প্রণয় স্রোতে পর্ব-০১

0
1833

#প্রণয় স্রোতে
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)

“আমার ভাই এর জীবনটা ন’ষ্ট করার জন্য এই বিয়েতে তুমি রাজি হয়েছিলে তাই তো মিস.বহ্নি।ওহ সরি মিসেস বহ্নি।”

সদ্য বিয়ে করা বউকে গাড়িতে বসিয়ে কথাটা বলে উঠল আরাব।

আজ একটু আগেই আজাদ ভিলাতে দুটো বিয়ের কা’র্য’ক্র’ম স’ম্পূ’র্ণ হয়েছে।হাসিখুশি দুই পরিবার নিজেদের মধ্যে আ’ত্মী’য়’তা’র ব’ন্ধ’ন সৃ’ষ্টি করেছে।বিয়ে শেষে নিজের বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করলো দুই নব দ’ম্প’তি আর তাদের পরিবার।তবে চলতি গাড়িতে নিজের সদ্য বিয়ে করা বউয়ের উ’দ্দে’শ্যে কথাটা বলে উঠল আরাব।
বহ্নি নির্বিকার।দৃ’ষ্টি তার জানালার দিকে স্থির।আকাশটা নিকাশ কালোতে নিমজ্জিত না হলে ও জ্যোতিতে ভরপুর ও নয়।গুমোট মেঘে পরিপূর্ণ। আর সেই আকাশকেই এক মনে প’র্য’বে’ক্ষ’ণ করে চলছে বহ্নি।বহ্নি এর কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে পুনরায় একই প্রশ্ন করে উঠল আরাব।এবার আরাবের দিকে চাইলো বহ্নি। শান্ত তার দৃ’ষ্টি। আরাবের দিকে চেয়েই বহ্নি উল্টো প্রশ্ন করে উঠল,

“তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে যে আমি তোমার ভাই এর ক্ষতি করব?”

বহ্নি এর প্রশ্ন শুনে দমে গেল আরাব।খোঁচা টা যে ঠিক জায়গায় লেগেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না বহ্নির। মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আবার ও আকাশ দেখাতে ব্য’স্ত হয়ে গেল বহ্নি। তবে দৃষ্টি আাকাশের দিকে আছে মানেই যে মনটা ও আকাশের কাছে এটা ভাবা ভুল। বহ্নি তো হিসাব কষতে ব্যাস্ত গত ৩৭ দিনের হিসাব।যেটা বহ্নি কে ভেঙে চূরে পাথরে পরিণত করেছে অথবা সৃষ্টি করেছে একটা কু’ৎ’সি’ত মনের।

এখান থেকে ঠিক ৩৭ দিন আগে চৌধুরি বাড়ির বড় ছেলে ইয়ারাব চৌধুরির জন্য পাত্রী দেখতে আসা হয় আজাদ ভিলাতে।নারায়ণগ’ঞ্জ এর জমিদার বংশের ছেলে।আবার ঢাকাতে বড় ব্যাবসা আছে এটা শুনে আর না করেন নি তোহান আজাদ।বহ্নি কে দেখতে আসে ইয়ারাব এর ফুফি উ’জ্জ’য়ী’নি চৌধুরি আর ভাই আরাব চৌধুরি। জানা যায়,কয়েকদিন আগেই নাকি ইয়ারাব বহ্নি কে রাস্তায় দেখেছে আর পছন্দ হয়েছে। নিজের মায়ের সমান ফুফির কাছে নি’র্ধি’দ্বা’য় সেটা জানায় ইয়ারাব। আর তার ফুফি ও সময় নষ্ট না করে ইয়ারাব এর জন্য বহ্নি কে দেখতে চলে আসে।

এক মাসের মাথাতে এনগেজ’মে’ন্ট হওয়ার প্র’তি’শ্রু’তি দিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেয় আরাবের পরিবার।তবে যাওয়ার আগে বহ্নি এর হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়ে যায় আরাব।যেখানে ইয়ারাব এর ফোন নম্বর ছিল।

বড় বোনের বিয়েতে তানভি ও আবেগে আ’প্লু’ত।সব কিছুই ভালে ভাবে ঘটছিল।উজ্জয়ীনি চৌধুরী কথামতে এক মাসের মাথায় এনগেজমে’ন্ট এর জন্য ও আসেন।তবে সবটা ওলট পালট হয়ে যায় যখন ইয়ারাব বহ্নি কে দেখে বলে ওঠে তার পছন্দ হওয়া মেয়েটি বহ্নি নয়।সে তানভি।

সকলের তখন হতভম্ব হয়ে যায় ইয়ারাব এর কথায়।কত বড় একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সেটা সকলেই বুঝতে পারে।

ইয়ারাব রাস্তায় এক পলক তানভিকে দেখে।না জানে তার নাম,না পরিচয়।তবে খোঁ’জ নিয়ে জানতে পারে তানভি তোহান আজাদ এর মেয়ে।ব্যস ইয়ারাব তার ফুফিকে জানায়।তোহান আজাদ এর বড় মেয়ে বহ্নি। তাই বিয়ের প্রস্তাব আসাতে সে অবশ্যই বহ্নি কে উজ্জয়ীনি চৌধুরি এর সামনে উ’প’স্থি’ত করেন।কারণ এটাই স্বাভাবিক। তবে এনগেজমেন্ট এর দিন এমন অ’প্র’ত্যা’শি’ত কিছু ঘটবে সেটা আশা ছিল না কারোর।

বহ্নি এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল সেদিন।আর ভেবে চলেছিল বিগত এক মাস ইয়ারাব এর সাথে কাটানো মু’হূ’র্ত।না! তারা দেখা করেনি! তবে ইয়ারাব প্রতি নিয়ত বহ্নি কে ফোন করত।নানা রকম স্ব’প্ন সাজাতো দুজন।বহ্নি এর শু’স্ক হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরেছিল ইয়ারাব এর প্রণয় বাণীগুলো।কিন্তু এখন সে সবই যেন মরিচিকা।

উজ্জয়ীনি চৌধুরি আর তোহান আজাদ মিলে সেদিন ভেবে কূল কিনারা করতে পারছিলেন না কি করবেন! উজ্জয়ীনি চৌধুরির পক্ষে সম্ভব ছিল না ইয়ারাব এর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বহ্নি এর সাথে বিয়ে দেওয়া।আর না তোহান আজাদ এর পক্ষে সম্ভব ছিল বড় মেয়ের স্ব’প্ন’গু’লো’কে গলা টিপে মেরে তার হবু বরের সাথে তার ছোট বোন তানভির বিয়ে দেওয়া।ইয়ারাব ও অনুতপ্ত হয় বিগত দিনগুলো নিয়ে। যে মেয়েটাকে ক’ল্প’না করে হাজার স্বপ্ন সাজিয়েছিল ইয়ারাব। বাস্তবে সেখানে ছিল তার বড় বোন।

যখন দিশেহারা পড়ে সবাই তখনই উজ্জয়ীনি চৌধুরি এক অন্য রকম সিদ্ধান্ত নেন। ইয়ারাব এর সাথে তানভি আর আরাব এর সাথে বহ্নি এর বিয়ের প্রস্তাব দেন তোহান আজাদের কাছে। তোহান আজাদ ও সবটা ভেবে দেখেন।এই মূহুর্তে এটাই সবচেয়ে ভালো পরামর্শ তাই তিনি ও আর দ্বি’ম’ত করেন না।আংটি বদলের মাধ্যমে সেদিন আরাবের অ’র্ধ অধিকার হয়ে যায় বহ্নি আর তানভি ইয়ারাব এর।

সেদিন সব মিটে যাওয়ার পর তোহান আজাদ বহ্নি জিজ্ঞেস করেন, সে কি কোনো ভুল করল এভাবে আরাবের সাথে বহ্নি এর এনগেজমেন্ট আর বিয়েতে রাজি হয়ে? কিন্তু বহ্নি সেদিন তার বাবাকে কিছুই বলে নি।সে মেনে নিয়েছে সবটা! এছাড়া তানভি ও বহ্নি এর কাছে জিজ্ঞেস করেছিল সে ইয়ারাব কে বিয়ে করবে কিনা!

সেদিন বড্ড হাসি পেয়েছিল বহ্নির।তবে সবাইকে সবদিক থেকে আস্বস্ত করেছিল।কারণ সবটা সবাই জেনে ও ওর ওপর কি সুন্দর চাপিয়ে দিল।বহ্নি জানে সে বিয়েতে রাজি না হলে ইয়ারাব আর আরাবের পরিবার ফিরে যাবে। তানভি এতে কিছু যায় আসবে না কিন্তু বহ্নি!সে তো এই কয়দিনে নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করেছিল যেখানে শুধু প্রেমের ফুল ছিল অথচ ইয়ারাব কি সুন্দর ভুল বোঝাবুঝির দোহায় দিয়ে তার সদ্য গড়ে ওঠা ফুলের বাগানটাকে পিসে চলে গেল।এর শা’স্তি তো তাকে পেতে হবে!আর তার জন্য যদি তাকে আরাবকে বিয়ে ও করতে হয় তবে সে রাজি।

সকল রীতিনীতি শেষে বাড়ির দুই বউকে পাঠানো হলো বাসর ঘরে।তানভি এক রাশ ভয় আর ভালোলাগার সংমিশ্রণে বসে আছে ইয়ারাব এর ঘরে। চারিদিকে ফুলে ফুলে সজ্জিত। মেঝের এক কোনো কিছু মোমবাতি ও আছে। মোমবাতির দিকে তাকাতেই যেন লজ্জারা এসে ভীড় করল তানভি এর হৃদয় কোণে। হুট করে যে এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে সেটা ভাবেনি তানভি।এই তো এক স’প্তা’হ আগে ও বড় বোনের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। বিয়েতে এটা হবে, ওটা হবে বলে কত আনন্দ ছিল। জিজু এটা করবে ওটা করবে বলে বহ্নি কে কয়েকবার ল’জ্জা ও দিয়েছে সে।অথচ সেই মানুষটার বউ হয়ে আজ তার ঘরে বসে আছে তানভি। মানুষটা তাকে পছন্দ করে,ভালোবেসে এই বিয়েটা করেছে এটা ভাবতেই যেন আরো বেশি ল’জ্জা লাগতে লাগল তানভি এর।

কিছুক্ষণ পরেই সেই ল’জ্জা’য় রাঙা হয়ে ওঠা মানবির স্বা’মী নামক মানুষটির আগমন ঘটল ঘরে। শুভ্র রঙের শেরওয়ানিতে এক অন্য রকম মাধুর্য চোখে বিধছে তানভি এর।লজ্জা আর অ’স্ব’স্তি’তে মানুষটির দিকে একবার ও তাকায়নি তানভি।কিন্তু তার স্বামী নামক ব্যাক্তিটি যে এতটা সুন্দর সেটা আগে জানলে সারাদিন ড্যাবড্যব করে তাকিয়ে থাকত তানভি। নিজের ভাবনাতে অবাক হলো তানভি।এসব কি ভাবছে সে!

ইয়ারাব নিশ্বব্দে এগিয়ে এলো।ইয়ারাব এগিয়ে আসতেই আরো জড়োসড়ো হয়ে বসল তানভি।হৃ’দ’পি’ণ্ড অ’স্বা’ভাবিক হারে ছুটছে।তানভিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ইয়ারাব বলে উঠল, চলো আগে নামাজটা পড়ে নেই তানভি ও দ্বি’রু’ক্তি করল না দুজনেই নামাজ পড়ে নিলো।ইয়ারাব একেবারে ফ্রেশ হয়ে নামাজে বসেছিল তবে তানভি তখনও বিয়ের সাজে থাকায় নামাজ শেষে তাকে ও ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল ইয়ারাব।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে দূর আকাশে তাকিয়ে আছে ইয়ারাব। তার থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে তানভি।

“আ’ম সরি তানভি।”

হঠাৎ ইয়ারাব এর কন্ঠে সরি শুনে অবাক হলো তানভি।ঠিক কি জন্য সরি বলল ইয়ারাব সেটা বুঝতে পারলো না।তখন ইয়ারাব তানভি এর দিকে ফিরে বলে উঠল,

“তুমি ভেবে তোমার বোনের সাথে এক মাস সময় কাটানোর জন্য সরি।জানো, এই এক মাস আমি বহ্নি এর সাথে অনেক গ’ল্প করেছি।মাঝে মাঝে ল’জ্জা ও দিয়েছি ওকে! তবে কখনোই সীমা ল’ঙ্ঘ’ন করে কথা বলিনি।তবু ও আমি দুঃখিত!”

ইয়ারাব এর কথা শুনে ভালে লাগল তানভি এর।সে ও জানে সবটা মি’স’আ’ন্ড্রা’স’ট্যা’নিং ছিল তারপর ও ইয়ারাব তাকে সবটা বুঝিয়ে বলার চে’ষ্টা করছে এটা ভেবেই অদ্ভুত ভালো লাগা গ্রাস করল তানভি কে।

“আপনি যেটা করেছেন সেটা একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ওসব ভেবে আর কষ্ট পাবেন না।আপু নিজেকে সামলে নিয়েছে!”

মাটির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে উঠল তানভি।কেন যেন তাকাতে পারলো না ইয়ারাব এর দিকে। ইয়ারাব তানভির হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো।ইয়ারাব এর বাহুতে নিজের বাহুর স্পর্শ যেন বিদ্যুৎ এর ন্যায় লাগলো তানভি এর।ইয়ারাব তানভিকে নিজের পাশে দাড় করিয়ে তানভি এর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল,

“আজ সারারাত গ’ল্প করব আমরা।”

আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো তানভি এর।নিজেকে বড্ড সুখী মনে হলো।কিন্তু তার অবচেতন মন জানতে ও পারল না।দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে কেউ।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে