অভিমান

0
2517

অভিমান

লেখিকা : শানজানা আলম

আমি দাঁড়িয়ে আছি ৪২/সি, আউটার সার্কুলার রোড, এই ঠিকানার সামনে। ঢাকা শহরে ঠিকানা খোঁজ করা সহজ নয়, বি, সি ভেজাল আছে, আবার এই নাম্বার ধরে খুঁজে পাওয়াও কঠিন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, শহরের দোকান গুলোতে ঝলমলে আলো জ্বলতে শুরু করেছে।
বিকেল থেকে কিছুটা বৃষ্টি হওয়ায় পথঘাট ভেজা ভেজা।
এটা একটা দোকান, দোকানের উপরে সাইনবোর্ড দেওয়া মেসার্স যমুনা স্টীলস।
কিন্তু সামনে দেখা যাচ্ছে একজন জমিয়ে টিক্কা জাতীয় কাবাব ভাঁজছে।
তার মানে এটা এখন একটা রেস্টুরেন্ট।
যদিও আমার ধারণা ছিলো এটা একটা বাড়ি হবে।
হতো হয়তো, বছর পঁচিশ আগে, তখন হয়তো মেইন রোড এতো বড় ছিলো না, হয়ত এই বাড়িটার একটা গেট ছিলো, গেটের সামনে কামিনী ফুলের গাছ ছিলো।

আমি এসেছি আসাদুল ইসলাম নামে একজনের খোঁজে।
আমার কাছে একটা চিঠি আছে, সেটা তাকে পৌছে দিতে এসেছি।
চিঠিটা আমি পড়ে ফেলেছি, না পড়ে উপায় ছিলো না। কারণ চিঠিটা আমি খোলা অবস্থায় পেয়েছি।
চিঠিটা লেখা হয়েছে ০৭/০৮/১৯৯৫ তারিখে।
লিখেছেন কোহিনূর আক্তার নামে এক মেয়ে।
মেয়ে হয়ত তিনি তখন ছিলেন, কিন্তু এখন হয়ত প্রৌঢ়া। আমি তাকে চিনি না।

আমি আজিজ। আব্দুল আজিজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ অনার্স পড়ছি, থার্ড ইয়ার।
পড়ার পাশাপাশি একটা ব্যবসা শুরু করেছি, নীলক্ষেত থেকে পুরোনো বই কিনে আনি। তারপর সুন্দর করে বাঁধাই করে অনলাইনে বিক্রি করি।
আমার পেজের নাম “ওল্ড বুক শপ বিডি”। গত সপ্তাহে একটা পুরোনো বইয়ের ভাঁজে আমি চিঠিটা পেয়েছি।
চিঠির গায়েই এই ঠিকানা লেখা ছিল, তবে চিঠির গায়ে ঠিকানা লেখার কোন কারণ আমি খুঁজে পাইনি।

চিঠিতে লেখা,

প্রিয় আসাদ, এই চিঠি তুমি পাবে কিনা বুঝতে পারছি না। আমার শরীর দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।
তোমার সাথে তাই নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারছি না।
আমাকে নাকি মাদ্রাজ নিয়ে যাওয়া হবে, বাবা বলছিলেন।
তাহলে হয়ত ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে।
সুস্থ হয়ে ফিরে তোমার সাথে দেখা করবো।
নীল শাড়ি পড়েই আসবো, তোমার চিনতে সমস্যা হবে না আমাকে।
অবশ্য আমার মাথাভরা কালো চুল গুলো উঠে যাচ্ছে গোছা গোছা।
হয়ত তোমার সাথে দেখা করার সময় মাথায় চুল থাকবেই না, তাই লম্বা মোটা বেণী আর করা হবে না।
আজ আর লিখতে পারছি না। বসে লিখতে কষ্ট হয় আমার।
ভালো থেকো। তোমার বাড়ির সামনে কামিনী ফুল কি ফুটেছে? জানিও কিন্তু।

ইতি

তোমার কুহু (কোহিনূর আক্তার)

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই চিঠিটা আসাদ সাহেব পাননি।
তাই ঠিকানা দেখে চলে এসেছি, একরকম ছেলেমানুষী বলা যায়।

আমি আসাদুল সাহেবকে খুঁজছি শুনে একজন আমাকে ভেতরের দিকে নিয়ে গেল।
দেখলাম আমার ধারণাই ঠিক।
এই দোকান পরে করা হয়েছে।
দোকানের পেছনে একটা পুরোনো ধরনের বাড়ি। ভেতরটা বেশ টিপটপ।
সুন্দর করে সাজানো।

আসাদুল সাহেব বের হলেন।
তিনি দোহারা গরণের, ছোটখাটো মানুষ।
বেশ ফর্সা। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা।
আমাকে বললেন, আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না।
আমি বললাম, আপনি আমাকে চিনবেন না।
চিঠিটা এগিয়ে দিলাম, বললাম, এটা বোধ হয় আপনার।
দুঃখিত, আমি চিঠিটা খুলে পড়ে ফেলেছি।
লোকটি চিঠিটা নিলো, ভেতরে চা দিতে বলে চিঠিটা।খুলে পড়ে দেখলো।
তারপর আমার দিকে তাকালো।
বললো, আপনি এটা কোথায় পেলেন? কুহুর কি হন আপনি??

আমি বললাম, আমি ওনাকে চিনি না।
একটা পুরোনো বইয়ে পেলাম।
-আই সি, যাই হোক, এত বছর পরে কুহুর চিঠি পেলাম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনার ঠিকানাটা রেখে যান।
আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করবো।

আমি ঠিকানা দিয়ে চলে এলাম, যদিও তার প্রয়োজন ছিলো না।
চিঠি দেওয়া তো শেষই।

দু দিন পরে আমার আস্তানায় আসাদুল সাহেব এলেন।আস্তানা বলতে আমি একটা রুম নিয়েছি, সেখানে বই আর বই শুধু।
এক কোণে আমার ঘুমানোর ব্যবস্থা।
খাওয়া দাওয়া বাইরেই করি।

আসাদুল সাহেব বসলেন, এই বইটই পাশে সরিয়ে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, যে বইয়ে এই চিঠিটা ছিল, সেটা আছে?
সেটা একটা মোটা ম্যাগাজিন, পূজাবার্ষিকী।
কলকাতার মনে হয়।
আমি দিলাম।
আসাদুল্লাহ সাহেব নিলেন।
তারপর উঠে চলে যেতো উদ্যত হলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোহিনূর ম্যাডামের খোঁজ পেয়েছেন?
আসাদুল।সাহেব বললেন, খোঁজ তো জানি।
ও আর বেঁচে নেই, ১৯৯৬ এর মার্চে ও মারা গিয়েছে।
ওর বাসা থেকে আমাকে ফোন করো জানিয়েছিলো।
খুব অভিমান হয়েছিলো, আমি জানতাম না ওর এত বাজে একটা অসুখ হয়েছিলো।।
আমাকে কিছু জানায়ও নি।
আসাদুল সাহেবের গলা ধরে এলো।
আমি বললাম, আপনারা বন্ধু ছিলেন?
আসাদুল্লাহ সাহেব বললেন, হু, পত্রমিতা।
হঠাৎ একদিন ও যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো।
তারপর কয়েকমাস পরে ওর মৃত্যুর খবর পেলাম।
তখন তো রোজ রোজ ফোন করা যেতো না! আমাদের দোকানের ল্যান্ডফোনে কেউ ফোন করে খবরটা দিয়েছিলো।
জানেন, খুব অভিমান ছিল, কেন আমাকে কিছু জানালো না। চিঠি লিখতে লিখতে দুজন কখন খুব কাছে চলে এসেছিলাম নিজেরাও জানি না।
এতদিনে অভিমানটা কাটলো।

আমি চুপ করো রইলাম, চিঠির কয়েকটা শব্দে কি ভীষণ ভালোবাসা লুকোনো ছিল, সেটা হয়ত অনুভব করতে পারবো না কখনো।

অভিমান

লেখিকা : শানজানা আলম

( প্রিয় পাঠক আপনাদের যদি আমার গল্প পরে ভালোলেগে থাকে তাহলে আরো নতুন নতুন গল্প পড়ার জন্য আমার facebook id follow করে রাখতে পারেন, কারণ আমার facebook id তে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গল্প, কবিতা Publish করা হয়।)
Facebook Id link ???
https://www.facebook.com/shanjana.alam

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে