আমার সন্তান

0
1246
পরশ ঘুমিয়ে পড়েছে। মিতু এখনো মুখ গোমড়া করে বসে আছে। বাসর রাতে প্রতিটা মেয়ে তার স্বামীর সাথে নতুন জীবন শুরু করে। আর সে রাতে যদি মেয়েটির স্বামী আগের সংসারের সন্তানকে বাসর ঘরের বিছানায় ঘুম পাড়ায় তাহলে কোনো মেয়েরই সহ্য হবার কথা নয়। মিতুরও সহ্য হয়নি। তাই মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। হুতুম পেঁচা যেমন করে বসে থাকে ঠিক তেমন। তার গায়ে লাল বেনারশি। যদিও বেনারশি শাড়ি আমার পছন্দ না। মিতুর গায়ের বেনারশি দেখে বুঝাই যাচ্ছে এর ওজন দশ কেজির মত হবে। একটু আগে ঘরে ঢুকে দেখি মিতু চোখ মুছে। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে আসাটা অবশ্যই কষ্টের। আমাকে দেখে মিতু খুব অবাক হল। আমার ডান হাতের আঙ্গুল ধরে আছে পরশ। তবুও মিতু এসে আমাকে একবার সালাম করে গেল। পরশ নতুন মানুষদের দেখলে হুট করেই মিশতে পারে না। অথচ টানা ছয় সাত মাস ধরে আমাকে আর আমার মা’কে বলে এসেছে তার মা লাগবে। আমি যেন তাকে মা এনে দেই। পরশের কপালে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। মিতু এতক্ষনের ভিতর কোনো কথা বলেনি। বিয়ের আগেই মিতুর পক্ষের মানুষের সাথে কথা বলে নিয়েছে আমার বাবা মা। আমিই শিখিয়ে দিয়েছি। বলেছি যেখানেই মেয়ে দেখতে যাবে অবশ্যই বলবে আমার একটি ছেলে আছে। এটা মেনে যদি কেউ বিয়ে করে তবেই আমি বিয়ে করব। কারণ আমার ছেলেটা অবহেলা পাবে, সেটা আমি মেনে নিতে পারব না। মিতুদের বাড়ি পাশের গ্রামে, শিলমান্দী। তার বাবা কৃষক, কলা গাছের বাগান আছে। সাথে বড়ই, পেঁপে, জলপাই সহ শাক-সবজি, তরকারির ফলন ফলায়। আমাদের সব কথা শুনে, বাড়ি ঘর দেখে তারা বিয়ে দিতে রাজী হয়েছিল। আমি বলেছি, তবুও আমি বিয়ের আগে মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই। সেদিন যখন বলেছি, মিতু আমার একটি ছেলে আছে। আর তাকে অবহেলা করলে আমি খুব কষ্ট পাব। তাকে মানতে পারলেই আমি তোমাকে বিয়ে করব। সেদিন মিতু বলেছিল, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি তাকে অবহেলা করব না। আদর ভালোবাসা দিয়েই রাখব। অথচ আজ আমাদের নতুন জীবনের শুরু। আজই মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। আমিও জানি বাসর ঘরে পরশকে আনা ঠিক হয়নি। কিন্তু পরশ নাছোড়বান্দা, আমাকে ছাড়া সে ঘুমাবে না। আমার মা পরশকে রাখতে চেয়েছিল। পরে দেখি কান্না করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলবে। বাধ্য হয়েই পরশকে নিয়ে এসেছি। মনে হচ্ছে মিতু বাকি রাতটা এভাবে মুখ ঘুরিয়েই বসে থাকবে। “পরশের মা বেঁচে আছে?” মিতুর মুখে এত নরম স্বরে কথা শোনে নিজেই অবাক হলাম। কোনো রাগ নেই, গলার স্বরে কোনো রুক্ষতা নেই। কী মোলায়েম গলার স্বর। শুধু আমার দিকে না তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে থেকেই প্রশ্নটা করল মিতু। আমি জবাব দিলাম, হ্যাঁ বেঁচে আছে। অন্য স্বামীর ঘর করছে। মিতু আমার দিকে ফিরে তাৎক্ষনিক প্রশ্ন করল, মানে? আপনাকে ছেড়ে গেছে নাকি আপনি ছেড়ে দিয়েছেন? -আমি ছাড়ব কেন? আমার চাচাত ভাই ছেড়ে দিয়েছে। পরশ আমার ভাইয়ের ছেলে। মিতু আবারো অবাক হল। মানুষ একজনমে অনেক অবাক হয়। কিন্তু একই সাথে অনেকবার অবাক হবার অভিজ্ঞতা সকলের থাকে না। মিতু প্রশ্ন করল, তাহলে বিয়ের সময় যে বললেন পরশ আপনার ছেলে? -আমি তো এখনো বলছি পরশ আমার ছেলে। আর সারা জীবন আমার ছেলে হয়েই থাকবে। সেজন্যই বিয়ের আগে সব বলে নিয়েছি। মিতু তাকিয়েই আছে আমার দিকে। চোখের পলক পড়ছে না। মুখটা ঈষৎ ফাঁক করে রেখেছে। অনেকেই কারো মুখ এতটুকু ফাঁকা থাকলে বলে উঠে,এই মুখ বন্ধ কর। মশা ঢুকবে তো। আমারো বলতে ইচ্ছে হল। কিন্তু আমি এই ব্যাপারে কিছু না বলে পরশের ব্যাপারে কথা বললাম মিতুর সাথে। আমার চাচাত ভাইয়ের নাম ফয়সাল। আমার চেয়ে চার বছরের বড়। ফয়সাল ভাই খুব রাগী মানুষ। আমার চাচী অবশ্য বলেন, বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হিসেবে রাগ থাকা স্বাভাবিক। আমিও কিন্তু বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার তেমন রাগ নেই। কেউ শালা বলে গালি দিলে আমি হাসিমুখে দুলাভাই ডেকে চলে আসি। মনকে শান্তনা দেই, শালা কোনো গালি নয়। আর আমার যেহেতু কোনো বোন নেই, কেউ শালা ডেকে যদি আনন্দ পায় আমি তার আনন্দ নষ্ট করতে যাব না। ফয়সাল ভাই বিয়ে করলেন চিনিশপুর গ্রামে। ভাবী খুব সুন্দর ছিলেন। একটু মডার্ণ টাইপ মেয়ে। রূপচর্চায় প্রথম সারিতে উনার অবস্থান। আশেপাশের দুই চার ঘরের মেয়েদেরও উপদেশ দিতেন, কী করলে ত্বক নষ্ট হয়ে যাবে। চুল লম্বা করতে হয় কিভাবে। মেয়েরাও গল্প গুজব করতে ভাবীর কাছে চলে যেত। আর গল্পের বিষয়বস্তু ছিল রূপচর্চা। ফয়সাল ভাই এসব মোটেই পছন্দ করতেন না। তবুও অনেক কিছুই মেনে নিতেন। কখনো ঝগড়া লেগে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতেন। ফয়সাল ভাই বিয়ে করার পর আমি তাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিলাম। সারাক্ষনই কোনো না কোনো মেয়ে ভাবীর সাথে বসা থাকত। চাচী আমার মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করত। মা আমাকে প্রায়ই বলত, তোকে বিয়ে করাব গরীব ঘরের সাধারণ মেয়ে। যে বউ হয়ে থাকবে। ফয়সালের বউয়ের মত নায়িকা হয়ে নয়। পরশ যখন ভাবীর পেটে, তখনো উনার রূপচর্চা এতটুকু কমেনি। গর্ভবতী মেয়েদের চেহারার কোমলতা থাকে না। কিন্তু ভাবী উনার ত্বক একটুও নষ্ট হতে দিবেন না। ফয়সাল ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করেও দুইবার ভাবী তার বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিল। ফয়সাল ভাই আবারো ফিরিয়ে এনেছেন। পরশ এল দুনিয়ায়। ভাবী পরশকে অবশ্যই আদর করত। প্রতিটি বাবা মা তার সন্তানকে আদর ভালোবাসা দিয়েই বড় করে। কিন্তু ফয়সাল ভাইয়ের ধারণা, ভাবী পরশের চেয়ে নিজের ত্বকের যত্ন বেশি নেয়। পরশের বয়স যখন দেড় বছর, তখন ফয়সাল ভাই একদিন ঝগড়া লেগে ভাবীকে বললেন, তুমি হয়তো এই রূপচর্চা ছাড়বে নয়তো আমার সংসার ছাড়বে। ভাবী রাগ করে পরশকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলেন। আমার আর ফয়সাল ভাইয়ের চেহারায় কিছুটা মিল রয়েছে। আমরা দু’জন অপরিচিত কোনো জায়গায় গেলে মানুষ অবশ্যই বলবে আমরা একই মায়ের পেটের ভাই। চাচাত ভাই সেটা মনের ভুলেও ভাববে না। এই কারণে একটা সমস্যাও দেখা দিয়েছে। পরশ ফয়সাল ভাইকে বাবা ডাকার পাশাপাশি আমাকে দেখলেও বাবা বলে ডাকে। আমার কাছে তার এই ডাক মধুর মত লাগত শুনতে। তবে পরশ আমার কোলে বেশি থাকত। কারণ ফয়সাল ভাই রাগী মানুষ। একটু এদিক সেদিন হলেই পরশকে ধমক দিয়ে কোল থেকে নামিয়ে দিত। সেজন্য পরশ ফয়সাল ভাইয়ের তুলনায় আমার আর ভাবীর কাছেই থাকত বেশি। ভাবী যখন রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছিলেন তখন ফয়সাল ভাই বলেছিলেন পরশকে রেখে যাও। ভাবী বলেছিল, পরশ যদি তোমার কাছে থাকতে চায় রেখে দাও। কিন্তু ছোট্ট পরশ মায়ের আঁচলকেই বেছে নিল। ফয়সাল ভাই দুইবার ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিল ভাবীকে। কিন্তু ভাবী আসবে না। পরশকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। ভাবীর একই কথা, তোমার সাথে গেলে নিয়ে যাও। কিন্তু পরশ মায়ের ভালোবাসাকেই বেছে নিল। ফয়সাল ভাইয়ের রাগ তখন চরমে। তিনি ছাড়াছাড়ির ব্যবস্থা করে ফেললেন। ভাবী যেহেতু আসবেই না তাহলে আর এই সংসার রেখে লাভ নেই। ফয়সাল ভাই আর ভাবীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। পরশ রয়ে গেল ভাবীর কাছেই। এর আড়াই মাস পরেই ফয়সাল ভাই আবার বিয়ে করলেন। সেই বিয়ের বর যাত্রীতে আমি যাইনি। আমি ফয়সাল ভাইয়ের দ্বিতীয় বিয়েকে মানতে পারিনি। তেমনি ভাবীর জিদ সমর্থন করেছি তেমনটাও না। ফয়সাল ভাই নতুন সংসার গোছাতে ব্যস্ত। একদিন হুট করেই ফয়সাল ভাইয়ের শ্বাশুড়ী পরশকে নিয়ে হাজির। এসে বললেন, তোমার ছেলে তুমি রেখে দাও। আমরা আমাদের মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি। ফয়সাল ভাই রেগে আগুন, আমি নেব না। দুইবার আনতে গিয়েছি তখন দিলেন না কেন? এখন পরশের জন্য মেয়ে বিয়ে দিতে পারেন না? নেব না আমি, পরশকে আপনারাই নিয়ে যান। ঘটনার দিন আমি ছিলাম চট্টগ্রামে। দুই দিন পর বাড়ি এসে মায়ের কাছে সব শুনেছি। মাসখানেক পর গ্রামের পঞ্চায়েতে শালিস ডাকা হলো। চিনিশপুর আর কাজলপাশা গ্রামের বিচারকরা উপস্থিত পঞ্চায়েতে। সারি সারি চেয়ার পেতে বসেছেন তারা। পরশকে নিয়ে ভাবী বিচারকদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন ডাকলেই সামনে আসতে পারেন। এতদিনে পরশের মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আজও তার রূপচর্চার কোনো কমতি নেই। চোখের উপরের ব্রু গুলো আরেকটু সরু করলে মনে হয় এখানে আর চুলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাবী আর তার মা এসেছেন পরশকে নিয়ে। নতুন স্বামীকে নিয়ে আর যাই হোক শালিসে আসা যায় না। হয়তো নতুন স্বামী জানেও না আজ তার স্ত্রীর একটি শালিস আছে। ফয়সাল ভাই মোড়া নিয়ে বসে আছেন। আমি ছিলাম দাঁড়িয়ে। চেয়ার বিচারক আর বয়ষ্ক মানুষদের জন্য। পরশ দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে। সে হয়তো জানে না আজকে তাকে নিয়েই এই শালিসের আয়োজন। শালিসের বিষয়বস্তু “ছেলে কার?”
দুই পক্ষের বক্তব্য শুনলেন বিচারকগণ। পঞ্চায়েত প্রধান ভাবীকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেকে তুমি নিবে না? ভাবীর মা আগ বাড়িয়ে উত্তর দিলেন। আমার মেয়েটার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে। তার নতুন একটি সংসার হয়েছে। তার স্বামী পরশকে মেনে নিবে না। আমি যে আমাদের বাড়িতে রাখব তারও উপায় নেই। পরশ সারাদিনই কান্নাকাটি করতে থাকে। ফয়সাল ভাইকে জিজ্ঞেস করা হল, তোমার ছেলেকে তুমি নিবে না কেন? ফয়সাল ভাই বললেন, তার যেমন সংসার হয়েছে, আমারো সংসার হয়েছে। আর আমি যখন দুইবার আনতে গিয়েছি তখন আমার কাছে পরশকে দেয়নি। তাছাড়া পরশ আমার কাছে থাকতে চায় না। তার মার কাছে থাকতেই পছন্দ করে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে