আফিম বড্ড নেশালো পর্ব-১৫+১৬

0
2950

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১৫
লেখিকাঃমাহযাবীন

“কোনো এক রাতের আকাশের নিচে ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোতে আপনার আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে উদ্দেশ্যহীন অনেকটা পথ চলতে চাই,আফিম।”
নাফিয়ার কথায় ঠোঁটে এক চিলতে হাসি টেনে আফিম বলে ওঠে,
-তবে আজ রাতটিই সে রাত হোক?
ঠোঁট হাসি টেনে সম্মতি দেয় নাফিয়া।

রাত ঠিক ১২ টা বেজে ১৫ মিনিটের মতো।রাস্তা সম্পূর্ণ জনমানব শূন্য তা বলা যাচ্ছে না।কারণ পথ চলার মাঝেই ১/২ জনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে।সেই সাথে খালি ২/৩ টে রিকশেরও দেখা মিললো।কিন্তু তাও পরিবেশ টা নিস্তব্ধ।ঠান্ডা বাতাস খুব বেশি না হলেও স্বস্তি দিচ্ছে।আকাশটা চাঁদ বিহীন কেমন যেনো শূন্য শূন্য কিন্তু তারার মেলায় বেশ লাগছে।
নাফিয়া ও আফিম উভয়ই হাত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে।অনেকটা সময় নিরাবতা চলার পর নাফিয়া নিরাবতা ভেঙে বলে ওঠে,
-আজ থেকে ঠিক ১০ মাস আগে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো।
একটু বিস্ময় নিয়ে ঠোঁটে আলতো হাসি টেনে আফিম বলে ওঠে,
-মনে রেখেছো দেখছি!
-রাখতেই হতো।যে কান্ড ঘটিয়ে ছিলেন!
-আর তুমি কি করেছিলে?
এক ব্রু উঁচু করে বলে ওঠে আফিম।
ঠোঁটে একটি চোরা হাসি টেনে নাফিয়া বলে ওঠে,
-কি করেছিলাম?
উত্তরে কিছু না বলে রাগী চোখে নাফিয়ার দিকে তাকায় আফিম।এমন রাগী চাহনিতে নাফিয়ার চোরা হাসি বিলীন হয়ে গেলো।সে নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে বলে ওঠে,
-আপনিই বাধ্য করেছিলেন।ওমন বাজে কথার উত্তরে যেকোনো মেয়ে ওমনটাই করতো।
-মাঝ রাতে ঝড়ের মধ্যে নিস্তব্ধ রাস্তায় একা একটি বোরকা পরিহিত কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে থাকে?
-জানি মাঝরাতে বোরকা পরে পতিতারা রাস্তায় ঘোরে।আসলে সেদিন টিউশনি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরার পথে মনে পরলো বাসায় কিছু বাজার দরকার তাই বাসার পথ ছেড়ে বাজারের পথ ধরলাম।বাজার বাসা থেকে দূরেই ছিলো।৯ টায় বাজার শেষে যখন ফিরবো তখন ঘটলো আরেক বিপত্তি।জুতো ছিড়ে গিয়েছিলো।বাজার থেকে বেরিয়ে একটু সামনে গেলেই জামা-কাপর সহ জুতোর দোকান আছে।তাই জুতো কিনবার জন্যে সেখানে যাই।আমার আবার সহজে কিছু পছন্দ হয় না।তাই পুরো শোরুম খুঁজে খুঁজে অবশেষে মোটামুটি পছন্দের একটা জুতো কিনলাম।এগুলো করতেই ১০ টা বেজে গেলো।তারপর বাড়ি ফিরার উদ্দেশ্যে শোরুম দিয়ে বেরোতেই খেয়াল করলাম ঝড়ের পূর্বাভাস।চটজলদি রিকশার খোঁজে লেগে পরেছিলাম।কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির সময় সদাসর্বদাই রিকশার খোঁজ মেলে না আর মিললেও তখন ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা হয়ে যায়।সেদিন ও এমন হচ্ছিল।১/২ টো যা পেলাম তার ভাড়া শুনে আর উঠলাম না।রিকশার খোঁজে সামনের দিকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েও রিকশা পেলাম না।অবশেষে হাঁটা ছাড়া উপায়ও ছিলো না।এমন সময় নিজেই নিজেকে কঠিন কিছু গালি দিয়েছিলাম,কেনো সেই ১/২টো রিকশার মাঝে কোনোটায় উঠে যাইনি!
নাফিয়ার কথার উত্তরে আফিম বলে ওঠে,
-তোমার ওমন কিপ্টামির জন্যেই তোমার সাথে আমার ওভাবে দেখা হয়।তাই দোষ সব তোমার।ঐ কাজের পানিশমেন্ট এখন অব্দি পাওনি তুমি।অনেক ছাড় দিয়ে দিয়েছি।এখন পানিশমেন্ট দেওয়ার পালা।
ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আজ আমাদের বিয়ের ৬ মাস পূর্ণ হলো,আফিম।আর এই দিনে আপনি আমায় শাস্তি দিতে চাইছেন?
-চাইছি।এখন এই মুহূর্তে আমার যে গালে চর দিয়েছিলে সে গালে গুনে গুনে ১০০ টি চুমু দিবে।
বিস্মিত চোখে আফিমের দিকে তাকিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-এমন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে?
-ইয়াহ!
-অসম্ভব।
-ভেবে বলছো?
-একদম।
ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-ঠিক আছে।আমি আগামী কালই আমার পিএ এরিন কে নিয়ে ৭ দিনের জন্যে বিজনেস ট্যুরে যাবো।

বাঙালি নারী আর যাই পারুক,নিজের পুরুষের আশেপাশেও অন্য কোনো নারীকে সহ্য করতে পারে না।নাফিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি ভিন্ন নয়।আফিমের কথায় মুহূর্তেই রেগে গেলো সে।রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
-খবরদার!এ কাজ করলে আপনার রক্ষা নেই।
-করবো যদি এ পানিশমেন্টটি স্বীকার না করো তবে।(বেপরোয়া সুরে কথাটি বলে ওঠে আফিম)
কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে নাফিয়া একটু একটু করে আফিমের অনেকটা কাছে চলে আসে।আলতো করে আফিমের গালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই আফিম নিজের চোখ জোড়া বুজে নেয়।নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন বেশ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।সেই সাথে লজ্জাও লাগছে তার কিন্তু যত যাই হোক নিজের বরকে তো অন্য নারীর সাথে দেখা সম্ভব নয়।
গুনে গুনে আফিমের পুরো গাল জুড়ে তেরোটি চুমু দিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আর কতো,আফিম?
-৮৭ টি।
-আর পারবো না।
-ঠিক আছে।এরিনের….
কথাটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই রাগে নাফিয়া উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে।মজাটি যে অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে তা বুঝতে পেরে আফিম নাফিয়ার পেছন পেছন গিয়ে হাত ধরে এক টানে নাফিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।অতঃপর বলে ওঠে,
-কোথায় যাচ্ছো?
-যেখানে ইচ্ছে সেখানে।আপনি যান না এরিনের কাছে!
-সত্যি যাবো?
-হ্যা।
-ঠিক আছে।
বলেই নাফিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আফিম।রাস্তা ফাঁকা হওয়ার পুরো ফায়দা লুটছে সে।নাফিয়া রাগে নিজেকে আফিমের বাহু বন্ধন হতে ছাড়াতে চেষ্টা করে তবে ব্যর্থ হয়।আফিম বলে ওঠে,
-কি গন্ধ!বাঁচা যাচ্ছে না।
আফিমের কথায় নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা থামিয়ে বলে ওঠে,
-কোনো গন্ধই তো নেই!
-কোনো কিছু পোড়ার ভীষণ গন্ধ পাচ্ছি।
নাফিয়ার আর বুঝতে বাকি রয় না আফিম কি বুঝাচ্ছাতে চাইছে।নাফিয়া আবারও নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরে।নাফিয়ার কাজে আফিমের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে।সে ঠোঁটে হাসি নিয়েই জড়িয়ে ধরে রাখে নাফিয়াকে।
কিছুটা সময় পাড় হতেই নাফিয়ার রাগ অনেকটা শান্ত হয়ে যায়।সে চুপটি করে আবদ্ধ হয়ে আছে আফিমের বাহুডোরে।
নাফিয়ার রাগ কমেছে বুঝতে পেরে আফিম বলে ওঠে,
-চলো সামনে এগোনো যাক।
উত্তরে কিছু বলে না নাফিয়া।আফিমের বাহুডোর হতে ছাড়া পেতেই সে হাঁটতে আরম্ভ করে।সাথে আফিমও।কিছুটা পথ চলতেই একটি মুদি দোকান খোলা পায় আফিম।এতো রাতে সচরাচর কোনো দোকানই খোলা থাকে না।কিন্তু মাঝে মাঝে এক-দুটি এমন খোলা পাওয়া যায়।
আফিম কিছু একটা ভেবে সে দোকানে প্রবেশ করে।নাফিয়া আফিমকে সেই দোকানে যেতে দেখে দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে।১/২ মিনিটের মাঝেই হাতে একটি কোণ আইসক্রিম নিয়ে ফিরে আসে আফিম।
আইসক্রিম দেখেই নাফিয়ার রাগ উধাও।আফিম আইসক্রিমটি তার দিকে এগিয়ে দিতেই সে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আইসক্রিমটি নিয়ে নেয় সে।

!!
রান্নার জন্যে ২ জন সেফ(chef) আছে।সেই সাথে ঘরের অন্যান্য কাজের জন্যেও গৃহপরিচারিকা আছে ২ জন।তাই জন্যে ঘরের বউ হওয়ার পরও নাফিয়ার তেমন কোনো কাজ থাকে না।সে আগের মতোই দাদীর সাথে থাকে।দাদীর এবং সানিয়া বেগমের খেয়াল রাখা ও তাদের সাথে গল্পে সারাটি দিন কাটে তার।
সখ করেই মাঝে মাঝে নিজে রান্না করে নাফিয়া।আজও তার ইচ্ছে হলো সবার জন্যে বিশেষ কিছু রান্না করার।আফিম ঝাল খুব পছন্দ করে সেই সাথে সবসময় রিচ ফুড বেশি খাওয়া পরায় আজ নাফিয়া ভিন্ন কিছু বলতে ঝাল করে আলু ভর্তা করার পরিকল্পনা করে।সেই সাথে ডিম ভাজা ও ডাল না হলে তো চলবেই না।সানিয়া বেগম এবং দাদী আবার রাতে রুটি খান।তাই জন্য নাফিয়া রুটি,পাঁচ মিশালি সবজি ও গাজরের হালুয়া তৈরি করার পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী রান্না শুরু করে সে।অনেকটা রান্না প্রায় শেষ এমন সময় হটাৎই সে তার শরীরের একটি অঙ্গে ব্যথা অনুভব করে।ধীরে ধীরে ব্যথাটি বাড়ছে।এমন ব্যথা সে আগেও ক’বার অনুভব করেছে কিন্তু তেমন একটা গায় লাগায়নি।কিন্তু আজকাল ব্যথাটা বেশি হচ্ছে সেই সাথে অঙ্গে কিছু পরিবর্তনও লক্ষ্য করছে সে।

চলবে

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১৬
লেখিকাঃমাহযাবীন

কফি হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নাফিয়া।চোখে রাতের অন্ধকার আকাশের দিকে থাকলেও মন ছেয়ে আছে তার দুশ্চিন্তা।নিজ শরীরের অঙ্গের ব্যথাটিকে জড়তার জন্যে এতো টা দিন অবহেলা করলেও ব্যাপারটি এখন বেশ ভাবাচ্ছে তাকে।
কক্ষের বিছানাতে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আফিম।কক্ষ হতে বারান্দাটি ভালোভাবেই দেখা যায়।কাজের মাঝেই হটাৎ আফিমের চোখ পরে নাফিয়ার দিকে।বাতাসে মেয়েটির কোমর অব্দি লম্বা চুলগুলো উরছে।পেছন থেকে নাফিয়াকে দেখতে বেশ মোহনীয় লাগছে।আফিম নিজের কোল হতে ল্যাপটপটি সরিয়ে বিছানায় রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বারান্দার উদ্দেশ্যে।
হটাৎ কোমরে অতি পরিচিত হাত দ্বয়ের স্পর্শ পেয়ে এক অদ্ভুত শিহরণে চোখজোড়া বুজে নেয় নাফিয়া।আফিম নাফিয়ার ঘাড়ে আলতো একটি চুমু বসিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-কিছু নিয়ে চিন্তিত?
অবাক হয় নাফিয়া।লোকটা কিভাবে যে ওকে এতোটা বোঝে তা বুঝে উঠতে পারে না সে।চোখ বুজে রেখে আফিমের বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-আফিম,আমার হয়তো ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।
কথাটি কানে আসতেই ব্রু জোড়া কুঁচকে নেয় আফিম।নাফিয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে পা হতে মাথা অব্দি চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
-কি হয়েছে তোমার?
আফিমের প্রশ্নের কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না নাফিয়া।কথাটি বলতে ভীষণ রকমের অস্বস্তিবোধ করছে সে।ঠিক তেমনই লজ্জা লজ্জাও লাগছে তার।কথাটি কিভাবে বলবে বুঝতে না পেরে সে বলে ওঠে,
-জানি না।ডাক্তার দেখালে জানতে পারবো।
-রোগের নাম জানতে চাইনি।লক্ষণ কি প্রকাশ পেয়েছে তা বলো।
নাফিয়া বেশ বুঝতে পারছে কথাটি আফিমকে না বলা অব্দি তার রেহাই মিলবে না।

!!
ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনী বিভাগের একজন মহিলা ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে আফিম এবং নাফিয়া।উভয়ের হৃদয় ধুকপুক করছে।ভীত এবং চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারা ডাক্তারের দিকে।কিছুটা সময় নিয়ে ডাক্তার সাহেবা বলে ওঠেন,
“আপনি ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত মিসেস.ইবনান।”
কথাটি শোনা মাত্রই যেনো নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন থেমে থেমে যাচ্ছে।সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এ কথার কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে।কথাটি যেনো কোনো ভাবেই হজম করতে পারছে না নাফিয়া।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে নাফিয়া একটু হাসার চেষ্টা করে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-এমন সামান্য লক্ষণ থেকে আমার ক্যান্সার কি করে হতে পারে?আপনি তো এখন অব্দি কোনো পরিক্ষা করে দেখেননি।হতেও তো পারে আপনি ভুল ভাবছেন।
নাফিয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে ডাক্তার সাহেবা কিছু টা সময় নিয়ে বলে ওঠে,
-আপনার অনুভূতি টা আমি বুঝতে পারছি মিসেস. ইবনান।লক্ষণগুলোকে আপনি সামান্য বলছেন কারণ আপনার এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।আসলে আমাদের বাঙালি সমাজে মেয়েরা এ অঙ্গ নিয়ে কথা বলতে ইতস্ততবোধ করে।সেখানে সচেতনতা সৃষ্টি হবে কোত্থেকে আর মেয়েরা এ ব্যাপারে জানবেও বা কোত্থেকে?
-তাও ডাক্তার আপনি আরেকটু পরিক্ষা করে দেখেন?অন্য কোনো রোগ ও তো হতে পারে।(করুন কন্ঠে বলে ওঠে নাফিয়া)
-আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত।
ডাক্তারের কথার উত্তরে আর বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না নাফিয়া।সে সত্যিই এমন রোগে আক্রান্ত?নিস্তেজ হয়ে নিজের দৃষ্টি মাটিতে আবদ্ধ করে নেয় সে।নিজেকে কেমন যেনো অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে তার।
আফিম ডাক্তারের কথাটি শোনা মাত্রই যেনো থমকে গেলো।নাফিয়া এমন বড় একটি রোগে আক্রান্ত তা ভেবেই নিজের পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার লাগছে তার কাছে।কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে।কেমন যেনো ভয় কাজ করছে তার মাঝে।নাফিয়ার কিচ্ছুটি হতে দিতে চায় না আফিম।কারণ নাফিয়াকে হারানোর সামর্থ্য তো তার নেই।”এ রোগ নিরাময়যোগ্য তো?” এ প্রশ্নটি মাথায় আসতেই আফিম ভীত ও চিন্তিত কন্ঠে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-এ রোগের চিকিৎসা আছে তো?
ডাক্তার সাহেবা ঠোঁটে একটু হাসি নিয়ে বলে ওঠে,
-আছে।দেখুন মিঃইবনান,ব্রেস্ট ক্যান্সারের কিছু লক্ষণ আছে।যেমন-বুকে বা বগলে চাকার মতো কিছু অনুভব করা,বুকের চামড়ার রং পরিবর্তন হওয়া বা চামড়া মোটা হয়ে যাওয়া(কমলা লেবুর খোসার মতো) ইত্যাদি।এসব উপসর্গ আপনার ওয়াইফের মাঝে পরিলক্ষিত হয়েছে।আবার এ রোগ হওয়ার কারণ সমূহের মধ্যে আছে-দেরি করে বিয়ে করা, শারীরিক পরিশ্রম কম করা,খাদ্য তালিকায় শাক-সবজি কম থাকা,অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া এবং পরিবারে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ইতিহাস থাকা।এসবও মিসেস. ইবনানে মাঝে পরিলক্ষিত হয়।এসব তথ্য অনুযায়ী বলছি যে সে এই রোগে আক্রান্ত।কিন্তু চিকিৎসা দেওয়ার আগে কিছু টেস্ট করা আবশ্যক।যেমন-ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি,এম আর আই,বায়োপসি।
-এ রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় যোগ্য তো?
-জ্বি।শুরুর দিকে এলে ১০০ ভাগ নিরাময় যোগ্য।কিন্তু অনেক বেশি দেরি হয়ে গেলে এ রোগের জন্য মৃত্যু পর্যন্ত হয়।মিসেস.ইবনান যে শুরুর দিকে এসেছেন এমনটি নয়।তিনি ও যথেষ্ট দেরি করে ফেলেছেন।এখন টেস্ট করে সার্জনের সাথে পরামর্শ করে চিকিৎসা আপনাদের জানানো হবে।হয় টিউমারের অংশ টুকু কাটলেই এই রোগ হতে নিরাময় লাভ করবেন নাহয় পুরো একপাশটিই কেটে ফেলতে হবে।
আফিম এতো টুকুতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে যে,তার নাফিয়াকে হারাতে হবে না।কিন্তু এ রোগটির প্রভাবে নাফিয়া মানসিক ভাবে কতোটা ভেঙে পরবে তা ঠিকই বুঝতে পারছে সে।বিষয়টি তার মানতেই কষ্ট হচ্ছে সেখানে নাফিয়ার মনের হাল ঠিক কেমন তা কল্পনা করার সাহস করলো না আফিম।নাফিয়াকে সে সামলাতে পারবে তো!
নিজের অনুভূতিগুলোকে পাত্তা না দিয়ে সে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করে নাফিয়াকে সামলানোর জন্য।
ডাক্তার সাহেবা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নিরাবতা দেখে বলে ওঠেন,
-বিষয়টিকে আপনারা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করুন।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ এ রোগে মারা যান।বেশিরভাগ নারীরা এ রোগে মারা যান তাদের অসচেতনতা এবং জড়তার জন্যে।বাংলাদেশি নারীরা নিজেদের এ অঙ্গের নাম মুখে নিতেও যেখানে লজ্জাবোধ করে সেখানে এ অঙ্গের কোনো সমস্যা নিয়ে অন্য কারো সাথে আলাপ-আলোচনা করা তো চিন্তাতেই আনা যায় না।ফলে এ রোগ সৃষ্টির একদম শেষের দিকে যখন তারা সহ্য করতে অক্ষম ঠিক তখনই ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়।কিন্তু তখন কিছু করার থাকে না এবং পরিনতি হয় মৃত্যু।মিসেস.ইবনান তো তাও সময় থাকতেই এসেছেন।তাই শুকরিয়া করুন।
-ধন্যবাদ।
বলে আর দেরি করা না আফিম।নাফিয়ার দিকে ফিরে তাকাতেই হৃদয় মোচড় দিয়ে ওঠে তার।মেয়েটির চেহারা পানে তাকানো যাচ্ছে না।দেখতেই কেমন অনুভূতি শূন্য লাগছে।আফিম নিজেকে সামলে নাফিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলে ওঠে,
-চলো,উঠি।
নাফিয়া,আফিমের দিকে না তাকিয়েই ধীরে ধীরে উঠে হাঁটা আরম্ভ করে।নাফিয়ার এমন অবস্থা আফিমকেও ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে কিন্তু তার তো শক্ত থাকতেই হবে,তার প্রিয়ার জন্যে।আফিম দেরি না করে নাফিয়ার পেছন পেছন যেয়ে নাফিয়ার হাতটি শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।এতেও নাফিয়ার উপর কোনো প্রভাব পরে না।মেয়েটির মাঝে যেনো কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না।

!!
সকাল সকাল আফিম ও নাফিয়াকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরোতে দেখে নিজেদের খুশি ধরে রাখতে পারছে না সানিয়া বেগম এবং দাদী।নতুন মেহমানের সুখবর শোনার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছে তারা।দু’জনে মিলে তো এখন থেকেই ভাবা শুরু করে দেয়েছে মেয়ে হলে কি নামে ডাকবে এবং ছেলে হলে কি নামে ডাকবে।সেই সাথে আরো অনেক জল্পনা কল্পনাও করে ফেলেছেন দুই বৌ-শাশুড়ি মিলে।তাদের আর তর সইছে না।কখন আফিম ও নাফিয়া এসে তাদের সুখবর দেবে আর কখন তারা পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করবেন।

অবশেষে অপেক্ষার প্রহরের ইতি টেনে আফিম ও নাফিয়া উভয়ই বাড়ি ফিরে আসে।আফিমের আগেই নাফিয়া গৃহে প্রবেশ করলো।ড্রয়িং রুমেই বসে ছিলেন সানিয়া বেগম তার ছেলে ও ছেলের বৌয়ের অপেক্ষায়।নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে তিনি দ্রুত পদে নাফিয়ার কাছে এসে বেশ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
-সুখবর তো?
শাশুড়ির উচ্ছ্বসিত কন্ঠ শুনে তার মুখ পানে তাকায় নাফিয়া।তার আনন্দিত চেহারা যেনো নাফিয়ার কষ্ট কয়েকশত গুণ বৃদ্ধি করে দিলো।এতোক্ষণ নিজেকে অনুভূতি শূন্য করে রাখলেও এখন আর নিজের অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলো না নাফিয়া।অনুভূতির প্রকাশ তার চোখেও ফুটে উঠলো।চোখ দু’টো ঝাপসা হতেই সে কিছু না বলে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে দৌড়ে এগিয়ে গেলো।এতোক্ষণে আফিমও সেখানে উপস্থিত হয়।নাফিয়াকে দৌড়ে কক্ষের দিকে অগ্রসর হতে দেখে সেও নাফিয়ার পেছন পেছন দ্রুত পদে অগ্রসর হয়।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে