নতুন জীবন পার্ট-১০

0
1108

নতুন জীবন
__________________
লেখিকা:বাবুনি
________________
(পার্ট:১০)

সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল তানছিয়ার। রাতে রাইফের জন্য ওয়েট করতে করতে, মিউজিক ভিডিও দেখে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে নিজেই জানে না। চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে একহাতে অন্য হাতে ফোনটা খুঁজছে। কিন্তু ফোন বালিশের পাশে নেই, একটু ভালো করে তাকাতেই দেখলো ফোন টা বিছানার শেষ প্রান্তে। হয়তো ঘুমের ঘোরে ফোন টা হাত থেকে পরে গেছে , আর পরে গড়াগড়ি করায় হয়তো পিছনে চলে গেছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো মাত্র ৫টা বাজে। নিজেই নিজেকে বলল,
– বাহ্ আমি তো খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠা শিখে গেছি। কিন্তু রাতে তো ঠিক মতো ঘুমাইনি, এতো তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গলো কেন _!

ইতিমধ্যে সুমাইয়া দরজায় নক করে বলল,
“- ভাবি তুমি কি ঘুম থেকে উঠে গেছো_!” নামাজ পড়ে নিচে আসো নাস্তা করবে ,রাতে ও তো কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে।
তানছিয়া বিছানায় থেকেই জবাব দিলো,
“- তুমি যাও আমি নামাজ পড়ে আসছি।”

তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমের দিকে রওনা দিল তানছিয়া। নামাজ পড়বে সে কিন্তু নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো সে।
-কিন্তু কেন _! আমি এসব কেন করছি_! নামাজ না পড়লেই কি হবে আর পড়লেই কি হবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আবার নিজের মনেই বলে উঠে।
– হ্যাঁ আমি নামাজ পড়বো আমার নিজের জন্য হলেও এটা খুব জরুরী। অন্যকারো জন্য নয় নিজেকে পরকালের জন্য তৈরি করতে হবে।
তানছিয়া ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করলো।
তারপর নাস্তার টেবিলে গিয়ে কোনো কথা না বলে চুপচাপ নাস্তা খেয়ে, নিজের রুমে চলে আসলো।
ওর খুব ইচ্ছে করছে কোরআন তেলাওয়াত করতে, বিছানায় বসে বসে ভাবছে তানছিয়া।
– কিন্তু আমি তো কোরআন তেলাওয়াত করতে জানি না। কি করবো এখন অতি আদরের কারণে, আসলেই আমি আধুনিক যুগের বাঁদর হয়ে গেছি। কি করবো এখন রাইফের কেনা ইসলামিক বই গুলো সময় কাটাতে পড়ে। এখন কেন যেনো নিজের মনে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। ইচ্ছে করছে ইসলামিক জীবন যাপন করতে। কেন এই বইয়ের কথা গুলো এখন মনে আসলো। কেন এরকম লাগছে আমার, ইচ্ছে করছে নিজেকে পাল্টে দিতে। উফ্ আমি পাগল হয়ে যাবো এরকম হতে থাকলে , কিন্তু এসবের ও তো প্রয়োজন আছে। মৃত্যু তো অনিবার্য সবার ক্ষেত্রেই, নিজেকে পরকালের জন্য প্রস্তুত রাখাও প্রয়োজন।যাতে পরে আফসোস করতে না হয় জান্নাতের জন্য।
কিন্তু এই বয়েসে এসে কে আমাকে আরবি পড়া শিখাবে_?
কথাটা মুখ থেকে বের হয়ে গেল একটু জোরে শব্দ নিয়ে।

“- রাইফ বলল কেন আমি শিখাবো সমস্যা আছে_!”
হঠাৎ করে রাইফের কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো তানছিয়া। ওর মুখ দিয়ে ওমনি বেরিয়ে আসে,
-” আপনি_!”
-” হুমমম আমি কেন অন্য কাউকে আশা করছিলে বুঝি_!”
-” আসলে ইয়ে মানে এরকম কিছু না। হঠাৎ করে এসেছেন তো দেখতে পাইনি তাই একটু।”
-” হুমমম বুঝতে পারছি। কিন্তু ম্যাডাম দরজা বন্ধ না করলে ,তো যে কেউ ঢুকতে পারে চুপিচুপি দেখবে কিভাবে_!”
-” আই এম সরি।”
-” কেন সরি কেন_?”
-” কালকে আপনার সাথে ঐরকম ব্যবহার করার জন্য।”
-” ইটস্ ওকে, এখন বলো তুমি সত্যি আরবি ভাষা শিখতে চাও_!”
-” হুমমম।”
-” ঠিক আছে, আমি তোমাকে শিখাবো সমস্যা নেই তো_!”
তানছিয়া কিছু একটা ভেবে বলল,
-” নাহ মোটেও না।”
-” ঠিক আছে কিন্তু তবে যে তোমাকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে রোজ। পারবে তো_!”
-” কেন সকাল উঠতে হবে কেন_!”
-” সকাল সকাল উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে আমার কাছে আরবি ভাষা শিখবে।কারণ ৯টা থেকে তো আমায় অফিসে যেতে হবে।আর রাতে তো ক্লান্ত থাকবো সো সকালেই শিখাবো।”
-” ওকে।”
-” হুমমম।”

রাইফ ওর আম্মুর রুমে আসলো কিছুক্ষণ পর। ওকে দেখে ওর আম্মু বলে উঠলেন,
-” কি রে চলে এসেছিস_! তর সাথে আমার কিছু কথা আছে কাছে এসে বস।”
রাইফ মায়ের কাছে গিয়ে বসে বলল,
-” হুমমম আম্মু বলো কি কথা_!”
-” আচ্ছা বাবা তুই সত্যি করে বল তো বউমার সাথে তোর সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি_? না কি কোনো ঝামেলা চলছে_! লুকাবি না কিন্তু আমার থেকে কিছু আমি তোর মা কথা টা ভুলে যাস নে।”

রাইফ কিছুটা সংশয়ে পড়ে গেলো সত্যি টা কি মাকে বলবো না কি_! আর আমি তো মায়ের কাছে কোনো দিন কোনো কথা লুকিয়ে রাখি না। তাহলে এই কথা গুলো কি বলে দেয়া উচিত মাকে। এমন ও তো হতে পারে মা আমাকে এই বিষয়ে আরেকটু হেল্প করবেন। আর আমার মায়ের উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে।
রাইফ কে চুপ থাকতে দেখে শিরীনা বেগম বললেন,
-” কি রে চুপ করে আছিস কেন_? বল কি হয়েছে সত্যি করে।”
-” আসলে আম্মু তোমাকে তো আমি কখনোই মিথ্যা বলি না।আজ ও সত্যিটা বলবো মিথ্যা বলবো না।( রাইফ , শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে সব বলল।)”
সব শুনে ওর আম্মু বললেন,
-” তুই এতো দিন আমার থেকে বিষয় টা লুকিয়ে রাখলি কেন_? আমি কি তোর পর কেউ না কি_!”
-” আম্মু তোমাকে হার্ড করতে চাইনি তাই বলিনি সরি। কিন্তু এখন প্লিজ তুমি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে এই বিষয়ে।”
-” হুমমম, কি সাহায্য লাগবে বল।”
-” তুমি শুধু এই বিষয়ে অন্য কাউকে কিছু বলো না প্লিজ।আর হ্যাঁ তানছিয়াকে বিশেষ করে বুঝতে দিও না তুমি এসব জানো। তুমি শুধু ওর সাথে একটু বেশি আদর করে কথা বলো।যেনো ওর তোমার প্রতি একটা আলাদা টান সৃষ্টি হয়।”
-” হুঁ বুঝতে পারছি,আর বলতে হবে না আমি সামলে নিবো সব ঘরের দিক থেকে।”
-” থ্যাংকস আম্মু লাভ ইউ।”


‘ পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রাইফের আগেই তানছিয়া রাইফকে ডাকলো।
-” এই যে মিস্টার সকাল হয়ে গেছে আজান হয়ে গেছে।এবার সোফা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
তানছিয়ার ডাকে রাইফ ঘুম থেকে উঠে গেলো। এ যেনো অবিশ্বাস্য ঘটনা , তানছিয়া এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেছে।তাও আবার আমাকে ডাকছে ঘুম থেকে উঠার জন্য। পরক্ষনেই মনে পড়লো ও তো আরবি শিখবে তাই হয়তো এরকম করছে।

‘ তানছিয়া একটু কাশিঁ দিয়ে বলল,
-” এখন কি এইভাবে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন না কি উঠবেন।”
রাইফ একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
-” হুঁ উঠছি।”
রাইফ ওয়াশ রুমে চলে গেল, ফ্রেশ হয়ে এসে দুজন একসাথে নামাজ আদায় করে নিলো আগে।
তারপর কায়দা নিয়ে বসলো , তানছিয়া আরবি হরফের অনির্দিষ্ট স্থানে আঙ্গুল রাখলো। তখন রাইফ তার নিজের হাত বাড়িয়ে, ওর হাত ধরে আঙ্গুল টা কে নির্দিষ্ট স্থানে রাখলো।
তানছিয়া, কিছু টা লজ্জা পেয়ে গেলো।
রাইফের মধ্যেও একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিল। এই প্রথম কোনো মেয়ের হাত স্পর্শ করলো। অবশ্যই মেয়েটার হাত স্পর্শ করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তাঁর।
আজ শুধু আলিফ ভা ই শিখালো তানছিয়াকে। আর বলল, সে অফিসে চলে গেলে।জোহরের নামাজের পর যেনো ও এইগুলো ভালো করে পড়ে। এবং রাতে এইগুলো দেখে এবং না দেখে রাইফকে পড়ে শুনায়।
নাস্তা করে রাইফ, অফিসে চলে গেলো।
জোহরের নামাজের পর তানছিয়া নামাজ পড়তে বসলো। যদিও সে আগে ঠিকঠাক ভাবে নামাজ পড়তে পারতো না ।রাইফ শিখিয়ে দিয়েছে আজ কিভাবে শুদ্ধ ভাবে নামাজ পড়তে হয়। নামাজ শেষে সে কায়দা নিয়ে বসলো। কিন্তু একটা হরফে এসে সে আটকে গেলো।
তখন ই পিছনে দাঁড়িয়ে ওর শাশুড়ি শিরীনা বেগম বললেন,
-” এইটা লাম হবে মা।”
তানছিয়া কিছু টা কেঁপে উঠলো,মনে মনে ভাবলো ওর শাশুড়ি কি না কি বলবেন যে আরবি ভাষা জানে না। কিন্তু এ কি ঘটলো তো পুরো উল্টো টা।ওনি তো বরং সুন্দর করে শিখিয়ে দিলেন এটা কি হবে।
তানছিয়া কে চুপ থাকতে দেখে তিনি বললেন,
-” লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মা, একটা মানুষ সব বিষয়ে একসাথে পারদর্শী হয়ে উঠে না। ধীরে ধীরে শিখতে হয় সবকিছু। আমি শিখিয়ে দিচ্ছি তুমি পড়ো।”
তানছিয়া প্রথমে লজ্জা পেলেও পরে খুব সুন্দর ভাবে পড়তে লাগলো।যেনো ওর নিজের মায়ের সামনে বসে পড়ছে ওর এইরকম অনুভূতি হচ্ছে।
তানছিয়া মনে মনে বলল,
-সত্যি এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ অনেক ভালো। কেন জানি না এই বাড়ির প্রতি একটা মায়া কাজ করছে।

‘ বিকালে রাইফ বাসায় এসে খেয়ে নামাজ পড়ে একটু ঘুমাতে চেষ্টা করছিল। ঠিক তখনই তানছিয়া এসে বলল,
-” আপনি এখানে ঘুমাচ্ছেন কেন , সোফায়_?”
রাইফ একটু ভারী গলায় বলল,
-” তো কোথায় ঘুমাবো_!”
-” কেন বিছানায় ঘুমাবেন।”
-” তাহলে তুমি কোথায় ঘুমাবে_!”
-” আমি ও বিছানায়।”
রাইফ বেশ অবাক হয়ে বলল,
-” কি_!”
তানছিয়া এতোক্ষণ মাথা নিচু করে ছিল, এখন মাথা টা উঁচু করে বলল।
-” এতো কি কি করার কি আছে, মাঝখানে বালিশ থাকবে আর দুই পাশে দুজন ঘুমাবো।”
রাইফ ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” জু হুকুম মহারানী।”
তানছিয়া একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে যেতে চাইলো।
কিন্তু রাইফ ওর হাত ধরে বলল,
-” থামো এই নাও।”
তানছিয়া কাগজে মোড়ানো প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বলল,
-” কি এটা_!”
-” আমি ঘুমিয়ে গেলে খুলে দেখো ওকে।”
-” ওকে।”
তানছিয়া প্যাকেট টা ট্রিটেবিলে রেখে চলে গেলো ছাদে কাপড় আনতে‌।
রাইফ, আনমনে হেসে উঠে বলল।
– সত্যি তোমার এই মিষ্টি হাসির প্রেমে পড়েছি।প্রেমে পড়েছি তোমার ঐ মায়াবী চেহারার। হ্যাঁ আমি প্রেমে পড়েছি তোমার ঐ হরিণী চোখের ও ঐ নাকের। সত্যি আমি তোমাকে ভালবাসি তানছিয়া আই রেলি লাভ ইউ। এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়লো।

তানছিয়া কাপড় নিয়ে এসে ,দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ কথা গুলো শুনছিল। রাইফের মুখে এমন কথা শুনে খুশি হবার বদলে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ওর প্রতি।
– না এই লোক টা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।এর থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে।

‘ রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে তানছিয়ার পড়া নিচ্ছিল রাইফ। সব পড়া একদম ঠিক ভাবে বলল তানছিয়া। যা শুনে রাইফ খুশি হয়ে বলল,
-” বাহ্ তুমি তো দেখছি সবকিছু একদিনে ভালো ভাবে মুখস্থ করে ফেলেছো।”
তানছিয়া একটু গম্ভীর গলায় বলল,
-” হ্যাঁ”
-” তা তোমাকে যে প্যাকেট দিছিলাম ঐটা খুলে দেখছো_!”
-” নাহ।”
-” কেনো_!”
-” মনে ছিল না,পরে দেখে নিবো।”
পড়া শেষ হলে তানছিয়া ওয়াশ রুমে চলে গেল।রাইফ শুয়ে শুয়ে ভাবছে তানছিয়ার মুহূর্তে এরকম ব্যবহার করার, পিছনে কি কারণ থাকতে পারে! কিছুক্ষণ ভেবে নিজের মাথায় নিজে একটা চাটি মেরে বলল।
– দেতত এসব মেয়েদের মনের ব্যাপার আমি কি করে বুঝবো‌। আল্লাহ যে ওকে এতো টুকু হেদায়েত দান করছেন এটাই অনেক।লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করছি আল্লাহর দরবারে।

তানছিয়া ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এসে দেখলো, রাইফ ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ ওর মনে পড়লো রাইফের দেয়া প্যাকেট টার কথা।
ট্রিটেবিল থেকে প্যাকেট টা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো, ভিতরে একখানা তাসবিহ। সোনালী রঙের তাসবিহ, খুব সুন্দর লাগছে তাসবিহ।
তানছিয়ার মন ভরে গেলো আনন্দে, রাইফের উপর থেকে নিমিষেই সবটুকু রাগ উধাও হয়ে গেলো। রাগের বদলে বরং শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করছে তাঁকে। সত্যি তুমি অনেক ভালো রাইফ, কিন্তু আফসোস আমি তোমাকে ভালোবাসি না। না চাওয়া সত্বেও কথা গুলো মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো তানছিয়ার। মাঝখানে বালিশ দিয়ে, তাসবিহ হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে ই ঘুমিয়ে পড়লো তানছিয়া।

চলবে_!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে