একটি পানকৌড়ির গল্প…!  পর্ব – ১ 

2
21322
একটি পানকৌড়ির গল্প…!
পর্ব – ১
আফতাব হোসেন তার চেম্বারে বসে বৃষ্টি দেখছিলেন। বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য তিনি জানালার গ্লাস সরিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু পানির ছিটা এসে দরকারী কাগজপত্র গুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো।  তাই তাড়াতাড়ি করে আবার গ্লাস লাগিয়ে দিয়েছেন। কী সুন্দর বৃষ্টি  হচ্ছে! ঝুম বৃষ্টি যাকে বলে।
এখন দুপুর ২ টা বেজে ১০ মিনিট। তার রোগী দেখা প্রায় শেষ। লাস্ট একজন রোগী আছে। বাইরে বসে ছিলো তার সিরিয়াল আসার আগেই মেয়েটা বমি করতে শুরু করলো। এখন নাকি ওয়াশরুমে আছে। পিএ ইউনুস তো তাকে এরকমই একটা ঘটনা শোনালো। অল্পবয়সী একটা মেয়ে নাকি। খুব মায়া হলো তার। তাই সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও সে রোগীর অপেক্ষায় আছেন। এমনিতে ২ টা বাজার সাথে সাথেই চেম্বার ছেড়ে বাসার উদ্দেশ্যে বের হন।
ইশ বৃষ্টির শব্দ টা যদি শোনা যেত। এককালে তাদের টিনের দোচালা ঘর ছিলো। বৃষ্টির শব্দ তখন বিরক্ত লাগতো আর এখন তার উল্টো! হিউম্যান ক্যারেক্টার যে কতোটা অদ্ভুত বলে বোঝানো যাবেনা।
দরজায় পরাপর তিনটা টোকা পড়ার পর ইউনুস দরজা খুলে বললেন
– স্যার রোগীকে আসতে বলবো?
– আসতে বলো।
আফতাব হোসেন ভাবছিলেন অল্পবয়সী মেয়েরা আজকাল পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি যে তার কাছে আসছে? এই মফস্বলে সাইক্রিয়াট্রিস্ট দের বলা হয় পাগলের ডাক্তার। সেখানে পাগল ছাড়া আসার সম্ভাবনা খুব কম।
দরজা দিয়ে যে মেয়েটি প্রবেশ করলো তাকে দেখে অবাক হলেন আফতাব হোসেন। একেবারেই অল্পবয়সী বয়স ১১-১২ বছর হবে। মেয়েটি খুব ফরশা তা না উজ্জ্বল শ্যামলা হবে কিন্তু ফ্যাকাসে গায়ের রঙটা। মেয়েটা হেলেদুলে হাঁটছে, মনে হচ্ছে এখনি পড়ে যাবে। সাথে ৩০-৩৫ বছরের একজন পুরুষ। দুজনের ব্যবহারে মনে হচ্ছে সম্পর্কটা বাবা – মেয়ে।
আফতাব হোসেন ধীর কণ্ঠে বললেন
– বসুন।
মেয়েটা বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। স্বাভাবিক পাগলের ডাক্তারের কাছে কেউই আসতে চায়না।
মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন
– তোমার নাম মামনী?
মেয়েটা তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।
– তোমার নাম বলো মা। তোমার যতো সমস্যা আছে সব বলো মা।
মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলতে শুরু করলো। ছাড়া ছাড়া ভাবে।
– আমি একটা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নটাতে আমি নিকশ অন্ধকার এক রাস্তায় হাঁটতে থাকি।
তারপর কিছুটা থামলো।
হোসেন সাহেব খেয়াল করলেন মেয়েটার কপালে মৃদু ঘাম। কিন্তু বেশ ঠান্ডা আবহাওয়া এখন। নিকশ কালো এই ধরনের বিশেষণ এতো অল্পবয়স্ক মেয়ের জানার কথা নেই। যদি সে বড়দের গল্পের বা উপন্যাসের বই না পড়ে থাকে।
মেয়েটি আবার বলতে শুরু করলো
– হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা সূক্ষ্ম  আলোর রেখা দেখতে পারি। যতো কাছে এগোই আলোর রেখা ক্রমশ সূক্ষ্মতর হতে থাকে কিন্তু হঠাৎ করে আলোর রেখা বিস্ফারিত হয়ে যায় এবং একটি পাথর বাহি ট্রাক আমার উপর উলটে এসে পড়ে। আমার পুরো শরীর পিষে যায়। কানে ক্রমাগত পাথরের শব্দ বাজতে থাকে। আমার দেহটা রাস্তার পিচের সাথে একদম মিশে যায়।
এমন অবস্থা হয় যে, বেলচা দিয়ে অবশিষ্টাংশ উঠাতে হয়। আর রক্ত মাংসের গন্ধ নাকে ভুরভুর করে ঢোকে।
মেয়েটা চুপ হয়ে গেলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম
– স্বপ্নটা কি একবার দেখেছো?
– নাহ,  সপ্তাহে দুদিন দেখি।
– কবে থেকে দেখছো?
– ৫-৬ বছর যাবত।
– স্বপ্নটা দেখো ঠিক কোন সময়ে? মানে রাতে ঘুমানোর সাথে সাথে নাকি ভোরের দিকে? নাকি মাঝরাতে?
– ভোরের দিকে। স্বপ্নটা দেখেই ঘুম ভেঙে যায় আর ঘুম ভাঙার পরপর পুরো শরীরে ব্যথা থাকে। নাকের কাছে সেই রক্ত মাংসের গন্ধটা!
– বমি হয় খুব?
– হ্যাঁ
– আজকে ভোরে সেই একই স্বপ্ন দেখেছো?
– হ্যাঁ, কিন্তু কীভাবে বুঝলেন?
– খুব সোজা মামনী। তুমি ঠিকঠাক মতো হাঁটতে পারছিলে না। তোমার বাবা না কী হন সে তোমাকে ধরে রেখেছিলেন। আর একটু আগেই তুমি বমি করে এসেছো। আমার পিএ ইউনুস বললো।
– আমার বাবা।
– গন্ধটা কতদিন থাকে?
– স্বপ্ন দেখার তিন দিনের মধ্যেই গন্ধটা থাকেনা একদম। আবার স্বপ্ন দেখি আবার গন্ধটা ফিরে আসে।
– তিনদিন গন্ধটা একইরকম থাকে নাকি পরিবর্তন আসে?
– আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
– পুরো শরীরে ব্যথা হয় নাকি নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গে?
– পুরো শরীরে কিন্তু মাথায় বেশি ব্যথা হয়। প্রথম দিন স্বপ্নের পরে বেশি ব্যথা থাকে।
– আচ্ছা। কোন ক্লাসে পড়ো মামনী?
– পড়াশোনা করিনা।
– তোমার নামটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি। নাম কী তোমার মামনী?
– ফারিয়া।
ফারিয়ার বাবাকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার। কী কী প্রশ্ন করতে হবে তারা জানা কিন্তু করতে ইচ্ছে করছেনা। স্বপ্নটা নিয়েই ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। স্বপ্নটা দেখার পিছনে কারণ অবশ্যই আছে। আর এই কারণ জানতে হলে তাকে ফারিয়ার বাবার সাথে কথা বলাটা জরুরি। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতেও তার ইচ্ছে নেই।
ফারিয়ার বাবাকে বললেন
– কিছু মনে করবেন না একটা রিকুয়েষ্ট করি?
ফারিয়ার বাবা অপ্রস্তুত ছিলেন এরকম কথা বলতেও পারে ডাক্তার সাহেব। তিনি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালেন।
– আপনি সন্ধ্যার পরে আমার বাসায় আসুন। আমার এখন খুব বিরক্ত লাগছে।
– আমাকে দরকার?
– জি, আমার বাসার ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। আপনি সন্ধ্যা ৭ টায় পৌঁছে যাবেন। আজ আমার ভালো লাগছেনা।
– আমরা যাবো?
– অবশ্যই, আর ফারিয়াকে একটু দেখে রাখবেন।
ফারিয়ার বাবা মানিব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার পুরাতন নোট বের করে ডাক্তারের হাতে দিতে গেলেন। আফতাব হোসেন বললেন
– আজকে নিবোনা। নিতে ইচ্ছে করছে না। মানে আজকে আমার কিছুই করতে ইচ্ছে করছেনা। বাসায় গিয়ে আমি টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবো।
কথা না বাড়িয়ে ফারিয়ার বাবা কালাম সাহেব চুপচাপ মেয়েকে নিয়ে চেম্বার ছেড়ে বের হয়ে এলেন। মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ তিনি। খুব কষ্টে সংসারের খরচ বাড়িয়ে তিনি এখানে এসেছেন। মেয়েটাকে তিনি খুব ভালোবাসেন। হয়তোবা এই পৃথিবীর সব বাবাই তার মেয়েকে ভালোবাসেন।
আফতাব হোসেন ধীর পায়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার গ্লাস খুলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বৃষ্টি থেমে গেছে কিছুক্ষণ হলো। এখনো বৃষ্টির রেশ কাটেনি পুরোপুরি!
চলবে……….!
© Maria Kabir

2 মন্তব্য

  1. একটু অন্য ধরনের থিম নিয়ে গল্পটা লেখা তাই ভালো লেগেছে। আশা করি পরে আরো ভালো ভালো গল্প পাবো ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে