স্বপ্ন ছোঁয়া

0
1070

আমি আমার মায়ের শেষ বয়সের কোলপোছা সন্তান। সাত ভাইবোনের বিশাল সংসারের বোঝা টানতে যেয়ে আমার কেরানী বাবা আমার জন্মের কয়েক বছরের মাথায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। আমাদের নিয়ে মা পরে যান ঘোর বিপদে। ওনার বাপের বাড়ির দিকও তেমন একটা সমৃদ্ধ না হওয়াতে তারাও খুব একটা গা করেন না। অবশ্য থাকলেতো গা করবেন? তার ওপর এক দুজন হলে একটা কথা, আটজন মানুষকে টানা তো আর চাট্টিখানি কথা না।

তখনো গ্রামের লোকে ততটা স্বার্থপর হয়ে যায়নি যে শুধু নিজেকে নিয়েই থাকবে। আমার চাচারা আমাদের ফেলে দেননি তাই। এ বাড়ির কাজ ও বাড়ির কাজ করে মা কিছু যোগাড় করে আনতেন। অল্প কিছু ধানী জমি থেকে বছরের খোরাকী চলে আসতো। সাথে বড় দুভাই যেয়ে চাচার আড়তের দোকানে বসতো। খুব ঠেকায় পরে গেলে চাচীদের বললে ওনারা ঐ বেলার খাওয়া ঠিকই খাইয়ে দিতেন।

কথায় বলে নিজের না থাকলে অন্যের দান দিয়ে জীবন কতক্ষণ চলে? আর তাই বোনেরা একটুখানিক বড় হতেই মা বিয়ে দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেন। তাতে করে অন্তত ঘরে খাওয়ার মানুষ যে কমবে। বাবা মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাও ভাইবোনেরা স্কুলে যেত। কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদে সেটা বন্ধ হয়ে যায় সহসাই। আমার বড় চাচার বাড়ির সবাই অবশ্য স্কুল কলেজে যেতো। আমি যেহেতু সবচেয়ে ছোট ছিলাম এবং ঘরের কোন কাজে উল্লেখযোগ্যভাবে সহযোগীতা করতে পারতামনা তাই আমাকে ঠেলেঠুলে মা ও স্কুলে পাঠিয়ে দিত। স্কুলের কোন পড়া কেন যেন আমার মাথায় ঢুকতো না। এমন না যে আমি পড়তে চাইনা বা আমার মনোযোগ কম। কেন যেন আমার কিছুই মনে থাকেনা। দিনে দিনে স্কুলের প্রতি আগ্রহ হারালাম। ঘরের কাজে মন দিলাম। পড়াশোনা না পারলেও ঘরের কাজ তো পারতে হবে। নয়তো বিয়ে কিভাবে হবে?

আমার বাবা মা দুজনেই ঘোর কৃষ্ণবর্ণের হওয়ায় আমার গায়ের রঙ ও তাদের চেয়ে আলাদা কিছু হয়নি। একেতো কালো মেয়ে, তার ওপর বাবার বাড়ি সেরকম গরীব কাজেই বিয়ের বাজারে আমার অবস্থান কোথায় সেটা সহজেই অনুমেয়। আমার চেয়েও গরীব একজনকে পাওয়া গেলো যে কিনা আমাকে দয়া করে বিয়ে করতে রাজী হলো। বিয়ের দিন সবার কাছে শুধু শুনলাম আমার মতো কালো মেয়ের কতো ভাগ্য আমার স্বামীর গায়ের রঙ নাকি ধবধবে ফর্সা তাই।

শ্বশুরবাড়ি কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আমাকে ঐ বাড়ির লোকে ডাকতোই কালি বলে। আমার জামাই তেমন কিছু করতো ও না যে সংসারের বাকী লোকে আমায় একটু আদর করে কথা বলবে। তার ওপর সে ছিল একটু অলস প্রকৃতির। সেই সময় মনে হতো পড়াশোনাটা যদি করতাম তাহলে তো নিজে অন্তত কিছু করে খেতে পারতাম। মনে মনে তখনই শপথ নেই নিজের ছেলেমেয়েদের আমি অনেক দূর পর্যন্ত পড়াবো।

সময়ের নিয়মে সংসারে নতুন মুখ যোগ হয় কিন্তু বাড়েনা আয়ের উৎস। ফলাফল নিত্য ঝগড়া আর খিটিমিটি লেগে থাকে। একদিন একটা সুযোগ চলে আসে বিদেশ যাওয়ার। এর কাছে ওর কাছে ধার দেনা করে স্বামীকে এক প্রকার জোর করে পাঠিয়ে দেই সৌদিআরব। সেখানে যেয়ে সে কাজও পেয়ে যায় মোটামুটি গোছের। সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করে। কিন্তু প্রতি দুমাস অন্তর স্বামীর মাথায় অলসতার ঘুনপোকা নড়ে উঠতো আর সে সুর তুলতো এবার চলেই আসবে বিদেশ থেকে। কতভাবে বোঝাতে বোঝাতে যে থামতো তা শুধু আমি আর আমার আল্লাহ জানে। আমার শুধু একটাই কথা ছিল আমার মেয়েদুটোকে পড়ানো যাতে তারা স্বামীর ঘরে আমার মতো ছোট হয়ে না থাকতে হয়। আর বাপ বিদেশ থাকে শুনলে একটা ভালো জায়গায় সম্বন্ধও আসা সম্ভব।

নিজে খেয়ে না খেয়ে শহরে বেশী টাকা বাসাভাড়ায় থেকে মেয়েদের কোচিং, বাসায় স্যার রাখলাম। তবু যেন ওরা পড়ালেখাটা করে অন্তত। কোচিংয়ে কেউ যেন আমার মেয়েদের গরীব বলতে না পারে নিজের পরনের কাপড়ের দিকে না তাকিয়ে ওদের ভালো কাপড় কিনে দিয়েছি। নিজের কোন সমস্যা মেয়েদের বুঝতে দেইনি। পাছে মন খারাপ করে ওদের পড়ালেখায় কোন ক্ষতি হয়।
অথচ এতো চেষ্টার পরও বড় মেয়েটা টেনেটুনে বি পেয়ে এসএসসি পাস করে। রেজাল্ট শুনে আমার ইচ্ছে করছিল মেয়েকে আমার প্রতিটা কষ্টের দিনের গল্পগুলো যদি শোনাতাম তাহলে হয়তো সে বুঝতো কতোটা ত্যাগ আমি করেছি তাদের জন্য। তার রেজাল্টের কাগজের বি যেন আমার দিকে ব্যঙ্গভরে চেয়ে থেকে বলে, গরীবের মেয়ে বড়জোর কোন বাড়ির মেট্রিক পাস বৌ হতে পারে কিন্তু পড়ালেখা করে চাকুরী করতে পারেনা। গরীবের মেয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে এসব স্বপ্ন দেখাকে আদতে গরীবের ঘোড়া রোগ বলে।

আমার মন খারাপ দেখে মেয়েটাও মন খারাপ করাতে মনের দুঃখ মনে চেপে মেয়েকে আদর করে বলি, সামনে যেন মনোযোগ দিয়ে পড়ে। আবারো নিজের সাথে নিজের আর্থিক টানাপোড়েনের যুদ্ধ। তবু মেয়েটা দূরের বড় কলেজে পড়তে চাইসে, আমি চেষ্টা করে ভর্তি করে দিসি। কলেজে ওঠায় খরচও বেড়ে যায় অনেক। তবু মেয়ের পড়ালেখার প্রশ্নে আপোষ করিনি। কিন্তু আজ যখন মেয়ে এসে জানায় সে টেস্ট পরীক্ষায় পাস করতে পারে নাই, এ বছর ইন্টার পরীক্ষা দিতে পারবেনা আমি তখন অধিক শোকে পাথর হয়ে যাই।

– মা, তুমি একবার শুধু স্যাররে অনুরোধ করো। আমি এই চারমাস অনেক পড়াশোনা করমু কথা দিতাসি। আমার বান্ধবীগো কাছে আমার ইজ্জত থাকবোনা।

‘আমার ইজ্জতের তোয়াক্কা তোর নাই, বান্ধবীদের নিয়া মাথাব্যথা? হায়রে কপাল। জেসমিন এই শেষ। তুই যদি ইন্টার পাস না করতে পারস আমি তোরে বিয়া দিয়া দিব। আমি ভুল মানুষরে নিয়া স্বপ্ন দেখসিলাম।’

সেদিন পুরোটা রাত গেছে আমার জায়নামাজে কাঁদতে কাঁদতে। যদি স্যার মেয়েকে পরীক্ষা না দিতে দেন আমি ওর বাবাকে কি বলে বুঝ দেবো? মেয়েদের জন্য সব ছেড়েছুড়ে বিদেশে চোখ বুঁজে কামলা দিতে থাকা লোকটা তাহলে জীবনে কি পেলো? আর আমি? এতোটা দিন মেয়েদের পেছনে জোঁকের মতো লেগে থেকেও নিজের স্বপ্ন থেকে এভাবে সৃষ্টিকর্তা আমায় ছিটকে দিল?

যা না তা বলে অপমান করলেও মেয়ের জন্য আমি কলেজের অধ্যক্ষের পায়ে পর্যন্ত ধরেছি। আমাকে শেষ পর্যন্ত আশ্বাস দেয়া হয় মেয়েকে পরীক্ষায় বসতে দেয়া হবে।

………………

সারাটা দিন কি উৎকন্ঠায় যে দিন কাটে আমার তা বুঝি কাউকে বোঝানো যাবেনা। কমপিউটারের দোকান থেকে ফোন আসে বিকাল চারটায়। জেসমিন এ পেয়েছে পরীক্ষায়। আমি দৌড়ে যেয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে গেলে মেয়ে আমার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পরে যায়।

– মাগো, তুমি আমারে মাফ করসো আগে এইটা কও।

এইটা কেমন কথারে মা? মাফ করার কথা আসতেছে কেন?

– আমার জন্য তুমি আমার স্যারের পায়ে হাত দিসো। এই লজ্জা আমি কই রাখি মা? তুমি কেন কোনদিন তোমার স্বপ্নের কথা আমারে কও নাই। কতোটা কষ্ট তুমি আর বাপজান করো তা দেখলেও কোনদিন ঐ ভাবে বুঝি নাই মা। আমি জীবনে অনেক বড় কিছু না হইতে পারলেও তুমি যেমনে চাও আমি সেইভাবে আমার পড়ালেখা শেষ করুম, কথা দিতাসি মা।

কান্নাভেজা চোখে মেয়েকে বুকে তুলে নিয়ে মনে মনে বলি, কে বলে গরীবের স্বপ্ন ছোঁয়া হয়না? নিজের স্বপ্ন সন্তানের চোখে দেখিয়ে দিতে পারলে তারা বোধহয় সহসা বাবা মাকে হতাশ করেনা।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে