বসের সাথে প্রেম পর্ব- ০৩

0
7881

বসের সাথে প্রেম
পর্ব- ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ছেলেটির ডায়েরী…..
পরদিন সকাল সকাল অফিসে পৌঁছলাম। কারন, ও যেন লেইট করে এসে বলতে না পারে তাড়াতাড়ি এসেছে। একটা জিনিস আমি আজো বুঝতে পারলাম না, আমার কর্মচারীরা আমায় দেখলে ভয়ে চুপসে যায় কেন? কেন’ই বা আমায় দেখে তাড়াতাড়ি যার যার মতে কাজ করা শুরু করে। যাকগে। যে কথাটি বলছিলাম। সকাল ১০টা বেজে ০২মিনিটে মেয়েটি মানে আমার পি.এ অফিসে ঢুকে। ওর চেম্বারের দিকে যেতে গিয়ে ও মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পরল। কারন, আমি তখন ওর চেম্বারেই বসে ছিলাম। ওকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ও মাথা নিচু করে ফেলল। তারপর বলতেছে- আমি স্যরি স্যার। ০১মিনিট ৫৮সেকেন্ড লেইট হয়ে গেল। ওর দিকে একবার তাকিয়ে আমার রুমে চলে গেলাম। যাওয়ার সময় বলে গেলাম আমার রুমে আসতে। আমি রুমে আসার ক্ষানিক বাদেই অনুমতি নিয়ে মাথা নিচু করেই আমার রুমে প্রবেশ করে। আমি ওর সাথে তেমন কোনো কথায় বললাম না। শুধু ওর দিকে ৯টা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললাম, আজকে রাত্রের ভিতর যাতে এগুলো কমপ্লিট করে দেয়। ও জল ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার! এত্তগুলো ফাইল একসাথে একরাত্রের ভিতর কমপ্লিট করা সম্ভব না। দয়া করে কাজ’টা আমায় আরেকটু কমিয়ে দিলে ভালো তো। ওর কথা শুনে কাল সারাদিন থেকে মনের ভিতর পুষে রাখা রাগ’টা দ্বিগুন বেড়ে গেল। ড্রয়ার থেকে আরো তিনটা পুরনো ফাইল বের করে ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে। ওর অবাক হওয়ার মাত্রাটা যেন বহুগুনে বেড়ে গেল এবার। ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল, ফাইলগুলো নিয়ে চলে গেল আমার রুম থেকে। সেদিন লাঞ্চের সময় সবাই যখন লাঞ্চ করতে ব্যস্ত, মায়া তখন ফাইল নিয়ে ব্যস্ত। এই শীতের মধ্যেও মেয়েটি ঘামছে। খুব হাসি পেলো আমার। বেচারি!!!!???
হঠাৎ করে মায়া আমার রুমের দিকে তাকালো। আমি দরজার কাছ থেকে পর্দার আড়ালে সরে যায়।

মেয়েটির ডায়েরী_
সে রাতে ভালো ঘুমাতে পারিনি। একে তো সারাদিন পরীক্ষা আর জার্নির ভিতর গেছে, তার উপর রাত্রে কিচ্ছু না খেয়েই ঘুমানোর কারনে শরীর’টা একটু দূর্বল হয়ে যায়। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মরিচ বর্তা দিয়ে কয়টা পান্তাভাত খেয়ে নিলাম। এটা রোজকার খাবার। মামি, মামাতো ভাই-বোন’রা খাওয়ার পর যে উচ্ছিষ্ট থাকে সেটাই খেয়ে নেই। কোনো কোনো সময় সেটাও জোটে না কপালে। ওহ,যে কথাটি বলছিলাম। ভোরে রান্না করে বাড়ির যাবতীয় কাজ করে গুছিয়ে রেখে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। অফিসে যেতে যাতে লেইট না হয় সেজন্য অন্যদিনের চেয়ে আধঘন্টা আগে বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে। কিন্তু বিধি বাম। গাড়িটা মাঝ রাস্তায় নষ্ট হয়ে যায়। অন্য গাড়ি আসার অপেক্ষা করতে গিয়ে অফিসে পৌঁছতে লেইট হয়ে যায় ২মিনিট। ভয়ে ভয়ে ভিতরে প্রবেশ করি। কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। সেটাই হলো। সামনে তাকিয়ে দেখি বস আমার সামনে আমার চেম্বারে বসে আছে। থমকে দাঁড়ালাম সেখানেই। ভিতর’টা শুকিয়ে আসছিল ভয়ে। ওনি বসা থেকে উঠে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি মাথা নিচু করে স্যরি বললাম। তারপর ওনি অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রুমে চলে গেলেন। বলে গেলেন,আমি যাতে ওনার রুমে যায়। না জানি, আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে ভাবতে ভাবতে ওনার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওনি রাগে ভাব নিয়ে আমায় ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিল। কোনো কথা-বার্তা নাই সেদিন ওনি আমার সামনে ৯টা ফাইল এগিয়ে দেয়, রাতের ভিতর এগুলোর সব অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করে দিতে হবে। এই ভেবে ভেতর’টা শুকিয়ে গেল, মামির সংসারে আমাকে তো রাত্রেও গাঁধার মত খাটতে হয়, তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ওনার এই ফাইলগুলো দেখতে যে বাড়তি সময় দরকার সেটা আমি কই পাব?! এসব ভেবে কান্না চলে আসছিল তাই আমি ফাইলের কাজের ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করলে ওনি আমার হাতে আরো ৩টা ফাইল ধরিয়ে দিলেন। আমি যেন এতক্ষণ সপ্ত আকাশে ছিলাম আর এখন হঠাৎ করেই সেখান থেকে মাটিতে পরে গেলাম। ওনাকে আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। চলে গেলাম ওনার রুম থেকে। সিদ্ধান্ত নিলাম অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফাইলগুলোও একটু একটু দেখে নিব। লাঞ্চের সময় সেদিন আর বাইরে যায় নি খেতে। কি দরকার আছে সময় নষ্ট করার? তারচেয়ে বরং লাঞ্চের সময়’টা কাজে লাগাব। হঠাৎ’ই মনে হলো সামনে থেকে কিছু একটা সরে গেল। স্যারের রুমের দিকে তাকালাম। নাহ, কেউ নেই……

ছেলেটির ডায়েরী_
দেখতে দেখতে তিন’টা বছর চলে গেল। মায়াকে এখন আর আপনি নয়, তুমি’ই সম্বোধন করা হয়। এই তিন’টা বছরে একটু একটু করে আমি মায়াকে চিনলাম। ওর দক্ষতা সম্পর্কে জানলাম। সত্যি, দেখতে পিচ্চি হলেও মেয়েটি সাংঘাতিক বুদ্ধিমতি এবং কাজের। যাক, এতদিনে এটা বিশ্বাস করতে পারলাম বাবার মন্তব্যগুলো সম্পূর্ণ অমূলকও নয়। হঠাৎ করে মেয়েটা কেমন যেন চেঞ্জ হয়ে গেল। আগের মত হাসে না, বেশী কথাও বলে না। সবসময় কেমন যেন গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করলে বলে, সে কিছু না। ব্যাপার’টা আমার কেন যেন ভালো ঠেকছিল না….

মেয়েটির ডায়েরী_
সেদিন স্যারকে নিয়ে বিদেশী ক্লাইন্টদের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গেল। সেদিনও স্যার আমায় একা ছাড়তে সাহস পায়নি। ওনার গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে আসলেন আমার বাসার সামনে। গাড়ি থেকে নেমে চলে যাওয়ার সময় ওনি আমার সাথে মজা করে বলছিলেন, বাব্বাহ! চলে যাচ্ছ? আমায় একটু সাধলে কি চলে যেতাম নাকি?! আমি মৃদ্যু হেসে বললাম, আরেকদিন স্যার। কি করব?! আমার যে হাত পা বাঁধা। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সাহস হয়নি স্যার’কে বাসায় নিয়ে যেতে। সেরাতে বাসায় পৌঁছে দেখি মামির ভাই’টা আমার রুমের পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে আমি যখন রুমে শুতে যাব, তখন’ই ওনি আমার পিছু পিছু রুমে প্রবেশ করে। ঝাপিয়ে পরে আমার উপর। প্রাণপনে বাঁচার চেষ্টা করেও যখন ওনার সাথে পারছিলাম না, তখন সতর্কতাসরুপ বালিশের কাভারের ভিতর যে চাকু’টা লুকিয়ে রেখেছিলাম, সেটা দিয়ে ওনাকে আঘাত করি। ওনার হাত কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। ছেড়ে দেয় আমাকে। সে রাতেই মামির হাত থেকে বাঁচার জন্য মামাতো বোনের সহযোগীতায় বাড়ি ছেড়ে পালাই। প্রথম দিন আমার একটা চিনা আন্টির বাসায় আশ্রয় নিলেও সে বাসায় ২দিনের বেশী থাকতে পারলাম না। ঐ বাসার আংকেল’টার বাজে দৃষ্টি সবসময় আমার উপর ছিল। সেদিন ঐ বাসা ছেড়ে চলে আসি। অনেক দেখে শুনে এবং একমাত্র বান্ধবীর সহযোগীতায় একটা ভালো বাসা খুঁজে পায়। আমার কোম্পানির মালিক ভালো আংকেলের বাসার সাথের বাসা’টায় আমি ভাড়াটিয়া থাকতাম। দেখতে দেখতে আরো একটা বছর চলে গেল। একসাথে কাজ করতে, চলতে চলতে কখন যে সিয়াম’কে নিয়ে বুকের গভীরে ভালো লাগার বীজ বপন করে ফেললাম বুঝতে পারিনি। সেই ভালো লাগা’টা কি শুধু’ই ভালো লাগা নাকি অন্য কিছু সেটা দেখার জন্য স্যারের থেকে ছুটি নিলাম তিনদিনের। স্যারের থেকে তিনদিন দুরে থাকতে পারি কি না সিদ্ধান্ত নিলাম। একদিনও থাকতে পারিনি। কেন জানি দুরে থাকার কথা ভাবতে’ই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আর থাকতে পারলাম না। ছুটে গেলাম অফিসে। সেদিন স্যার আমাকে দেখে এতটা অবাক হয়েছিল যা বলার মত না। অবাক হওয়ার’ই কথা। বহু অনুনয়-বিণয় করে তিনদিনের এই ছুটি নিয়েছিলাম আমি। তারপর কেটে গেল আরো একটি বছর। আমার এম.বিএ’টাও কমপ্লিট হলো। পড়াশোনার কোনো চাপ নেই, বাড়তি কোনো টেনশন নেই। সারাদিন শুধু অফিস আর রাত্রে রুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ওর রুম’টার দিকে তাকিয়ে থাকা। আজকাল ওনার বাড়ির ছাদেরও প্রেমে পরে গেছি আমি। প্রেমে পরে গেছি ছাদের ফুলগাছগুলোর। প্রেমে পরে গেছি ওনার রুমের জানালার। যা দেখে’ই প্রতি রাত্রে’ই আমার ঘুমুতে যাওয়া। সময় বয়ে যেতে লাগল, আর আমি ওনার ওনার প্রেমে ভেঙে চূড়ে পরলাম। ওনার প্রতি আমি যেন ভিষন রকম দূর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম। আজকাল তেমন কথাও বলি না কারো সাথে। ভাবতে ভালো লাগে। ওনাকে নিয়ে ভাবতে…..

ছেলেটির ডায়েরী_
আজকাল রাত্রে ভালো ভাবে ঘুম হয় না। ছাদে গেলে কেন যেন মনে হয় ওপাশের ছাদ থেকে একটা অস্পষ্ট ছায়া আমার দিকে চেয়ে আছে। তাকালে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু’ই দেখতে পায় না। মাঝ রাত্রে ঘুম ভেঙে যায়। জানালার পাশে দাড়িয়ে রাতের যান্ত্রিক শহর’টা দেখতে যাব, তখন’ই কেন যেন মনে হয় ওপাশের বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে কেউ একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পরক্ষণে ঐদিকে তাকায়! নাহ! এবারো শূন্যতা ছাড়া কিছু’ই দেখতে পায় না। ভ্রম ভেবে এসব চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে দেয়….. সেদিন সারা রাত ধরে বিছানায় ছটফট করে ঘুমুতে পারলাম। কিসের যেন এক শূন্যতা ভেতর’টাকে অস্থির করে তুলছিল। কিন্তু কিসের শূন্যতা? আমার তো সব আছে। মা-বাবা, ছোট বোন, বন্ধু-বান্ধব। সবাই আছে। তারপরও কিসের এত শূন্যতা?!!! ভাবতে পারছিলাম না, আবার শত চেষ্টা করার পর ঘুমও আসছিল না। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গেলাম। নাহ, কিছুতেই ভালো লাগছে না। রুমে চলে আসলাম। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেতর’টা এতক্ষণে শীতল পরশে ঠান্ডা হয়ে গেল। আহ! কত শান্তি…!!!
নাহ, এখন আর খারাপ লাগছে না। আচ্ছা, আমার কি হয়েছে? কেন রোজ রোজ এমনটি হয়? কেন আমার ভিতর’টা এমন লাগে। কিসের জন্য এত হাহাকার বুকে। হঠাৎ’ই আমার এক কাব্যিক বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। যে প্রায়’ই একটা কথায় ওর গার্লফ্রেন্ড’কে বলত, যদি কখনো কোনো রাত্রে ঘুম ভেঙে যায়, হাজার চেষ্টা করেও ঘুমুতে না পারো, ভিতর’টা যদি অজানা এক শূন্যতা’য় ছটফট করে, ভেবে নিও তোমার পৃথিবীর আরেক প্রান্তে তোমার জন্য অন্য একজন রাতজেগে স্বপ্ন বুনছে। যার কারনে তোমার ঘুম আসছে না। আচ্ছা, আমাকে নিয়েও কি কেউ রাতজেগে স্বপ্ন বুনছে?
-‘ ধূর! এসব কি ভাবছি? এ যুগে এমন ভালোবাসা হয় নাকি? ?
নিজের মাথায় নিজেই হাত দিয়ে থাপ্পর দিলাম। হঠাৎ মনে হলো ওপাশের বিল্ডিংটার রুমের জানালার পর্দা’টা নড়ে উঠল। মনে হচ্ছে, কোনো আবছায়া সরে গেছে ওখান থেকে…….
চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে