তুমি রবে ৫২

1
1930

তুমি রবে ৫২
.
– “ব্যাপারগুলো কীভাবে জানাব তোমাকে বলো তো? আমার বাবা আর মায়ের সম্পর্কটাকে ঠিক কীভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত তা আমার জানা নেই। তবে ভাইয়া নিজেই তোমাকে সব ধীরে ধীরে জানাবে মাহি।”
– “জানালে তখনই জানাতো দিশান। শুধু বলল সে তোমাদের মা ছিল। এরপর সেই আগের মতো গম্ভীর মুখ করে উঠে চলে গেল।”
– “তুমি আমাদের পরিবারেরই একজন এখন। তাই এসব তোমাকে একদিন জানতেই হবে। টেনশান করো না ভাইয়াকে নিয়ে। আমি নিশ্চিত, ভাইয়া নিজেই একদিন তাঁদের বিষয়ে তোমাকে সব বলবে। আমি কী বলতে কী বলে দেবো তার ঠিক নেই। কারণ ওই মানুষ দুটোর একজনকেও আমি পছন্দ করি না।”
.
জ্যামে এসে দাঁড়াল দিশানের গাড়ি। মাহি কোনোভাবেই স্বস্তি পাচ্ছে না। আশফির হঠাৎ রাশভারী চেহারাটা মাহিকে একটু বেশিই ভাবাচ্ছে। মানুষটাকে সে মুখে যা-ই বলুক, তার উদাসীনতা মাহি ঠিক নিতে পারে না। কেমন চুপচাপ অফিসে যাওয়ার কথা বলে সে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল তখন। মাহির সাথেও তেমন কোনো কথা বলল না। শুধু গাড়িতে ওঠার পর কয়েক নজর তাকিয়েছিল মাহির দিকে।

দিশান দিয়াকে পৌঁছে দিয়ে মাহিকে নিয়ে এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। এর মাঝে মাহি তাকে প্রশ্ন করল,
– “ঐন্দ্রীর বিষয়ে কিছু জানো দিশান?”
– “হুঁ জানি। ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ হয় ওর। এখান থেকে চলে যাওয়ার পর নিজের বাড়ি ছেড়েও চলে গিয়েছিল মিনহাজ আঙ্কেলের কথাতে কষ্ট পেয়ে।”
– “তারপর?”
– “তারপর আঙ্কেল নিজেই গিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে।”
– “তোমার ভাইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ কি ও করেছিল না কি তোমার ভাইয়া?”
– “ঐন্দ্রী নিজেই করেছিল। আমাদের ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। মিনহাজ আঙ্কেল কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন না এ বিষয়ে। দাদার সঙ্গে কথা বলেছিল ঐন্দ্রী। দাদাও না জানিয়েছেন। ভাইয়াকে অনুরোধ করেছে খু্ব। আমাদের ডিভোর্সের ব্যাপারটা ভাইয়াকে সামলাতে বলেছে।”
– “তিন মাসের আগে সম্ভব?”
– “বোধহয় না।”
– “ওর সঙ্গে অনেক বড় অন্যায় করেছে তোমার ভাইয়া।”
– “হয়তো। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম। ভাইয়াকে হারিয়ে ফেলতাম আমরা সবাই। ঠিক বাবার মতো। বাবা যেমন আমাদের মা’কে ফেলে হঠাৎ করেই চলে গিয়েছিল। ঠিক তেমনই হতো ঐন্দ্রীর সঙ্গে।”
– “আমার শ্বশুড়সাহেব কি অন্য কাউকে ভালোবাসতেন?”
– “তা অজানা। তবে শুনেছি তার প্রতি অনেক রমণী আসক্ত ছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা তার উল্টোটা।”
– “ছিঃ দিশান! এভাবে বলো না। বাদ দাও এসব কথা।”
– “ও যেটা বলতে চেয়েছিলাম ঐন্দ্রীর ব্যাপারে। ঐন্দ্রী এখন বসুন্ধরাতে থাকে।”
– “কেন?”
– “ওখানে কোথায় যেন একটা জব করতে শুরু করেছে দু’দিন হলো। তাই অফিসের কাছাকাছিই থাকে।”

.
বাড়িতে ফেরার পর মাহি দাদীবু আর চাচির সঙ্গে নিচে বসে অনেক সময় কাটাল। এ সংসারের নানানরকম গল্পও শুনল সে। কিন্ত মনের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকল তার স্বামী মানুষটার কথা। বেলা বারোটা বাজে সবে। মাহি চাচির সঙ্গে টুকটাক রান্নার কাজ সামলে রুমে ফিরে এলো। তার মনটা যে বড্ড উদাসীন, চাচির তা বুঝতে দেরি হলো না। তাই শাওনকে পাঠাল তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্য। শাওনের সঙ্গে মাহির তেমনভাবে কখনো কথা বলা হয়নি। শাওন নিজেও প্রথম প্রথম খুব সংকোচবোধ করতো মাহির সঙ্গে কথা বলতে। সে বয়সে তাদের থেকে ছোট হলেও আজকে মাহির স্থানে যে ঐন্দ্রীকেই সে এক সময় হবুভাবি বলে জানতো আর মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করে ডাকতোও, আর তাই হঠাৎ করেই সে মাহির সামনে আসতে কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়ে পড়তো। মাহির সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর শাওন অনেকটা সহজ হলো। হঠাৎ সে মাহিকে বলল,
– “ভাবি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব?”
– “অবশ্যই। এত সংকোচ করো না শাওন। আমি কিছুই মনে করব না বলো।”
– “বিগ ব্রো’কে কি কখনো তোমার ওড়না গিফ্ট করেছো?”
মাহি অনেকটা অবাকের সুরে বলল,
– “ওড়না গিফ্ট করব তাও তোমার বিগ ব্রো’কে? প্রথমত, তোমার ভাইয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ওই ধরনের ছিল না। মানে যে ধরনের হলে এক অপরের মাঝে গিফ্ট দেওয়া-নেওয়া হয়। আর দ্বিতীয়ত, ওড়না ও কি কখনো কাউকে গিফ্ট দেওয়া যায়?”
– “তাহলে তুমি দাওনি?”
– “না!”
– “দাদীবু একদিন ভাইয়ার ক্লোজেট গুছিয়ে রাখতে বলেছিলেন আমাকে। তো সেদিন গোছাতে গিয়েই একটা সাদা ওড়না পেয়েছিলাম ক্লোজেটে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ওড়নাটা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে ভাইয়া। আর ভাইয়ার বিয়ের পর জানতে পারলাম যে সে এক মাত্র তোমার প্রতি অ্যাডিক্টেড। এছাড়া ভাইয়ার জীবনে বিশেষ কোনো মেয়ের গল্প শুনিনি। তাই ভাবলাম ওটা তোমার কিনা।”
– “ও, আচ্ছা।”
শাওনের কথাগুলো শোনার পর একটা বড়-সড় সুনামি চলছে মাহির মনের মধ্যে। এরপর শাওনের সাথে তার টুকটাক আরও কিছু গল্প চলল একদম মনের বিরুদ্ধে জোর করে। শাওন চলে যেতেই মাহি দরজাটা আটকে দ্রুত ক্লোজেটটা খুলল। এতক্ষণ সে এটা খোলার অপেক্ষাতেই বসেছিল। এ ক’দিনে মাহি একবারের জন্যও আশফির তাকগুলোতে নজর দেওয়ার আগ্রহবোধ করেনি। করলে হয়তোবা আরও আগেই তার চোখেও পড়তো ওড়নাটা।

চার মিনিট যাবৎ খোঁজাখুঁজির পর মাহি অবশেষে ওড়নাটা খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। আর এ মুহূর্তে সে ওড়নাটা কোলের ওপর নিয়ে নিস্তব্ধ এক পাথর মূর্তির মতো বসে আছে। সারা শরীর তার এখনো কাঁপছে। প্রচন্ডভাবে চমকে উঠেছে সে আশফির ক্লেজেটে নিজের ওড়নাটা খুঁজে পেয়ে। নিমিষে মনে পড়ে গেল সেই প্রিয় চাঁদনিরাতের মুহূর্তগুলো। যে রাতটা তার জীবনেছিল হাজার সুখের মুহূর্তে সমতুল্য। কিন্তু তারপরই তো ঝরের আভাস।

এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে তা সে ‘ভালোবাসি’ বলে কথাটা মাহির কাছে উল্লেখ না করলেও তার বিভিন্ন কথা দ্বারা মাহি বুঝেছে। কিন্তু এই যে গাঢ়ভাবে আশফি তাকে ভালোবাসে তা হয়তো মাহি আগামীতেও উপলব্ধি করতো না, যদি না এই ওড়নাটা সে দেখতে পেতো আজ। মাহি ফোনে সময়টা দেখে নিলো। মধ্যাহ্নের সময় চলছে এখন। এ বাড়িতে আসার পর আশফিকে মাহি সন্ধ্যার পর ফিরতে দেখে। কিন্তু আগে তো সে অফিস ছুটির পরই বেরিয়ে পড়তো! উফ্! আজ যেন একদমই ধৈর্য থাকছে না মাহির। অপেক্ষার যন্ত্রণা সে কোনোদিন উপলব্ধি করেনি। কিন্তু এই যন্ত্রণা কত কঠিন তা আজ সে হারে হারে টের পাচ্ছে।
.
.
তৌহিদ আর ফয়সাল সাড়ে চারটার সময় এসে দাঁড়িয়ে আছে এয়ারপোর্ট। দুজনের মাঝেই ব্যাপক উত্তেজনা। প্রায় দশ বছর পর তারা আজ সেই শৈশবের বন্ধুটির দেখা পেতে চলেছে তারা। ফয়সাল জিজ্ঞেস করল তৌহিদকে,
– “মেয়েটার নাম যেন কী রে তৌহিদ? ভুলে গিয়েছি।”
তৌহিদ সামনে নজর রেখে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকে বলল,
– “মেহরিন।”
– “আরে হারামী মেহরিন তো ওর বউয়ের নাম।”
তৌহিদ এবার ভ্রুকুটি করে তাকাল ফয়সালের দিকে। হালকা ধমকানির সুরে বলল,
– “ধুরঃ শালা! শাহরিন ওর বউয়ের নাম।”
– “নাউজুবিল্লাহ!”
ফয়সাল জিহ্বা কামড়ে হেসে ফেলল।

মাহতীম ঠিক পাঁচটার মধ্যে এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাগেজগুলো নিয়ে বেরিয়ে এলো। মাহতীমকে দেখেও তারা দুই বন্ধু চিনতে পারল না। তাকে সামনে রেখে ঘড়িতে টাইম দেখে নজর এদিক ওদিক ঘুরাতে থাকল তৌহিদ। চার বছর বয়সের ছোট্ট মেহরিন তার বাবার হাত ধরে সামনে এগিয়ে আসছে। মাহতীমের ঠোঁটে তখন ঈষৎ হাসি। বেশ মজা লাগল তার। ছোটবেলার বন্ধু দুটি তাকে সামনে রেখেই খুঁজে চলেছে। গা থেকে কোর্টটা খুলে মাহতীম তার রাশভারী কণ্ঠে তাদের উদ্দেশে বলল,
– “কাউকে কি খুঁজছেন আপনারা?”
মাহতীমের আচমকা আওয়াজে ওরা দুজনেই চমকে উঠে তাকাল পাশে ফিরে। পাকা দেড় মিনিট সময় ধরে ফয়সাল আর তৌহিদ তাকিয়ে রইল তাদের বন্ধুটির মুখপানে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই দুজনেই জড়িয়ে ধরল মাহতীমকে। ছোট্ট মেহরিন হা করে তাকিয়ে দেখতে থাকল তাদের তিনজনকে। তৌহিদ মাহতীমকে ছেড়ে দ্রুত মেহরিনকে কোলে তুলে নিলো। ফয়সাল ছেড়ে দিয়ে মাহতীমকে বলল,
– “শালা নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে গেছোস! এত্ত চেঞ্জ! এখনো আট দশটা বউ পালতে পারবি।”
– “হিংসা বাদ দে। এখন চল।”
ফয়সাল তৌহিদের কোল থেকে মেহরিনকে নিয়ে তৌহিদের গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িতে বসে প্রথমে তারা মাহতীমের নতুন ফ্ল্যাট সম্পর্কে বলতে থাকল তাকে।
.
.
মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে মাহি। সাঁঝ শেষে আঁধার নামতেই কেমন শীতের তেজটা বেশিই লাগল তার। গায়ে চাদরটা পেচিয়ে ডিভানে পা দুটো তুলে বসলো। আশফির ইদানীং ফিরতে এত দেরি হওয়ার কারণটা মাহি আজ জিজ্ঞেস করবেই তাকে। বাড়িতে ফেরার পর থেকে তার ঘড়িতে সময় দেখে দেখেই দিনটা পার হলো আজ। এখন সে আরও একবার দেখল সময়টা। সন্ধ্যা সাতটা বেজে ছয় মিনিট। অদ্ভুত তো! অফিস ছুটি হয় পাঁচটার মধ্যে। তাহলে নিশ্চয় ফিরতে ফিরতে সময় লেগে যায়। কারণ অফিস থেকে উত্তরা পৌঁছাতে বেশ সময়ই লাগে। কিন্তু আজ যে মাহির ধৈর্য যে একেবারেই থাকছে না। ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে সে বসলো এবার। আজ সকালের মিষ্টি ক্ষণগুলো মনে পড়তেই কেমন বুকের মাঝে ধুক ধুক আওয়াজ হতে শুরু করল। আশফি একটা কথা বলেছিল তখন। সুন্দর করে চুমু খাওয়াও একটা যোগ্যতা। আসলেই কথাটা তীব্র সত্য। মানুষটা যখন তার ওই চোখ জোড়ার গাঢ় চাহনি মেলে তাকিয়ে মাহির খুব কাছে এসে অনেক সুন্দর করে চুমু খেয়ে বসে, তখন মাহির শরীরের প্রতিটা লোমও দাঁড়িয়ে যায়। এই মানুষটার মাঝে তাকে মারার জন্য মারাত্বক দুটো মারণাস্ত্র আছে। একটি হলো তার চাউনি আর আরেকটি হলো তার অতি যত্ন করে দেওয়া চুমু। যে দুটো থেকে মাহি চাইলেও দূরে রাখতে পারে না নিজেকে। তার প্রতিটা চুমুর মিষ্টি মুহূর্তগুলো মাহি মনে করতে থাকল। প্রচন্ড লজ্জা ঘিরে ধরলেও মুহূর্তগুলো ভাবতে প্রচন্ড সুখ হচ্ছে তার। তাই শত লজ্জা পেলেও আজ সে ওই প্রতিটা মুহূর্তগুলো ভাববে। তবে আচমকা ভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দিলো গতরাতে দিশানের দেখানো সেই ভিডিওগুলো। যেখানে বিভিন্ন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে আশফিকে, ঠিক সেই সময়গুলো নিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করে রেখেছে দিশান। যার মাঝে সব থেকে অসহ্যকর ঘটনা ছিল লাইব্রেরির ঘটনাটি। আশফি সেখানে একটি হাস্য ও রোমাঞ্চকর উপন্যাস পড়ে শোনাচ্ছিল কিছু ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষগুলোকে। তার পড়া শেষ হলেই এক ঝাঁক তরুণী এসে আশফিকে ঘিরে রেখে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে আর কেউবা আশফিকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলছিল। বলা বাহুল্য, আশফি খুব সুন্দর করে কথা বলতে জানে। তা সে বাংলা হোক অথবা বৃটিশদের ইংরেজিতে হোক। তার আকর্ষণীয় চেহারা আর সুন্দর করে কথা বলার ভঙ্গি যেকোনো মেয়েকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। যেটা মাহির কাছে আজ খুব অসহ্যকর লাগছে।
.
আটটা বাজার কিছুক্ষণ পূর্বে আশফি রুমে ঢুকল। রুমটা মৃদু আলোতে উজ্জ্বল। রুমে ঢুকে আশফি টিউবলাইটটা জ্বালিয়ে হাতের ব্যাগটা বিছানাতে রাখতে নজর পড়ল ব্যালকনিতে। এক কাত হয়ে পা দুটো তুলে তার বউটা ঘুমিয়ে আছে ডিভানে। তাকে ওভাবে দেখতে পেয়ে মৃদু হেসে উঠল আশফি। আজ কাল রুমে পৌঁছানোর তাড়া তারও খুব থাকে। কিন্ত কাজের চাপে দ্রুত ফিরে আসা আর হয়ে ওঠে কই? তবে ফেরার মুহূর্তে তার ভেতরে এক অনাবিল প্রশান্তি বিরাজ করে। যা সে আগে উপলব্ধি করতো না। আর এই প্রশান্তির কারণটা যে তার এই প্রিয় মানুষটি, তা ভাবতেই আশফির ভেতরে এও শান্তিটা আরও বেশি অনুভূত হয়। পনেরো মিনিট সময় ব্যয় করে আশফি ফ্রেশ হলো।
.
মাহির কাচা ঘুমটা গাঢ় হওয়ার মুহূর্তেই ঘুমটা ভেঙে গেল যেন কীসের আওয়াজে। চোখ দুটো মেলে বুঝতে চেষ্টা করল শব্দটা। গান বাজছে মৃদু আওয়াজে। পুরোনো সময়কার বেশ জনপ্রিয় একটি হিন্দি গান। গানটা আশফির অনেক পছন্দের একটি গান। তবে আশফি জানে না, এটা তার বউয়েরও খু্ব পছন্দের। তার ভাই যখন তার গার্লফ্রেন্ডকে গানটা গেয়ে শুনিয়েছিল, ঠিক তখন থেকেই গানটা খুবই পছন্দের তার কাছে। মাহি স্মিতহাস্যে গানটা শুনতে থাকল নীরবে।
“Neele neele ambar par chaand jab aaye
Pyaar barsaaye humko tarsaaye
Aisa koi saathi ho aisa koi premi ho
Pyaas dil ki bujha jaaye…”

গানের চারটা লাইন শোনার পথেই সেটা বন্ধ হয়ে গেল। হাসি মুখটা নিমিষে গম্ভীর হয়ে উঠল মাহির। সোজা হয়ে বসে এবার রুমের দিকে ঘুরে তাকাল। কিন্তু রুমে তো কাউকেই দেখা গেল না। হঠাৎ-ই মাউথ অর্গানে বেজে উঠল গানের সুরটা। আর সেই সুরটা তার খুবই কাছে। তবে সে সুরটাও বাজল মাত্র এক মিনিটের জন্য। সুরটা যখন বেজে ওঠে তখন মাহির সেই হাসিটা আবার ধীরে ধীরে ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ে। সুরটা থামতেই আবার গানটা বেজে উঠল। এবার আর গানটা থামল না। মৃদু গতিতে প্রিয় গানের সুর আর খুব কাছে প্রিয় মানুষটার উপস্থিতি। মাহি তার পানে একটিবার ফিরে তাকাবার সাহসটুকু পাচ্ছে না। কেন যেন এক রাশ লজ্জা তাকে ঘিরে ধরেছে। আশফি ডিভানে তার উল্টোপাশেই বসেছিল। উঠে এসে সে নিজেই মাহির সামনে এসে দাঁড়াল। মাহি তার দিকে এক নজর চেয়ে আবার দৃষ্টি ঝুকিয়ে নিলো। আশফি তার সামনে অনেকটা হাঁটু গেড়ে বসার মতো করে বসলো। ওদিকে গানটা রিপিট চলছে তখনো। আশফি মাহির কানেকানে ফিসফিস করে বলল,
– “অ্যাসপেক্টেশন কিন্তু অনেক। গানটা শুনতে হলে কিছু দিতেও হবে।”
মাহি লাজুক হাসির মাঝে দৃষ্টি সেই আগের মতো নিচু রেখেই আশফিকে প্রশ্ন করল,
– “যেমন?”
আশফি উঠে দাঁড়াল। তার প্রশ্নের উত্তরে নীরবে তার দিকে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো সে। মাহি অপ্রস্তুতভাবে বলল,
– “আমার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়।”
– “আমি সম্ভব করে নেবো।”
আশফির এবারের চাউনির সঙ্গে তার মুচকি হাসিটা মাহিকে ভেতরে ভেতরে একেবারে দূর্বল করে দিলো। তার হাতটা ধরে উঠতেই আশফি তার কোমরে হাত রেখে মাহির হাতটা নিজের কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে নাচতে থাকল। নাচের মাঝে মাহির পিঠটা ঠেকাল আশফির বুকের সঙ্গে। ঠিক গতকাল সেই রাতের মতোই। তখনকার মতোই এবারও আশফির হাতটা পড়ল মাহির পেটের ওপর। মাহির কাঁধে আশফি থুঁতনি বাঁধিয়ে মৃদুস্বরে তাকে বলল,
– “নেশা ছাড়াই মাতালকে কি আজও দেখব?”
মাহি নিজেকে নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাতে নিয়োজিত। সেও খুব মৃদুস্বরে তবে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
– “কোনো সেকেন্ড হ্যান্ড ঠোঁটের ছোঁয়া যেন আমাকে ছোঁই।”
আশফি কিঞ্চিত ভ্রুকুটি করে বলল,
– “সেকেন্ড হ্যান্ড ঠোঁট! সেটা কীরকম?”
– “ওখানে অন্য কারো ব্যবহার হয়েছে। ওটা ব্যবহৃত।”
আশফি নাচের মাঝেই হেসে ফেলল। মাহির কপট রাগের সুর আশফিকে প্রচন্ড হাসালো। মাহি এবার একটু রেগে বলল,
– “ডাউট আছে। নিশ্চয় ভার্জিন নন আপনি!”
– “চুমু খেলে ভার্জিনিটিও চলে যায় না কি?”
আশফির ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি। মাহি জবাব দিলো,
– “সত্যি কথা বলুন।”
– “কেউ যাচাই করে নিতে পারলে নিক। আমার কী দায় পড়েছে সত্যি বলার?”
মাহি এবার নাচ থামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আশফির মুখোমুখি। চকিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল আশফিকে,
– “কীভাবে?”
– “সেটা আমাকে কেন বলতে হবে?”
– “আমি জিজ্ঞেস করছি তাই বলতে হবে আপনাকে।”
– “মেয়েদের ক্ষেত্রে কীভাবে যাচাই করে?”
মিটিমিটি হাসতে থাকল আশফি প্রশ্নটা করে। মাহিও প্রত্যক্ষ উত্তর দিলো,
– “আমি ছেলের ভার্জিনিটি যাচাইয়ের উপায়টা জানতে চাই। কোনো মেয়ের নয়।”
– “মানে আমাকে ঘায়েল করার উপায় আমাকেই বলতে হবে?”
– “আপনি বলুন।”
মাহির কড়া কণ্ঠের আদেশ শুনে আশফি এক টানে মাহিকে নিজের পায়ের পাতার ওপর টেনে নিয়ে বলল,
– “এই যে যে ঠোঁটটাকে সেকেন্ড হ্যান্ড বললেন সেই ঠোঁটটাকে কয়েকবার ব্যবহার করতে হবে আপনাকে। তবে এক ধাপ বুঝতে পারবেন আমি ভার্জিন কি না? তারপর এই যে এত বড় ব্লেম দেওয়া হলো আমার ভার্জিনিটির ওপর, সেই ভার্জনিটি সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে হলে আমাকে….”
কথাটা আর সম্পূর্ণ করার সুযোগ দিলো না মাহি। আশফির ঠোঁটটা হাত দিয়ে চেপে ধরল। লজ্জাতে সে মুখ গুঁজল আশফির বুকে। আশফি হাসতে থাকল শুধু। কয়েক মুহূর্ত পর মাহি মুখ তুলে তাকে বলল,
– “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আউটস্পোকেন ছেলেটাই বোধহয় আমার বর।”
এর জবাবে আশফি হেসে তাকে বলল,
– “আর পৃথিবীর সবচেয়ে ব্লাশিং বিউটি কুইন-ই বোধহয় আমার বউ।”
মাহি আলতোভাবে আশফিকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল রুমে। পকেটে হাত পুরে মুচকি হাসতে হাসতে আশফি ভেতরে এলো। বিছানার ওপর একটি শপিং ব্যাগ। ব্যাগটার দিকে চেয়ে মাহি প্রশ্ন করল,
– “ওটা কী?”
আশফি মাহির পিছে খুব কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর বলল,
– “গিফ্ট।”
মাহি ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল আশফির দিকে।
– “গিফ্ট! কার জন্য?”
– “বিশেষ কারো জন্য।”
– “আমি কি দেখতে পারি সেই বিশেষজনের গিফ্টটা?”
– “হ্যাঁ অবশ্যই।”
মাহি ব্যাগটা হাতে তুলে ভেতরে কী তা দেখার পূর্বেই আশফি তার হাত ধরে বাধ সাধল। তারপর মাহিকে বলল,
– “সেই বিশেষজনের কাছে আমারও একটা দামি গিফ্ট পাওনা আছে। আমাদের বিয়ের সেই বিশেষ রাত উপলক্ষে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা বাকি পড়ে আছে। আমাকে সেই গিফ্টটা আগে দিতে হবে। তারপর এটা দেখার সুযোগ পাবেন আপনি।”
– “ইস! কী চিপ মাইন্ডেড আপনি!”
– “বউয়ের কাছে চিপ হলে পাপ নেই।”
– “দেবো বলেছি তো।”
– “কবে সেটা?”
– “এই উইকের মাঝেই।”
আশফি এবার হেসে ব্যাগটা মাহির হাতে দিয়ে বলল,
– “এটা দেখার একটা শর্ত আছে।”
– “আবার শর্ত?”
– “হ্যাঁ অবশ্যই। আশফি মাহবুবের গিফ্ট তো আর যেমন তেমন কিছু নয়।”
– “হ্যাঁ তাই তো। মহামানব আশফি মাহবুবের গিফ্ট বলে কথা। তো বলুন কী শর্ত?”
– “এটা দেখার পর আমি যেটা বলব সেটা শুনতে হবে এবং মানতে হবে। রাজি?”
মাহি সন্দেহের চোখে তাকাল আশফির দিকে। তার চাউনি দেখে আশফি বলল,
– “এত দ্বিধা থাকলে কোনো প্রয়োজন নেই এটা দেখার।”
কথাটা বলেই আশফি ব্যাগটা নিয়ে নিলো মাহির হাত থেকে। মাহি ছোঁ মেরে ব্যাগটা তার হাত থেকে নিয়ে বলল,
– “ডান।”
আর এক মুহূর্ত ব্যয় না করে ব্যাগটা খুলে ভেতরের জিনিসটা বের করল সে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মাহি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সেটার দিকে। লজ্জাতে তার দৌঁড়ে পালাতে ইচ্ছা করছে ঘর থেকে। আশফির দিকেও সে তাকাতে পারল না লজ্জাতে। আশফি তখন মাহির মুখটা দেখে মিটিমিটি হাসছে। আশফি তার কানেকানে বলল,
– “ডেয়ার নেওয়ার মতো ক্ষমতা যার আছে তার নিশ্চয় আমার শর্ত মানার সাহসও আছে?”
মাহি চোখ গরম করে তাকাল আশফির দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল,
– “এটা পরব আমি?”
– “হ্যাঁ। কেন সমস্যা? আমি কি বাইরের পুরুষ?”
মাহি তার রাগটা বশে আনার চেষ্টা করল। অবশ্যই আশফি বাইরের কোনো পুরুষ নয়। তার স্বামীর অধিকার অথবা প্রাপ্যও বলা চলে এগুলোকে। স্বামীর মনোরঞ্জনের আদেশ তো সে সেই ছোটবেলা থেকে সে শুনে এসেছে তার দাদীর মুখে। আর দাদীর কথাও খুব মান্য করতে দেখেছে সে তার মা’কে। আজ সকালের ঘটনায় তো। তার দাদীশ্বাশুড়িও তাকে স্বামীর খেদমত করা সম্পর্কে কত নসিহত প্রদান করল। কিন্তু আশফি তো বলেছিল, তার অনিচ্ছায় আশফি তার কাছে কোনোদিনও আসবে না। তাহলে এসব কী? নাইটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে এখন সেটা পরে আসার হুকুম জারি করছে। তাহলে কি পুরুষ মানুষের দৈহিক চাহিদার চেয়ে বড় কিছু আর নেই? বিয়ে করেছে বলেই কি এই অধিকারবোধ তাকে দেখাতেই হবে? তার ইচ্ছার কি তবে কোনোই মূল্য থাকবে না আশফির কাছেও?

আশফি শুধু দেখতে থাকল মাহির চোখদুটো। মাহি তার দিকে তাকালে আশফি ইশারা করল নাইটিটা পরে আসার জন্য। মাহি কিছু বলল না তাকে। বাথরুমে গিয়ে শাড়িটা খুলে সে বেশ কিছুক্ষণ সেটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। আশফি দরজার ওপাশ থেকে তাকে বলল,
– “রাতের রানিকে দেখার সুযোগ হবে কি?”
আশফির মুখে ‘রাতের রানি’ এই শব্দ দুটো শুনে প্রচন্ড অবাক হলো মাহি। তার ভেতরটা ভেঙেচুরে আসতে থাকল যেন। তবে কি সে ভুল চিনেছিল আশফিকে? সেও কি শারীরিক চাহিদার প্রতি বাকি সব পুরুষদের মতো আসক্ত? মাহি আর ভাবতে পারল না। এত কিছু ভাবার থেকে পরীক্ষা করেই নেওয়াই ভালো।

সাদা নাইটিটা পরে ওপরের দীর্ঘ কোটির মতো জামাটার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে এলো সে। আশফি রুমে নেই তখন। আয়নার সামনে বসলো আশফির রাতের রানি সাজার উদ্দেশে। মনের একটা কোণে আশফির প্রতি প্রচন্ড রাগ চলতে থাকল তার। আর আরেকটা কোণে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকল তার মানুষটা যেন কখনোই ওই চরিত্রের মানুষগুলোর মতো না হয়, যারা শুধু রাতের রানির জন্য অপেক্ষা করে। এমনটা হলে যে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে তাদের।

……………………………..
(চলবে)
– Israt Jahan Sobrin

ভুল-ত্রুটি কষ্ট করে বুঝে নেওয়ার অনুরোধ রইল। ১ম খন্ড শেষ হতে আর মাত্র ৩ পর্ব বাকি।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে