ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ১০

0
2946

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

রুগ্ন দেহ, মলিন চেহারার নীলিমাকে চিনে নিতে একটু কষ্ট’ই হচ্ছিল আবিরের। দু’বছরে মানুষ এতটা বদলে যেতে পারে সেটি নীলিমাকে না দেখলে আবির বোধ হয় জানতেই পারত না। শুকিয়ে আগের চেয়ে লম্বা হয়ে গেছে, চোখের নীচে দাগ পরে গেছে, দাতগুলো কেমন ভেসে গেছে।
না চাইতেই আবিরের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। পাশে বসা অর্থনীতি মেম নীলিমার হাতে একটা মাইক ধরিয়ে দিয়ে গান গাওয়ার জন্য বলে। আচমকা আবির মাইকে ঘোষনা করে দেয়-
” সুপ্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ_
এখন এই মুহূর্তে মঞ্চে আপনাদের সামনে গান নিয়ে আসছেন এ কলেজের’ই প্রাণ, কলেজের একসময়ের সেরা ছাত্রী মিস নীলিমা। নীলিমার জন্য একটা জোড়ে হাত তালি হবে। সকল ছাত্র ছাত্রীরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পরে। নীলিমাকে করজোড়ে অভিবাদন জানায়। আবির আবারো মাইকে ঘোষনা করে, নীলিমাকে মঞ্চে আসার জন্য বিনীত অনুরোধ করা হচ্ছে। কাঁপা পায়ে নীলিমা মঞ্চে উঠে। ভীরু চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে, মাইক’টা মুখের সামনে নিয়ে গাইতে শুরু করে-

“তুই ফেলে এসেছিস কারে,
মন, মনরে আমার
তাই জনম গেল,
শান্তি পেলি নারে…!!
মন, মনরে আমার
তুই ফেলে এসেছিস কারে,
মন, মনরে আমার।
যে পথ দিয়ে চলে এলি
সে পথ এখন ভুলে গেলিরে!!
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে
মন, মনরে আমার
তুই ফেলে এসেছিস কারে,
মন, মনরে আমার।
নদীর জলে থাকিরে কান পেতে
কাঁপেরে প্রাণ পাতার মর্মরেতে….!!
মনে হয় যে পাবো খুঁজি
ফুলের ভাষা যদি বুঝিরে…!!
যে পথ গেছে সন্ধ্যা তারার পানে
মন, মনরে আমার….
তুই ফেলে এসেছিস কারে,
মন, মনরে আমার
তাই জনম গেল,
শান্তি পেলি নারে….!!
মন, মনরে আমার
তুই ফেলে এসেছিস কারে,
মন, মনরে আমার….”

গান শেষে মঞ্চ থেকে নেমে দৌঁড়ে কলেজ মাঠ ছেড়ে পালায় নীলিমা। কলেজ লাইব্রেরি’টা খোলায় ছিল, সেখানে গিয়ে হু, হু করে কেঁদে উঠে নীলিমা__
” তুমি আমাকে এভাবে অপমান করলে?
আমি তো শুধু একটু গান’ই গাইতে চেয়েছিলাম…”

অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরছিল আবির, পথিমধ্যে পথ আগলে দাঁড়ায় নীলিমা। গাড়ি থামিয়ে জানালার গ্লাসটা নামিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে নীলিমার তাকায় আবির। প্রশ্ন করে,
” দুনিয়াতে এত গাড়ি থাকতে আমার গাড়ির সামনে এসেই মরতে হলো?”
দৌঁড়ে গাড়ির জানালার পাশে যায় নীলিমা। করুণ গলায় বলে, প্লিজ! আপনি আমার কথাটা শুনোন…..
দেখুন মিস নীলিমা! এটা কলেজ নয়, পাবলিক প্লেস। তাই প্লিজ অযথা বাড়াবাড়ি করবেন না এখানে। আমার তাড়া আছে। রাস্তা ছাড়ুন।
প্লিজ, আপনি আমার কথাটা তো শুনোন। তারপর না হয় চলে যাব…..
ওকে, বলুন! কি বলতে চান আপনি?

কথাগুলো একান্ত’ই ব্যক্তিগত, এখানে বলা ঠিক হবে না। আমি কি আপনার সাথে আপনার বাসায় গিয়ে ধীরে সুস্থে কথাগুলো বলতে পারি…???
আবির নীলিমার দিকে একবার ফিরে তাকায়। তারপর গাড়ির দরজাটা খুলে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে-
ওকে, ফাইন! চলুন…..
নীলিমা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসে। গেইটের ভিতর গাড়ি’টা ঢুকাতে ঢুকাতে নীলিমা উপরে নিজ রুমে চলে যাচ্ছিল, পিছন থেকে ডাক দেয় আবির। নীলিমা পিছনে ফিরে তাকালে আবির জানায়, “রুম চেঞ্জ করে ফেলেছি। এখানে আমার এক কাজিন থাকে। উপরে আমার রুম। চলুন….”
নীলিমা আবিরের পিছুপিছু ওর রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজার লক খুলে ভিতরে ঢুকে আবির, তার পিছু পিছু নীলিমা। অনেক সুন্দর গুছানো দুটো রুম। একটা আবিরের বেডরুম, আরেকটা স্টাডি রুম। নীলিমাকে আবির স্টাডি রুমে বসার অনুমতি দিয়ে নিজে বেডরুমে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পর ফ্রেস হয়ে ফিরে আসে আবির। স্টাডি রুমে একজন বসা যাবে এরকম একটা ছোট্ট সোফা আছে। আবির সেখানে বসে নীলিমার দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকায়। নীলিমা কিছু না বলে চুপসে বসে আছে। ভ্রু-কুচকে প্রশ্ন করে আবির, কি হলো? বলুন কি বলতে চান…?!!!
নীলিমা বার কয়েক বলতে গিয়েও আটকে যায়, পারেনি বলতে। অতিবাহিত হয়ে যায় ত্রিশ মিনিটেরও অধিক সময়। এরই মধ্যে আবিরের স্টুডেন্ট’রা এসে যায়। বিরক্তির দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে একবার তাকিয়ে সোফা থেকে উঠে ওদের পড়াতে চলে যায় আবির। ঘন্টা’খানেক পর ওদের বিদায় দিয়ে স্টাডি রুমে ঢুকে আবির। নীলিমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে আবারো বলে উঠে,
” আপনি এখনো এখানে বসে আছেন যে?” করুণ গলায় উত্তর দেয় নীলিমা, আমার কথাটা যে বলা হয়নি আপনাকে।
স্বাভাবিক হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে আবির। জ্বি, বলুন। কি বলতে চান…..?
জবাব আসে, একটা বাসা ভাড়া দিবেন?
বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে আবির। কোনো রকম রাগকে কন্ট্রোল করে বলে, এই কথাটা আপনি রাস্তায় বললেই পারতেন। যায় হোক! আমার এখানে কোনো বাসা খালি নেই। কথাটা বলে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় আবির। ওয়াশরুম থেকে মাগরিবের নামাজের জন্য অজু করে ফিরে এসে দেখে নীলিমা তখনো সে স্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে আবির, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আপনি এখনো এখান থেকে যাচ্ছেন না যে?

মাথা নিচু করে জবাব দেয় নীলিমা,
“আজ রাতটা কি এখানে থাকতে পারি আমি? অবাকের চরম সীমায় আবির-
“What?”
কেঁপে উঠে নীলিমা। আমতা আমতা করে বলতে থাকে, না মানে আমি যে বাসায় থাকি সে বাসাটা এখান থেকে মাইল তিনেক দুরে। ঐ এলাকার ছেলেরা খুব খারাপ। দিনে দুপুরে রাস্তাঘাটে মেয়েদের জ্বালাতন করে। তাই আজ রাতটা যদি আমাকে এখানে থাকতে দিতেন….
ঠিক আছে, থাকুন! তবে আজ রাতটাই। কাল সকালে উঠে যাতে স্টাডি রুমটা পরিষ্কার দেখি…!!!
নীলিমা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।

পরদিন সকালবেলা_
অটো রিক্সার ক্রিং ক্রিং আওয়াজে ঘুম ভাঙে আবিরের। জানালা মেলে নিচে তাকায় আবির। কিছুটা ঘুম গলায় প্রশ্ন করে,
” ও ভাই! সকাল সকাল কি শুরু করছেন এসব?”
অটোচালক আবিরকে দেখে জোরে হাকিয়ে বলে, ” ভাই! ডাক্তার আপা আছে এখানে?”
আবির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে, কোন আপা? অটোচালক চিল্লানোর স্বরে জবাব দেয়, ডাক্তার নীলিমা আপা…. ওনাকে একটু ডেকে দিন।

আবির ওর স্টাডিরুমের দরজায় গিয়ে নক করে, মিস নীলিমা! আপনাকে নেয়ার জন্য অটো এসেছে। নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ধরমরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দৌঁড়ে নিচে নামে নীলিমা। আবির ওয়াশরুমে চলে যায়। ততক্ষণে নীলিমা অটো থেকে ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নামিয়ে অটোওয়ালাকে দিয়ে ব্যাগপত্র উপরে তুলে। সবশেষে অটোওয়ালাকে বিদায় দিয়ে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে উপরে উঠে নীলিমা। ওয়াশরুম থেকে কেবল বেরিয়েছিল আবির। নীলিমার জিনিসপত্র দেখে “থ” হয়ে যায় ও। নীলিমা আপনমনে আলমারির লক খুলে কাপড় গুলো আলমারিতে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পরে। চোখ কপালে উঠে যায় আবিরের। পিছন থেকে বলে উঠে আবির-
” বসতে বলেছিলাম, এখন তো দেখি শুয়ে পরার ব্যবস্থা করেছেন আপনি…”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে