#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
২.
‘ভেজা চুল দেখিয়ে নিজের প্রতি আকর্ষণ করতে চাও!কি ভেবেছো তুমি!মুভি স্টাইলে সকাল সকাল আমার ঘুমন্ত মুখে চুলের পানি ইচ্ছে করে ছিটাবে আর ওমনি আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে যাবো।হ্যাঁ?’
কি বিপাকে পড়ে গেলাম!গতকাল সারা দিন,রাত একটানা বিয়ের বেনারসি শাড়ি পড়ে থাকায় খুব গরম লাগছিলো তাই সকাল সকাল গোসলটা সেড়ে নেই।এখন গোসল করাতেও এতো সমস্যা হয়ে যাবে কে জানতো!আমি তো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল আঁচড়াচ্ছিলাম।চুল আঁচড়ানো শুরু করতে না করতেই বিছানায় এতো দূরে পানি গেলো কি করে কে জানে!এমনভাবে শক্ত হাতে কাঁধটা ধরেছে যে মনে হচ্ছে ব্যাথা বানিয়েই ছাড়বে।
‘খবরদার!আর কখনো যেনো আমার সামনে ভেজা চুলে না দেখি।’
কথাটি বলে অভ্র ভাইয়া কাঁধ ছেড়ে দিতেই হঠাৎ তার চোখ পড়লো আমার হাতের দিকে।এবার আমার মেহেদী পড়া হাত দুটো তার চোখের সামনে মেলে ধরে ঝাঁকানো শুরু করে চেঁচাতে লাগলেন,
-‘তোমার হাতে A লিখে রেখেছো কেনো?বলো!
A তে তো আমার নাম।আগে থেকেই জানতে এসব হবে?জবাব দাও!’
তার কথার আমি কি জবাব দিবো বুঝতে পারছি না।ইরা আপুর থেকে ছ্যাকা খেয়ে কি তার মাথা পুরো আউট হয়ে গেলো?কি আবোল তাবোল বকছে তা কি সে বুঝতে পারছে!আমি আগে থেকে কি জানবো?আমি কি নিজে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি নাকি!
-‘কি হলো?কথা বলছো না কেনো!’
তার অনবরত ধমকের চোটে এবার আমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে বললাম,
-‘আমার নামও তো অরু,A দিয়ে শুরু।’
নিজের উদ্ধৃত আচরণ আর বোকামো বুঝতে পেরে তিনি কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মেঝের দিকে দু একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলেন আর আমিও সেখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর তার এক দূরসম্পর্কের ভাবী এসে আমাকে একটি গোলাপী রঙের শাড়ী পড়িয়ে দিয়ে বাইরে নিয়ে গেলেন।বাইরে গিয়ে দেখি বাড়িতে মেহমান ভালোই আছে।সবার মুখ গোমড়া হয়ে আছে,আমাকে এমন ভাবে দেখছে যেনো আমি তাদের সবার কিডনি চুরি করে পালিয়ে ধরা পড়ে গেছি।এতোগুলো তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টির মেলায় একজোড়া নিষ্পাপ চোখ আমার দিকে তাকিয়ে দৌঁড়ে এসে কোলে উঠে দুহাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে রাখলো।গালে তার নরম ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে সামনে দাঁড়ানো সুতি শাড়ি পরিহিতা মাঝ বয়সী একজন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আম্মু দেখো মামানিকে দেখতে কি সুন্দর লাগছে!ঠিক যেনো একটা গোলাপী পরী!’
বাচ্চাটার কথায় আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে ইনিই অভ্র ভাইয়ার বড় বোন আরিশা আপু।পাশ থেকে একজন মহিলা আরেকজনকে বলতে লাগলো,
-‘এই বোনটাও তো ভালোই সুন্দরী।তবে ঐ বোনটার গায়ের রং আরো ফর্সা ছিলো।কি
বলো?’
-‘হুম।কিন্তু এই জনের আবার চেহারায় ঢক বেশী।
অভ্র’র সাথে ভালোই মানায়।’
-‘মানাবে না কেনো!আমাদের অভ্র লাখে একটা।কি সুন্দর দুধ বরন গায়ের রং,তেমনি চেহারাও মাশআল্লাহ।একটা শুকনা মড়া গাছের সাথে দাঁড় করিয়ে রাখলেও ও’র সৌন্দর্য্যে তার ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।কতো বললাম!আমার বোনের মেয়েটারে আনতে ও’র সাথে আরো ভালো মানাতো।কিন্তু কে শোনে কার কথা!মামী যে ও’র ভলো চায় তা তো আর বুঝলো না।পরে রইলো এই বোনদের পেছনে।বড়টা পালাইছে ছোটোটা আবার কি করে তার কি ঠিক আছে!যতই সুন্দরী হোক স্বভাবতো মনে হয় বোনদের বোনদের একই!’
ওনার শেষোক্ত কথাটি শুনে আমার চোখ ভিজে উঠলো।কতো অনায়াসেই সবাই আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠিয়ে ফেলছে।এই অচেনা পুরীতে নিজেকে বড্ড একলা আর অসহায় লাগছে।
-‘না!আমার মামানি সব থেকে বেস্ট।’
ছোট্ট ছেলেটি আমার গালে পুনরায় তার ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,’আমার মিষ্টি মামানি।আম্মু, আমার এই মামানিটাই বেশি পছন্দ হয়েছে।ঐ বুড়ি এমন কটকট করে কথা বলে কেনো!’
‘তুতুল চুপ!বড়দের নিয়ে এভাবে কথা বলে!যাও ভেতরে যাও।’
মার বকায় তুতুল সোনা মুখ গোমড়া করে ভেতরে চলে গেল।আরিশা আপু এরপর তার মামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘আহ্! মামী আপনারা কি শুরু করলেন বলেন তো।যা হবার তা হয়ে গেছে।এখন এসব বলে কি কোনো লাভ হবে!’
কথাটা বলে আরিশা আপু একবার বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।এই বাড়ির কেউই যে আমাকে ঠিক পছন্দ করছেন না তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন যা কিছু হয়েছে সেসব কিছুর পেছনে আমারই হাত ছিলো।সবকিছুর জন্য একমাত্র দায়ী আমি।
৩.
অভ্র ভাইয়ার মা মিসেস সালেহা বেগম মাইগ্রেইনের ব্যাথায় বিছানায় শয্যাশয়ী হয়ে রয়েছেন।গতকাল ছেলের হবু বউয়ের পালিয়ে যাওয়ার খবর শোনার পর থেকেই নাকি তার এই প্রচন্ড মাইগ্রেইনের ব্যাথা হামলা করেছে।আর যখন শুনতে পেলেন সেই মেয়ের ছোট বোনকেই তার ছেলে জেদের বশত বিয়ে করে এনেছে তখন থেকে তিনি আর বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছেন না।তার একমাত্র ছেলের বউকেও তিনি এখনও স্বচক্ষে দেখেননি।সেই সুবাদে আমাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তার কক্ষে।উনার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম।দুই বিবাহিত ছেলে মেয়ের মা হয়েও তার মধ্যে এখনো যথেষ্ট সৌন্দর্য্য ফুটে আছে।একটি সাদা জমিনের অ্যাশ কালারের সুতি শাড়ি পড়ে বিছানায় সাদা চাদরটি কোমড় পর্যন্ত টেনে তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।কারো ডাকে চোখদুটো ইষৎ মেলে গম্ভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে একটানা তাকিয়ে রইলেন।আমি শুধু একবার সালাম দিয়ে হাত দিয়ে শাড়ির ঘোমটা টা আরেকটু টেনে মাথা অল্প নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তাদের সবার আমার দিকে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখতে দেখতে এবার আমার মধ্যেও কেমন যেন একটা অপরাধী অপরাধী ভাব এসে পড়েছে।রুমের মধ্যে অনেকেই ছিলো।সবাই পিনপতন নিরবতা বিরাজ করে রয়েছে।আমার শ্বাশুড়ি মা সেভাবেই আমার দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে তার মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘আরিশা,জানালার পর্দাটা আরেকটু টেনে দাও।আমার চোখে আলো লাগছে।’
কথাটা বলে তিনি পুনরায় কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলেন।সবাই বুঝে গেল এখানে তিনি আর কারো উপস্থিতি চাইছেন না।তাই আমাকে সহ সবাই বেড়িয়ে এলো।
এই বাড়িতে একটি মানুষকেই শুধু দেখলাম যিনি আমার দিকে বিরক্তিমাখা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন না।তিনি হলেন আরিশা আপুর হাজবেন্ড শফিক ভাই।খুব হাসিখুশি একজন মানুষ,সবসময় সবার সাথে মজা করে চলেছে।কিছু কিছু মানুষ অন্যদের হাসাতে পারার এক অদ্ভুত সুন্দর ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।তিনি তাদের মধ্যে একজন।আরিশা আপু যেমন গম্ভীর তিনি তেমন হাস্যময়ী।দুজন পুরো বিপরীত তবুও একে অপরের জন্য পারফেক্ট।
নাস্তার টেবিলে দুলাভাই আমাকে খেতে না দিয়ে কিছুক্ষণ পরে অভ্র ভাইয়াকে রুম থেকে জোর করে টেনে এনে কিছু দুষ্টুমি মাখা কথা বলে আমাকে সহ অভ্র ভাইয়াকে পাশের একটি রুমে টেনে নিয়ে গেলেন।এক প্লেটে খাবার দিয়ে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে বলতে লাগলেন,
‘প্লেট পুরো খালি করলে তারপর দুজনকে বের হতে দিবো।শালা সাহেব,এবার দুজন দুজনকে নিজ হাতে খাইয়ে দেন।কতটা সুবিধা করে দিলাম দেখেছেন, একা একা এখন আর লজ্জা পেতে হবে না।’
দুলাভাইয়ের এমন পাগলামিতে আরিশা আপু যে আপত্তি করছিলো তা ভেতর থেকে বোঝা যাচ্ছিলো।অভ্র ভাইয়া তখন থেকেই চরম রাগ করছেন।বারবার দরজা পিটিয়ে বলছেন,
-‘দুলাভাই….দুলাভাই দরজা খুলেন।সবসময় কিন্তু মজা ভালো লাগে না।’
দুলাভাইয়ের কোনো সারা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।সম্ভবত তিনি দরজার ওপারে সবাইকে নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়েছেন।অভ্র ভাইয়া অনবরত দরজায় বারি দিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন।আর আমি চুপচাপ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
-‘দুলাভাই….দুলাভাই!কেউ কি শুনতে পাচ্ছে না নাকি!ডেম ইট!’
দরজায় একটি জোড়ে হাত দিয়ে বারি দিয়ে তিনি একটু নিঃশ্বাস ফেলে কোমড়ে দু হাত দিয়ে আমার দিকে তাকালেন।আমি ঝটপট মাথা নিচু করে ফেললাম।আমার চরম অস্বস্তি লাগছে সাথে ভয়ও।এমনিতেই উনাকে এখন আমার খুব ভয় লাগে তারউপর উনার সাথে একা একটা রুমে এভাবে আটকে আছি এই প্রথমবার….!নাহ্! কথাটা ভুল।এই প্রথমবার নয় দ্বিতীয়বার।কারণ আরো একবার তার সাথে একা একটি রুমে ফেঁসে গিয়েছিলাম।
ইরা আপুর বেস্ট ফ্রেন্ড সায়মা আপুর বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো।তাদের ক্লাসের সকলকেই ইনভাইট করা হয়েছিল।সায়মা আপুর সাথে ভালো সখ্যতার দরুণ আমিও সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলাম।বিয়ের কার্যক্রম শুরুর পর্যায়ে হঠাৎ ইরা আপুর মনে পড়ে তার পার্স সে দোতলার একটি রুমে ভুলে ফেলে এসেছে যেখানে একটি ছোট্ট মেকআপ কিট রয়েছে যা একটু পরপর আপুর প্রয়োজন হয়।সেই পার্স আনতে আপু আমাকে নিয়ে যাত্রা করে দোতলায়।কিন্তু সিঁড়ির কাছে আসতেই একজন ফটোগ্রাফারকে পেয়ে আপু ছবি তোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং আমাকে একাই পাঠায়।বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে পরায় সবাই নিচে চলে গেছে।দোতলায় এখন পুরো শুনশান নিরবতা।পার্স নিয়ে ফেরত আসছিলাম এর মাঝে আবার দোতলার লাইট সব চলে গেলো।হয়তো লোডশেডিং,নিচে জেনারেটরের ব্যাবস্থা করায় সেখান থেকে আসা মৃদু আলো দোতলার ঘন অন্ধকারকে কাটিয়ে আবছা করে রেখেছে।সেই আবছা আলোকে অনুসরণ করেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম।কিন্তু হঠাৎ একটি রুমের সামনে দিয়ে যেতেই রুমটির বন্ধ দরজা খুলে গিয়ে একটি হাত আচমকা আমাকে ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে টেনে নিল।আমি চেঁচাতে যাবো তার আগেই আমার মুখ হাত দিয়ে চেঁপে ধরে আমাকে দেয়ালের সাথে দু হাত দিয়ে আঁটকে দিলো।আর আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই চট করে আমার গালে একটি কিস করে মৃদু হেঁসে একটি পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠলো,
‘এবার হ্যাপি তো?’
সাথে সাথে লাইট চলে আসলো।তাকিয়ে দেখি আমার সামনে অভ্র ভাইয়া।আমি চোখ বড় বড় করে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি।মনে হচ্ছে আমার চোখ যেন কোটর থেকে এক্ষুনি বেড়িয়ে আসবে তার অবস্থাও সেম।মুখের মৃদু হাসি গায়েব হয়ে গিয়ে সেখানে এখন বিস্ময় রাজ্যের সাম্রাজ্যতা এসে ভর করেছে।বিস্ময় ভাব কাটিয়ে তিনি দ্রুত আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বারবার বলতে লাগলেন,
‘স্যরি..স্যরি…স্যরি।আমি আসলে ভেবেছিলাম ইরা।’
তার গলা দিয়ে আর কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।বেচারা এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে কি বলবে কি করবে ভাবতে ভাবতে একবার হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে আবার পরক্ষনে রুমাল খোঁজার জন্য একবার বুকে একবার সাইড পকেটে দ্রুত হাত বুলাতে থাকে।আর আমি তখনও খাম্বার মতো বিস্মিত চোখে তাকিয়ে স্থির হয়ে রইলাম।তার এমন অস্থিরতা দেখে আমি আরও জমে রইলাম।তার চেহারার অবস্থা সেই মুহুর্তে দেখার মতো ছিলো!
আমাকে কিছু একটা আমতা আমতা করে বলতে গিয়ে বলার মতো কিছু না পেয়ে বেকুবের মতো একটি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে দ্রুত দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় দরজার সাথে জোড়ে মাথায় বাড়ি খেয়ে বসলো।কপালে হাত দিয়ে একটু থেমে পুনরায় যাওয়ার সময় আবার পায়ে হোঁচট খেলো।কিন্তু এবার আর থামলো না সোজা এক ছুটে পালালো।আর আমি এক মিনিটের মধ্যে ঘটে যাওয়া এতকিছু দেখে তারপরের পাঁচ মিনিটও সেখানে শকড হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
‘হাসছো কেনো?’
সেদিন অভ্র ভাইয়ার চেহারা আর অস্থিরতার কান্ডগুলোর কথা মনে পড়ে আনমনে কখন যে মুচকি মুচকি হাসা শুরু করেছি সেদিকে টেরই পায়নি।অভ্র ভাইয়ার কথায় ঘোর কাটায় হাসি গায়েব হয়ে গেলো।মাথা নিচু করে মৃদু ঝাঁকিয়ে বোঝালাম কিছু না।
হঠাৎ আমার ফোনে একটি আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে আমি রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
‘হ্যালো!অরু,তুই ঠিক আছিস?’
আমি বিস্মিত স্বরে বলে উঠলাম,’ইরা আপু!’
‘আমি যা শুনলাম তা কি সত্যি! অভ্র নাকি তোকে…..
ইরা আপুর কথার মাঝ পথে অভ্র ভাইয়া এসে আমার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে উচ্চ স্বরে ইরা আপুকে বলতে লাগলো,
‘হ্যাঁ,তুমি ঠিকই শুনেছো,তোমার বোনকে আমি বিয়ে করেছি।কি ভেবেছো?এতো সহজে ছাড় পাবে।হ্যালো! ইরা….ইরা!’
ইরা আপু হয়তো ফোন কেটে দিয়েছে।অভ্র ভাইয়া কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে রাগের চোটে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে খাবারের প্লেট হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল।কাঁচের প্লেটটা চুরমার হয়ে ভেঙে গিয়ে খাবার গুলো পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়লো।আমি ভয়ে পুরো জড়সড় হয়ে পরলাম।এরপর তিনি দ্রুত গতিতে আমার দিকে এগিয়ে এসে শক্ত হাতে আমাকে ধরে দাঁত কটমট করে বলতে লাগলো,
‘খবরদার!ইরার সাথে যেনো আর কখনো কথা বলতে না দেখি।না হলে কিন্তু…..
‘অভ্র!’
অভ্র ভাইয়ার বাবা মি.শাহাদাত হোসেন দরজা খুলে অভ্র ভাইয়াকে ধমক দিলে অভ্র ভাইয়া আমাকে ছেড়ে রাগে দ্রুত গতিতে রুম ত্যাগ করলো।আর তার বাবা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।হয়তো তিনি কিছু বলতে চাইছিলেন,কিন্তু বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
৪.
সকাল থেকে বারবার আটকে রাখা অশ্রু আমি আর আটকাতে পারলাম না।যখন জানতে পারলাম,আজ আমাকে আমাদের বাড়িতে যেতে দেওয়া হবে না।বিয়ে উপলক্ষে যেই বিশাল বৌ ভাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো সেটা ক্যান্সেল করা হয়েছে।নিয়ম অনুযায়ী আজই তো বর নিয়ে কনের বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা।পরিস্থিতি এখন ঠিক নেই বলে বলা হয়েছে দু একদিন পর আমাদের পাঠানো হবে ও বাড়ি।কিন্তু আমার মন মানছে না।কেমন যেন দম আটকে আসছে এখানে।ছুটে নিজের বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে।একধরনের ভয় শুধু মনকে সর্বদা গ্রাস করে রাখছে।এভাবে কি কোথাও থাকা যায়!
দোতলার সিঁড়ির কর্ণারে রেলিং ধরে অশ্রু চোখে দাঁড়িয়েছিলাম।কারো পদচারণের শব্দে সচকিত হয়ে দ্রুত অশ্রু মুছে ফেললাম।মুখে একটি নকল ফ্যাকাসে হাসি টেনে এনে পাশে তাকিয়ে দেখলাম অভ্র ভাইয়ার বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন।আমার মাথায় হাত রেখে তিনি নরম গলায় বললেন,
‘অরু মা,আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।যে ব্যবহার তুমি সবার থেকে পাচ্ছো তা তোমার প্রাপ্য নয়,যা কিছু হয়েছে সেখানে তোমার কোনো হাত নেই।তবুও তোমাকে এসব ভোগ করতে হচ্ছে।অভ্র’র আচরণে কষ্ট পেয়ো না মা।আমার ছেলেটা মোটেও এমন নয়।তীব্র আঘাত ওঁকে এখন আবেগশূণ্য করে রেখেছে।ও নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে না ও কি করছে।ভালোবাসা থেকে প্রাপ্ত ধোঁকার আঘাত যে খুব তীক্ষ্ণ কষ্টের হয়।ও’র এখন একজনের সঙ্গ’র খুব প্রয়োজন।যে ওঁর নির্জীব দেহে আবার প্রান ফিরিয়ে আনবে।আর আমি জানি এই কাজটা একমাত্র তুমিই পারবে।তোমার কি মনে হয় অভ্র তোমাকে বিয়ে করতে চাইলো আর ওমনি আমি শুধু শুধু রাজী হয়ে গেলাম!না,এতটা নির্বোধ আমি নই যে ছেলের জেদের বশে হুট করে নেওয়া এত বড় একটি সিদ্ধান্তকে মেনে নিবো।আমি মেনে নিয়েছি কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম,তুমিই সেই জল যে আমার ছেলের রক্তাক্ত বুকের মৃতপ্রায় হৃদয় নামক চারা গাছে পুনরায় প্রাণ এনে দিবে।যাকে পেয়ে আমার ছেলে আবারো প্রাণবন্ত হতে পারবে।
কাল যখন আমরা তোমাদের বাড়িতে জানতে পারলাম ইরা পালিয়ে গেছে তখন যেখানে আমরা সবাই আমাদের নিজ নিজ সম্মানের ভয়ে চিন্তিত ছিলাম সেখানে একমাত্র তুমিই ছিলে যে আপনজন না হয়েও কোনো মান সম্মানের চিন্তা না করে অভ্র’র দিকে শুধু ব্যথিত চোখে তাকিয়ে ছিলে।তোমাকে তখন কি মনে হচ্ছিলো জানো!তুমি অভ্র’র আয়না।অভ্র’র কষ্টের প্রতিফলন তোমার চোখে দেখা যাচ্ছিলো।তাই তো ছেলের জন্য একটু স্বার্থপর হয়ে গিয়ে তুমি কি চাও তা না জেনেই অভ্র’র প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাই।পারলে এই বুড়ো বাবাকে ক্ষমা করে দিয়ো।আর আমার ছেলেটাকে ঠিক করে দিয়ো।’
কথাগুলো বলে অভ্র ভাইয়ার বাবা বা হাত দিয়ে চশমা খুলে চোখ মুছে সেখান থেকে চলে গেল।আমি শুধু নিশ্চুপ হয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম।আমার আর কিই বা বলার ছিলো!কতটা বিশ্বাস ছিলো তার দৃষ্টিতে আমার প্রতি।আমি কি সেই বিশ্বাস আদৌ রাখতে পারবো।
রুমে আসতেই দেখলাম অভ্র ভাইয়া সোফায় বসে কাঁদছে।আমার শব্দ পেয়েই তিনি দ্রুত চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।অশ্রু ভেজা লাল হয়ে যাওয়া চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সোফার কাছে যেতেই দেখতে পারলাম সেখানে অভ্র ভাইয়া আর ইরা আপুর বিয়ের কার্ড পড়ে রয়েছে।তার মানে এটাকে ধরেই সে এতক্ষণ কাঁদছিলো।কিছুক্ষণ আগে তার করা আচরণে যতটুকু ভয় আর তার প্রতি বিতৃষ্ণা জেগেছিলো তার অশ্রু দেখে এখন সবটা উদ্বেগ আর সহানুভূতিতে রুপান্তরিত হয়ে গেলো।তিনি যেই কষ্ট পাচ্ছেন তার কাছে তো আমার কষ্ট আর কিছুই না।আর এই কষ্টের জন্য দায়ী তো আমার নিজের বোনই।একারণে নিজেকেও কোনো না কোনো ভাবে অপরাধীই মনে হয়।
৫.
আমাদের বিয়ের আজ চারদিন হলো।আজ আমাদের ও বাড়িতে যাওয়ার কথা।আমার বাবা আর কাকারা আমাদের নিতে এসেছে।অভ্র জানিয়ে দিলো তিনি যাবেন না।তার বাবা আর দুলাভাই মিলে অনেক জোরাজোরি করেও তাকে রাজী করাতে পারলেন না।শেষে তার বাবা এসে আমার বাবাকে বললো,
‘অভ্র’র শরীরটা বেশ ভালো নেই।কিছু মনে করবেন না বেয়াই,ও না হয় অরু মাকে ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে যাবে।’
বাবাও আর বেশি জোর করলেন না।হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছেন কারণটা,হয়তো না।
রুমে আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম।হঠাৎ তখন অভ্র এসে আমাকে ভ্রু কুঁচকে বলতে লাগলো,
‘সেখানে যে যাচ্ছো আবার সবসময়ের জন্য থেকে যেও না।তোমরা বোনরা বোনরা তো আবার হুট করে ছেড়ে যেতে ভালোই পারো।’
কথাটি বলে তিনি সেখান থেকে চলে যাবার জন্য উদ্যত হলে আমি পেছন থেকে তাকে বললাম,
‘চিন্তা করবেন না।আপনার অনুমতি ছাড়া আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবো না।’
পেছনে ঘাড় ঘুড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পুনরায় চলে গেলেন।আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া সীমাবদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চলবে,,