বদলে দেয়ার কারিগর

0
602

বয়সভেদে বেশীর ভাগ মানুষের জীবনের গল্পগুলো একইরকম ছকে বাঁধা হয়; খাওয়া, পড়ালেখা/কাজ, ঘুম, মাঝে মাঝে স্বাদ বদলাতে একটু কোথাও বেড়াতে যাওয়া। তবে কিছু কিছু মানুষ এই ছকের বাইরে গিয়েও কিছু অদ্ভুত রকমের কাজ করে আনন্দ পান। যাদের কাজগুলো দেখে আপাতদৃষ্টিতে অনেকের মনে হতে পারে কিরকম বোকামানুষ এরা।

যেমন আমার ছোটচাচা। ওনাকে সবাই বলেন উনি নাকি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। কার বাড়িতে বাজার নেই, কার ছেলেমেয়ে টাকার জন্য স্কুলে যেতে পারছেনা, কার মেয়ের বিয়ে টাকার জন্য আটকে আছে, কার বাড়িতে কে অসুস্থ তাকে হাসপাতালে নেয়া; এসব কাজে সদা ব্যস্ত ছোটচাচাকে বাড়ি পাওয়াই মুশকিল। নিজে যা বেতন পান তার পুরোটাই চলে যায় এসবের পেছনে। আমাদের যৌথ পরিবার হবার সুবাদে থাকা খাওয়াটা নিয়ে তার তেমন একটা ঝামেলা না হলেও প্রায়শই দাদীকে চিন্তা করতে দেখতাম, তার এই আধপাগলা ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে। দাদী কিছু বললে জবাবে ছোটচাচা বলতেন, ‘বিয়েশাদী করে সংসারী হওয়াটাই সবার জীবনের লক্ষ্য না মা। কাউকে কাউকে সমাজ উদ্ধারের কাজ ও করতে হয়।’

অন্যের বিপদে ঝাপিয়ে পরা এই পাগল মানুষটাকে অনেকেই পছন্দ করলেও কেউ কেউ আড়ালে বাজে কথাও বলে। অবশ্য সব ভালো কাজের উদ্দেশ্য বানচাল করতে কিছু লোক তো থাকেই। বিশেষ করে পাড়ার রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকেরা, যাদের অনেকের কাছেই পরোপকারী মানুষ মানেই নিজেদের প্রতিযোগী তৈরী হওয়া।
আমি ছোটবেলা থেকেই ছোটচাচার বেশ ন্যাওটা। চাচাও আমাকে বাড়ি ফিরে এসে সারাদিনভর ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা বলে যেন একটু স্বস্তি পেতেন। বাকী লোকে যে হইসে, থাম, এতো ভালো সাজার দরকার নাই এসব বলেই দমিয়ে দিতে চাইতো। শিশুরা অবশ্য এসব দিকে নিরাপদ ভেবেই চাচা নির্দ্ধিধায় আমার কাছে এসব খুলে বলতেন। খুব যে আমার শুনতে ভালো লাগতো তা কিন্তু না বরং আরো অনেকের মতো আমারো ছোটচাচাকে একটু পাগলাটেই মনে হতো। কি দরকার খামোখা নিজের পয়সা খরচ করার। বরং তা দিয়ে কত মজার কিছু কিনে খাওয়া যায়। কত রং বেরংয়ের ঘুড়ি কেনা যায়।

একদিন গভীর রাতে আগুন আগুন শব্দে ঘুম ভাঙে বাড়ির সবার। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখে ছোটচাচা গায়েব। সেই রাতে পাশের বাড়ির এক ছোট বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে বেশ অনেকটা পুড়ে যান উনি। হাসপাতালে যখন দেখতে যাই ওনাকে ডাক্তাররা ওনার ড্রেসিং করছিলেন। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছোটচাচার গগনবিদারী চিৎকারে দাদী যখন আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছিলো আমার তখন খুব রাগ হয় তার ওপর। কে বলেছিল এভাবে নিজের বিপদ ডেকে আনতে?

চাচার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে জানতে চেয়েছিলাম কেন এমন করে অন্যকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজী রাখা?

‘ শিপলু, তুই কিছুদিন আগে আমার কাছে একটা সারাংশ বুঝতে চেয়েছিলি মনে আছে? একটা কবিতার কয়েকটা লাইন।

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

অন্যের জন্য কিছু করতে পারার যে কি আনন্দ সেটা যেদিন থেকে তুই করতে শুরু করবি শুধু সেদিন বুঝতে পারবি। বাইরে করিডোরে তাকিয়ে দেখ পুরো পাড়ার লোকে আমার খোঁজ নিতে এসেছে। এইসব ভালবাসা পাবার কাছে নিজের জীবন বড়ই তুচ্ছরে শিপলু।’

শরীরের একটা বড় অংশ পুড়ে ঘা হয়ে যাওয়ায় হাসপাতাল থেকে ছোটচাচা আর জীবিত ফেরেননি। পুরো পাড়ার মানুষ ভেঙে পরেছিল ওনার জানাজায়। আমি এমন সব মানুষের চোখে ওনার জন্য জল দেখেছি যাদের আমরা নিজেরাও ভালভাবে চিনিনা।

…………….

রাতের আঁধারে গ্রামের মেঠোপথে হেঁটে যেতে যেতে এই মাসের কি কি কাজ করা হবে তার লিস্ট শোনাচ্ছিল আমার ম্যানেজার রকিব। তিনটি পরিবারের ঝড়ে ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামত, দুই পরিবারের দুটো পানির টিউবওয়েল, দুটো মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা আর পাঁচজন বাচ্চার পড়ার খরচ দেয়া হবে এই মাসের দানের খাত থেকে। ছোটচাচার মতো রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাইনি আমি কখনোই। আর তাই নিজের গ্রামের লোকের সমস্যাগুলো নিজের সামর্থ্যের মধ্যেই পরিচয় লুকিয়ে মেটানোর চেষ্টা করি। আমার সামান্য অর্থ সাহায্যে করা কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে কিনা তা জানতেই মাসে একবার আমি শহর থেকে গ্রামে আসি। রাতের আঁধারে হেঁটে বেড়াই গ্রামের পথে পথে।

গ্রামের নিস্তব্ধ পথে চাঁদের আলো ঠিকরে পরে গাছের পাতার ফাঁকে যে মায়াবী বিভ্রম তৈরী করে তার আলোতে আমি যেন আমার ছোটচাচাকে দেখতে পাই। আমার মানসিকতা বদলে দেয়ার কারিগর যে তিনি।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে