এসো শব্দহীন পায়ে পর্ব ৩

0
1113

এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ৩
মিশু মনি
.
মন্তাজ মাস্টার ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। খানাপিনা তৈরি হয়ে গেছে, পাত্রের খোঁজ নেই। পাত্রের মামা ও বন্ধু আলাদা ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। তারাও ছেলেটাকে ছাড়া খেতে বসবে না। কিন্তু সে গেছে কোথায় এটাই ভাব্বার বিষয়। নিশ্চয় ওয়ামিয়ার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য এলাকাবাসীকে চুপিচুপি কিছু জিজ্ঞেস করবে। যদিও মন্তাজ মাস্টারের অনেক সুনাম, এলাকাবাসী ওনাকে ভালোবাসেন বটে। তবুও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। দু একজন গোপন শত্রুর তো অভাব নেই। কে আবার কোন মতলবে ওয়ামিয়া সম্পর্কে ভুলভাল কথা বলে বিয়েটা ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করে এই ভয়েই উনি টতস্থ হয়ে আছেন।

তিতাস ফুরফুরে মেজাজে হাসতে হাসতে বাড়িতে ফিরে এলো। ওকে দেখেই মাস্টার সাহেব ছুটে এসে বললেন, কোথায় যাওয়া হয়েছিল বাবা? কোনো দরকার লাগলে আমারে বললেই হইতো। আমরা অনেকগুলা মানুষ তো রয়েছি বাড়িতে।
– না না চাচা। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি শুধু একটা ছোট্ট কাজে গিয়েছিলাম।
– ছোট্ট কাজ?
মাস্টার সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে এই গ্রামে প্রথমবার এসেছে। তাও আবার পাত্রী দেখতে। এখানে আবার তার কি কার্য থাকতে পারে? বড়ই চিন্তার বিষয়।
ওনার কুঁচকানো ভ্রু দেখে চিন্তাটা দূর করে দিতে তিতাস বললো, আমি দুটো ছবি তুলতে গিয়েছিলাম ।বিলে পাখি বসেছে অনেক, এই দেখুন।

ক্যামেরাবন্দি এক ঝাঁক পাখির ছবি দেখিয়ে মন্তাজ মাস্টারের দুশ্চিন্তা নিমেষেই দূর করে দিলো তিতাস। তারপর খাওয়াদাওয়ার জন্য তাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।

খাবারের এক পর্যায়ে তিতাস বললো, চাচা একটা কথা বলতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন তবেই..

মাস্টার সাহেব মুখ তুলে তাকালেন, জ্বি বাবা বলেন। কিছু মনে করবো না। আপনে হচ্ছেন মেহমান। মেহমানের কথায় কিছু মনে করতি হয় না বাবা।

তিতাস বললো, আমি যদি আজকের রাতটা আপনাদের এখানে থেকে যেতে চাই তাহলে কি কোনো সমস্যা হবে? আসলে গ্রামটা এত সুন্দর, আমি আগে এত সুন্দর গ্রাম দেখিনি। শহরেই মানুষ হয়েছি, গ্রাম আমার বড্ড ভালো লাগে। কিছু ছবি সংগ্রহ করবো আর ঘুরে ঘুরে দেখবো।
– এ তো বড় আনন্দের কথা। আপনে থাকেন। যতদিন ইচ্ছা থাকেন। কেউ কিচ্ছু বলবে না। আমরা আপনেদের সেবা করতি পারলে আরো খুশি হই।

ছোটমামা অবাক হলেন। তিতাসের মাথায় কি ঘুরছে কে জানে। আপা ও দুলাভাই আজকেই চলে যেতে বলেছেন। তবুও তিতাস থেকে যেতে চাইছে। গ্রাম তো পরেও দেখার সুযোগ হতে পারে। মতলবটা কি ওর? পাত্রী আদৌ পছন্দ হয়েছে কি না তাও তো বোঝার উপায় নেই।

তিতাস মামার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর অন্য ঘরে এসেই মামার কাছে ফোন চেয়ে নিয়ে কল দিলো তিতাস। কল করেছে তার নিজেরই নাম্বারে। মোবাইলটা রূপসাদের বাড়িতে ফেলে এসেছে ও। ভুল করে নয়, ইচ্ছেকৃত ভাবেই। ও চলে আসার পর নিশ্চয় রূপসা ওর বসার জায়গাটার দিকে একবার তাকাবে। তাকালেই ফোনটা ওর চোখে পড়বে। সে যার চোখেই পড়ুক, ফোনের খোঁজে আরেকবার ওই বাড়িতে যাওয়াটাই হচ্ছে তিতাসের উদ্দেশ্য। যদিও কাজটা রিস্কি হয়ে যায়, ফোনটা ফেরত পাবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও ফেলে আসা।

তিতাস চলে যাওয়ার পর সত্যিই সেখানে এসে একবার উঁকি দেয় রূপসা। চেয়ারের ওপর একটা বড় মোবাইল ফোন দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ উল্টে পাল্টে দেখে। স্ক্রিনে একবার স্পর্শ করে দেখে লক দেয়া আছে কি না। মজার ব্যাপার হচ্ছে ফোনে কোনো লক দেয়া ছিলো না। এই ব্যাপারটায় আরো চমকে যায় রূপসা।
ও মায়ের কাছে গিয়ে বললো, ‘লোকটা তো তার মোবাইল রাইখা গ্যাছে মা। আমি গিয়ে দিয়া আসি?’

মা সাথে সাথেই ফোড়ন কেটে বলে উঠলেন, ‘পুরুষ মানুষ দেখলে শইল্যে জ্বালা উঠে? তার মুখ দেখার জন্যি আবার যাইতে হবি? যার মোবাইল সে আবার আসবে খুঁজতে। আইলে দিয়া দিস কাহিনি শ্যাষ।’

রূপসা মন খারাপ করে নিজের ঘরে চলে এলো। কারো নিজের মা এভাবে মেয়েকে বলতে পারে এটা ওর মাকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। মা শব্দটা মহান, মধুর। সেই মা কি করে এমন বিশ্রী ভাষায় মেয়েকে কথা শোনাতে পারেন সেটা ভেবেই ওর কষ্ট হয়।

এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। নাম্বার সেভ করা ‘choto mama’ নাম দিয়ে। রূপসা ফোন মিউট করে রেখে দিলো। মায়ের কাছে নিয়ে গেলে আবার কথা শোনাবে। তারচেয়ে বরং না জানানোই ভালো।
আবারও কল এলো সেই নাম্বার থেকে। এবারও রিসিভ করলো না। ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কি করবে ও?
স্ক্রিনে ছেলেটার ছবি। সুদর্শন চেহারা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। কিন্তু কোঁকড়ানো চুল আর মায়াবী হাসিতে দারুণ লাগছে। ছবিটা দেখে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।

তৃতীয়বার কল আসার পর রূপসার মনে হলো, হয়তো ছেলেটাই ফোন করে মোবাইল খুঁজছে। এবার অন্তত রিসিভ করা উচিৎ।

ওপাশ থেকে তিতাসের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘হ্যালো হ্যালো। কথা বলুন, হ্যালো।’

রূপসা বিনয়ের সহিত সালাম দিলো। তিতাস সালামের জবাব দিয়ে বলল, আপনি কি রূপসা?
– জ্বি। আপনি কে? আমাকে কিভাবে চিনলেন?
– আমার মনে হচ্ছিল আপনি ই রূপসা। আপনার নাম শুনেছি চাচার কাছে। আমি তিতাস। আমার ফোনটা ভুলে আপনাদের বাসায় ফেলে এসেছি।
রূপসা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, আচ্ছা। এসে নিয়ে যাবেন। আপনার ফোন সহীহ সালামতে আছে। এক পার্সেন্ট চার্জও শেষ হয়নি।
– হা হা হা।
– হাসবেন না। আপনার হাসি শুনলে আমারও হাসি আসবে। আর মেয়েদের হাসির শব্দে শয়তান এসে হাজির হয়।
– কিহ? হা হা হা। আপনি তো খুব মজার মানুষ।
– জ্বি। কিন্তু আপনি মজার নন। আপনি মিথ্যা কথা বলেন। তখন কেন বললেন ছবি তুলতে এসেছেন? আপনি তো আমাকে দেখতে এসেছেন।

তিতাসের আরো একবার উচ্চ হাসির শব্দ শোনা গেলো। ও হাসি থামাতেই পারছিল না। পাত্রী দেখতে এসে এভাবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মত হাসলে বিয়ে তো দূরের কথা, পাত্রের নামে বদনাম ছড়াবে। হাসি চেপে রেখে তিতাস বললো, আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি আপনাকে দেখতে গেছি?
– আপনি সকালে আমার ছবি তুলে নিয়ে গেছেন। কথাটা আমি চাচাকে বললে কি হতো জানেন? লঙ্কাকান্ড বেঁধে যেত।
– পেয়াজকান্ড বাঁধলেও আমার সমস্যা নেই। কারণ আমি সকালে আপনার ছবি তুলি নি। তুলতে চাইও নি বিশ্বাস করুন। আপনি আপনাদের জানালাসহ শিউলি গাছটার ছবি তুলেছিলাম। বাসায় এসে দেখি জানালায় আপনার মুখ দেখা যাচ্ছে।

রূপসা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ওহ আচ্ছা। তাহলে আপনাকে অযথা ভুল বুঝেছি।
– সমস্যা নেই। ভুল বুঝলে যদি কেউ মজা পায়, তবে ভুল বোঝাটা ভালো।
– মজা কে পেয়েছে?
– আমি। আপনার কথা শুনে। হাসি থামাতেই পারছি না বাবাহ।
– ছেলেরা এত সামান্য কথায় হাসে না। তবে, যারা হাসে তারা অনেক দিলখোলা হয়।

তিতাস মুগ্ধ হয়ে বললো, এই তথ্য কোথায় পেলেন?
– আমার দর্শন থেকে বলেছি।
– বাবাহ! আপনি তো দেখি দার্শনিক।
– আমি ফোনটা রাখছি। আপনি এসে আপনার ফোন নিয়ে যাবেন। আর দয়া করে আমার ছবিটা ডিলিট করে দেবেন।
– আপনার কাছেই তো আছে। গ্যালারিতে ঢুকে ডিলিট করুন না।
– আমি অন্যের ফাইলে ঢুকি না।
– নিষিদ্ধ কিচ্ছু নেই। আপনাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলো।

এমন সময় মায়ের গলা শুনতে পেয়ে ফোনটা দ্রুত লুকিয়ে রাখলো রূপসা। একবার দরজার দিকে উঁকি দিয়ে আবার ফোন বের করে সাইলেন্ট করে বালিশের নিচে রাখলো। বালিশে চিৎ হয়ে শুয়ে একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। হাতে একটা চিমটি কেটে ‘আউ’ শব্দ করে উঠলো। তারপরও মনে হচ্ছিল এতক্ষণ যা হচ্ছিল সবকিছু স্বপ্নেই হচ্ছিলো। কারণ রূপসা একজন শান্ত মেয়ে। পরিচিত কারো সাথেই ও খুব বেশি কথা বলে না। অপরিচিত দের সাথে তো একেবারেই নয়। আজ আচমকা কারো সাথে ফোনে কথা বলে ফেললো তাও আবার একগাদা। নিঃসংকোচে। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে ওর। এটা কি করে সম্ভব?

রূপসা বেশিরভাগ সময়ই ঘরে কাটায়। জানালার পাশের বিছানাটায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুধু গল্পের বই পড়ে। বই পড়তে ওর খুব ভালো লাগে। মা গল্পের বই পড়তে দেখলে রাগারাগি করেন। তাই বাড়ির সব কাজে মাকে সাহায্য করে, সবকিছু সামলে তারপর নিজের ঘরে এসে বই পড়তে হয় ওকে। বই কিনে পড়ারও সুযোগ নেই। বেশিরভাগ সময়ই চাচাতো বোন স্কুলের লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তে দেয়। আবার কখনো বান্ধবীরা চুপিচুপি দিয়ে যায়। এইভাবেই চলছে ওর বই পড়া।

একবার শখ করে একটা বই কিনেছিলো রূপসা। মা বিষয়টা জানার পর সোজা মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন, আইজ থাইকা ভাত খাইস না। গল্পের বইয়ের পাতা ছিইড়া ছিইড়া খাইস।
সেইদিনের পর থেকে আর কখনো বই কেনার দুঃসাহস হয়নি রূপসার।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে