মন ফড়িং  ৪৫.

0
1827
মন ফড়িং  ৪৫.
নিদ্র খেয়াল করলো অনেক দিন ধরে নীলিমা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেনা। ভালোই হয়েছে ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। অদ্রি এমনিতেই অসুস্থ তার উপর যমজ বাচ্চার মা হতে চলেছে। ৬ মাসেই তার পেট যে পরিমাণ বড় হয়েছে তাতে নিদ্রের মাঝেমধ্যে মনে হয়, যমজ না তিন জন বাচ্চা তো আছেই। ডাক্তার হয়তোবা ধরতে পারছেননা।
অদ্রিকে আজকাল অসহ্য রকমের সুন্দর লাগে তার। দিন দিন যেন সৌন্দর্য তার বেড়েই যাচ্ছে।
নিদ্র প্রায়ই হা করে অদ্রির ধীরে ধীরে হাঁটা দেখে। অদ্রির ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পেটের উপর হাত বোলানো দেখে।
হঠাৎ করে মনের মধ্যে উঁকি দেয় দুই একটা দুঃস্বপ্ন। অদ্রির যে অবস্থা হয়েছিল তাতে নিদ্র ভেবেই বসেছিলো অদ্রিকে সে বেশিদিন পাবেনা।
নাজমুল সাহেবও প্রতিদিন বাসায় ফেরার পথে নতুন অতিথিদের জন্য এটা ওটা কিনে আনে। নিদ্র না করলেও কানে তোলে না কথা।
– বাবা, ওরা আসতে এখনো অনেক দেরি। তুমি এতো তাড়াতাড়ি খেলনা কেনো কিনছো?
– আরে খেলনা তো আর নষ্ট হয়ে যাচ্ছেনা।
– কিন্তু যাবে। ময়লা পরে যাবে, ভেঙে যেতে পারে!
– উঁহু নিদ্র! বাপের উপরে কথা বলবা না খবরদার। আমার নাতীদের জন্য আমি যা ইচ্ছা হয় কিনবো এখানে তোমার মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ তোমাকে।
নিদ্র আর কিছু বলেনা। অবাক চোখে তার বাবার বাচ্চাদের জন্য জোড়ায় জোড়ায় ঝুনঝুনি, গাড়ি, পুতুল, খেলনা মোবাইল কিনতে দেখে। মাঝেমধ্যে তার ঘরের মধ্যে উঁকি দিলে দেখা যায়, খেলনা দিয়ে একা একা বির বির করে কীসব বলছে আর খেলছে।
আসমা জামান অদ্রির জন্য পিঠা, নাড়ু, মোয়া বানিয়ে পাঠিয়েছেন। গ্রামের ফ্রেশ সবজি পাঠিয়েছেন আর বলে দিয়েছেন বাচ্চাদের যেন কোনো অযত্ন না হয়। কিন্তু তিনি অদ্রিকে দেখতে আসার কথা একবারও বলেননি।
রীতা খুব ব্যস্ত সময় কাটান। ছুটা কাজের লোক এসে অনেক কাজ করে দিয়ে যার আর রান্নাসহ বাকি কাজগুলো তিনি করেন। অদ্রির খেয়ালও তিনি রাখেন। নিদ্র আর নাজমুল সাহেব নিউমার্কেটে ছোট্ট একটা কাপড়ের দোকান নিয়ে বসেছেন। প্রথম দিকে বেচাকেনা তেমন না হলেও আস্তে আস্তে বাড়ছে।
অদ্রির তার মা’কে খুব মনে পড়ে। আজ যদি মা থাকতেন তাহলে অনেক যত্ন করতেন। যদিও তার যত্নের কোনো অভাব হচ্ছেনা। নিদ্র পারলে তাকে হাঁটতে দিতে চায়না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকো। সারাদিন শুয়ে থাকা যায়? মাজা ব্যথায় টনটন করে।
আর ৬ মাসেই এতো বড় পেট। তার নিজেরই কাছে কেমন বেঢপ লাগে নিজেকে। স্বাস্থ্যও বেড়েছে তার। রুচি না থাকা সত্ত্বেও তাকে পেট ভরেই খেতে হচ্ছে। তবে বাচ্চাদের কথা ভেবে না। বাচ্চার বাবার কথা ভেবে।
এই মানুষটা তার জন্য কী করেনি? তার মতো বিধবা, মা – বাবার ত্যাজ্য করা মেয়েকে সে কীভাবে আগলে রেখেছে?
যেখানে তার মা বাবা তার কথা বিশ্বাস করেনি সেখানে নিদ্র কতো সহজে বিশ্বাস করে সমস্যাটাকে গোড়া থেকে উপরে দিয়েছে।
যেকোনো পুরুষ তার মতো বিধবা, অসুন্দর, মানসিক রোগীকে বিয়ে করতে চাইবেনা।
অনেক সময় অর্ধেক রাতে অদ্রির ঘুম ভেঙে যায়। পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত নিদ্রের দিকে একপলকে তাকিয়ে থাকে অদ্রি। আর মনে মনে ভাবে, আমাকে বাঁচতে হবে। আমাকে বাঁচতে হবে শুধুমাত্র এই মানুষটার জন্য। আর এই মানুষটার হাসি তার যমজ সন্তানে আটকে আছে। তখন নিজের যত্ন করতে বাধ্য হয়। মুখের সামনে ভাতের লোকমা ধরলেই পেটের ভেতর পাকিয়ে বমি আসে। অনেক কষ্টে বমি আটকে রেখে ভাত গুলো মুখে পুড়ে নেয়।
ইখলাস সাহেবকে মাঝেমধ্যেই অদ্রি দেখে। দেয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলছে আর কুৎসিত হাসিতে ফেটে পড়ছে। অদ্রি কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজেকে বলে
– নিদ্রের জন্য মাশরুমের স্যুপ রান্নাটা শিখতে হবে। ওর খুব পছন্দের, ওর খুব পছন্দের।
রীতা বাচ্চাদের জন্য কাঁথা সেলাই করছেন। প্রায় চার তাকের সেল্ফ ভরে গেছে। আরও বানাতে নিষেধ করলে বলে
– দুই দুইটা বাচ্চা আসতেছে। এগের জন্য কি একটা দুইটা কাঁথায় হবে নাকি?
– আপনার এতো কষ্ট করতে হবেনা। অন্য কাউকে দিয়ে বানানো যাবে বা কেনা যাবে।
– আমার নাতীদের জন্য আমি বানাবো। তাতে কষ্ট হবে ক্যান?
– আপনি তো কম কষ্ট করছেন না। সারাক্ষণ আমার পিছুপিছু থাকেন। এটা খাওয়া, ওটা খাওয়া, মেডিসিন টাইম টু টাইম দেয়া। তার উপর যদি আবার এসব করেন….
– আমার ইচ্ছা হয় তাই করি। ভালো না লাগলে চুপ থাকবা কিন্তু আমাকে না করতে পারবা না।
অদ্রির আজকাল খুব খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। চার চারটা মানুষ নতুন অতিথিদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। হাজার হাজার স্বপ্ন বুনে চলেছে। সে কি সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে?
ফুলে ওঠা পেটের উপর হাত বুলিয়ে অদ্রি বিরবির করে বলে
– হে আল্লাহ, আর যাই করো; আমার বাচ্চাদের ভালো রেখো। আমার জানের বিনিময় হলেও ওদের বাঁচিয়ে রেখো। চারজন মানুষকে তুমি নিরাশ করো না।
বলতে বলতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায় অদ্রির।
চলবে…..
~ Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে