খাবোনা খাবোনা বলেই খাবারের প্লেটটা ফেলে দিল রুবাসা।পানির গ্লাসটাও ছুড়ে মারলো মেঝেতে ।রুবাসার এরকম অদ্ভুত আচরনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওর আম্মু ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো রুবাসার মুখে।
রুবাসা কান্না করলো না। সে ক্ষিপ্রগতিতে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। রুবাসার আম্মু দৌঁড়ে গিয়ে দরজা নক করতে লাগলো।
__রুবাসা দরজা খোল। দরজা খোল বলে চেঁচামেচি করলো।
একটু পর দরজা খুলে দিল রুবাসা।
__কি হয়েছে তোর।ক’দিন ধরে এই রকম করছিস কেন?
রুবাসা কিছুই বলল না। রুবাসা বারান্দায় গিয়ে ওর একটা প্রিয় পুতুল ডাস্টবিনে ফেলে দিল।
রুবাসার এইসব কান্ডকারখানায় ক্ষিপ্ত হয়ে
ওর আম্মু আমাকে ফোন করে সব জানালো।আমি সব শুনে পাথরের মূর্তির মত নির্বাক হয়ে গেলাম।কি হলো আমার মেয়েটার?কেন এমন করছে?
রুবাসা আমাদের একমাত্র মেয়ে।
রুবাসার বয়স নয় বছর। এ বছর ক্লাস থ্রি তে উঠেছে। আমাদের বড় আদরের এই মেয়েটা কোন কিছু না চাইতেই হাজির করি।
সারাক্ষন রুবাসাকে চোখে চোখে রাখে ওর আম্মু।
বেশ হাসি খুশি বুদ্ধিমতি আমাদের আদরের রুবাসার হঠাৎ আচরনের এই পরিবর্তন আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
শীতে থরথর করে কাঁপে রুবাসা কিন্তু শীতের পোশাক পরে না। ওর আম্মু জোড় করে গায়ে পরিয়ে দিলে সেটা আবার খুলে ফেলে। রাগি রাগি চোখ করে তাকিয়ে থাকে,
মুখে কিছুই বলে না। ওর আম্মু খাবার দিলে খায় না। বুয়ার হাতে খাবার খায়।ওর আম্মুকে একদমই সহ্য করতে পারে না। ঠিক মতো গোসল করে না, খাওয়া,ঘুম সব কিছু তেই অনিয়ম। পড়াশুনাও করতে চায় না।
টিচার অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নাম মাত্র পড়ায়।
দিন যতই যাচ্ছে রুবাসার মানসিক অবস্থার ততই অবনতি হচ্ছে। যে মেয়েটিকে ঘিরে ছিল আমাদের সুখসপ্ন।আজ তার আচরনে আমরা বড়ই অসহায় বোধ করতে লাগলাম।
আমি বাধ্য হয়ে এসব কথা আমার একজন ডাক্তার বন্ধুর সাথে শেয়ার করলাম।
সব শুনে বন্ধু বলল, রুবাসার আচরনের এই পরিবর্তনের কথা শুনে মনে হচ্ছে,ওর নিউরোটিক সমস্যা হয়েছে।যা সাধারণত মানসিক চাপ থেকে হতে পারে। কোন কারনে মানসিক চাপে আছে মনে হয় রুবাসা। সেটাই ফাইন্ড আউট করতে হবে।
রুবাসা তার মাকে সহ্য করতে পারে না কেন সেটা বুঝতে পেরেছো?
আমরা কিভাবে বুঝবো।রুবাসাতো আমাদের সাথে ঠিক মত কথা বলে না। তবে একটা ব্যপার আমার মাথায় সব সময় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু,..বলা ঠিক হবে কিনা..
মেয়েকে সুস্থ করে তুলতে হলে কিছুই গোপন করা চলবে না। সব বল আমাকে। আমি যেহেতু শিশুমনরোগ বিশেষজ্ঞ,ভয় নেই তোর।
সব সমস্যারই সমাধান আছে।
আমি একে একে সব খুলে বলা শুরু করলাম __মেয়েটাকে আমরা অতিরিক্ত সুরক্ষা দিতে গিয়ে, ওর ইচ্ছেটাকে আমরা কখনও একসেপ্ট করিনি।আমাদের ইচ্ছেটাকেই ওর উপর চাপিয়ে দিয়েছি সব সময়। শ্রেনীতে প্রথম স্থানটা বজায় রাখার জন্য টিচার রেখে দিয়েছি দু’জন । বইও তো অনেকগুলো ওদের ক্লাসে।
আবার গানের টিচার ও আছে একজন।একটা মাত্র মেয়ে,তাই সব দিক দিয়েই পারদর্শী করে গড়ে তোলার নেশায় মেয়েটাকে ব্যস্ত রেখেছি সব সময় ।
সব সময় বলতাম, তোমার র্ফাস্ট পজিশন ঠিক রাখতে হবে।
বাসায় কোন মেহমান আসলেও ওকে মেহমানের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতাম না।
সারাদিন পড়ার মধ্যেই রেখেছি মেয়েটাকে।কিন্তু দুঃখের বিষয়
এবার সে প্রথম হয় নি,পঞ্চম হয়েছে। এই কারনে ওকে অনেক বকেছি আমরা।
ওর আরেকটা বদ অভ্যাস কাজের বুয়ার মেয়ের সাথে বন্ধুর মতো আচরন করা।
আমাদের লেভেলটা বুঝতো না রুবাসা।
কাজের বুয়ার মেয়েটার সাথে নিয়মিত পুতুল খেলতো,এটা ছিল আমাদের খুব অপছন্দ।তাই এটা নিয়ে ও বকাঝকা করতাম।
একদিন কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করেছি, ওর সাথে যেনো পুতুল না খেলে।
বুয়াকে বলেছি ,তোমার মেয়েকে আর আমাদের বাসায় নিয়ে আসবা না।
বুয়া সেদিন অনেক কান্নাকাটি করে জানালো,বস্তিতে দুস্ট ছেলেদের উপদ্রব।ছোট হলেও মেয়েটাকে একা বাসায় রেখে আসতে ভয় লাগে।তাই নিয়ে আসি।
আমরা বুয়াকে বলে দিয়েছি, তোমার মেয়েকে অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে।
তারপরও বুয়া তার মেয়েকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতো।
মেয়েটি সেদিন শীতে কাঁপছিল।
রুবাসা ওর কাপুঁনি দেখে মাকে বলল, আম্মু আমার তো অনেকগুলো সোয়েটার। একটা সোয়েটার শ্রাবনীকে দিব? ওর একটা মাত্র সোয়েটার।ঐটা আজ ধুয়ে দিয়েছে।
ওর আম্মু বলল, বেশি পাকামো করো না।যাও পড়তে বস।
শ্রাবনীকে ধমকের স্বরে বলল, আজ আবার কেন আসলি।তোকে আসতে নিষেধ করেছি না?
কাল থেকে আর আসবি না।
রুবাসার অনেক পড়া আছে। ওর পুতুল খেলার সময় নেই।
বুয়া এসে বলল,
খালাম্মা বস্তির ছেলেগুলো ভালো না।বাসায় একা রেখে আসতে ভয় লাগে।রুবাসা আপুমনি ছোট বেলা থেকে ওর সাথে পুতুল খেলে, আমি একটু নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি।
__তোমার কোন কথা শোনবো না আর। তোমার মেয়েকে আর আমাদের বাসায় নিয়ে আসবা না।
কথার এক ফাঁকে রুবাসা ড্রয়ার থেকে একটা সোয়েটার শ্রাবনীর হাতে দিয়ে বলল, এটা গায়ে দিয়ে যা।
রুবাসার আম্মু দেখা মাত্রই সোয়েটারটা কেড়ে নিয়ে রুবাসাকে বলল, জানো এটার দাম কত?
ওদের মতো গরীব মানুষ এগুলোর কদর বুঝবে?।তুমি এটা কেন দিয়েছো?
এই সোয়েটার তোমার আব্বু থাইল্যান্ড থেকে এনেছে, একদম নতুন।
এসব কথা শুনে রুবাসা কাঁদতে কাঁদতে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসেছিল অনেক্ষন।
রুবাসা এই রকম ওল্টা পাল্টা কাজ করতো দেখে,
সারাক্ষন মায়ের বকুনি শুনতো।
সব শুনে ডাক্তার বন্ধু বলল,
অনেক বড় ভুল করেছিস তোরা।রুবাসার সাথে অন্যায় করেছিস। তারই ফলে আজ এই দিনটি দেখতে হচ্ছে তোদের।
বাচ্চাদেরকে ঘুড়ির মতো স্বাধীন ভাবে উড়তে দিতে হয়। শুধু সুতোটা ধরে রাখতে হয় মা-বাবাকে।
বাচ্চাদেরকে বেশী শাসন করতে হয় না।আবার বেশী প্রশ্রয় দিতে হয় না। মাঝামাঝি অবস্থান নিলে বাচ্চাদের মনের উপর চাপ পরে না।
তোদের অতিরিক্ত শাসন রুবাসার মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
মনে রাখিস,শুধু ক্লাসে র্ফাস্ট হলেই ভাল মানুষ হওয়া যায় না।ভালো মানুষ হতে হলে সামাজিক, মানবিক, নৈতিক, সব শিক্ষারই দরকার আছে।
তোরা ওকে র্ফাস্ট পজিশন রাখার জন্য নিয়মিত চাপে রেখেছিলি।
যা ওর জন্য ক্ষতি বয়ে এনেছে।
দ্বিতীয়ত
রুবাসার মনটা কোমল।ওর ভিতরে গরীব ধনীর ভেদাভেদ নাই। শ্রাবনী হলো তার খেলার সাথী। সাথী শীতে কষ্ট পাচ্ছে বলে, ওর মনে শ্রাবনীর জন্য মায়া অনুভব হয়েছে। কিন্তু তোরা ওর সেই মায়ার জায়গায় আঘাত করেছিস।
এটা সে মেনে নিতে পারে নি। তার ভীতরে অভিমান সৃষ্টি হয়েছে। এই অভিমান ওর স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করেছে। ও এখন ইমব্যলেন্সড। রুবাসার এখন চিকিৎসার প্রয়োজন।
আর এই চিকিৎসার জন্য তোদের অনেক উদার হতে হবে।
আমি সব কিছু রুবাসার আম্মুকে খুলে বললাম। রুবাসার আম্মু সব শুনে বলল_ আমার মেয়েকে সুস্থ রাখতে হলে আমি সব করতে রাজী।
এরপর আমরা বন্ধুর পরামর্শ মত চলতে লাগলাম।
একদিন রুবাসার আম্মু বুয়াকে বলল, কাল থেকে আবার শ্রাবনীকে নিয়ে এসো।
বুয়া বলল, আমরা হলাম বড়লোকদের হাতের পুতুল।যেমনি নাচায় তেমনি নাচি।
রুবাসার আম্মু আমাকে বলল, মেয়েই যদি সুস্থ না থাকে,তবে এই দামী সোয়েটার দিয়ে কি হবে, বলো।
রুবাসাকে না জানিয়ে চুপি চুপি বুয়াকে সোয়েটারটা দিয়ে বলল, কালকে এই সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে শ্রাবনীকে নিয়ে এসো।
পরদিন শ্রাবনী সেই সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে রুবাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে আছে রুবাসা।এক অদ্ভূত আনন্দের দৃষ্টি ওর চোখে মুখে।
রুবাসার আম্মু সুন্দর আরেকটি সোয়েটার এনে রুবাসার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল__
দেখো, শ্রাবনী শীতের পোশাক পরে আছে।আসো তোমাকে ও পরিয়ে দেই।
আজ রুবাসা সোয়েটার গায়ে দিয়েছে।
রুবাসার আম্মু চোখ মুছতে মুছতে দুজনাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল।
শাহনাজ বুলবুল
January 4.2020