দহন দিনের প্রশান্তি

0
1002

নীপা ম্যাডাম, আজকের পর আর না আসলেও চলবে আপনার। আমার মেয়ের জন্য ওর স্কুলের এক শিক্ষক ঠিক করেছি। ওনার কাছে ব্যাচে পড়বে কাল থেকে।’ এই একটা বাক্য আমার মতো নিত্য যুদ্ধ করতে থাকা মানুষের জন্য কতোটা ভারী তা যদি ভাষায় বোঝানো যেত আমার ছাত্রীর মা কে।
‘ঠিক আছে আপা’, বলে পড়ানো শুরু করি ছাত্রীকে। কিন্তু কিছুতেই মন দিতে পারছিনা আজ। ক্ষণে ক্ষণে চোখ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে জলে।বোরকার খসখসে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে চোখটাই লাল হয়ে যায় শুধু কিন্তু বুকের ভেতরের ভারটুকু যে কমানো যায়না কোনভাবেই। কোথা থেকে পাবো আরেকটা টিউশনি? এ বাসার টাকাটা দিয়ে আমার পড়ার খরচ চালাতাম। আজকে দেয়া বেতনের টাকা দিয়ে হয়তো সামনের মাস চলবে। কিন্তু তারপর? সাহায্য করার একজন অবশ্য ছিলেন, রাবেয়া আন্টি; আমাদের বাসার বাড়িওয়ালী। কিন্তু ওনাকেও সৃষ্টিকর্তা তুলে নিয়েছেন সপ্তাহ দুয়েক আগে।

ছোট্ট একটা সুখী পরিবারে আমার জন্ম। নিম্ন আয়ের চাকুরীজীবি বাবা মায়ের অনেক ছিল না কিন্তু দুই বোন এক ভাইকে নিয়ে আমাদের সংসার চলে যাচ্ছিল তেমন বড় কোন ঝামেলা ছাড়াই। একদম বিছানায় না শুয়ে গেলে ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য বা সুযোগ আমার মতো পরিবারের হয়না। আর তাই বাবার শরীরে যে অদৃশ্য অসুখের ঘুনপোকা বাসা বেঁধেছিল বেশ শক্তভাবে তা বুঝে উঠতে বড় দেরী হয়ে যায় আমাদের। হঠাৎ করে হওয়া বাবার একটা স্ট্রোক আমাদের সংসারের চাকাটাকে সজোরে থমকে দেয় যেন চলতে চলতে হঠাৎ কিছুতে পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পরার মতো। আমি তখন মোটে অনার্স প্রথম বর্ষে। ছোট ভাইবোন দুটো স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি।

সংসারের এখন তখন জমানো যা কিছু ছিল সব চলে যায় বাবার চিকিৎসায়। উন্নতি হয় বাবার, নিজে অন্তত চলতে ফিরতে পারেন। সব বিপদের সাথে সৃষ্টিকর্তা সমাধানের জন্য কাউকে না কাউকে রাখেন। রাবেয়া আন্টি আমাদের এরকম বিপদের দিনে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। আমার বাবাকে ওনার বাসার ম্যানেজার হিসাবে নিয়োগ দেন। বিনিময়ে আমরা অর্ধেক ভাড়ায় থাকার সুযোগ পাই ওনার একটা ফ্লাটে। ওনার ছেলেমেয়েরা সব দারুন রকম বিত্তবান আর সবাই থাকেন ও দেশের বাইরে। তবু সব ছেলেমেয়ের যাবতীয় সব আগ্রহ এই বাড়িটার প্রতি। আংকেল মারা যাবার আগে বাড়ির পুরো মালিকানা আন্টির নামে দিয়ে যান। ছয়তলা বাড়ির বারোটা ফ্লাটের মালিক আন্টির সাথে ছেলেমেয়েরা রাগ করে কথাই বন্ধ করে দেয় কেন উনি সবকিছু তাদের নামে ভাগ করে দিচ্ছেন না। আন্টি প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন, ‘ দেখেছিস নীপা, মানুষে মানুষে কত তফাত? তোর বাবামা তোদের চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তবু তুই কিভাবে ওদের পাশে পাশে থেকে কষ্ট করে যাচ্ছিস। আর আমার ছেলেমেয়েদের দেখ, লোভের ডিপো একেকটা। এরকম কিছু লোভী বংশধর পৃথিবীতে রেখে যাচ্ছি ভেবে নিজেরই বড় কষ্ট হয়রে মাঝে মাঝে।’

আমি হেসে ওনাকে সান্তনা দিতাম, বোঝাতাম তারা একদিন নিশ্চয়ই বুঝবে বলে। আর নিজের কথা ভেবে অবাক হতাম কেন সম্পদ এবং সুযোগের এমন অসম বন্টন সৃষ্টিকর্তা করে রেখেছেন পৃথিবীতে? একটু ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় আমাকে রোজ। রোজদিন দুটো টিউশনি করতে যাই হেঁটে হেঁটে। বোরকা পরে মুখ ঢেকে চলি যেন লোকে বাজে দৃষ্টি না দেয় কিন্তু বাজে নোংরা হাতগুলোর ছোঁয়া থেকে বাঁচাবে কে? বাধ্য হয়ে ভীড়ের বাসে ওঠাই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। গরমের দিনগুলোতে কি যে কষ্ট হয় হেঁটে যেতে! তবু কয়েকটা টাকা বাঁচাতে, মায়ের হাতে দুটো টাকা বেশী তুলে দিতে বড় বেশী বেপরোয়া এই আমার মাঝেমধ্যেই ইচ্ছে হয় জীবন থেকে পালিয়ে যেতে। কি হতো আমি যদি রাবেয়া আন্টির একটা মেয়ে হতাম? আমি ও কি ওনার বাচ্চাদের মতো লোভী হতাম?

গত তিন মাস ধরেই ওনার শরীরটা ভালো যাচ্ছিলোনা। প্রায় রাতেই বাবার অনুরোধে আমি ওনার কাছে শুতাম। কোন বিপদ যদি হয়? সাথে এ ডাক্তার ও ডাক্তার এসব কাজগুলোও আমি হাসিমুখেই করতাম। আমার প্রতি ওনার ভালবাসাটুকু খুব বুঝতে পারতাম আমি। অদ্ভুত হলেও সত্য ওনার কোন ছেলেমেয়ে দেখতে আসাতো দূরের কথা ফোনে খোঁজ নিতেও যেন তাদের অনীহা। ছোটমেয়ে তো একদিন ফোনে বলেই বসলো, ‘তোমার কোনদিন কি হয়ে যায়, তারপর দেখা যাবে ঐ বাড়ির কোন মালিক নেই। ভাড়াটিয়ারা সব দখল করে নেবে।’ ফোনের স্পীকারে মেয়ের কথা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলেও রাবেয়া আন্টিকে বুঝতে দেইনি আমি সব শুনতে পেয়েছি। সন্তানের লোভী চোখ অন্য লোকে দেখে ফেললে যে মায়েরই লজ্জা, এরকম কোন লজ্জায় আমি তাকে পরতে দিতে চাইনি।

বিদেশ থেকে চাইলেই বোধহয় যখন তখন ছুটে আসা যায়না। আর তাই দু সপ্তাহ আগে মারা যাওয়া রাবেয়া আন্টির সব দাফনকাফনের ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হয়। ওনার ছেলেমেয়েরা দিন পাঁচেকের মধ্যে এসেই বাসার হিসেব নিয়ে বসেন। বাবাকে গত পরশু নোটিশ দেয়া হয়েছে পুরো ভাড়া না দিতে পারলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে সামনের মাসে। ওনারা নতুন ম্যানেজার রাখবেন। আজকে পেলাম আমার টিউশনি হারানোর নোটিশ। থেকে থেকে শুধু এটা ভেবেই কষ্ট লাগছে, বেঁচে থাকার জন্য তো অনেক কিছু সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইনি। একটু ইজ্জত নিয়ে বেঁচে থাকা আর দু বেলা পেট পুরে খাওয়ার নিশ্চয়তাটুকু ছাড়া।

বাসাভাড়ার নোটিস পেয়ে বাবা মা দুজনেই খুব ভেঙে পরেছেন; কি করবেন, কোথায় থাকবেন? গ্রামেও বসতভিটা বলে কিছুই যে নেই। আমি বলেছিলাম, চিন্তা না করতে; আরো একটা টিউশনি জুটিয়ে নেব। ছাত্রীর বাসা থেকে বেরিয়ে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের জীবনের হিসাব নিয়েই ভাবছিলাম। বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল বেশ কয়েকটা। বাবামায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি সব। এই সংসারটা চালিয়ে নিতে আমার দুটো শক্ত হাতের যে বড় প্রয়োজন তাদের। বইয়ের পড়া লাইনের মতো চিৎকার করে আজ বলতে ইচ্ছে করছে , ‘ওহে ঈশ্বর তুমি কি শুধু সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষগুলোর জন্যই থাকো?’

মানুষ আনমনে চলতে থাকলেও মনের অজান্তে তার গন্তব্যের দিকেই হাঁটে। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাসার দরজা ভেজানো ছিল। বসার ঘরে বাবামা দুজনেই বসা, তাদের মুখোমুখি বসে আছে একজন মোটামুটি চেনা লোক, রাবেয়া আন্টির কেমন যেন ভাগ্নে হয়। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি তাহলে আজ আসি বলে একটা খাম ধরিয়ে দেয় আমার হাতে। বাবামায়ের সপ্রশ্ন দৃষ্টির সামনে খাম খুলে ফেলি। একটা চিঠি সাথে কিছু স্ট্যাম্প করা কাগজ বেরিয়ে আসে।

প্রিয় নীপা,

চিঠির সাথে থাকা উইলটা তোর নামে করা। আমার মৃত্যু পরবর্তী দশ বছর তোরা আমার বাসায় বিনা ভাড়ায় থাকবি। সাথে একটা ব্যাংক চেক আছে তোর নামে রাখা। তুই ভালোভাবে পড়া শেষ করার মতো টাকা তাতে আছে। তোর বুদ্ধি বিবেচনায় আমার পুরো আস্থা আছে। আমি জানি তুই তোর পরিবারের দিন ফেরাতে পারবি। গত তিনমাসে আমার পাশে পাশে থেকে যে ভালবাসা তুই দেখিয়েছ্স এটার মূল্য আমি পৃথিবীর কোন কিছু দিয়ে দিতে পারবো না। তুই হয়তো ভাবতে পারিস এতোটুকু দিলাম তবে কেন পুরো বাসাটাই তোকে দিয়ে দিলাম না। কারণ আমি চাই তুই তোর নিজের পায়ে দাঁড়া। তোর একেকদিনের গল্প শুনে আমার ইচ্ছে করতো তোর জন্য তখনই কিছু করি কিন্তু আমি তোর ধৈর্য দেখতে চাচ্ছিলাম। এ বড় অদ্ভুত নেশা জানিস? একজন মানুষের টিকে থাকার লড়াই দেখার আনন্দ অন্যরকম। তুই হোঁচট খেলে আমি পাশে দাঁড়াতাম অবশ্যই। আমার অবর্তমানে এরকম কেউ যদি তোর পাশে না পাস, তাই এই সামান্য চেষ্টা।

আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষগুলোর মধ্যে তুই একজন। কখনো ভুলে যাসনা তোর বাবামায়ের জন্য তুই পৃথিবীর আলো দেখছিস। শুধু নিজের স্বার্থের জন্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে কোন তফাত নেই এটা সবসময় মনে রাখিস। পৃথিবীর মানুষগুলো তোকে কি দিল সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবি না, তুই পৃথিবীর মানুষকে কি দিচ্ছিস সেটাই সবসময় মাথায় রাখবি।
দোয়া করি একটা সত্যিকারের আলোকিত জীবন যেন
তোর হয়।

রাবেয়া আন্টি।

দহন দিনের এক পশলা বৃষ্টির শান্ত পরশের মতো আমার যাবতীয় মন খারাপ নিমিষেই মুছে দিল ঐ একটা চিঠি আর এক তাড়া কাগজ। কাউকে সত্যিকারের ভালবাসলে সৃষ্টিকর্তা বুঝি তা এভাবেই শতগুণে ফিরিয়ে দেয়।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে