অনুভূতি পর্ব ১৬

0
2012

অনুভূতি
পর্ব ১৬
মিশু মনি
.
২৭.
মিশু মেঘালয়ের বুকে হাত রাখতেই মেঘালয়ের মুখ থেকে যন্ত্রণার আওয়াজ বের হলো। মিশু অবাক হয়ে খেয়াল করলো, মেঘের বুকে অজস্র আচড়ের দাগ। গলায় তাকিয়ে দেখে একদম হিংস্র কিছু আচড়, নখ বসে গেছে। লাল হয়ে ফুলে গেছে কয়েক জায়গায়। ও আঁৎকে উঠলো।
মেঘালয় বললো,”দেখেছো কি অবস্থা করে ফেলেছো?”
মিশু মুখটা করুণ করে বললো,”এই অবস্থা আমি করেছি?”
– “তাছাড়া? কি পরিমাণ অত্যাচার চালাচ্ছিলে আমার বুকের উপর। দুহাত দিয়ে একদম। আচড়াতে আচড়াতে অবস্থা খারাপ করে দিয়েছো।”
আচড় দেয়া জায়গাগুলোতে আলতো করে স্পর্শ করলো মিশু। মেঘালয় ব্যথা পেয়ে শব্দ করে উঠছে। ফর্সা গলা আর বুকের এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে মিশুর।
মেঘালয় বললো,”আগামী এক সপ্তাহ এই দাগ থাকবে মনেহচ্ছে।”
– “সেকি! এত গভীর ক্ষত করে ফেলেছি আমি?”
– “হুম ম্যাম। চিন্তা করছি আমি বাইরে বের হবো কিভাবে? মেয়ে হলে নাহয় হিজাব বাঁধতাম। এই অবস্থা দেখলে লোকজন কি যে ভাব্বে! ”
মিশু চিন্তিত হয়ে বললো,”লোকজন অনেক আজেবাজে জিনিস ভাব্বে।”
– “তা তো ভাব্বেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো নতুন বিয়ে করছি ভাই। সেজন্য বউ এ দশা করছে।”
– “নতুন বিয়ে করলে বউ এ দশা কেন করবে?”
– “জানো না কেন করবে?”
– “না তো। কেন?”
মেঘালয় হেসে বললো,”ওটা একটা শাস্ত্র। বাসর রাতে বরের গলা,বুক,কাঁধে বড়বড় নখ দিয়ে আচড় দিয়ে দাগ করে দিতে হয়।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “কি বলছেন এসব? আমিতো এমন শাস্ত্র কক্ষনো শুনিনি। বউরা কেন এরকম হিংস্র কাজ করবে? আমি বাবা পারবো না। আচ্ছা, আমাকে ও কি আবারো এভাবে আচড় দিতে হবে?”
মিশুর অবুঝের মতন কথাবার্তা দেখে দারুণ মজা লাগছে মেঘালয়ের। ও মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “হুম দিতে হবে।”
– “তোমার ব্যথা লাগবে না?”
– “নাহ লাগবে না। লাগলেও কিছু করার নাই।”
– “আমি পারবো না। তখন তো অজান্তেই এরকম করে আচড় দিয়ে ফেলেছিলাম। সিরিয়াসলি আমি জেনেশুনে এসব করতে পারবো না।”
মেঘালয়ের আরো হাসি পেয়ে গেলো। ও হাসি চেপে রেখে বললো,”তাহলে কামড় দিয়ে কাজ চালিয়ে দিবা। কামড়ে দাগ বসালেই হলো।”
– “আমি কি কুত্তা? মানুষ কি মানুষ কে কামড়ায়?”
মেঘালয় হেসে বললো,”তুমি কুত্তা না, বউরা তো কামড়ায় ই। কিছু করার নেই। বিয়ের শাস্ত্রে এটাও আছে। এটা তো মানতেই হবে তাইনা?”
– “এসব আজেবাজে শাস্ত্র কে বানিয়েছে বলুন তো? যত্তসব বাজে বাজে কথা। আমি আচড়াতেও পারবো না,কামড়াতেও পারবো না।”
– “তাহলে তো বিয়ে পরিপূর্ণ হবেনা ম্যাম। এটা যে শাস্ত্র।”
– “কি মুছিবত! দাগ করতেই হবে?”
– “হুম হবে। নিয়ম পালন করতে হবেনা?”
মিশু একটু ভেবে বললো,”তোমার ব্যথা লাগবে না?”
মিশুর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে এবার সত্যিই বড্ড হাসি পেলো মেঘালয়ের। কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারলো না। শব্দ করে হেসে ফেললো। মিশু জিজ্ঞেস করলো, “হাসছেন কেন আপনি? আমি কি হাসার মতন কিছু বলেছি? ”
– “একদম ই নাহ। তুমি একটা কাজ করতে পারো। তাহলে নিয়ম ও পালন হয়ে যাবে, আর আমি ব্যথাও পাবো না।”
মিশু মেঘালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি সেটা শুনি? আমি সেটাই করবো তাহলে।”
মেঘালয় কণ্ঠে একটু আবেগ ঢেলে বললো, “ঠোঁট দিয়ে কামড় দিতে পারো।”
কথাটা শোনামাত্র এক পলকেই মিশুর চেহারা নীল বর্ণ ধারণ করলো লজ্জায়। এতবেশি লজ্জা পেলো যে, না পারছে দাঁড়িয়ে থাকতে,না পারছে বসে পড়তে। লজ্জায় চোখ মেলে থাকতেও পারছে না। ওর এমন লাজুক চেহারাটা মেঘালয় হা হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে। মিশু মুহুর্তেই পিছন ফিরে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মেঘালয় উঠে পিছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে মিশুর কাঁধের উপর মাথা রাখলো। আবেশে চোখের পাতা ঘনঘন কাঁপছে মিশুর। অন্যরকম একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে ও।
মেঘালয় ওর লাল মসৃণ গালের সাথে নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষে দিলো। সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো মিশুর। এ কেমন অনুভূতি! এমন অনুভূতি কক্ষনো হয়নি ওর। মেঘালয় আলতো করে মিশুর কাঁধ থেকে এক গোছা চুল সরিয়ে ওর ঘাড়ে খুব নিবিড় ভাবে দুই ঠোঁট দিয়ে চাপ দিলো। জিভটা চামড়া স্পর্শ করতেই দারুণ ভাবে শিহরিত হয়ে উঠলো মিশু। দ্রুত নিশ্বাস পড়তে লাগলো। সুখের আবেশে চোখে জল এসে গেছে। কোনো নড়াচড়া করতে পারলো না ও। মেঘালয় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। একটু পিছিয়ে আসতেই মিশু ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো। মেঘালয় মিশুকে টেনে এনে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দিয়ে সিটে হেলান দিলো। মিশু ওর বুকে মাথা লুকিয়ে চুপটি মেরে রইলো।
এভাবে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ বুজেই বিড়বিড় করে মিশু বললো,”এটাকে কি চুমু বলে?”
– “হুম।”
মিশু কেঁপে উঠলো। আবারো বিড়বিড় করে বললো,”আমার না খুব ভালো লেগেছে। খুউউব ভালো লেগেছে। আমি আমার জীবনে কতবার কতরকম গাড়িতে উঠেছি। কক্ষনো এরকম আরাম লাগেনি।”
মেঘালয় ফিক করে হেসে বললো,”গাড়িতে ওঠা আর চুমু বুঝি এক হলো?”
– “কেন হবেনা? না মানে কখনো এত ভালো লাগেনি কোনোকিছু। সেজন্য বললাম। আর কোনো উদাহরণ পাচ্ছিলাম না ত।”
মেঘালয় মিশুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো,”পাগলী টা। এত অবুঝ কেন তুমি? আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব ম্যাচিউরড। কিন্তু এতটা ইনোসেন্ট সেটা সত্যিই কল্পনা করিনি।”
– “কেন? আমি কি করেছি?”
– “নাহ, কিছু করোনি। অবুঝ মেয়েটা। খুকুমণি বললেও কম বলা হবে।”
মিশু কিছু বললো না। অনেক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা তুলে তাকালো মেঘের দিকে।মেঘালয়ের চোখ একদম লাল হয়ে গেছে। মিশু অবাক হয়ে বললো,”আপনার চোখ লাল কেন?”
মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো মেঘালয়। কিভাবে মেয়েটাকে বুঝাবে ওর ভেতরে কি তুমুল ঝড় শুরু হয়ে গেছে। মেয়েটা যে কিচ্ছু বুঝেনা। একটা সেকেন্ড ও স্থির হয়ে থাকতে পারছে না মেঘ, প্রচণ্ড ছটফটানি কাজ করছে ভেতরে। মিশুকে কিভাবে বুঝাবে সেটা? একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে মেঘালয় বললো, “রাতে না ঘুমালে আমার চোখ লাল হয়ে যায়।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ওহ আচ্ছা। এই আমার না কেমন কেমন লাগছে।”
হাসলো মেঘালয়। তার নিজের ই তো কেমন কেমন লাগছে। মিশুর কেমন লাগছে সেটা অনুধাবন করতে ওর কোনোই সমস্যা হলোনা। তবুও জিজ্ঞেস করলো, “কেমন কেমন?”
– “একটা কেমন কেমন, দুইটা কেমন কেমন, অনেক গুলা কেমন কেমন।”
মিশুর বাচ্চাদের মতন কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো মেঘালয়। সুখের মুহুর্ত গুলোতে মেয়েটার বয়স যেন হুট করেই অনেক কমে যায়। খুব কিউট লাগে তখন। গালটা টেনে দিতে ইচ্ছে করে।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “সেই কেমন গুলা কেমন গো মিশু? একটু কওনা শুনি?”
– “আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না সেই কেমন গুলা কেমন। তবে ইচ্ছে করছে।”
– “কি ইচ্ছে করছে?”
মিশু ওর বুকে মুখটা আরো একটু লুকিয়ে বিড়বিড় করে বললো, “আপনি একটু আগে যেটা করলেন, আরেকবার সেটা করুন।”
শিউরে উঠলো মেঘালয়। কি বলবে মিশুকে? নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে বললো, “নারে পাগলী। ওটা করা যাবেনা আর।”
– “এটাও কি শাস্ত্রে আছে?”
– “হুম আছে। বিয়ের আগে এসব করতে হয়না রে।”
– “তাহলে আপনি কেন করলেন?”
থতমত খেয়ে গেলো মেঘালয়। এর উত্তর কি দেবে সে? আবেগের বশে অজান্তেই করে ফেলেছে। সেটা বললে তো মেয়েটা বুঝবে না। ও বললো, “আমিতো জানি রাত পোহালেই এই মেয়েটাকে আমি বিয়ে করে নিচ্ছি। সেজন্যই করেছি।”
-” আপনি আবার জানুন রাত পোহালেই আমাকে বিয়ে করে নিচ্ছেন। তারপর আবার করুন।”
মিশুর মাঝে এখন চরম আকারের ঘোর কাজ করছে। তার উপর একটু ঘুম ঘুম ভাব ও চলে এসেছে ওর। এমন ভাবে বলছে যে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে বুকের সাথে পিষে ফেলি। ওর বুকের ভেতর ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। ও নিজেও জানেনা এভাবে বলে কিভাবে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে মেঘালয়কে। এতদিন শুধু মনের আকর্ষণ ছিলো, এখন দৈহিক আকর্ষণ অনুভূত হচ্ছে। ভেবেছিলো আরো কয়েকদিন সময় দেবে মিশুকে যাতে ও মেঘালয়কে বুঝতে পারে। কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছে নেই, ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ওকে বিয়ে করে নিয়ে স্বর্গসুখের অন্যতম একটা স্তরে ওকে ঘুরিয়ে আনতে। অচেনা একটা পাগলামিতে পেয়েছে দুজনকে।
মিশু বললো, “কি ভাবছো? করবে না?”
– “উহু মিশু, এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।”
– “কেন? আপনার বুঝি ভালো লাগেনি?”
– “ব্যাপার টা ভালো লাগা খারাপ লাগার নয় রে। ব্যাপার টা অন্যকিছু।”
– “কি ব্যাপার? আমার গা ঘেমে গেছে বলে?”
– “কি বিপদে পড়লাম রে বাপ! মেয়েটাকে একটু বুঝ দাও কেউ। মিশু, তুমি কি দয়া করে আমার কোল থেকে উঠে সামনের সিটে গিয়ে বসবা? প্লিজ?”
– “না বসবো না। এভাবে বললে আমি কান্না করবো। আমি চেয়েছি বলে আপনি আমাকে দূরে গিয়ে বসতে বলবেন কেন? আমি কোলেই বসে থাকবো, আর আপনি আবারো ঠিক ওইভাবে ওইভাবেই একবার জিভ দিয়ে ছুঁয়ে দিবেন।”
মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটা একেবারেই খুন করে ফেলেছে। এতটাও ইনোসেন্ট স্বভাবের মেয়েও জগতে আছে সেটা ওর জানা ছিলোনা। অনায়াসে এভাবে বললে কি মাথা ঠিক রাখা যায়?
– “মিশু, তোমার কি লজ্জা লাগেনা এসব বলতে?”
– “এখন লাগছে না। আপনি তো বললেন রাত পোহালেই আমাকে বিয়ে করে নেবেন। আর একটা মেয়ের সবচেয়ে আপন হচ্ছে তার বর।বরকেই তো বলবো তাইনা?”
– “এটা বুঝো আর আমার ব্যাপার টা বুঝো না? ন্যাকামি করো?”
– “আরে বাবা সত্যি বুঝিনি। বুঝলে কি আর বারবার বলি বলো? কোথায় সমস্যা একটু বলবে?”
– “আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারবো না রে। টিকতে পারবো না,বুঝো না কেন?”
– “কেন পারবা না?”
মেঘালয় মাথাটা তুলে মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ধরো তুমি একজন রাইটার। তুমি আমাদের এই জার্নিটা নিয়ে একটা গল্প লিখবা। সেই গল্পটা পড়ে দুনিয়ার সমস্ত পাঠক বুঝে যাবে আমার মধ্যে কি হয়ে যাচ্ছে। একটা দুইমাসের বাচ্চাও এই গল্পটা পড়লে বুঝবে মেঘের ভেতরে কেমন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর তুমি বুঝতে পারছো না। আজব না?”
মিশু হেসে বললো, “তাহলে আমি লিখালিখি শুরু করে দিই? পাঠকদেরকে জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিবো তোমার ভেতরে কি চলছে? মেঘের ভেতরে বিদ্যুৎ চমকানোই স্বাভাবিক। আর তারপর সেই মেঘ থেকে জলকণা বৃষ্টি হয়ে ঝড়বে আমার গায়। ঠিক না?”
মেঘালয় বললো, “তোমাকে আর সাহিত্য চর্চা করতে হবেনা। নিজেও পাগল হইছো, আমাকে ও বানাইছো। এরপর পাঠকদেরকেও বানাবা। পাজি মেয়ে কোথাকার, দয়া করে উঠে গিয়ে ওই কোণায় জানালার সিটে বসে থাকো। আর একটাও কথা বলবা না। কালকে বিয়েটা হতে দাও, তারপর দেখে নিবো কত বৃষ্টিতে ভেজার শখ। অধিকারের বৃষ্টি দেখেছিলে কখনো?”
মিশু আর কিছু বললো না। মুখটা গোমরা করে উঠে গিয়ে সামনের সিটে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাইরে তাকিয়ে রইলো। মেঘালয়ের খুব খারাপ লাগছে মিশুর জন্য। ও জানে মিশু এখন বাইরে তাকিয়ে খুব কান্না করছে। কাঁদুক, তবু ওর কাছে যাওয়া যাবেনা। বিপজ্জনক মেয়ে একটা।
একবার ওর দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে রইল মেঘালয়। মিশুকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভেবে নিজের ই কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে