টেষ্ট_টিউব ২য়_পর্ব
লিখা:Nilufar_Nijhum
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলেই নীলা কাঁদতে থাকে। শেষে ওকে থামাতে বলি-
– নীলা?
– হুম,
– আমার দিকে তাকাও। দেখো আমাকে, আমি কি তোমাকে কখনো কিছু বলেছি?
– নাহ,
– তাহলে? মানুষের কথায় কান দাও কেন! মানুষের কথায় কি এসে যায় হু? যেদিন আমি বলবো সেদিন কষ্ট পাবে। বুঝেছো?
– হুম।
আমার কথা শুনে ও চুপ হয়ে যায় ঠিকই কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে সব সময় কষ্টে কষ্টে মরে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারি। প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরে ওর মলিন মুখটা যখন দেখি খুব খারাপ লাগে, অথচ কিছুই করতে পারিনা!
চুপ করে আছি দেখে ও বলে উঠে-
– আবির,
– হু, বল, কিছু বলবা?
– অনেক ভেবে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– কি?
– আগে বল, রেগে যাবেনা?
– আচ্ছা, কি এমন কথা? যা শুনে রাগতে পারি!
– আমি তোমার বিয়ে দেবো।
– কিহ!!! পাগল হইছো? মাথা ঠিক আছে তোমার?
– আগে ছিলো কিনা জানিনা, তবে এখন ঠিক আছে।
– ঠিক থাকলে এমন উদ্ভট চিন্তা আসতো না তোমার!
– তুমি যায় বলো, আর যায় বোঝাও না কেন, এটা আমার আগেই ভাবা উচিৎ ছিল। এতদিন তোমাকে হারানোর ভয়ে এসব ভাবতে পারিনি! বলতে পারো সাহস করে উঠতে পারিনি। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম আমি আসলেই স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম! আম্মা, গুরুজনেরা যা বলেন ঠিকই বলেন। সত্যিতো, ভবিষ্যৎ বংশ রক্ষা বলে একটা ব্যাপার আছে! আমি এতদিন তোমাকে কারর সাথে ভাগাভাগি করতে পারবো না ভেবেই এই বিষয়ে ভাবিনি। কিন্তু এখন আমি মনস্থির করে ফেলেছি।
– কিসব আজেবাজে বকো? তুমি ভাবছো কি করে, শুধুমাত্র বাচ্চা হয়না বলেই আমি তোমার উপরে এতবড় অন্যায় করবো? আজ আমার জায়গায় তুমি থাকলে, তুমি কি তাই করতে পারতে? পারতে নাতো !
– আমার আর তোমার ব্যাপার ভিন্ন। আমি শুধুমাত্র নিজের কথা ভেবে এতবড় অন্যায় করতে পারিনা।
– অন্যায়ের তুমি কি বুঝো? হু! এসব বাদ দিয়ে ঘুমাও। যত জেগে থাকবা, ততই মাথায় আজেবাজে ভাবনা ঢুকবে!
আমার কথা শুনে, নীলা কি বুঝে জানিনা, রাতের সমস্ত কাজ গুছিয়ে ও শুয়ে পড়ে। সারাদিন সংসার সামলিয়ে তারপর এই সব চিন্তাভাবনাই বোঝা যায় ও অনেক বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে!মাত্র কয়দিনেই চোখের নিচে কালি ও জমেছে। এত করে বুঝাই তবুও বুঝেনা! কে কি বললো সে নিয়েই ভেবে মরে! ইদানীং আমিও অফিসের এটা সেটাই ব্যস্ত থাকি, ওর দিকে সেভাবে নজরও দিতে পারিনা! নাহ আমার মনে হয় ওকে আরো একটু সময় দেওয়া উচিৎ। ও বুঝেনা, আমি শুধু সন্তানের জন্য ওকে ভালবাসিনা! ওর জন্যই ওকে ভালবাসি! প্রয়োজনে অন্য কোন ব্যবস্থা নেবো তাই বলে ওকে দেয়া প্রতিজ্ঞা আমি ভুলে যাবো, ও ভাবছে কি করে!
এইতো কয় বছর আগেও ও কতটা প্রাণোচ্ছল চঞ্চল ছিল! সত্যি বলতে, আমি ওর ওই চঞ্চলতা দেখেই ওকে ভালবেসেছিলাম। সেদিন ভার্সিটিতে একটা প্রোগ্রাম চলছিল। আমি তখন থার্ড ইয়ারে, আর ও সবে মাত্র ক্লাশ শুরু করেছে। পরিচয় টাও সেইরকম কাকতালীয় ভাবেই!
আমার এখনো মনে আছে, সেদিন বিকেল বেলা অলস হয়ে শুয়ে ছিলাম- হঠাত- ইমন এসে বললো-
– এই আবির চল, উঠ, এক জায়গায় যাবো।
– কোথায়?
– ভার্সিটির ক্যাম্পাসে!
– কেন?
– দেখে আসলাম কিসের যেন অনুষ্ঠান চলছে।
– ও তো ডেইলি ডেইলি হয়! এটা কি আর এমন নতুন কথা!
– নতুন কথা হল, তুই আমি এখন সেখানেই যাবো।
– ধুর, তখন থেকে কিসব ভাঙা রেকর্ডের মত বকেই যাচ্ছিস! বলছিতো এসব আমার ভাল্লাগেনা।
– আরেহ চল ব্যাটা। রুমে তো শুয়েই থাকবি। তারচেয়ে কিছুক্ষণ গান টান শুনে আসি।
– যেতে পারি, এক শর্তে,
– কি শর্ত?
– তুই কিছু খাওয়াইবি।
– ওহ, এই কথা? যা- খাওয়াবো। ঝটপট উঠে রেডি হয়ে নে।
ওর কথা শুনে একরকম বাধ্য হয়েই ক্যাম্পাসে যাই। বিরস মনে একপাশে আমি আর এমন ইমন গিয়ে দাঁড়াই। মাইকে কি যে বলে- কিছুই বুঝিনা! হঠাত দেখলাম একটা সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরা মেয়ে মাইক্রোফোন নিয়ে দাঁড়ালো।
মেয়েটিকে দেখেই চমকে উঠি! আরেহ এত স্নিগ্ধ শুভ্র মেয়ে এই ক্যাম্পাসে! এর আগে তো দেখিনি!
ইমনের ঘাড়ে হাত চাপিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মেয়েটিকে দেখে নড়েচড়ে দাঁড়াই। আমার অবস্থা দেখে, ইমন বলে-
– ধুর ব্যাটা একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। এত নড়িস কেন!
– মেয়েটি কে রে? এর আগেতো দেখিনি।
– কার কথা বলছিস?
– এই যে, যে এখন কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে?
– কেন ব্যাটা? এত ঠিকুজী কুষ্ঠি জেনে তুই কি করবি?
– সেটা পরে বলছি, আগে বল?
– আরেহ, ও তো বাংলা ডিপার্টমেন্ট এর। নতুন এসেছে।
– তুই চিনিস?
– ওই হালকা পাতলা। মেয়েটা ভাল কবিতা লেখে, আবৃত্তি ও ভাল করে।
– তুই ওর খবর নে, ওর সাথে আমাকে যেমনে পারিস যোগাযোগ করিয়ে দে।
– আমি কেমনে পারুম? আমি কি ওর বন্ধু লাগি? না ভাই ব্রাদার লাগি? অদ্ভুত! তোরে নিয়ে আনাটাই ভুল হইছে। সাথে আবার খাওয়ানো বাবদ লস!
– যা তোকে খাওয়াতে হবেনা, মাফ কইরা দিলাম।
– এমনভাবে বলছিস যেন ধার করছি, তার মাফ দিচ্ছিস!
– যেটা বলছি সেটা কর। বকবক বাদ দিয়ে, আজকেই খবর নে। বাসা কই, নাম কি সব।
– বাসা কই জানিনা, নাম জানি।
– নাম কেমনে জানলি?
– ওই যে কবিতা আবৃত্তির আগে মাইকে নাম এ্যনাউন্সমেন্ট করলো তাই শুনেছি। কেন, তুই শুনিস নাই?
– খেয়াল করি নাই।
– তো এখন এত উৎসাহ কেন! তাছাড়া তুই কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট, বাংলা ডিপার্টমেন্ট এর মেয়েতে তোর কি কাম!
– সে তুই বুঝবিনা।
– যা বলছি তাই কর।
তারপর থেকে ইমনের পিছনে লেগে থাকি, অবশেষে, ইমন অনেক বুদ্ধি করে ওর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর থেকে দুইজন দুই বিভাগের হয়েও আসতে আসতে চেনাজানা, সম্পর্ক। একসময় আমরাই ভার্সিটির সেরা কাপোল! ভার্সিটির এমন কেউ ছিলনা, যে আবির- নীলা এই নাম দুটি চিনতো না।
সম্পর্ক টা তখন একদম তুঙ্গে! কেউ কাউকে একদিন না দেখলে, না কথা বললে থাকতে পারিনা। যেই আমি কবিতা টবিতা পছন্দ করতাম না, সেই আমি কিনা ওর কবিতার ভক্ত হয়ে উঠলাম! অদ্ভুত সুন্দর কবিতা লিখতো ও! মুগ্ধ না হয়ে পারা যেতো না! আর ও বেশিরভাগ কবিতা আমাকে নিয়েই লিখতো। আমি ওর পাশে বসলে ও সে সব শুনাতো।
সময় দ্রুত শেষ হয়ে যায়! আমার তখন মাস্টার্স শেষের দিকে, আর ও তখন সবেমাত্র সেকেন্ড ইয়ারে। আমি বের হয়ে যাবো ভেবে নীলার সেই কান্না! বলে আমাকে না দেখে ও থাকবে কি করে!
ওকে অনেকভাবে বুঝাতে হয়েছে, তুমি পড়াশোনা কর, এর ফাঁকে আমি চাকরী জোগাড় করি। তাছাড়া বের হয়ে গেলেও সপ্তাহে তো একবার দেখা হবেই। এত মন খারাপ করোনা প্লিজ। শুনে ও বলতো-
– আবির, তুমি কথা দাও দিনে অন্তত একবার এসে দেখা দিয়ে যাবে।
– পাগলি, চাকরী না হওয়া অব্দি বলছো, সে না হয় ঠিক আছে, কিন্তু চাকরী হলে কিভাবে রোজ আসবো তুমিই বল!
– হুম্মম বুঝছি। কিন্তু আমার তো খুব কষ্ট হবে!
– সেতো আমারো হবে? আমি কি তোমায় না দেখে ভাল থাকবো?
– হুম্মম, জানি। কিন্তু একটা কথা।
– কি!
– আমি তোমার সামনে থাকি বা না থাকি, তুমি কিন্তু কোন মেয়ের দিকে তাকাবে না।
– আচ্ছা, চোখ আছে যখন তাকাবো না?
– কি বললা?
– আচ্ছা আচ্ছা সরি। এমনি মজা করছি। আচ্ছা তুমিই বল আমার এমন পাগলি টা থাকতে কি আমি আর কারর দিকে তাকাতে পারি? কখনওই না!
ও সব সময় এমনি সব পাগলামো করতো। তারপর আমি যেদিন ফাইনালি বের হয়ে আসি। আমি বের হওয়ার এক বছর এর মধ্যে জব পাই।
চার বছরের সম্পর্ক তখন চলছে- অফিস শেষে ওর সাথে দেখা করার সুযোগ খুব কম হত। এই নিয়ে ওর প্রায় গোমড়া মুখ দেখতে হতো। অভিমান করে ও তখন বলতো-
– আবির, তুমি আমাকে আগের মত আর ভালোবাসো না!
– কে বলেছে বাসিনা?
– আমি বুঝতে পারি! আগে কতটা আমার জন্য পাগল ছিলে, আর এখন!
– আরেহ, পাগলি, ব্যস্ত থাকি বুঝতে হবেতো! তাছাড়া তোমাকে ঘরে তুলতে হবেনা? একটু গুছিয়ে নিচ্ছি। বুঝোয়তো।
– আমার অতো বেশি কিছু লাগবেনা। তুমি থাকলেই চলবে।
– তোমার লাগবেনা , কিন্তু আমার হবু শশুরের তো লাগবে , তাছাড়া আব্বু মারা যাওয়ার পর আম্মা আমাকে একা হাতে মানুষ করেছেন, তার ও তো কিছু দায়- দায়িত্ব আছে!
– হুম্মম।
– নীলা,
– হু,
– রাগ করছো?
– নাহ, আমি কার কে যে রাগ করবো!
– শোনো পাগলির কথা! আচ্ছা তুমি আমাকে না বুঝলে কে বুঝবে বলতো? তাছাড়া, আমি একটু গুছিয়ে না নিলে তুমি তোমার আব্বুর সামনে আমার কি পরিচয় দিবে?
– হইছে, আর বুঝাতে হবেনা!
– না এই যে তুমি সপ্তাহে একদিন দেখা করার জন্য রাগ করছো, বুঝোতো- বাকি দিন গুলো আমার কতটা স্ট্রেস এর উপর দিয়ে যায়! সারাদিন অফিস করে এতটা ক্লান্ত থাকি, যে বাসা থেকে এতদূর আসতে আর সময় পাইনা।আর হলের ও তো অনেকপ্রকার নিয়ম কানুন আছে, চাইলেও তো আর হয়না। তাছাড়া-
– তাছাড়া কি?
– শোনো, বিয়ের আগে একটু কম কম দেখায় ভাল। তাতে ভালবাসা বাড়ে।
– হুম বলছে তোমাকে! ঠিক আছে, তাহলে একবারই বিয়ে করতে এসো। তার আগে আর আসা লাগবেনা।
– হা হা হা, পাগলি! আমি কি তাই বলেছি!
এইভাবে ওর সাথে আমার সম্পর্ক টা চলতে থাকে। রাগ, অভিমান, ভালবাসার খুনসুটি তে মেশানো সেই সম্পর্ক!
এরই মধ্যে আম্মা আমার বিয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেন। একদিন আম্মা আমার রুমে এসে বলেন-
#চলবে…