ্! খুব চমৎকার বিষয় তো।”

সোনিয়া কিছু বলতে নিলো, মাহবিন থামিয়ে দিলো। মাহবিনের মুখশ্রীতে এখন পুরো দমে গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। সে কী ভয়ংকর লাগছে তাকে। মাহবিন রাশভারী কন্ঠে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“খুব টাকার গরম দেখিয়েছিলেন না? আজ সেই টাকা আর ক্ষমতা দিয়েই আপনাদের পিষে ফেললাম। এবার লোন কীভাবে শোধ করবেন, আপনাদের বিষয়।”
এবার সোনিয়া না পেরে বেশ অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করলো। অতীতের কীর্তিকলাপ সব মুখে প্রকাশ করলো। মানুষের গোপন সত্যি তখনই বেরিয়ে আসে যখন মানুষটি অসম্ভব রেগে কাহিল হয়ে পরে। সোনিয়ার বেলাতেও ব্যতিক্রম হলো না। রাগের মাথায় মাহবিনকে এবং তার বাবাকেও খুব রকম গালাগাল করলো। একসময় না পেরে এও বলে ওঠে,
–“যেদিন তোর জম্ম হইছে, আমার উচিত ছিলো সেদিনই তোকে গলা টিপে হ/ ত্যা করার। তোর বাপরেও বালিশ চাপা দিয়ে হ/ ত্যা করার। ম/ রাডা ম’ রেও আমায় অশান্তিতে ফেলে গেলো। তোদের বাপ-ছেলেরে…”

বাহিরে শব্দ হওয়ায় সোনিয়া থামলো। মাহবিনের পিছে তাকাতেই যেন আকাশ থেকে পরলো। রিহাব এবং শায়লা দাঁড়িয়ে আছে। রিহাবের কানে ফোন। চোখ-মুখ অসম্ভব শক্ত। চোখ রক্তিম হয়ে টলমলে। পাশে দাঁড়ানো শায়লার চোখে জল। যেটা গাল স্পর্শ করেছে অনেক আগেই। সোনিয়ার মাথায় হাত। উপলব্ধি করতে পারছে রাগের মাথায় বেহুঁশ ছিলো সে, সেই বেহুঁশতা তার জীবনে কাল ডেকে আনবে শীঘ্রই।

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে