এসো শব্দহীন পায়ে পর্ব ১৭

0
916

এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ১৭
মিশু মনি

সাহিল নাস্তা সামনে নিয়ে অপেক্ষা করছে রূপসার জন্য। রূপসার মা বারবার মেয়ের ঘরে গিয়ে ওকে তাগাদা দিয়ে আসছেন। তবে তারাতাড়ি আসার জন্য নয়, তারাতাড়ি সাজগোজ সেরে নেয়ার জন্য। রূপসা শুধু মুখে পাউডার লাগিয়ে ছেলের সামনে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মায়ের নির্দেশ ক্রিম লাগাতে হবে, লিপস্টিক লাগাতে হবে, কাজল মাশকারা সব লাগিয়ে তারপর সুন্দরভাবে যেতে হবে। তার কথামতে, ছেলে শহরে মানুষ। সুন্দরী মেয়েদেরকে দেখে দেখে অভ্যস্ত। গ্রামের সাদাসিধা মেয়েদেরকে দেখলে নাকি আষাঢ় মাসের আকাশের মত লাগবে। তাই উনি আশ্বিন মাসের নীল ঝকঝকে আকাশের মত মেয়েকে উপস্থাপন করাতে চান। যাতে ছেলেটার মন অন্যদিকে ঘুরে না যায়। মেয়ের সৌন্দর্যে হবু জামাইকে বধ করে রাখতে হবে।

রূপসা অতি সন্তর্পণে সাজসজ্জা সম্পন্ন করে ফেলে। শাড়ি পরে খুব যত্ন করে কুঁচি ঠিক করে, চুলে ক্লিপ দিয়ে ডিজাইন করে বাঁধে। চোখে দেয় কাজল, কপালে টিপ, ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিপ৷ সাজে যেন কোনো কমতি না থাকে। খোপায় গাজরা পরে তার উপর ঘোমটা টেনে দেয়। আজকে ভীষণ গরম পরেছে। শাড়ি পরে কতক্ষণ থাকতে পারবে কে জানে। তবুও মায়ের আদেশ, পালন না করবার জো নেই।

রূপসাকে দেখে ক্ষণিক মুহুর্ত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সাহিল। প্রথমদিন যেমন সাধাসিধা লেগেছিল, আজ সেরকম লাগছে না। চেহারায় একটা লাবণ্য ফুটে উঠেছে। সৌন্দর্যের ষোলকলা পূর্ণ করতে আজকে আবার সাজসজ্জাও করেছে। সাহিল মুচকি হেসে রূপসাকে বসতে বলে।

রূপসা সাহিলের সামনে জড়োসড়ো হয়ে বসে। মা পিছনে দাঁড়িয়ে সৌজন্যতা প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। রূপসার ইচ্ছে করছে উঠে পুরো গ্রাম হেঁটে হেঁটে ঘুরে আসতে। সবাই ওকে দেখে অবাক হয়ে তাকাবে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করবে কি গো তুমি এত সাজছো কেন? আইজ কি তোমার বিয়া?
কেউ আবার জিজ্ঞেস করবে কইন্যার রূপে আকাশের চান মাটিত লুইট্যা পড়ে৷

তখন রূপসার খুব আনন্দ হবে। কিন্তু রূপসা বেশ ভালো করেই জানে ওর কল্পনাগুলো সারাজীবন অধরাই থেকে গেছে। কল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব হতে পারে নি। হয়তো কখনো পারবেও না। কোনোদিনও বিনা কারণে এই গ্রামে ঘুরে বেড়াতে পারবে না, পারবে না কখনো কারো প্রশংসা শুনতে। সেই সুযোগ আজ অব্দি কেউ পায় নি। সাহিলের কপাল ভালো হলে প্রশংসা করার সুযোগ পেতেও পারে।

মনেমনে হেসে উঠে রূপসা।

সাহিল বলল, ‘তুমি খাচ্ছো না যে?’

সামনে নারিকেল পিঠা রাখা আছে। রূপসার খুব পছন্দের। ও একটা পিঠা তুলে নিয়ে মনেমনে ভাবে, ‘তিতাস প্রথমদিন এসে নারিকেল পিঠা খেয়েছিলো।’
কথাটা মনে হতেই পিঠাতে আর কামড় দিতে পারলো না রূপসা। মুখের সামনে থেকে ফিরিয়ে আনলো। সাহিল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রূপসা বলল, ‘মা। ঘরে তো বেল আছে। বেলের শরবত করে দেই ওনারে?’
– ‘আমি কইরা দিতেছি। তুই এইখানে থাক।’

মা চলে গেলেন ভেতরে। রূপসা কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে বললো, ‘আমাকে কেমন লাগছে সাহেব?’
– ‘খুব সুন্দর লাগছে।’
– ‘পরীর মত সুন্দর?’
– ‘হ্যাঁ। পরীর মত?’
– ‘পরী দেখছেন জীবনে?’
– ‘না দেখি নাই।’
– ‘তাহলে বললেন কিভাবে? আমি তো ভাবছিলাম আপনি জ্বীন পরী ধরা ছেলে।’
– ‘জ্বীন পরী ধরা মানে?’
– ‘মানে ছেলেরা বেশি সুন্দর হলে তাদের ঘরে পরী আসে।’

সাহিল মনে হচ্ছে বেশ অবাক হয়েছে। জিজ্ঞেস করলো, ‘পরীরা ঘরে এসে কি করে?’

রূপসা মুখ টিপে হেসে বলল, ‘ তার সাথে ঘুমায়। তাকে পিঠে তুলে পরীদের রাজ্যে নিয়ে যায়।’
– ‘যাহ। কি বলছো এসব? তা কখনো হয় নাকি?’
– ‘খুব হয়। আমাদের গ্রামেই এরকম অনেক ছেলে আছে। যাদেরকে পরী ধরছে।’
– ‘কই আমাকে তো ধরে নি।’
– ‘আপনি তো বললেন আমি পরী। আমি আপনার উপর ভর করবো। সেজন্য ওরা আপনাকে ধরে নাই।’
রূপসার কথা শুনে বিস্মিত নয়নে চেয়ে রইলো সাহিল। ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না কথাগুলো। এ আবার কখনো সম্ভব নাকি? ওর ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা দেখে রূপসা বলল, ‘ভয় পেলেন নাকি? আমি তো মজা করছিলাম।’

রূপসার হাসি দেখেও সাহিল সহজ হতে পারলো না। সে নিজেও হাসার চেষ্টা করলো। দাঁত বের হলো ঠিকই কিন্তু হাসির আসল চেহারা ফুটে উঠলো না। বিচ্ছিরি দেখালো। রূপসা মনেমনে কেবল ভাবলো, ‘লোকটা এত বিশ্রী ভাবে হাসে কেন!’

নাস্তা খাওয়ার পর্ব শেষ হলে সাহিল রূপসাকে বলে গ্রামটা ঘুরে দেখাতে। এ যেন কল্পনার ভেতর আরেকটি কল্পনা। রূপসা কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। যেখানে একাকী বাইরে বের হতে সাহস পায় না ও, সেখানে একজন পুরুষ লোককে নিয়ে। ওরে বাপ রে!
রূপসার মা পাশেই ছিলেন। শরবতের গ্লাস নিয়ে এসেছেন তিনি। শরবত এতটাই ঘন যে কামড়ে কামড়ে দিয়ে খেতে পারবে সাহিল। চিনি একেবারেই কম হয়েছে। লবণ কিঞ্চিত বেশি। সাহিল ভদ্রতাসূচক কয়েক ঢোক খেয়ে গ্লাসটা রেখে দিলো। গলাটা কেমন যেন হয়ে গেলো।
রূপসার মা বললেন, ‘বাবা এলাকার লোকজন তো ভালো না। একসাথে বাহির হইলে নানান কথা হবে। বুঝতি পারিছেন?’
– ‘বেশি দূরে যাবো না। আশেপাশে ঘুরে দেখি?’
– ‘বিবাহের পর অনেক দেখতি পারবেন। এখন বাড়িতেই বসে কথাবার্তা বলেন।’

রূপসার মা গ্লাস ও প্লেট নিয়ে চলে গেলেন। রূপসা হেসে ফেললো। ফিসফিস করে বলল, ‘এখানে এসব চলবে না। অন্য কারো বাড়ি হলে আলাদা ব্যাপার। আমাদের বাড়ির মেয়েদের সেই দুঃসাহস করা যাবে না।’
– ‘হুম। শুনেছি অনেক কনজার্ভেটিভ ফ্যামিলি। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হবে। চলো পুকুরপাড়ে গিয়ে বসি?’

রূপসা উঠে দাঁড়ায়। ধীরপায়ে হাঁটতে থাকে সাহিলের সাথে। সাহিল রূপসার চেয়ে বেশি একটা লম্বা নয়। দুজনের উচ্চতা প্রায় কাছাকাছি। রূপসা মনেমনে ভাবছে, ‘এ জীবনে আমার আর উঁচু জুতা পরা হবে না।’

পুকুরপাড়ে গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর বসে দুজনে। মাঝখানে বেশ খানিকটা দূরত্ব। রূপসার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। এই প্রথম কারো সাথে এভাবে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে ও।
সাহিল বলল, ‘তোমার শখ কি কি?’
– ‘আমার কোনো শখ নাই।’
– ‘কি বলো? মানুষের শখ থাকবে না কেন?’
– ‘একটা স্বপ্ন আছে। একটা বইয়ের লাইব্রেরি দেয়া। আর শখ হচ্ছে অনেক বই লাইব্রেরিতে এনে রাখা।’
– ‘আর কিছু নেই?’
– ‘না।’

সাহিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার প্রিয় নায়ক কে?’
– ‘সালমান শাহ।’
– ‘হিন্দি নায়কের মধ্যে?’
– ‘শারুখ খান।’
– ‘ওর নাম শাহরুখ খান। শারুখ নয়।’
– ‘একই তো। হিন্দি ছবি দেখার সুযোগ নাই। এমনিই নায়কটাকে চিনি আরকি। একবার চাচার ঘরে সিডিতে দেখেছিলাম।’
– ‘তোমাদের বাড়িতে টিভি নেই কেন?’
– ‘আব্বা পছন্দ করে না। বলে শয়তানের বাক্স।’
– ‘ওহ আচ্ছা।’

আবারও নেমে আসে নীরবতা। বোধহয় দুজনের কেউই বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছে না। রূপসার মন ভীষণ ফুরফুরে। এখন অন্তত কথা বলার একজন মানুষ হচ্ছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। বিয়ের পর একটা লাইব্রেরি হবে। এটাও সুখের কথা। ওনার তো টাকার অভাব নেই। অনেক বই থাকবে রূপসার লাইব্রেরিতে।

সাহিল বলল, ‘আচ্ছা তোমার বাবার কি খুব রাগ?’
– ‘নাহ।’
– ‘ওহ আচ্ছা। তুমি কি সিনেমা হলে ছবি দেখতে চাও?’

রূপসা তাকিয়ে রইলো। প্রশ্ন বুঝতে পারে নি। সাহিল বলল, ‘পাশের এলাকায় একটা সিনেমা হল আছে। আমি আসার সময় দেখেছি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওখানে ছবিও চলে। চলো একদিন একসাথে ছবি দেখি। তোমার বাড়ি থেকে পারমিশন নিতে পারবে না?’
– ‘কিভাবে পারমিশন নেবো?’
– ‘মাকে রাজি করাবে। যেভাবে পারো। আমি তোমার হবু স্বামী, আমার কথা নিশ্চয় ফেলবে না। তুমি বুঝিয়ে বলবে যে আমার সাথে ছবি দেখতে চাও।’
– ‘আমি তো চাই না। আপনি চেয়েছেন।’

সাহিল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। লজ্জাও পেলো কিছুটা। কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। সিনেমা দেখার প্রসঙ্গটা আপাতত এখানেই স্থগিত রয়ে গেলো।

রূপসা বলল, ‘আপনার নাম শুনলে আমার কি মনে আসে জানেন?’
– ‘কি?’
– ‘কাহিল। সাহিল কাহিল।’

রূপসা হেসে উঠলো। সাহিল থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে। রূপসার হাসি দেখে নিজেও আর না হেসে থাকতে পারলো না। বললো, ‘তুমি ফাজিল আছো।’
– ‘হুম। মাইন্ড করলেন?’
– ‘না। মাইন্ড করি নি। তোমাকে সাজলে কিন্তু অনেক সুন্দর লাগে।’
– ‘আপনার কপাল ভালো।’
– ‘কেন?’
– ‘ভাবছিলাম জীবনে কেউ আমার প্রশংসা করবে না। আপনি করার সুযোগ পেলেন তাই।’

রূপসা হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে। সাহিল নিজেও হাসছে। মেয়েটা একটুখানি অদ্ভুত ধাচের। শাড়ির আঁচল বারবার মাথা থেকে পরে যাচ্ছে। রূপসা বারবার তুলছে। সাহিল একবার বলেছিল, আঁচলটা নামানোই থাক। রূপসা বলেছিল, ‘আচ্ছা। আর তুলবো না।’
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ‘তুলবো না’ শব্দটা উচ্চারণ করার পাশাপাশি ঠিকই আবার লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিয়েছিলো।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে