পূর্ব-রোদ পর্ব-৩০

0
2034

@পূর্ব-রোদ?
#পর্ব_৩০
#লেখিকা_আমিশা_নূর

আজ কোনো প্রথম মেয়েকে নিলয় টাচ করেনি।তবুও নাবিলা যেনো অন্য রকম।মাতাল করা মতো ঘ্রাণ নিলয়ের নাকে বেঁধে গেলো।কালো শাড়ি’টা নাবিলা’র সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করেছে। নাবিলা মুখে তাকা তীল চিহ্ন যেনো নাবিলা’র সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা!খুব কষ্ট হয় নিলয়ের যখন মনে পরে নাবিলা অন্যকারো হয়ে যাবে।কিন্তু নিয়তির খেলা তো কেউ আটকাতে পারে না।

নাবিলার নিজের মধ্যে হুস আসায় তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো।আমতাআমতা করে নিলয় বললো টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বললো,”বসো।’
“এসব কী?”
“কিছুই না।ক্যান্ডেল লাইট ডিনার উইথ ইউ।”

নাবিলা’র স্নায়ু উত্তেজিত হলো।এত্তোক্ষনে নাবিলা এটুকু বুঝলো যে নিলয় তার সাথে শুধুমাত্র টাইম স্পেন্ড করার জন্য ডেকেছে।নাহলে এতোকিছুর আয়োজন করতো না।নাবিলা নিলয়’কে কোনো প্রশ্ন করলো না বরং চেয়ারে গিয়ে বসলো।


“পূর্ব দরজা খুলো।দেখো আমি আর কোনোদিন মেঘের সাথে কথা বলবো না।পূর্ব…”

এখন প্রায় রাত বারোটা।পূর্বের দরজা খুলার কোনো নামই নেই।রোদ অনেকবার ডেকে গেছে কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হয়েছে।রোদ মনে মনে কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছে যে পূর্বের কাছ থেকে কোনোদিন কিছু লুকাবে না।ডাকতে ডাকতে রোদ একসময় দরজার কাছেই বসে পড়লো।

পূর্বের খুব রাগ হচ্ছে রোদের উপর।মেঘের সাথে কথা বলছিলো আর সেটা লুকালো?রোদ যে এতোক্ষণ ধরে ডাকছিলো তা পূর্ব শুনছিলো কিন্তু কোনো সাড়া দে নি ইচ্ছে করে।কিন্তু পাঁচ মিনিট হয়ে গেলো রোদের কোনো আওয়াজ আসছে না।পূর্ব একবার ভাবলো ঘুমিয়ে পড়বে।পরক্ষণে আবার রোদের কথা মাথায় আসায় সব রাগ সাইড করে দরজা খুললো অমনি রোদের কান্না-কান্না চেহেরা দেখা গেলো।পূর্ব কিছু বলতে যাবে তার আগেই রোদ বলে উঠলো,”পূর্ব আ’ম সরি।আর কোনোদিন এমনটা করবো না।মেঘের সাথে আমার কী কথা….”
“শুনতে চাইনা আমি কী কথা হয়েছে।”

সূর্য মোহাম্মদের বলা কথা অনুযায়ী রোদ পূর্বের সামনে ঠোঁট উল্টিয়ে কান্না করে দিলো।অমনি পূর্বের সব রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।হাত ধরে রোদকে রুমে এনে দরজা বন্ধ করে দিলো।তারপর বার বার অনুরোধ করলো কান্না থামাতে কিন্তু রোদের কান্না থামানোর কোনো নামই নেই।শেষমেশ পূর্ব বললো,

“মেঘের সাথে কী কথা হয়েছে বলো..”

রোদ যেনো এই একটি কথা অপেক্ষা করছিলো।অমনি গদগদ করে মেঘের সাথে কী কী কথা হয় সবটা বলে।সবশুনার পর পূর্ব বলে,

“তুমি আমাকে রাতে বলে দিলেই পারতে…”
“তুমি রাগারাগি করবে তাই আমি রাতে বলিনি।ভেবেছিলাম মেঘ আসলে সবটা বলবো।”
“মেঘের সমস্যা’টা কী বুঝলাম না।আমরা সুখে সংসার করছি এইটা ওর সহ্য হচ্ছে না?”
“পূর্ব,মেঘ নাহয় পরশু এসে দেখে যাক।”
“কিন্তু পরশু কী স্পেশাল কিছু?”

পূর্বের কাছ থেকে রোদ ম্যারেঞ্জ ডেইটের বিষয়টা লুকিয়ে রাখলো।পূর্বের কথায় রোদ বললো,”সামথিং স্পেশাল!”
“আমাকে বলো।”
“নাহ।সারপ্রাইজ!”


আজ পূর্ণিমা!চাঁদ চারিদিকে নিজের সম্পূর্ণ আলো বিলিয়ে দিচ্ছে।নাবিলা দোলনায় ভাবান্তর হয়ে বসে আছে।রাত এখন ১টা!নিলয় তার সামনে চাঁদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।নাবিলা তার থেকে কিছু শুনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে নিলয় বলতে শুরু করলো,

“জীবনে প্রথম প্রেম করেছিলা রুমি নামের মেয়ের সাথে।প্রপোজটা আমি নিজে করেছিলাম।প্রথম আবেগময় অনুভূতি’র সৃষ্টি হয় ইন্টারের রুমিকে নিয়ে।আমাদের দুজনের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় ছয়মাসের মধ্যে ব্রেকআপ হয়ে যায়।তার তিনমাস পর আবার প্রেম করলাম তবে সেটা রুমি’র সাথে পাল্লা দেওয়ায়।রুমি রিলেশনে যায় তখন আমিও তাকে দেখিয়ে প্রেম করতাম।এরপর কলেজে আরো ক’জনকে ভালো লেগেছে জানিনা।হঠাৎ একদিন জানতে পারি মায়ের ক্যান্সার।তখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না।কিন্তু যেভাবে হোক মা’কে সুস্থ করতে হতো।তখন মেঘ আমাকে বুদ্ধি দে আমার গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে টাকা নিতে।আমার হাতে আর কোনো অপশনও ছিলো না।তাই আমি গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে টাকা ধার নিই।মায়ের চিকিৎসা’র জন্য শুধু অল্প টাকা না আরো বেশি প্রয়োজন ছিলো।তারপর তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়।তোমার আইডি’র নাম ছিলো “নী রা”।ভেবেছিলাম তুমি বড় লোকের মেয়ে তাই টাকা উসুল করা সহজ হবে।আমার এসব কর্মে কেউ বাঁধা দেইনি।বরং মেঘ উৎসাহ দিতো।শেষে তুমি যখন বললে আমেরিকা থেকে চলে আসবে তখন রাগ হয়েছিলো।তিন তিনটে বছর তোমার পেছনে নষ্ট করলাম অথচ কোনো লাভই নেই?শেষমেশ মাকে ইন্ডিয়া নিয়ে সেখানকার চিকিৎসা চালানো হয়।আর দেখতে দেখতে ইন্ডিয়া’তে বাড়ি তৈরি করে ফেলি।সব টাকা দিয়েছিলো আমাকে অনন্য নামের একটি মেয়ে।ওর সাথে প্রেমের সম্পর্কটা শেষ করে অনন্য নিজে।তারপর ছয়মাস আমি একা ছিলাম।বিডি’তে এসে তোমার সাথে দেখা।কখনো ভাবিনি কারো জন্য নিজে এতোটা পাগলামো করবো।কিন্তু নাবিলা তোমার সাথে যে এটাই আমার শেষ দেখা।”

নিলয় পেছন ঘুরে দেখলো নাবিলা আরামে দোলনায় ঘুমাচ্ছে।নাবিলা’র ঘুমন্ত চেহেরা দেখে নিলয় আরো গলে গেলো।চুপি চুপি সে নিজের রুম থেকে ছাদর এনে নাবিলা’র গায়ের উপর টেনে দিলো।তারপর সামনের চেয়ারে বসে এক ধ্যানে নাবিলা’র দিকে তাকিয়ে রইলো।এই দেখা যেনো কোনোদিন শেষ হওয়ার নই!


পূর্বের ঘুম ভাঙ্গতে দেখলো রোদ তার বাহু দুহাতে ধরে রেখেছে।পূর্ব এগিয়ে রোদের কপালে চুমু দিলো।এই মেয়েটাকে ছাড়া পূর্বের এক মুহূর্তেও কাটে না।কানাডা গিয়ে কীভাবে থাকবে সে বুঝতে পারছে না।রোদ যখন জানতে পারবে পূর্ব কানাডা গেছে তখনই বা কী করবে?আবারো ভূল বুঝবে না তো?পূর্ব মনে মনে ঠিক করে নিলো রোদকে সবকিছু পরশু জানিয়ে দিবে।


সূর্যের কড়া রশ্মি একদম চোখ বরাবর এসে পড়তেই নাবিলা চোখ কুচকে নিলো।গায়ে থাকা ছাদর টেনে মুখ ঢেকে দিলো।পরক্ষণে নাবিলা’র কাল রাতের কথা মাথায় আসায় ঘুম ছেড়ে উঠে বসলো।এখনো সে দোলনায় আছে।নাবিলা চারপাশে চোখ বুলালো।সবকিছু কাল রাতের মতো আছে।নাবিলা’র মনে প্রশ্ন জাগলো নিলয় কোথায়?আশে পাশে থাকিয়ে মোবাইল খুঁজলো তখন মাথায় আসলো মোবাইল কাল রাতে নিলয়ের রুমে রেখেছিলো।নাবিলা দোলনা ছেড়ে নিচে গেলো।তার চোখ জোড়া নিলয়কে খুজছিলো।নাবিলা নিলয়ের রুমে গিয়ে দেখলো তার মোবাইল টেবিলে রাখা৷নাবিলা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো মেবাইলের নিচে সাদা কাগজ রাখা।নাবিলা কাগজটি তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলো,

“শুভ সকাল পাখি!
আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার সাথে এক রাত কাটাতে।আর দেখো কাল রাত’টা কাটিয়ে দিলে।রাত কাটানো মানে শারীরিক সম্পর্ক নই শুধু আড্ডা দেওয়া,একসাথে রাত পার করা কেও রাত কাটানো বলে।অনেক ধন্যবাদ তোমাকে একটা রাত আমাকে দেওয়ার জন্য!বাড়িতে আমি নেই তাই খোঁজে পাবে না।নাস্তা রাখা আছে টেবিলে।খেয়ে নিও!”

চিরকুট’টা পড়ে নাবিলার অনুভূতি’টা কেমন হলো সে জানে না।শাড়ি পাল্টিয়ে নাবিলা নিজের ড্রেস পড়ে নিলো।সাথে ব্যাগে করে আনা মরিচ গুঁড়া,দুটো ছোট কাটি আছে কি’না চেক করলো।রাতে যদি নিলয় উল্টা পাল্টা কিছু সত্যি করতো তাহলে মার্ডার করেই যেতো।অবশ্য সেই চিন্তা ভাবনা করেই নাবিলা এসেছিলো।কারণ আর যাই হোক নাবিলার মতো কঠিন মেয়ে অতো সহজে হার মেনে নিবে না।রুম থেকে বেরিয়ে নাবিলা নিলয়ের রাখা নাস্তার দিকে তাকায়নি।সে সোজা বাইক নিয়ে বেরিয়ে এলো।


“আম্মি তোমরা কোথায় যাচ্ছো?”
“একটু ছোট’র কাছে যাচ্ছি আমি।কাল চলে আসবো।”
“বাবাই যাবে?”
“হুম।”
“আচ্ছা।”
“পূর্ব কোথায়?”
“রুমে আছে।”
“আমি ডাকছি বল।”

চাঁদনি মোহাম্মদের আদেশ পেয়ে রোদ তাদের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে গেলো।রোদ বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ঘুরতে কেনো যাচ্ছেন।তবু এতে রোদের ভালোই হচ্ছে।এলোমেলো হেটে রোদ রুমে এসে পূর্বকে খবরটা জানালো।দুজনে বের হয়ে চাঁদনি মোহাম্মদ এবং সূর্য মোহাম্মদ’কে বিদায় জানালো।

রুমে এসে পূর্বের আড়ালে রোদ রাফিয়াকে কল করলো,

“রাফিয়া তোকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।”
“কী কাজ?”
“তিহান ভাইয়া’কে ফোন করে বলবি পূর্বকে রাত বারোটা অবধি বাইরে রাখতে।”
“ক্যান ক্যান?”
“তুই আমার কাছে চলে আয় তোকে সবটা জানাবো।”
“কখন যাবো?”
“এক ঘন্টা বাদে আসলে হবে।আর শুন তোকে কিছু জিনিস বলছি।আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসিস।”
“ওকে।”

কী কী আনতে হবে তার লিস্ট রোদ রাফিয়া’কে মেসেজ করে দিলো।এখন রোদের অর্ধেক কাজ রাফিয়া করে দিবে।বাকি কাজটা রাফিয়া আসলে করবে।এখন নাবিলা’কে ফোন করে জানাতে হবে।


নাবিলা ঢাকায় যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে রুম থেকে বেরুতে যাবে তখন দেখলো মেঘ নিজের রুমে র‍্যাডি হচ্ছে।নাবিলা ভ্রু-কুচকে মেঘের রুমে ঢুকলো।পূর্ব নাবিলাকে ফোন করে মেঘের কথা সবটা জানিয়েছে।তাই নাবিলা সোজাসাপ্টা বললো,

“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“নাবু তুই?ঢাকা যাচ্ছিলাম। কেনো?”
“ভাই তুই পাগল হয়ে গেছিস?তোর মাথায় আছে তুই কী করছিস?”
“বুঝলাম না তোর কথা আমি।”

মেঘ নাবিলা’র কথায় কোনো ভাবান্তর দেখাচ্ছে না।সে নিজের মতো আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছে।নাবিলা কঠিন কন্ঠে বললো,”এই দিকে তাকা তুই।”,

নাবিলা’র কঠোর আদেশ শুনে মেঘ তার দিকে ঘুরে তাকালো।এতোদিনে তাদের সম্পর্ক আসল ভাই-বোনের মতো হয়েছে।আর মেঘ যেনো নাবিলা’র কথাই বাধ্য।

শীতল কন্ঠে নাবিলা বললো,”তুই সত্যি রোদকে ভালোবাসিস?”
“হ্যা।”
“না তুই ভালোবাসিস না।তুই যদি রোদকে ভালোবাসতি তাহলে রোদের খুশিতে আগুনে ঘি ঢালার মতো হতো না।”
“তুই জানিস আমি কোথায় যাচ্ছি?”
“হুম জানি।ভাই তুই যেটা করছিস সেটা সম্পূর্ণ ভূল।পূর্ব-রোদ দুজন দুজনকে যথেষ্ট ভালোবাসে।এন্ড দে আর সো হ্যাপি।মাঝখান থেকে তুই যদি রোদকে উল্টা পাল্টা কন্ডিশন দিস তাহলে ওদের মধ্যে ঝামেলা হবে।আর ঝামেলা হওয়া মানে এমনটা নয় যে রোদ তোর কাছে আসবে।রোদ শুধুমাত্র পূর্বকে ভালোবাসে।তোকে কিন্তু একবিন্দুও পছন্দ করে না।নিজেকে ছোট কেনো করছিস?কতো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলবি তোরা?তোদের নিয়ে মানুষ কী ভাবছে সেটা একবারও মাথায় আনিস না?”

নাবিলা’র প্রত্যেকটা কথা মেঘ মন দিয়ে শুনছিলো।কিন্তু শেষে ‘তোরা’ শব্দটা শুনে মেঘ হকচকিয়ে উঠলো।মেঘের সাথে নাবিলা আর কাকে সম্মোধন করছে?

“মেঘ তুই রোদের থেকে অনেক বেটার মেয়ে পাবি।”

“হ্যা।রোদের থেকেও ভালো মেয়ে পাবি যে আমার ছেলেকে ভালোবাসবে।”পেছন থেকে নিনা হাসানের কন্ঠস্বর আসায় নাবিলা-মেঘ দুজনে পেছন ফিরে তাকালো।নিনা হাসানের কথা মেঘ কিঞ্চিৎ অবাক হলো।তার মা তাকে রোদের থেকে দূরে আসতে বললে এইটা সে এক্সপেক্ট করেনি।


[চলবে]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে