#মধুবালা [১৬]
#ফারজানা_আক্তার
বাতাসে খেলা করছে পানির ঢেউ। রিনিঝিনি শব্দ আলিফ লিলির কর্ণকুহর হলেও কারো এতে কোনো ধ্যান নেই। চারপাশের সবুজ পাতা বাতাসে দুলছে। গাছের পাতা যেনো অদ্ভুত শব্দ করছে লিলির মনে হচ্ছে।
“সম্পর্কের পর এই প্রথম আমাদের দেখা হলো। এর আগে কখনোও আমাদের আর ভিডিও কলেও কথা হয়নি। তবুও তোমায় দেখে আমি একটুও অবাক হয়নি। তোমার কী একটুও মাথায় আসেনি যে আমি ছোঁয়াকে ভালোবাসলে তোমাকে দেখে আমি অবাক হলাম না কেনো?”
“তাহলে কী?”
“হুম তাহলে আমি দুইদিন আগেই জেনেছি আলিয়ার থেকে।
আমার প্রথম দেখায় ছোঁয়া কে ভালো লেগেছিলো। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি আমি সেদিন ছোঁয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম মুগ্ধ নয়নে। পরে আমি খোঁজ নিয়ে দেখি তোমার চাচাতো বোন লামিয়া আমার বোন আলিয়ার সাথে পড়ে তারপর আলিয়াকে বুঝিয়ে বলে ওকে দিয়ে তোমার নাম্বার সংগ্রহ করলাম যদিও আমি ছোঁয়ার নাম্বার চেয়েছিলাম কিন্তু আলিয়া ভুল করে তোমার নাম্বার নিয়ে এসেছিলো। তারপর থেকে তোমার সাথে কথা বলা শুরু করলাম কিন্তু মনে মনে ছোঁয়ার ছবি আঁকতাম।
বিশ্বাস করো মনে ছোঁয়ার ছবি আঁকলেও আমি তোমাকেই ভালোবেসে ফেলেছি। যার সাথে কথা বলেছি তার প্রতিই দূর্বল হয়েছি। ছোঁয়াকে শুধু দুই একবার দেখেছি আর তোমার সাথে এতগুলো দিন এতো এতো মুহুর্ত কাটিয়েছি। শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাাতে বাধ্য হয়েছি আমি। তোমার কথাগুলো মুগ্ধ করছে আমায়, এতোটা মুগ্ধ আমি ছোঁয়াকে দেখেও হয়নি।
আলিয়ার থেকে জানতে পেরে এই বিষয়টা আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছি সাথে বুকের বাঁ পাশে ব্যাথাও হয়েছিলো খানিকক্ষণ। তবে পরে মাথা ঠান্ডা করে ভেবেছি আমি। ভুল আমারই ছিলো। আমি আলিয়াকে নাম বলতে ভুল করেছিলাম। কিন্তু একদিকে ভালোই হয়েছে। যদি সেদিন নামে ভুল না করতাম তাহলে তোমার মতো পাগলীকে পেতাম না কখনোই। হুম ছোঁয়াকে আমি মায়াবতী বলতাম ঠিকই কিন্তু এই মুহুর্তে আমার চোখে একটামাত্র তুমিই আমার মায়াবতী। ভালোবাসি তোমায়, স্বপ্নেও তোমায় ছেড়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করবোনা আমি”
লিলি হা হয়ে শুনছে আলিফের সব কথা। লিলির সত্যিই খেয়াল ছিলোনা যে আলিফ ছোঁয়ার জায়গায় ওকে দেখে অবাক না হওয়ার বিষয়টা।
আলিফের কথা শোনে লিলির চোখে খুশির অশ্রু চিকচিক করছে আর ঠোঁট জোড়া থরথর করে কাঁপছে। লিলির মনে হচ্ছে এই মুহুর্ত টা ওর জীবনের সেরা মুহুর্ত।
***********
এভাবে নিস্তব্ধ নীরবভাবে কেটে গেলো অনেকগুলো দিন। ছোঁয়া এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি কারো সাথে।
একদিন সন্ধ্যার দিকে জায়েদা বেগম ছোঁয়ার রুমে যায় কফি নিয়ে। সন্ধ্যায় কফি খাওয়া ছোঁয়ার একটা বদঅভ্যেসে পরিনত হয়েছে তবে সেলিনা পারভীনের মৃত্যুর পর থেকে ওকে সন্ধ্যায় কফি খেতে দেখা যায়নি আর। জায়দো বেগমের প্রবেশ দেখে ছোঁয়া বেলকনিতে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। জায়েদা বেগম ডাকতে চেয়েও ডাকতে পারেনি, গলা ধরে এসেছে উনার। তাই চোখের কোণে জমা জল নিয়ে চলে গেলেন উনি। ছোঁয়ার কেমন জানি ভীষণ লজ্জা লাগছে এই মহিলার সামনে যেতে আজ। ছোট থেকে যাকে চাচিম্মু জেনে এসেছে সে কিনা তার সৎমা, মানতে পারছেনা ছোঁয়া। গাল বেয়ে অশ্রুকণা ঝড়তে থাকে তার।
লামিয়া সানিয়া সোহা লিলি সবাই এসে ছোঁয়ার সাথে আড্ডা দিচ্ছে। উদ্দেশ্য ছোঁয়ার মন ভালো করা। সোহার মন টাও অনেকটা খারাপ তাই সে চুপচাপ হয়ে আছে। সোহা একা একা বসে খাতায় আঁকিবুঁকি করছিলো মন খারাপ করে। তাই লিলি ওকে জোর করে নিয়ে এসেছে। সবার হাতে কফির মগ। কিন্তু ছোঁয়া হাতে কফি মগ নেয়নি। সন্ধ্যার কফিটা ওকে সবসময়ই সেলিনা পারভীন করে দিতো, কফির মগ হাতে নিলেই গলা জড়িয়ে কান্না চলে আসে ছোঁয়ার।
সোহার মন খারাপের প্রধান কারণ হলো মা নেই আর সবে জানতে পেরেছে ছোঁয়া তার আপন বড় বোন নয় তাই সে মনমরা হয়ে আছে। যদি ছোঁয়া আর আগেরমতো আদর না করে সে ভয়ে। মায়ের পরে যে একমাত্র বড় বোনকেই মা’য়ের স্থানে বসানো যায়।
ছোঁয়ার অবস্থা দেখে লিলি সানিয়া আর লামিয়াকে ইশারা করলো সোহাকে নিয়ে অন্যকোথাও যাওয়ার জন্য। তারা চলে গেলে লিলি ছোঁয়ার বাহু জরিয়ে ধরে বলে “এই শুভ্র ভাইয়ের মধুবালা এবার তো একটু স্বাভাবিক হ। আর কত এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকবি। যে যাওয়ার সে তো চলে যাবেই, আমরা সবাই-ই একদিন এভাবে চলে যাবো না ফেরার দেশে। বাঁচা ম’রা আমাদের হাতে কিছুই নেই ছোঁয়া বুঝার চেষ্টা কর। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকেনা বোন। এবার একটু নিজেকে সামলা। তুই কি জানিস তোর এমন অবস্থা দেখে সোহার অবস্থা কতটা খারাপের দিকে যাচ্ছে? মেয়েটা সবেমাত্র মা হারিয়েছে, বয়স খুব অল্প। মায়ের পর তুই ওর মা। তুই যদি এভাবে মনমরা হয়ে থাকিস সারাক্ষণ তবে কিভাবে হবে? সোহাকে কে সামলাবে? মেয়েটা যে তোর আদর পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
তুই কি জানিস তুই সোহার আপন বোন না জেনেও সোহা তোকে না পেয়ে সেদিনরাতে কত পাগলামি করেছে? ওকে অনেক কষ্টে ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে ঘুম নেওয়া হয়েছিলো।”
লিলির কথা শোনে ছোঁয়া কি করবে বুঝতে পারছেনা। সবকিছু যে ওর এই মুহুর্তে বি’ষা’ক্ত লাগছে। লিলি চলে গেলে ছোঁয়া চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে ওর বলা প্রতিটি কথা। লিলি তো ভুল কিছু বলেনি। সোহার বয়স অল্প, এই বয়সে মা হারিয়ে মেয়েটা সত্যিই ভে’ঙে পরেছে খুব কিন্তু বাহির থেকে দেখে তা বুঝা মুসকিল।
সোহা হলরুমে সবার সাথে বসেছিলো। ছোঁয়া দৌড়ে এসে সোহাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে সবার সামনে। সোহাও নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে চোখের জল ছেড়ে দেয়।
সেলিনা পারভীন মা’রা যাওয়ার পর এই প্রথম দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এর আগে যে যার মতো শোক পালন করেছে। কারো দিকে কারো কোনো লক্ষ ছিলোনা।
ছোঁয়া পাগলের মতো সোহাকে কপালে গালে থুঁতনিতে চুমু দিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে বোনকে। আর প্রমিজ করে আজ থেকে সে মায়ের সব দায়িত্ব পালন করবে। সোহার বুকের শূন্যতা যেনো মিলিয়ে যায় মুহুর্তে।
দূর থেকে দুই মেয়েকে দেখে অশ্রু চোখে একটা মুচকি হাসি দেয় মান্নান মির্জা।
***********
রাত ১১টা ৩০ ছুঁই ছুঁই। সবাই খেয়ে যার যার রুমে চলে গেলো। ছোঁয়া সোহার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। সোহাকে আজ সে নিজের কাছে রেখেছে, সোহা এমনিতে সানিয়ার সাথেই থাকে। হঠাৎ দরজায় কটকট শব্দ হলে ছোঁয়া গিয়ে দরজা খুলে দেখে শুভ্র দাঁড়িয়ে। আজ সারাদিন শুভ্রর দেখা পায়নি ছোঁয়া। হঠাৎ এভাবে দরজায় শুভ্রকে দেখে ছোঁয়া অবাকই হয়েছে বটে। তবুও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ছোঁয়া বললো “সারাদিন কোথায় ছিলে শুভ্র ভাই?”
“ভাই ডাকলে বলবোনা কোথায় ছিলাম।”
“আচ্ছা বলতে হবেনা। কেনো এসেছো বলো।”
“তোর সাথে একটু সময় কাটাতাম। কিন্তু আজ নাকি সোহা তোর সাথে ঘুমাবে।
চল বেলকনিতে যায়। একটু প্রাণভরে দেখে অশান্ত মনটাকে শান্তি করি।”
ছোঁয়া একটু লজ্জা পায়। শুভ্র মুচকি হেঁসে রুমে প্রবেশ করে বেলকনির দিকে যেতেই ছোঁয়া বলে “সোহা জেগে আছে, ওকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর আসি?”
শুভ্র কিছু বলার আগেই সোহা বলে “আমি একা ঘুমাতে পারবো আপা। তুমি যাও শুভ্র ভাইয়ার সাথে। না হয় পরে দেখা যাবে আমার আগে তোমারই ঘুম পেয়ে যাবে।”
শুভ্র কুটকুট করে হেঁসে দিলো। ছোঁয়া আরো বেশিই লজ্জা পেলো যেনো।
এবার শুভ্র ছোঁয়ার হাত ধরেই বেলকনিতে নিয়ে যায়। ওরা বেলকনিতে গেলে সোহা উঠে ধীর পায়ে বাহিরে চলে যায়।
“এই মধুবালা কবে হবি তুই আমার?
বুকটা যে শুন্য হয়ে আছে তোর শূন্যতায়।”
“আমার হাতে কি কিছু আছে বলো? বড় আব্বু আর দাদি কিছুতেই রাজি হবেনা এই বিয়ের জন্য।”
“ধর তারা রাজি তারপর তুই কি সাজবি আমার বধু?”
“হুম”
মুচকি হাসির সাথে কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে ছোঁয়া।
ঘড়ির কাঁ’টা’য় ১১টা ৫৫। ১২টা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট। শুভ্র ছোঁয়াকে বললো “চল ছাঁদে যাবো।”
“এতো রাতে?”
“সমস্যা কি? আমি আছি তো আমার পাগলী মধুবালা।”
“নাহ আজকে নাহ। ঘুম আসে আমার।”
“জানি তো তুই ঘুম পাগলী তাইতো এতোক্ষণ গল্প করলাম যাতে ঘুম চোখে বাসা বাঁধতে না পারে।”
“এ্যাঁ?”
“হ্যাঁ। চল তো”
এটা বলেই শুভ্র ছোঁয়ার চোখ বেঁ’ধে দেয় একটা সাদা রুমাল দিয়ে। ছোঁয়া অবাক হয় ভীষণ। শুভ্র ছোঁয়ার হাত ধরে খুব সাবধানে ছাঁদে নিয়ে যায় ওকে। ছাঁদে গিয়ে শুভ্র ছোঁয়াকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড় করিয়েে চোখের বাঁধন খুলে দেয়।
পুরো ছাঁদ খুব সুন্দর করে সাঁজানো হয়েছে। প্রত্যকেটা ফুল ছোঁয়ার পছন্দের। ছোঁয়ার মনের মতো করে সাজানো হয়েছে আজ ছাঁদের প্রতিটি কোণা। হঠাৎ ছোঁয়ার কানে ভেসে আসলো ছাঁদের দরজা থেকে_____
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
#মধুবালা [১৭]
#ফারজানা_আক্তার
ছোঁয়ার কানে হালকা গরম হাওয়া লাগতেই সে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে। চোখ বন্ধ করে ছোঁয়া শুভ্রর অস্তিত্ব অনুভব করে। শুভ্র ছোঁয়ার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে “শুভ জন্মদিন মধুবালা।”
সাথে সাথেই দরজা থেকে পুরো পরিবারের গলার স্বর ভেসে আসে “শুভ জন্মদিন ছোঁয়া।”
সবার আগে দাঁড়ানো বেলাল মির্জা আর আনজুমা খাতুন। এদের দুজনকে হাসিমুখে দেখে অনেকটা অবাক হয় ছোঁয়া। থমথমে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। আনজুমা খাতুন এসে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চান। ছোঁয়া আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলে। বেলাল মির্জা ছোঁয়াকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে উনার ছেলের বউ হওয়ার প্রস্তাব রাখেন। আনজুমা খাতুন ইশারায় ছোঁয়াকে বলেন প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য। ছোঁয়া একবার মান্নান মির্জার দিকে তাকিয়ে অনুমতি চাইলো ইশারায়। মান্নান মির্জা হ্যাঁ সূচক ইশারা করতেই ছোঁয়াও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে ছোঁয়া অথচ কয়েকমাস আগেও ভয়ে নিচু হয়ে থাকতো ছোঁয়ার মাথা কিন্তু আজ ভিন্ন। ভাগ্য বড্ড বেশি জাদুকর। মুহুর্তেই মানুষের দিন বদলে দিতে ভাগ্য সক্ষম।
সবাইকে নিয়েই হৈ হুল্লোড় করে কেক কাটা হলো। সবার আগে শুভ্র কেক খাওয়ালো ছোঁয়াকে। তারপর একে একে সবাই খাইয়েছে ছোঁয়াকে কেক। সবার শেষে জীবন মির্জা আর জায়েদা বেগম আসলেন কেক খাওয়ানোর জন্য। উনারা দুজন ছোঁয়ার সামনে আসতেই ছোঁয়া মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে হেঁটে চলে যেতে নিলে তখনই শুভ্র এসে ছোঁয়ার হাত ধরে থামায় ওকে।
“দেখ ছোঁয়া যা হয়েছে ভুলে যা এবার। অনেক তো দিন কাটলো, একটু স্বাভাবিক কর নিজেকে এবার। এসবের মধ্যে তো চাচিম্মুর কোনো দোষ নেই তাহলে উনাকে কেনো কষ্ট দিচ্ছিস তুই? তুই কি জানিস তুই উনার সতীনের মেয়ে জেনেও উনি তোকে কতটা ভালোবাসে এখনো। তোকে এখন আগের থেকেও বেশি মায়া করেন উনি। কবে বুঝবি তোর প্রতি উনার একটা আলাদা মায়া আছে টান আছে, যা আমাদের কারোর প্রতি নেই। উনার সাথে তোর রক্তের সম্পর্ক না হলেও উনি তোকে চোখে হারায়।”
“কিন্তু শুভ্র ভাই আমার যে ভীষণ লজ্জা লাগে উনার চোখে চোখ রাখতে।”
“দেখো পাগলী মেয়ের কান্ড। লজ্জার কি আছে? আজ থেকে চাচিম্মু নয় মা বলে ডাকবে আমায় বুঝেছো। মেজু ভাবি মা’রা যাওয়ার কয়েকদিন আগে আমায় বলেছিলেন উনার যেমন অধিকার আছে তোমার উপর তেমন অধিকার আমারও আছে কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি উনি সত্যি সত্যিই আমার হাতে তোমাকে রেখে চলে যাবেন দূর অজানায়।
ডাকবে তো আমায় মা বলে?
ছোঁয়া জায়েদা বেগমের কথা শোনে অশ্রু চোখে মান্নান মির্জার দিকে তাকায়। উপস্থিত পুরো পরিবার শব্দহীন অনুভূতিতে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। ছোঁয়ার সেজু চাচা চাচি সবসময়ই চুপচাপ এবং দূরে থাকে সবরকম ঝামেলা থেকে কিন্তু আজ তাদের চোখেও জল চিকচিক করছে।
মান্নান মির্জা মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিতেই ছোঁয়া ঝাপটে জড়িয়ে ধরে জায়েদা বেগমকে। মা মেয়ে দু’জনই কাঁদছে, বোবা কান্না।
পুরো পরিবারের চোখে জল টলমল করছে। লিলি সোহাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু চোখে হাসছে।
ছোঁয়া একবার কাঁপা কন্ঠে মা বলে ডাকে জায়েদা বেগমকে এতেই উনি যেনো স্বর্গ সুখ পেয়েছেন এমন ভাবে খুশি হয়েছেন।
হঠাৎ ছোঁয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ” আমি একটা কথা ক্লিয়ার করে বলে দিচ্ছি জীবন মির্জার সাথে স্বাভাবিক হতে যেনো কেউ আমায় জোর না করে। নয়তো এবার এমন ভাবে যাবো ঘর ছেড়ে কেউ আর খোঁজে পাবেনা আমায়। এই মানুষটার জন্য আমি আমার জন্মদাত্রী মায়ের মুখটা পর্যন্ত দেখতে পারিনি, এই মানুষটার জন্য আমার গর্ভধারণী মা আমাকে গর্ভে নিয়ে দীর্ঘ নয়মাস কষ্ট করেছে। কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা আমি এই মানুষটাকে। যে পুরুষ স্ত্রী সন্তানকে অস্বীকার করে আমার নজরে সে কাপুরুষের চেয়েও যদি কোনো নিচু স্থান থাকে তাহলে সে স্থানে উনি।
মা প্লিজ তুমিও কখনো জোর করিওনা আমায় নয়তো তোমাকেও দূরে করে দিতে বাধ্য হবো নিজের থেকে।”
ছোঁয়ার কথা বলা শেষ হতে না হতেই জীবন মির্জা চলে গেলেন সেখান থেকে। জীবন মির্জার চোখে আজ জলের স্রোত। নিজের মেয়ের মুখে এসব শোনার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভালো। লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে জীবন মির্জার। জীবন মির্জার জীবনে যে আরো একটি কঠিন সত্যি লুকিয়ে আছে এটা যে সবার অজানা। শুধুমাত্র ছোঁয়ার জন্য যে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন সেটা যে আজও সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। ছোঁয়া কী জানতে পারবে এই নির্মম সত্যি টা? পারবে কী জীবন মির্জা কে ক্ষমা করে একবার বাবা বলে ডাকতে। জীবন মির্জার যে খুব ইচ্ছে করে একবার ছোঁয়ার মুখে বাবা ডাক শুনতে।
***********
শুভ্র সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটা স্বর্ণের আংটি ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে “হবি আমার বেডরুমের রাজ রানী? হবি কী আমার হৃদয়ের হৃদস্পন্দন? দিবি কী অধিকার তোকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসার? থাকবি সারাজীবন আমার মধুবালা হয়ে কথা দে।”
ছোঁয়া লজ্জামাখা মুখশ্রীতে একটু হাসি ফুটিয়ে বাম হাত এগিয়ে দেয় শুভ্রর দিকে। শুভ্র খুশি হয়ে দ্রুত ছোঁয়ার আঙ্গুলে আংটি টা পরিয়ে দিয়ে খুশিতে লাফাতে থাকে। শুভ্র তার সব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হবে হয়তো ভাবতে পারেনি। শুভ্রর লাফানো দেখে পুরো পরিবার কুটকুট করে হেঁসে উঠে। ছোঁয়া ভীষণ লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে আছে। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে ছোঁয়ার বুকজুড়ে।
শুভ্র হুট করে সবার সামনে ছোঁয়াকে বলে উঠে “এই মধুবালা শোন।”
“হু শুভ্র ভাই।”
“আর একবার যদি শুভ্র ভাই ডাকিস আমায় তবে মাথায় তুলে ছাঁদ থেকে টুপ করে ছেড়ে দিবো মনে রাখিস। হয় শুধু শুভ্র ডাকবি নয়তো কিছু ডাকার দরকার নাই। আসছে ভাই ডাকতে, চুল যা বাকি রেখেছিলাম গতবার সেগুলোও কেটে নেঁড়া করে দিবো একদম।”
শুভ্রর কথা শোনে সবাই কিছুক্ষণ হা হয়ে থেকে হু হু করে হেঁসে উঠে। ছোঁয়া এবার লজ্জা সামলাতে না পেরে এক ছুটে নিজের রুমে চলে গেলো।
***********
সকালে আলিফের কল পেয়ে লিলি ঘুম থেকে জাগে।
আজ লিলি ছোঁয়ার রেজাল্ট দিবে। তাই লিলির মন খারাপ। আলিফ ওকে অনেকভাবে বুঝাচ্ছে।
আলিফের কল কেটে লিলি ছোঁয়ার কাছে গেলো। এমা এতো সকালে ছোঁয়া গেলো কই।
ছোঁয়াকে খুঁজতে খুঁজতে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে দেখে লিলি জায়েদা বেগমের সাথে বসে কফি খাচ্ছে ছোঁয়া। লিলি ছুটে গিয়ে ছোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে “আরে ওই মধুবালা তোর কী ডর ভয় কিছু নেই। আজ রেজাল্ট দিবে আর তুই এখানে বসে রিলাক্স হয়ে কফি খাচ্ছিস?”
“আরে কুল মাই ডিয়ার অনলি ওয়ান জামাইর বোন আমার ননদ।”
“এ্যাঁ!! হঠাৎ কী হলো রে তোর ছোঁয়া? জ্বর টর হয়নি তো?”
“আরে নারে। একটু আগেও ভয়ে ঘামছিলাম কিন্তু আমার মা আমাকে এখনই একটা কথা বলেছে আর আমার সব চিন্তা উড়াল দিয়ে পালিয়ে গেছে।”
“কী এমন বলেছে চাচিম্মু।”
মুখ গোমড়া করে লিলি বলে কথাটি। জায়েদা বেগম হাসতে হাসতে চলে যান সেখান থেকে। তারপর ছোঁয়া বলে “মা আমাকে বলেছেন ভাগ্যে যদি পাশ থাকে তবে অবশ্যই পাশ করবো আর ফেইল থাকলে ফেইল। আল্লাহর উপর ভরসা রাখলে তিনি আমাদের নিরাশ করবেননা কখনো। আর আমাদের পরিক্ষা তো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই হয়েছে।
আর একটা গোপন সূত্র জানিস?
আমার মা আমাদের জন্য রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েছেন।
আর মায়ের দোয়া কখনোই বিফলে যায়না। তাই নো চিন্তা ডু ফুর্তি। ”
লিলি কিছুক্ষণ থ মে’রে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একটা হাসি দেয়। তারপর বলে “এই ছোঁয়া শোন।”
“বল শুনি।”
“আলিফ স্যার বলেছে রেজাল্ট দিলে ঘরে জানানোর জন্য আমাদের কথাটা কিন্তু আমার মনে হয় কেউ রাজি হবেনা। আলিফ স্যার রা একটু মধ্যবিত্ত। বিয়ে করার জন্য ঘর বাঁধতেছে ঠিক করে কিন্তু আমি যে ঘরে কিভাবে জানাবো ভেবে পাচ্ছিনা। ভয় লাগছে খুব, দাদি রাজি না হলে যে আব্বুও রাজি হবেনা কখনো।”
“আরে চিল মা’র বোন। সবাই মেনে নিবে দেখে নিস। আমাদের আলিফ স্যার কোনদিক দিয়ে খারাপ নাকি? সবদিক দিয়েই ঠিক আছে শুধু চোখ টা একটু টেরা আরকি।”
ছোঁয়া মজার ছলে কথাটি বলে, লিলি মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। অভিমান হয় লিলির।
“কে টেরা বললি? কার কথা হচ্ছে এখানে?”
শুভ্রকে দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলে লিলি ছোঁয়া আর শুকনো ঢুক গিলে।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়। গল্প কী খারাপ হচ্ছে? রিচ কমে যাচ্ছে ইদানীং খেয়াল করলাম।