গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব-২৪

0
1825

গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব-২৪
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

অতলের কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগছিল । মনে হচ্ছিল ভিতর থেকে কিছু একটা ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে। আর তাতেই রক্তের স্রোতধারা বয়ে যাচ্ছিল তার সমস্ত শরীরে। আর তার যন্ত্রণা সে ক্রমাগত অনুভব করছে। তাই আড্ডা থেকে এক ফাঁকে চলে এসেছে নিজেকে একটু রিল্যাক্স ফিল করানোর জন্য। সে শিহরণের রুমে এসেই প্রথমে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। বেসিনের সামনে দাঁড়াল । সামনে বড় একটা আয়না। আয়নাতে অতল তার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে আঁৎকে উঠল। এ কোন অতল! তার মনের মধ্যে প্রথমেই এই প্রশ্নটা এলো। চুল উষ্কখুষ্ক। চোখ দুটো কেমন যেন ফ্যাকাশে লাল হয়ে গেছে। এক কথায়, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। সে দ্রুত কয়েক ঝাপটা পানি দিলো মুখে। নাহ্! এখনো কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সে আবারো একটানা পানির ঝাপটা দিচ্ছে তার মুখমণ্ডলে। পানির ঝাপটাতে তার শার্টের সামনের বেশিরভাগ অংশই ভিজে গেছে। অথচ তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। পানির ঝাপটা দেয়া শেষে সে বেসিনের কিনারা ধরেই ফ্লোরে বসে পড়ল ধপাস করে। তারপর এক চাপা কষ্ট ভর করেছে তার সমস্ত শরীর ও মন জুড়ে । পানির কলটাও বন্ধ করেনি। পানি পড়ছে অবিরতভাবে।

শিহরণের রুম ফেলে বহ্নির রুমে যেতে হয়। বহ্নি যখনই শিহরণের রুম অতিক্রম করবে ঠিক তখন একটা আওয়াজ পেতেই সে ভাইয়ের রুমে উঁকি দিলো। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি সে ভুল শুনেছে! অবশ্যই না। তাই সে শিহরণের রুমের দরজা হাট করে খুলে প্রবেশ করলো । শব্দের উৎস রুমে নেই দেখে বের হতেই যাচ্ছিল। তখন আবার তার কানে বাজল একটা চাপা কান্নার শব্দ যা পানি পড়ার শব্দের সাথে মিশে খুব ক্ষীণ শোনা যাচ্ছে। যার উৎস ওয়াশরুম। সে তৎক্ষনাত ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেল। দরজা লাগানো বুঝতে পেরে কয়েকবার নক করলো। কোনো শব্দ আসছে না। শুধু কল থেকে অনর্গল পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে। আর তার সাথে থেকে থেকে চাপা আর্তনাদ। বহ্নি বুঝতেই পারছে এটা শিহরণ নয়। শিহরণ এখনো আসেনি রুমে । তবে অতলকে দেখেনি। সে তৎক্ষনাত অতল ভাইয়া ভলে ডাকল। কয়েকবার ডাকার পর অতল দরজা খুলল। দরজা খুলেই আবার সেখানেই বসে পড়ল। বহ্নি এতটা আশ্চর্য বোধহয় জীবনেও হয়নি যতটা আজ হয়েছে। অতলকে পুরোই বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। ছেলেরাও এমনভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়তে পারে সেই বিষয়ে বহ্নির কোনো ধারণাই ছিল না। অনেকক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থেকে বহ্নির মুখ থেকে অস্ফুটে বেরুলো ‘অতল ভাইয়া’।

সেই অস্ফুটে বেরুনো ডাকটা অতলের কর্ণকুহরের পাতলা পর্দাকে বেশ ভালোই প্রকম্পিত করেছে । হয়তো তাই অতল বহ্নির দিকে অসহায় চোখে তাকালো । এভাবেই কেটে গেলো কয়েকটা ক্ষণ। ঠিক কতক্ষণ কে জানে! মানুষের এভাবেই মাঝেমধ্যে কোনো সময় জ্ঞান থাকে না। থাকে শুধু মস্তিষ্কে বিরাজমান চিন্তার খেলা। এই যেমন বহ্নির চিন্তা একরকম আবার অতলের চিন্তা একরকম।

সম্বিৎ ফিরে পেতেই বহ্নি অতলকে টেনে তুলল ওয়াশরুমের ফ্লোর থেকে। অতলকে দুর্বল মনে হলো। আচ্ছা মন দুর্বল হলে কি শরীর ও দুর্বল হয়ে যায়! বহ্নির মনের এক অতি সাধারণ প্রশ্ন। অতলের ডান হাতটা বহ্নির বাম কাঁধের উপর রেখে বহ্নি অতলকে টেনে তুলল। তারপর অতি সাবধানে শিহরণের বেডে বসাল। তারপর চিন্তিত স্বরে নরম গলায় বলল,’কী হয়েছে, অতল ভাইয়া?’

অতল নিরুত্তর। তার মুখে কোনো শব্দ নেই। ঠোঁট দুটো হালকা ফাঁক করা। মনে হচ্ছে সে খুব করে বলতে চাইছে অনেক কিছু। কিন্তু বলতে পারছে না। পানিতে ভিজে যাওয়া অতলের চুপচুপে শার্টের দিকে তাকিয়ে বহ্নি বলল,’শার্ট তো একদম ভিজিয়ে ফেলেছ। ভাইয়ার থেকে একটা শার্ট দেব তোমায়?’

অতল শুধু মাথাটা উপর নিচে দুলাল। আর কিছু বলল না। বহ্নি শিহরণের কাবার্ড খুলে একটা শার্ট নিলো। তারপর সেই শার্টটা অতলের সামনে ধরে বলল,’এই নাও। এটা দ্রুত পরে ফেলো। নইলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।’

অতল নিস্তেজ চোখে তাকাল আবারো। বহ্নি শার্ট ধরে আছে আর অতল তাকিয়েই আছে। বহ্নি এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,’তুমি কি মেয়ে মানুষ নাকি? এভাবে মরা কান্না করতেছ কেন?’

অতল এবারো নিরুত্তর। যেন বোবায় ধরেছে তাকে। বোবায় ধরলে মানুষ যেমন চিৎকার করে অনেক কিছু বলে কিন্তু কেউ কোনো কথা শুনতে পায় না। ঠিক তেমন দেখাচ্ছে তাকে।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


বহ্নি এবার গলার স্বর নরম করে বলল,’মানিয়ে নিতে পারাটা মানব চরিত্রের সব থেকে বড় গুণ। জানো তো সেটা। তাই না? আর একটা কথা মনে রেখো, আজ তুমি যা ভাবছ তা ভবিষ্যতে পরিবর্তন হয়ে যাবে।’

অতল সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে বহ্নির দিকে। যেন সে বুঝতে পারছে না বহ্নি কী বলতে চাইছে! বহ্নি সেটা বুঝতে পেরে বলল,’আমার কথার মানেটা হলো, আজ তুমি হয়তো ভাবছ যে , তোমার ভালোবাসার মানুষটা ছাড়া তুমি অচল কিন্তু নিজেকে একটু সময় দাও দেখবে এই ধারণাটা হচ্ছে মানুষের সব থেকে বড় একটা ভুল ধারণা। কারণ , কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। ঘড়ির কাটা যেমন ঘড়ি সচল থাকা অবস্থায় বন্ধ হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব ঠিক তেমনি একজন মানুষের দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় তার জীবন থেমে যাওয়াটাও অসম্ভব । শুধু নিজেকে সময় দেওয়া প্রয়োজন । নিজেকে সময় দাও দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। সময় সব থেকে বড় রেমেডি। এই কথাটা শুধু মনে রেখ। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে সময়ের কিউর করার প্রবল ক্ষমতাটা বুঝতে পারবে।’

অতল এবার ধীরে ধীরে শার্টটা খুলতে শুরু করেছে। যেন বহ্নির বলা কথাগুলোতে সে শরীরে খানিক শক্তি পেয়েছে। অতলকে শার্ট চেইঞ্জ করতে দেখে বহ্নি মুখ ফিরিয়ে নিলো। অতলের দিকে আর তাকাচ্ছেই না।

অতল শার্ট চেইঞ্জ করার পর বহ্নিকে নরম সুরে ডাকল,’আগুনণি।’

বহ্নির মনে হলো কত বছর পর সে এই ডাকটা শুনেছে। কিন্তু সে ফিরলো না অতলের দিকে। এই কারণে অতলের হাসি পেলো। সে মৃদু হাসল। তার বিষণ্ণতায় ভরা চোখে মুখে দেখা দিল এক মৃদু হাসির রেখা। ঠিক যেমন চৈত্রের খর তাপে দগ্ধ কোনো ভূমির উপর আকাশ থেকে পতিত ঝিরিঝিরি বৃষ্টির এক ক্ষুদ্র পশলা। যা মুহূর্তের মধ্যেই পরিমাণে কম হওয়া স্বত্ত্বেও মনে দিয়ে যায় আনন্দের এক অকৃত্রিম দোলা।

‘আরেহ তাকা না আমার দিকে। শার্ট পরে ফেলেছি তো।’ অতল নিষ্প্রভ স্বরে বলল।

বহ্নি এবার তাকালো অতলের দিকে। এখন অনেকটা ঠিক লাগছে অতলকে। এতক্ষণ তো পুরোই দেবদাস ছিল। অভাব ছিল শুধু ওয়াইনের। তারপর বহ্নি অতলের পাশে গিয়ে বসল যদিও তার খুব সঙ্কোচ লাগছিল আজ। অতলের ডান কাঁধে একটা হাত রাখতেই অতল সেই হাতের উপর নিজের হাতটা রাখল। খুব শক্ত করে চেপে ধরল হাতটা। যেন এই হাতটাই তার ভরসার এক অনন্য স্থল। তারপর অতলের উপর কী ভর করলো কে জানে সে অঝোরে কেঁদে ফেলল। বহ্নি মুহূর্তেই বিমূঢ় হয়ে পড়ল। সে অতলের কান্না দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। অতলের কষ্ট যেন সে তার মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করছে। তার চোখেও অশ্রুবিন্দুরা হানা দিয়েছে। তার পর মুহূর্তেই সে অতলকে জড়িয়ে ধরল এক পাশ থেকে। যার উদ্দেশ্য শুধুই সান্ত্বনা দেয়া বা সমব্যথী হওয়া ।

রাদিদ বহ্নির পিছন পিছন এসেছিল। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছে সে । শেষমেশ শিহরণের রুম অতিক্রম করার সময় সে যা দেখল তাতে তার মাথার শিরা-উপশিরা রাগে দপদপ করছিল। তার সুন্দর হাসি সমপূর্ণ রূপে বিলীন হয়ে গেল। চোখ দুটো থেকে যেন আগুনের তেজ বের হচ্ছিল। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল । অতল আর বহ্নিকে এক সাথে এভাবে দেখে সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। তৎক্ষনাত সে সেই স্থান ত্যাগ করল ।

চলবে…..ইন শা আল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে