হলুদ খাম ৫.

0
1170
হলুদ খাম ৫.
অনুজের টিফিন বক্সের দিকে চোখ পরতে খেয়াল করলাম খুব সাধারণ খাবার। সাদা ভাত, ভাজি। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। আমার অবশ্য এরচেয়ে বেশি আইটেম। মুরগির মাংস, মসুরের ডাল সাথে সালাদ। একসাথে লাঞ্চ করার সময় একজনের ভাত, ভাজি আরেকজনের মাংস ভাত ; কেমন অড দেখাচ্ছে। ভাজি, ভাতই অনুজ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে খাচ্ছে। মাংসের বাটি থেকে বড় টুকরোটা অনুজের প্লেটে দিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম
– আপনার আম্মা বুঝি অসুস্থ?
অনুজ আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বললেন
– আমার মা – বাবা বেশ আগেই মারা গেছেন ম্যাম। আসলে আজকে বাসায় বুয়া আসেনি। একা একা এতো কাজ সামলে রান্নাটা করার তেমন সুযোগ হয়নি। এই শহরে মন্ত্রীদের তুলনায় বুয়াদের দেখা পাওয়া কঠিন।
– আচ্ছা।
অনুজ নিজ থেকেই ডাল নিয়ে নিলেন। লাঞ্চ শেষ করে যার যার কাজে চলে এলাম। অনুজকে তার নিজের ডেস্কে বেশ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখলাম। আমার হাতে আপাতত কাজ নেই। তাই কেবিন ছেড়ে ক্যান্টিন থেকে ব্ল্যাক কফি নিয়ে বসে অফিসের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি৷ যদিও মন বসাতে পারছিনা।
ফেসবুকে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার অফলাইনে চলে এলাম। অফিস থেকে ফিরে গোসল করে নিলাম। সন্ধ্যায় মায়ের পাশে কিছু সময় কাটালাম৷ মা ছোটটা আর মেজোটাকে নিয়ে এক হাড়ি নালিশ করলো। বাবা মীরা আর নীরাকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। সন্ধ্যা হলে আজকাল রুটিন করে পড়তে বসান বাবা। এতে বাবারও সময় কেটে যায় আর ওদেরও ফাঁকি দেয়ার সুযোগটা কমে আসে।
রাতে ঘুমানোর আগে অনলাইনে এসে বেশ অবাক হলাম। অনুজ সাহেব  ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছেন! যতদূর জানি ওনার ফেসবুক একাউন্ট নেই। রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে প্রোফাইল ঘেটে বুঝতে পারলাম। আজকেই নতুন আইডি খুলেছেন। প্রোফাইলে সেই গোমড়া মুখের ছবি। একটু হেসে ছবি তুললে কী হয়? অনুজ সাহেবের হাসিটা খুব মিষ্টি।
যারা খুব কম হাসে বা একেবারেই হাসেনা তাদের হাসি খুব সুন্দর আর মিষ্টি হয়। এরা হাসেনা,  যদি কেউ প্রেমে ট্রেমে পড়ে যায় – সেই ভয়ে।
ওনার বাসায় তো কাজের বুয়া আসেনি। রাতেও কি একই খাবার খেয়েছে নাকি?
ভাবতে ভাবতেই ফেসবুকে ম্যাসেজ দিলাম।
– আচ্ছা আপনি কি রাতেও ভাজি আর ভাত খেয়েছেন?
অনুজ এক্টিভ আছেন। ম্যাসেজ সাথে সাথে সিন হলো। টাইপিং সাইন দেখাচ্ছে। ভয় ভয় লাগতেছে। উনি আবার মাইন্ডে নিলো নাকি?
ম্যাসেজের রিপ্লাই দেখে শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। লিখেছেন
– না, রাতে রুটি আর ভাজি খেয়েছি।
আমি একটা হাসির ইমো দিলাম।
উনি রিপ্লাই দিলেন
– মাংস আর ডাল খুব সুস্বাদু ছিলো। আপনার কাজের বুয়াটা দারুণ রান্না করে।
– হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন বাসায় কাজের বুয়া রান্না করে। মাও তো।রান্না করতে পারে!
একটা হাসির ইমো দিয়ে লিখেছেন
– আপনার মা অনেক অসুস্থ আর বিছানায় পরা। পুরো অফিস জানে। আর আপনার হাতের নখ আর আঙুল দেখে মনে হয়না আপনি রান্নাবান্নার কাজে কখনো যান। হঠাৎ শখের বশে রান্না করেন বা টুকটাক নাস্তা বানান।
– হ্যাঁ আমার এখন ভালো লাগেনা রান্না করতে। একসময় করতাম। আচ্ছা আমার ছোট দুই বোন আছে তারাও তো রান্না করতে পারতো তাই না? আপনি কাজের বুয়া কীভাবে শিওর হলেন?
– শুনুন, আমি ব্যাচেলর মানুষ আর মা – বাবা অনেক আগেই গত হয়েছেন। তাই বড় হয়ে ওঠা কাজের বুয়াদের রান্না করা খাবার খেয়েই। তাই তারা যতই ভালো রান্না করুক না কেনো আমি বুঝতে পারি।
– এতো কিছু খেয়াল আর চিন্তা কীভাবে করলেন?
অনুজ হাসির ইমো দিয়ে বললেন
– একা মানুষ। কথা বলারও কেউ নেই আর ঘোরাঘুরি করারও কেউ নেই। কিছু একটা নিয়ে থাকতে হয়। বুঝতেই পারছেন।
– কাজের বুয়া কালকেও আসবেনা?
– না, তার নাকি জ্বর। জানেন তো এই শহরের সব কাজের বুয়ার ঘনঘন জ্বর আসে। গত মাসেই দশ দিনের মতো ছুটি কাটিয়েছে জ্বরের অজুহাতে।
– আপনি বলতে চাচ্ছেন তাদের জ্বর আসেনা। মিথ্যা বলে?
– জ্বর আসেনা সেটা বলছিনা। জ্বর আসে বাট ধরুন ৬-৭ মাসে একবার। আর বাকি গুলো ছুটি কাটানোর অজুহাত মাত্র।
– আমি তো এতো কিছু নোটিশ করিনি।
– আপনি অনেক কিছুই নোটিশ করেননা। আপনার চোখ কান বন্ধ করে চলাচল করার ব্যাপারটা আমাকে অবাক করে।
– আসলে নিজের চিন্তায় আমি চিন্তিত সেখানে অন্যের বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সময় কই?
– সময় আছে। তবে আপনি নিজেকে নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকেন। একটু আশেপাশে তাকিয়ে দেখবেন, কী চলছে? ভাববেন, কেনো চলছে? বুঝেছেন?
– বুঝলাম।
অনুজ ঘুমের ইমো দিয়ে বললেন
– সকালে অফিসে লেট হলে আপনার ঝাড়ি খেতে হবে ম্যাম। তাই এখনকার মতো টা টা।
– এক মিনিট অনুজ।
– তাড়াতাড়ি বলুন।
– আমি আজ পর্যন্ত আমার জুনিয়র স্টাফদের ঝাড়ি দিয়েছি?
– না, আমার সামনে পড়েনি আর কানেও আসেনি।
– তাহলে বললেন কেন?
– কথার কথা বলেছি। সিরিয়াসলি নিবেন না প্লিজ।
– আর বলবেন না।
ম্যাসেজ সিন হলো না। কিছু সময় অপেক্ষা করার পরে ম্যাসেঞ্জারের চ্যাট লিস্টে তার নাম দেখলাম না। ইনবক্সে ঢুকে ফাইভ মিনিটস এগো দেখলাম। অর্থাৎ অনুজ সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনুজকে সরাসরি দেখে বোঝাই যায়না সে এতো কথা বলতে পারে। আর অব্জার্ভ করার ক্ষমতা অনেক। আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই তার জানা। আর জানারই কথা।
মোবাইল বালিশের পাশে রেখে চোখ বুজলাম। সাথে সাথে রিংটোন বাজল। বেশ বিরক্তি লাগতেছে এতো রাতে কে ফোন দিল ভেবে।
ঘড়ির কাটায় সাড়ে বারোটা বেজে আরও কিছু মিনিট পার হয়ে গেছে।
মোবাইলের স্ক্রিনে অরিত্রের নাম দেখে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। এতো রাতে উনি কেন ফোন দিচ্ছে?
অফিস সংক্রান্ত কোনো কথা তো না?
ফোন রিসিভ করা ঠিক হবে কি হবেনা?
শত হলেও তিনি চেয়ারম্যান কিন্তু….
ভাবতে ভাবতেই ফোন কেটে গেলো। মোবাইল পাশে রেখে দিলাম। অফিস সংক্রান্ত কিছু হলে উনি আবারও ফোন দিবেন৷
অরিত্র আর ফোন দিলেননা। এটার দ্বারা দুটো জিনিস বোঝায়।
এক.  ভুলে ফোন এসেছে। একজনকে দিতে গিয়ে আরেকজনকে ফোন দিয়ে ফেলেছেন।
দুই. না, দুই বলে কোনো অপশন নাই। কারণ উনি বিবাহিত আর এখন ওনার স্ত্রী পাশেই আছেন।
যত্তসব ফাউল চিন্তা মাথায় আসে।
চলবে……
~ Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে