বসন্ত এসে গেছে পর্ব-১৮+১৯+২০

0
1123

গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
১৮.১৯.২০
পর্বঃ১৮
,

ঘড়ির কাটা এখন ১টার ঘরে।
চারিদিকে শুনশান নিরবতা।মাঝে মাঝে দু’একটা নাম না জানা নিশাচর পাখি ডেকে উঠছে।
দেয়ালে টানানো ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা টিকটিক করে শব্দ করে ছুটে ছলেছে।
তার সাথে পাল্লা দিয়ে শব্দ করছে অপুর হার্টবিট।
অতিরিক্ত টেনশনে অপুর মাথা ব্যাথা করছে।
এসি রুমে থেকেও গা ঘামছে।ভিজে চিপচিপে হয়ে গেছে সে।

মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে ঠান্ডা পানিতে গোছল করলে একটু ভালো হতো।
কিন্তু এতো রাতে গোছল করলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে সে ভয়েই অপু গোছলের চিন্তা বাদ দিলো।
রুমের একপাশ থেকে আরেকপাশে পায়চারি করতে লাগলো।
টেনশনে অপুর মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
এতো টেনশন করা যায় নাকি?

রাত আটটা নাগাদ অনিক ফোন দিয়েছিলো অপুর কাছে।অপু খুশি মনে লাফাতে লাফাতে ফোন রিসিভ করেছিলো।
যতোই সে ভাইয়ের উপর রেগে থাকুক না কেনো,ভাই ফোন দিলে এক নিমিষে রাগ গায়েব হয়ে যায় অপুর।
কিন্তু ফোন রিসিভ করে অনিক ভালোমতো একটা কথাও বলেনি,এমনকি একবার জিজ্ঞেস ও করেনি যে অপু কেমন আছে।
মায়ের আজ রাতে হার্টের অপারেশন সে কথাই জানাতে কল দিয়েছিলো সে।
অপু বলেছিলো,আগে কেনো জানায়নি যে আজ রাতে মায়ের অপারেশন?

অনিক তখন রাগারাগি করে অনেক কথা শুনেয়েছিলো অপুকে।তারপর আরকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে ফোন রেখে দিয়েছিলো অনিক।

অপুর খুব খারাপ লেগেছিলো।কিন্তু খারাপ লাগাটা মায়ের জন্য চিন্তার নিচে চাপা পরে গেছে।
আগে বললে হয়তো অপু মায়ের কাছে যেতে পারতো,কিন্তু এতো রাতে শশুড় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে অপুর মন সায় দেয়নি।
যদিও আরমান খান কিছু বলতেননা,তবে মিসেস রিচি?সে কিছুতেই ছাড় দিতো না অপুকে।

অপুর এখন কান্না পাচ্ছে, হাউমাউ করে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।
এতোক্ষণ যাবত সারা ঘরময় হাটতে হাঁটতে অপুর পা টাও ব্যাথায় টনটন করছে।

মাথা ব্যাথাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
চা খেলে হয়তো মাথা ব্যাথা কমতে পারে এই ধারনা নিয়ে অপু রুম থেকে বের হলো।
মায়ের অপারেশন হয়েছে নাকি আরও পরে হবে,এসব জানার জন্য অপু বারকয়েক অনিকের নাম্বারে কল করলো।
কিন্তু অনিক রিসিভ করলোনা।
অপুর টেনশন আরও বাড়লো।এবার টেনশনে হাত পাও কাঁপা শুরু হলো।
অপু বারবার কল করতে করতে সাবধানে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো।

এতো রাতে রুজি খালা আর নয়না খালা অবশ্যই ঘুমিয়ে গেছে।
সে কথা ভেবে অপু নিজেই কিচেনে গেলো।
কেতলিতে পানি গরম করতে দিয়ে আবার কল করতে লাগলো অনিকের নাম্বারে।

পানি গরম হয়ে এলে,কাপে চিনি,পানি, টি ব্যাগ দিয়ে নেড়ে হাতে তুলে নিলো অপু।
এমন সময় সিড়ির ওপর থেকে নোমানের গলা ভেসে এলো,
সে বললো,

—রুজি,এককাপ কফি দিন তো আমায়।

এতো শুনশান অন্ধকার রাতে হঠাৎ করে নোমানের গলা শুনে অপু চমকে উঠেছে।
বুকে ফু দিলো সে।

কিচেন থেকে বেরিয়ে সিড়ির দিকে উঁকি দিলো অপু।
নোমান নেই।কথাটা বলে সে আবার নিজের রুমে চলে গেছে।

আজ নোমান আরমান খানকে হাসপাতাল থেকে এনে এ বাড়িতেই থেকে গেছে।
নোমান থাকবে বলে অপু অন্য রুমে শিফট হয়েছে।
নোমান তো আর অপুকে বউ বলে মানে না যে এক রুমে থাকবে।
যদিও নোমান অপুকে অন্য রুমে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেনি তবু অপু নিজেই অন্য রুমে এসেছে।
নোমানের সাথে থাকলে তো অপুকে সোফায়ই শুতে হবে।আর শুনতে হবে নানাধরনের অপমানজনক কথা।তারচেয়ে বরং অন্য রুমে থাকাই ভালো।

অপু খুব সাবধানতার সাথে নোমানের কফি বানালো।
এবার মনে করে সে চিনি দিলোনা।
এর আগে তো এই চিনি নিয়েই তাকে কতো কথা শুনতে হয়েছিলো।

ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠে নোমানের রুমের সামনে দাড়ালো অপু।
রুমে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না সে।
অনেক চেষ্টা করে বুকে সাহস জমিয়ে দরজায় টোকা দিলো।

ভেতোর থেকে নোমান বললো,

—কাম ইন!

অপু রুমে ঢুকে সাবধানে টেবিলের ওপর কফির কাপ রাখলো।
নোমান তখন লেপটপে মুখ গুজে আছে।

কফির কাপ রেখে অপু মানে মানে কেটে পরতে চাইলো।

নোমান ততক্ষণে মুখ তুলে চেয়েছে।
অপুকে দেখে সে কপাল কুঁচকে ফেললো।
মেয়েটা থ্রী পিস পরেছে।
যদিও তাকে দেখতে ভালো লাগছে তবুও নোমানের ভালো লাগলোনা।
বিয়ের পর যে দুদিন নোমান বাড়িতে ছিলো তখন মেয়েটা শাড়ি পরতো।
শাড়ি পরে সারা বাড়ি টুকটুক করে ঘুরে বেড়াতো।
একদম বউ বউ লাগতো তাকে।
কিন্তু এখন? এখন কেনো শাড়ি পরেনা সে?সে কি বউ বউ সাজে আর থাকতে চায়না?মেয়ে সাজতে চায়?কার জন্য?
ফোনে কথা বলা ওই প্রেমিকের জন্য?

নোমান বলে উঠলো,

—শাড়ি পরোনা কেন এখন তুমি?

অপু ততক্ষণে দরজার কাছে এসেছিলো।
নোমানের কথা শুনে ঘুরে তাকালো।
প্রশ্নটা মাথায় ঢুকতে একটু যেনো সময় লাগলো।
বুঝতে পারতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।

নোমান অপুর মুখ থেকে উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষায় ছিলো।উত্তর না পাওয়ায় হতাশ হলো।
লেপটপ বন্ধ করে,সোফা থেকে উঠে দাড়ালো।
হাত দিয়ে মাথার সিল্কি চুলে বারকয়েক চিরুনি মতো করলো।
অপুর মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো,

—কথা বলো?

অপু নিশ্চুপ হয়ে কাঠ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।
তার কন্ঠ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
গলার কাছে সব কথা আটকে আসছে।

নোমান এবার বেশ বিরক্ত হলো।
একটু রাগী গলায় বললো,

—কথা বলছো না কেনো?বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে গেলে তো ভালই বলতে পারো।দাঁত কেলিয়ে হাসতেও পারো।

অপু বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললো,

—বয়ফ্রেন্ড?

—এইতো!বয়ফ্রেন্ডের কথা বলার সাথে সাথে মুখে কথা ফুটে গেলো।

অপু অবাক হলো।তার বয়ফ্রেন্ড কোথা থেকে আসলো?আর কবেই বা তার সাথে দাঁত কেলিয়ে হাসলো?কি বলছে টা কি নোমান।
অপু অবাক চাহনি দিয়ে নোমানের মুখের দিয়ে তাকালো।

হঠাৎ অপুর ফোন বেজে উঠলো।অনিক ফোন দিচ্ছে।
অপু ভয়ে ভয়ে নেমানের দিকে তাকালো।
নোমান অপুর দিকে রাগী চেহারায় তাকিয়ে আছে।
দেখেই মনে হচ্ছে সে ভয়ংকর রেগে যাচ্ছে।
কিন্তু কেনো?অপুর মাথায় ঢুকলো না।
হয়তো ফোন বেজে উঠেছে সেইজন্য?
অপু টুক করে কল কেটে দিলো।
নোমান খানের সামনে সে ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারবেনা।
তারচেয়ে রুমের বাইরে গিয়ে কল ব্যাক করবে।

নোমান তীক্ষ্ণ চোখে অপুর ফোন দেখলো।
মাথায় রাগগুলো দপদপ করে জ্বলে উঠলো।
মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড আছে।সত্যি আছে।
নয়তো নোমানের কথার জবাবে কেনো বললো না যে তার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই।
তাছাড়া এতো রাতে নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড ছাড়া অন্য কেউ ফোন দেয়না।
আবার নোমান সামনে আছে দেখে কল কেটেও দিলো?
এতোটা সাহস হয়েছে মেয়েটার?

নোমান রাগে চিৎকার করে বললো,

—এখনো দাড়িয়ে আছো কেনো?কেনো দাড়িয়ে আছো?
আউট,আউট ফ্রম মাই রুম!

,

,

গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
পর্বঃ১৯
,

,
খুব ভোরে বাইরে বেরিয়ে একটু হেটে এলো অপু।
কাল রাতে তার ঘুম হয়নি।
মায়ের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিলো তার।
ভাইকে কল দিয়োছিলো অনেকবার কিন্তু ভাই রিসিভ করেনি।
কল ব্যাক করেছিলো যখন অপু নোমানের ঘরে ছিলো।রুম থেকে বাইরে এসে অনেকবার ট্রাই করেছে অপু কিন্তু ফোন বন্ধ পেয়েছে সে।

কিচেনে ঢুকে সবার চা,কফি বানালো অপু।
রুজি হাই ছাড়তে ছাড়তে কিচেনে উঁকি দিয়ে দেখে অপু কিচেনে।
রুজি বললো,

—তুমি এতো ভোরে এইখানে কেন মা?

—চা আর কফি বানাই।

—আমিই তো আইতাছিলাম।তুমি কষ্ট করলা কেন?

—কষ্ট কোথায় রুজি খালা?এতটুকু কাজে কারও কষ্ট হয় নাকি?

চা আর কফি কাপে ঢেলে ট্রে তে তুলতে তুলতে বললো,

—এগুলো যার যার রুমে পৌছে দিতে পারবে খালা?

রুজি এগিয়ে এসে ট্রে হাতে নিলো।

—পারমু না কেন?অহনি যাইতাছি।

অপু তারাতাড়ি নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে জামা বদলালো।
কিছু টাকা আর ফোনটা ব্যাগে পুরে বের হলো রুম থেকে।
আরমান খানের রুমে গিয়ে দেখে নোমান দাঁড়িয়ে আছে।
সেও পুরো সুট বুট পরে রেডি।
হয়তো নিজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য।

অপু নোমানকে দেখে রুমের একটু কোনায় গিয়ে দাড়ালো।
ততক্ষণে নোমান আর আরমান খানের নজর অপুর উপর পরেছে।
দুজন কথা বলছিলো এতক্ষণ যাবত।অপুকে দেখে আরমান খান বললেন,

—এতো সকালে কোথায় যাচ্ছিস মা?ভার্সিটিতে?

অপু মাথা নাড়লো।
বললো,

—একটু মায়ের সাথে দেখা করতে যাবো বাবা?

আরমান খান হাসলেন।
—পাগলী মেয়ে,তোর মায়ের সাথে যখন ইচ্ছে হবে তখন দেখা করতে যাবি একথা আমাকে জিজ্ঞেস করার কি আছে।

একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,

—কিন্তু এতো সকালে?কিছু হয়েছে?সব ঠিক আছে তো?

—কাল রাতে মায়ের অপারেশন হয়েছে।

—ওহ,তাই নাকি?আচ্ছা যা।

অপু আরমান খানের সাথে আর কথা বাড়ালো না।নোমানের সামনে বেশি কথা বলতে পারেনা অপু।
কেমন অসস্থি হয় তার।
ঘুরে দাড়াতেই আরমান খান আবার বললেন,

—একটু দাড়া না মা।

অপু দাড়ালো।আরমান খান নোমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—তুমিও তো এখন চলে যাচ্ছো নোমান।
তোমার যাওয়ার পথেই অপু যাচ্ছে। তো সেখানে যদি একটু ওকে নামিয়ে দিতে।

আরমান খান আমতাআমতা করলেন।
কথাটা বলা ঠিক হয়েছে কিনা তিনি বুঝতে পারলেন না।
নোমান যে অপুকে সাথে নেবেনা সেটা তিনি জানেন তারপরও যে কেনো বলতে গেলেন।
এখন নোমানের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটা আরমান খান জানেন।হয়তো বাবার উপর রেগে যাবে।রাগারাগি করবে।
তবুও তো।
আরমান খান যে চায় মরার আগে দুজনকে একসাথে দেখে যেতে।

ভাবনার মাঝে নোমানের গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেলো।

—ওকে।

নোমানের কথা শুনে অপু এবং আরমান খান দুজনেই বিস্ফোরিত নয়নে নোমানের মুখের দিকে তাকালো।

নোমান ব্যাপারটা লক্ষ করে বললো,

—হোয়াট?

আরমান খান আর অপু দুজনেই রোবটের মতো না সূচক মাথা নাড়লো।
এই মূহুর্তে তারা অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে পৌছে গেছে।

নোমান আরমান খানকে বললো,

—আসছি।নিজের যত্ন নিও।

অপুর দিকে তাকিয়ে অপুকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—আর তুমি?
আমার সাথে এসো।

—-

গাড়িতে উঠে অপু রোবটের মতো বসে আছে।
না হেলছে না দুলছে।একটু নড়নচড়ন তো দুর মুখ থেকে টু শব্দ ও বের করছেনা।
গাড়ির কাচ বন্ধ থাকায় অপুর কেমন হাস ফাঁস লাগছে।
মনে হচ্ছে কেউ তার গলা টিপে ধরে রেখেছে।
অপু জানালার দিকে তাকিয়ে নোমানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।

নোমান গাড়ি চালানোর ফাকে ফাঁকে অপুর দিকে তাকাচ্ছিলো।
অপু তাকাতেই দুজনার চোখাচোখি হলো।

নোমান এতক্ষণ যাবত অপুর হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছিলো।
এই প্রথম নোমানের কোন মেয়েকে বুঝতে ইচ্ছে করছে।
তাকে খুশি রাখতে ইচ্ছে করছে। তার সাথে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

অপুর এভাবে তাকানো দেখে কেন যেনো নোমানের মনে হলো হয়তো মেয়েটা কাচ খুলতে চাইছে।
কিন্তু নোমানের ভয়ে বলতে পারছেনা।
নোমান হালকা ঝুকে কাচ নামিয়ে দিলো।

অপু সেদিকে দেখে বড় করে হাফ ছাড়লো।
জানালার কাছে মুখ নিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলো।

নোমান তা দেখে নিজের মনেই হাসলো।
যাক সে তাহলে মেয়েটাকে বুঝতে শুরু করেছে তাহলে?

কিছুদুর যেতে না যেতে জ্যামে আটকা পরলো তারা।
নোমান কপাল কুঁচকালো।
এই জ্যাম ট্যাম নোমানের খুবই বিরক্ত লাগে।
ফোন বের করে কিছুক্ষণ ফোন টিপলো সে।
তারপরও জ্যাম ছাড়ার কোন নামগন্ধ নেই।
পাশে তাকিয়ে দেখলো অপু জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে কিছু দেখছে।
কিন্তু কি দেখছে?

নোমান পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো।
তারপরও হাল ছাড়লো না।
আবার চেষ্টা করলো।
অবশেষে দেখতে সক্ষম হলো।

সেই ছোট্ট মেয়েটা। যে বেলিফুলের মালা বিক্রি করে বেড়ায় সে।
তার দিকে এভাবে তাকিয়ে কি দেখে মেয়েটা?
খাবার খাওয়াবে নাকি একেও?
নাকি অন্যকিছু?
নিজের মনেই বিরবির করে বুঝার চেষ্টা করলো নোমান।

অপুকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—বাইরে কি দেখো?

অপু আকস্মিক নোমানের কথায় কিছুটা হকচকিয়ে গেলো।
পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

—না মানে,বেলিফুল!

—বেলিফুল পছন্দ?

অপু দ্রুততার সাথে মাথা নাড়লো।

নোমান সেদিকে দেখে বাইরে মেয়েটার উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে ডাকলো।
কয়েকটা বেলিফুলের মালা কিনে অপুর হাতে দিলো।

অপু কিছুটা অবাক হয়ে নোমানকে দেখলো।
বিয়ের পরের নোমান আর এখনকার নোমান তার কাছে আলাদা লাগছে।
মনে হচ্ছে এ যেনো অন্য কেউ।
যাকে দেখলে ভয় হয়না,আস্থা জাগে।
ভরসা করতে ইচ্ছে হয়।

এদিকে সামান্য বেলিফুল পেয়ে অপুর উচ্ছাস, তার খুশি মাখা মুখ দেখে বারংবার নোমান মুগ্ধ হলো।
তাকে হাজারওবার এমন খুশি দেওয়ার ইচ্ছে জাগলো।

,

,গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
পর্বঃ২০

,
,
সন্ধায় বেলকনিতে বসে ঝিরিঝিরি মৃদুমন্দ বাতাস উপভোগ করছে অপু।
বাতাসে খোলাচুল গুলো এদিক ওদিক দোলা খাচ্ছে।
নাকে ভেসে আসছে মিষ্টি ফুলের ঘ্রান।
নোমানের রুমের এই বেলকনিটায় এখন সম্পূর্ন রূপে অপুর রাজত্ব।
অপু নিজের পছন্দ মতো নানা ধরনের ফুলের গাছের টব দিয়ে সাজিয়েছে বেলকনিটাকে।
একটা দোলনাও রেখেছে পাশে।
অন্য রুমের বেলকনিতে যদিও লাগাতে পারতো অপু,কিন্তু এই রুমটা বাগানের একদম পাশে এবং খুব সুন্দর বাতাস আসে এ পাশটায় তাই এখানটাই নিজের মতো করে সাজিয়েছে সে।
দোলনায় শুয়ে শুয়ে বাতাস উপভোগ করছে অপু।
কিছু একটা মনে করে উঠে ফোন হাতে নিয়ে ভাইয়ের নাম্বারে কল করলো সে।
কিন্তু ওপাশ থেকে রিসিভ হলোনা।
অপু ফোনটা পাশে রেখে চোখ বন্ধ করলো।
ভাবল হয়তো ভাই বিজি আছে তাই রিসিভ করেনি।
পরশু অপু গিয়েছিলো মায়ের কাছে।তার সাথে দেখা করে অপুর ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে গেছে।
খুব ভালভাবে মায়ের অপারেশনটা হয়েছে।
যদিও একটু অসুস্থ তিনি এখন কিন্তু কিছুদিনের ভেতরই মা সুস্থ হয়ে যাবেন।
সারাদিন মায়ের সাথে কাটিয়েছিলো অপু।
বিকেল হতেই আবার বাড়ি ফিরে এসেছিলো।যতো যাই হোক আরমান খানও তো অসুস্থ। তাকেও তো দেখতে হবে অপুকে,তার প্রতিও তো দায়িত্ব আছে।

এসব ভাবতে ভাবতে অপু উঠে দাড়ালো।
এখানে বসে থাকতে থাকতে তার চা খেতে ইচ্ছে করছে।
এমন পরিবেশের সাথে এক কাপ চা হলে মন্দ হতোনা, ভেবে কিচেনের উদ্দেশ্যে নিচে গেলো সে।
কিচেনে ঢুকে চা বানিয়ে আবার রুমে ফিরে এলো।
বেলকনিতে এসে দেখলো দোলনার উপর রাখা তার ফোনটায় আলো জ্বলছে।
পাশের টুলের ওপর চা র কাপ রেখে ফোন হাতে তুলে নিলো অপু।
দেখলো ফাইভ মিসডকল।
একটা আননোন নাম্বার থেকে।
কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে আবার ফোন বেজে উঠলো।
অপু রিসিভ করে সালাম দিলো।
ওপাশ থেকে সালামের উত্তর নিয়ে বললো,

—এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

অপু নিস্তব্ধ হলো।
এক নিমিষে কন্ঠ চিনতে পারলো।কিন্তু সে কি সত্যি অপুকেই কল দিয়েছে?সত্যি কি সে?সে কেনো অপুকে কল দিতে যাবে?এটা হয়তো অন্যকেউ।
কিন্তু কন্ঠ তো হুবহু এক।
অপুর নিজের উপরই নিজের অবিশ্বাস হলো যেনো।
তবুও যাচাই করার জন্য বললো,

—কে?

ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় জবাব এলো,

—-আমি।

—আমি কে?

নোমানের রাগ করে বলতে ইচ্ছে হলো,আমি কে চিনোনা?নিজের স্বামীর কন্ঠও চেনোনা?বলতে ইচ্ছে হলো, আমি তোমার হাসবেন্ড।
কিন্তু বলা হলো না।
হাসবেন্ড এর কোন দায়িত্বই সে পালন করেনি,তাহলে কোন মুখে বলবে সে কথা।
মুখে বললো,

—আমি নোমান।

যদিও উত্তরটা আশা করেছিলো অপু তবুও চমকালো।
কি বলবে খুজে পেলোনা।ভয়ে নয় লজ্জায়।
আজকাল নোমানের কথা ভাবলে অপুর মনে ভয় কাজ করেনা।কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। অপু বোঝে তার মনে জায়গা নিতে শুরু করেছে নোমান।হয়তো নোমানের মনেও।
নোমানের কিছু কিছু কাজেই তা প্রকাশ পায়।
একটু রাগী বেশি সে,হুটহাট রেগে যাওয়া তার অভ্যাস তবুও অপুর তার প্রতি এক ভাললাগা কাজ করে ইদানিং।

নোমান আবার বললো,

—বললে না?

—কি?

—এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?ফোন রিসিভ করোনি কেনো?

—কিচেনে ছিলাম।

—ওহ।

দুজনেই বেশকিছু সময় নিরবতা পালন করলো।
দুজনেই কোন কথা খুজে পেলোনা।
নোমান হুট করে বলে উঠলো,

—বাবা কেমন আছে?

অপু হাসলো।নিঃশব্দ হাসি হাসলো।
নোমান যে একটু আগে আরমান খানের সাথে ফোনে কথা বলেছে তা অপু দেখেছে।
এখন কথা বাড়ানোর জন্যই যে নোমান বাবার কথা বলেছে সেকথা সে বোঝে।

—ভালো।

নোমান আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফিসফিস গলায় বলে,

—আর তুমি?

অপু কেঁপে ওঠে।মুখ লজ্জায় নতো হয়।
বলে,

—ভালো।

কিছুটা সময় নিয়ে আবার বলে,

—কিন্তু আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?

—আমার পক্ষে সামান্য একটা নাম্বার জোগাড় করা কোন ব্যাপার হলো?

পাশে একজন কর্মচারীর ডাক শুনে সেদিকে তাকিয়ে কোন কারনে চিৎকার করে কিছু বলে উঠলো নোমান।

অপু ভয় পেলো।
আবার রাগলো কেনো লোকটা,এবার কি ওখানকার রাগ সব অপুর উপর ঝারবে নাকি।

কিন্তু সেরকম কিছুই হলোনা। নোমান স্বাভাবিক গলায় অপুকে উদ্দেশ্য করে ফোনে বললো,

—দুমিনিট পরে ফোন করছি তোমায়।

অপু মাথা নাড়লো।

নোমান যেনো এক লহমায় সে কথা বুঝে ফেললো।একটু হেসে বললো,

–মাথা নাড়ালে কি ফোনের ওপাশের মানুষটা শুনতে পাবে?মুখে বলবা কথা।

অপু হেসে ফেললো।

–আচ্ছা।

——

ভার্সিটিতে যেতে আজ অপুর বেশ দেরি হয়ে গেছে।
কাল সারারাত নোমানের সাথে কথা বলেছে সে।
ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরেছিলো তাই উঠতে একটু বেলা হয়ে গেছে।
উঠে তারাতাড়ি কাজা নামাজ আদায় করে সবার জন্য চা বানিয়েছে।
আরমান খানকে চা দিয়ে রেডি হয়ে ভাড়সিটির উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে।

মনের ভেতর কেমন যেন অশান্তি লাগছে অপুর।
ভেতরটা খুব হাসফাস করছে।
এমনটা তো হওয়ার কথা না।
সব তো ঠিকঠাক চলছে।
মা ভাল আছে,নোমানোর সাথে আস্তে আস্তে সম্পর্কটা ভালোর পর্যায়ে যাচ্ছে। তবু কেন ভেতরটা এতো অশান্ত তার?

অপু সিদ্ধান্ত নিলো আজ একটা ক্লাস করে বাড়ি ফিরে আসবে।

হাটতে হাটতে কিছুদুর যেতেই একটা রিকশা পেলো।
রিকশা ডেকে দাড় করিয়ে উঠতে যেতেই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো,

—রুপা দাড়াও?

অপু পেছন ফিরে দেখে রায়হান ভাই।
দৌড়ে এসে রিকশার একপাশে বসে পরলো সে।
অপুর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একগাল হেসে রায়হান বললো,

—কি?এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?ওঠো রিকশায়।

অপু কথা বাড়ালো না।
চুপচাপ রিকশায় উঠে বসলো।
যদিও রায়হান একপাশে সরে বসেছিলো তারপরও অপু সাবধানে একপাশে বসলো যাতে স্পর্শ না লাগে।
অপু ইদানীং কিছুটা বুঝতে পারে রায়হানকে।
সে যে মনে মনে অপুকে পছন্দ করে তাও বোঝে।
যদিও মুখে কখনো বলেনি তবু অপু বুঝতে পারে।
এই যে প্রতিদিন অপু ঠিক যে সময় ভার্সিটিতে যায় অলৌকিক ভাবে ঠিক সেই সময়ে রায়হানের যায়।
অপুর লেট হলে সেদিন নাকি রায়হানেরও লেট হয়।
একদিন দু’দিন মিলতে পারে তাই বলে প্রতিদিন?
অপু তো আর বাচ্চা না!
তাছাড়া রাস্তার পাশে কোনার ঐ দোকানটায় রায়হানকে বসে থাকতে দেখেছে অপু।
রায়হান ঐ দোকানটায় বসে অপুর জন্য রোজ অপেক্ষা করে।
ব্যাপারটা খুব বিরক্ত করে অপুকে।
কিন্তু কিছু বলতে পারেনা।
কি বলবে?আগ বাড়িয়ে কিছু কি বলা যায়?রায়হান ভাই তো মুখে কিছু বলেনি,বা কোন খারাপ ব্যবহারও করেনি।

,

চুপচাপ মাথা নিচু করে রিকশায় বসে থাকে অপু।
এরমাঝে ফোন বেজে ওঠে।
অপু কল রিসিভ করে কানে ধরা মাত্র কারও কথা শুনে স্তম্ভিত হয়।
হাত থেকে আপনাআপনি ফোন খসে পরে।
চোখ জলে ভরে ওঠে।
রিকশা থেকে পরে যেতে গেলে রায়হান হাত টেনে ধরে।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে