নীলপদ্ম ১১তম পর্ব

0
1529

#নীলপদ্ম
#১১তম_পর্ব

হঠাৎ টুং করে মোবাইলটা বেজে উঠে হৃদয়ের। ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে মোবাইলের লক খুললে দেখে একটা আননোন ইমেইল এড্রেস থেকে একটা মেইল এসেছে। মেইলটা ওপেন করতেই দেখে একটি নোট এবং একটি ভয়েস রেকর্ড ফাইল পাঠানো হয়েছে। নোটটি এমন,
“ নিজের প্রেয়সীর আসল রুপ চিনতে এই ভয়েস মেইলটি ওপেন করুন”

ফাইলটা অন করে এমন কিছু শুনতে পায় যার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না হৃদয়। হৃদয় থ মেরে বেশ কিছুক্ষণ বসে আছে। নিজের কানকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে হাতমুষ্টিবদ্ধ করে রাগ সংবরণের চেষ্টা করলো সে। কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হলো না। চোখজোড়া রক্তবর্ণ ধারণ করেছে সব ভেংগেগুড়িয়ে দিতে মন চাচ্ছে। মেইল এড্রেসটি ট্রেস করার চেষ্টা করলেও তেমন একটি লাভ হয় না। অবশেষে নিজেকে কোনো মতে শান্ত করে পুনরায় একই এড্রেস এ একটি মেইল লিখে সে,
“ এই ভয়েস রেকর্ডের অর্থ কি? এই মেইলটা আমাকে পাঠিয়ে আপনার কি লাভ? কে আপনি? প্রেয়সীকে আপনি কিভাবে চিনেন?”

মেইলটা সেন্ড হবার দু মিনিট পর ই পুনরায় একটি রিপ্লাই আসে সেটা ঠিক এরকম,
“ আম খাওয়া নিয়ে আপনার মতলব, গাছ কেনো গুনছেন? আমি কে সেটা জানার কোনো প্রয়োজনীয়তা আমি দেখছি না। তবে হ্যা, প্রেয়সীকে একবার হারিয়ে ফেললে তাকে যে আবার ফিরে পাবেন সেই গ্যারান্টি কিন্তু নেই। সুতরাং আমি আপনার গন্তব্যের পথটুকু এঁকে দিলাম। বাকিটুকু নিজেই বের করে নেবার বুদ্ধি আপনার আছে বলে আমার ধারণা। আল্লাহ হাফেজ।“

রিপ্লাইটুকু পড়ে নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছে না হৃদয়। কে এই ব্যাক্তি? আর ভয়েস মেইলটিতে যা শুনলো তা যদি সত্যি হয় তবে প্রেয়সীকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে সে। নিজের ভালোবাসা নিয়ে এতো বড়াই করে কি লাভটি হলো। অজান্তেই চোখের কোনে পানি জমতে লাগলো হৃদয়ের। শরীরটা আর চলছে না। আড়াই বছর আগের হৃদয়ে ফিরে যেতে পারলে হয়তো ঢের ভালো হতো। অন্তত পক্ষে চোখের অন্ধত্বের শিকার হতো এখন তো চোখ থেকেও অন্ধত্বকে বরণ করতে হচ্ছে___

সকাল ১১টা,
ফাইলগুলো চেক করে যাচ্ছে দিশা, আজ সন্ধ্যার ট্রেনে চিটাগাং যেতে হবে প্রজেক্টের জন্য। হয়তো দিন পাচেক থাকতে হতে পারে। ভালোই হলো একদিক থেকে। হৃদয়কে নিজ চোখে অন্যের হতে দেখতে হবে না হয়তো, এবং মনটা ও হৃদয়ের চিন্তার থেকে দূরে থাকবে। এসব চিন্তাই করছিল হঠাৎ রাসেল এসে জানালো,
– দিশা, আপনাকে স্যার কেবিনে কল করেছেন

দিশার বুকে কোথাও যেনো একটা হাহাকার শুরু হয়। বারংবার হৃদয়ের কাজ থেকে পালিয়ে যাবার কথা চিন্তা করলেও কেনো যেনো পরিস্থিতি সেটা হতে দিচ্ছে না। ছোট একটা নি;শ্বাস ছেড়ে হৃদয়ের কেবিনের দিকে রওনা দেয় সে। নক করতেই হৃদয় রিপ্লাই দেয়,
– কাম ইন

রুমে ঢুকতেই বুকটা টিপ টিপ করে উঠে দিশার। একটা নীল রঙের শার্ট পড়ে রয়েছে হৃদয়। হাতা গুলো কনুই অবধি ফোল্ড করা। সিল্কি চুলগুলো ফর্সা কপালে পড়ে রয়েছে। এক দৃষ্টিতে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। এতদিন জংলির মতো দাঁড়ি রাখলেও আজ যেন ক্লিন সেভে অন্যরকম লাগছে তাকে। দিশা চাইলেও নজর সরাতে পারছে না। পুরুষও বুঝি এতোটা সুন্দর হয়। কোনো হিরোর চেয়ে কম লাগছে না তার সামনে থাকা পুরুষটিকে। খেয়াল করে দেখলো হৃদয়ের পরণের শার্টটি তার ই কেনা। দু বছর আগের শার্ট দেখলে কেউ বলবেই না এটাকে অযত্ন করা হয়েছে।
– এভাবে হা করে কি দেখছেন? আমার মাথায় কি দুটো শিং গজিয়েছে?

হৃদয়ের বাকা হাসি মিশ্রিত কথা শুনতেই ঘোর কাটে দিশার। কি করছিলো সে? এভাবে দাগর দাগর করে কোনো মেয়ে যদি কোনো পুরুষকে দেখে তবে ব্যাপার হয়তো ব্যাঙ্গ করার উপযোগী একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবে আজ হৃদয়কে ঠিক তেমন লাগছে যেমনটা দিশার পছন্দ ছিলো। ঠিক এভাবেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতো সে হৃদয়কে। আজ অন্য রকম লাগছে হৃদয়কে, যেনো এতোদিনের অপেক্ষা, ক্লান্তির অবসান ঘটেছে। বিয়ের আনন্দের জন্য হয়তো এই রুপ তার। হতেই পারে। আজ বাদে কাল বিয়ে তার। নিজের উপর বড্ড বেশি অভিমান হচ্ছে, এই মানুষটা তো তার একান্ত ছিলো। কিন্তু সে অন্য কারোর, তার উপর কোনো রকম অধিকার নেই দিশার। নিজেকে সামলে ভাংগা কন্ঠে বললো,
– স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?
– জ্বী, আমাদের আজ দুপুরে চিটাগাং যেতে হবে
– আমাদের?
– হ্যা, রাসেল তোমাকে জানায় নি?
– রাসেল ভাই জানিয়েছেন, কিন্তু সেটা তো কেবল আমার যাবার কথা তাই নয় কি?
– প্লান চেঞ্জ হয়েছে, আমিও যাবো।
– আপনার তো শুক্রবার বিয়ে
– যার বিয়ে তার খোজ নেই, পাড়াপরসির ঘুম নেই টাইপ ব্যাপারটা হয়ে গেলো না।

হৃদয়ের ব্যাঙ্গাত্বক কথায় মেজাজ খারাপ লাগছে দিশার। কিন্তু এই লোকের সাথে কথা বলতে গেলে উলটা দু কথা শুনাবে। তাই চুপ করে থাকাটাই হয়তো শ্রেয়। দিশাকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে হৃদয় বাকা হেসে বলে,
– তোমার কাছে ২.৩০ ঘন্টা আছে। বাসায় যেয়ে প্যাকিং করে ফেলো। আমরা দেড়টায় রওনা দিবো। কাল সকালে আমাদের মিটিং আছে। পাঁচ দিন ওখানেই থাকতে হবে। সেভাবে জিনিসপত্র নিও। এখন ট্যুরিস্ট টাইম তাই আমাদের তাড়াতাড়ি সেখানে পৌছাতে হবে
– ………
– কথা কি বুঝেছো? নাকি কথা কানেই যাচ্ছে না?
– জ্বী বুঝেছি
– তাহলে এখন যেতে পারো তুমি।

দিশা আর কথা না বাড়িয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো। হৃদয় মিটিমিটি হাসছে। মাথায় তার খোরাফাতি বুদ্ধিরা দলা পাকাচ্ছে। এখন শুধু চিটাগাং এ পৌছাতে যতটুকু সময় লাগে____

রাত ৮টা,
কেবল চিটাগাং এ পৌছেছে দিশা এবং হৃদয়। ধুম বৃষ্টি, রাস্তায় জ্যাম। সব মিলিয়ে এতো সময় লেগে গেছে তাদের। বৃষ্টি যেনো থামার নাম নেই। অঝর ধারায় বৃষ্টি পরেই যাচ্ছে। বৃষ্টিতে গাড়িও ঠিকমত চলছে না। কোনো একটা কারণে গাড়ি জ্যাম হয়ে রয়েছে। এদিকে রাস্তায় নেমে গাড়ি ঠিক করতে যেয়ে ভিজে একাকার অবস্থা হৃদয়ের। একটা পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ড্রাইভারকে রেখে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রওনা দিতে হয় দিশা এবং হৃদয়কে ।কোনো মতে “ হোটেল আগ্রাবাদ” হোটেলের কাছে এসে পৌছেছে তারা। কাক ভেজা যাকে বলে সেই অবস্থা তাদের। এখন তাড়াতাড়ি জামা চেঞ্জ না করলে ঠান্ডা লেগে খারাপ অবস্থা হতে বেশি সময় লাগিবে না। হোটেলের রিসিপশনে যখন হৃদয় জিজ্ঞেস করলো,
– আমরা পাঁচদিনের বুকিং করেছিলাম, শেখ হৃদয় আহসান নামে।

রিসেপশনিস্ট কমপিউটার ঘেটে উত্তর দেয়,
– সরি স্যার এই নামে কোনো বুকিং নেই
– কিহ? আমার সেক্রেটারি করেছে বুকিং, প্লিজ চেক করুন
– নাহ স্যার নেই।
– আচ্ছা, তবে কি দুটো সিংগেল রুম দেয়া যাবে?
– লেট মি চেক স্যার।

মিনিট পাঁচেক পর রিসিপশনিস্ট বলে,
– স্যার আমরা আপনাকে কেবল একটি হানিমুন সুইট ই দিতে পারবো।

দিশা কথাটি শুনার সাথেই সাথেই হৃদয়কে বলে,
– স্যার, অন্য কোথাও চলুন। এক রুমে কিভাবে থাকবো আমরা?
– বাহিরের অবস্থা দেখেছো? কিভাবে যাবো? তার থেকে ভালো এখানেই এডজাস্ট করে নেই। প্লিজ, এমনেই ভিজে একাকার অবস্থা।

আর কি শেষমেশ একরুমেই উঠতে হলো তাদের। কেমন জানে অস্বস্তি লাগছে দিশার। এভাবে একরুমে থাকাটা তাকে আরো দূর্বল না করে দেয়। যত মানুষটার থেকে দূরে যেতে চাইছে মানুষটা তত তাকে নিজের সাথে পেঁচিয়ে ফেলছে। উফফফ। নিজের চুল নিজের টানতে ইচ্ছে করছে দিশার। কেনো যে এই কোম্পানিতে চাকরি করতে হলো তার। এসব চিন্তায় যখন মগ্ন সে…………

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে