অতঃপর_তুমি পর্ব-৩৬

0
4817

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৩৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

৪২.
স্বর্ণমন্দির নাম হলেও এখানে স্বর্ণের কোনো স্থাপনা নেই।মূলত মন্দিরটির সোনালী রঙের জন্যই এটি স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত।দুপুরের রৌদ্রজ্জ্বল আলোয় সোনালী রঙের স্তম্ভগুলো চিকচিক করে স্বর্ণের মতোই লাগছে।মন্দিরের চারপাশে ছোটো বড় সবুজ পাহাড়গুলো উঁকি দিয়ে আছে।মাথার উপরে নীল আকাশ।অসম্ভব সুন্দর রঙের মেলা।দেখলে শুধু বিমোহিত হতে হয়।একদৃষ্টিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।সোনালী আলোর প্রতিফলনে চোখ ধাঁধিয়ে আসে।চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে।অনেকেই ঘুরতে এসেছেন।সবাই একের পর এক ছবি তোলায় ব্যস্ত।মন্দিরটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম উপসনালয় হওয়ায় অনেক বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদেরও দেখতে পাওয়া গেলো।এতো মানুষের মাঝে বেশি ভালো লাগলো না।এজন্যই আমার মতে ঘুরতে আসার জন্য অফ সিজন ভালো।আমরা এসেছি পিক সিজনে।এই সময় পর্যটন এলাকাগুলো থাকে মানুষে ভরপুর।সাবিহাও একের পর এক ছবি তোলায় ব্যস্ত।আর আমি ব্যস্ত তাদের দুজনকে দেখে দেখে রাখতে।কারণ সাবিহার ছবিগুলো সে অভ্রকে দিয়েই তোলাচ্ছে।মেয়েটি সুন্দরের সাথে সাথে অতিরিক্ত মডার্ণ।আমি শুধু দাঁত কির মির করে তার ছবি তোলার ঢং গুলো দেখতে লাগলাম।এতোই যদি ছবি তোলার শখ তাহলে সাথে করে একটা ক্যামেরা ম্যান নিয়ে এলো না কেনো।আমার বরকে কি ক্যামেরা ম্যান পেয়েছে নাকি!অভ্রও ভদ্রতার খাতিরে না করতে পারছে না।এই সুন্দর মেয়েটাকে আমার অতিসুন্দর বরের সাথে আমি জাস্ট সহ্য করতে পারছি না।একসময় অতিষ্ট হয়ে দাঁত মুখ খিচে জোরে বলে উঠলাম,
‘শাকচুন্নি!পেত্নী!বান্দরনী!’

আমার আশেপাশের লোকগুলো অবাক হয়ে আমাকে দেখতে লাগলো।আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সামনে এগিয়ে গেলাম।অভ্র আমার কাছে এসে বলল,
‘আসো তোমারও কয়েকটা ছবি তুলে দেই।’
আমি মুখ ভার করে বললাম,
‘থাক।আমার ছবি তোলা লাগবে না।’
‘হুম ঠিকই বলেছো।সবাই শুধু ঘুরতে এসে ছবি তোলাতেই ব্যস্ত হয়ে থাকে।প্রকৃতির সৌন্দর্য্যটাকে উপভোগ করে না।আমরা ছবি তোলবো না।আমরা শুধু দেখবো আর দেখবো।ক্যামেরায় ছবি না তুলে মনের চোখ দিয়ে ছবি তুলে রাখবো।যেখানে চোখ হবে ক্যামেরা মন হবে মেমোরি।’

কি সুন্দর কথা!’মনের চোখ দিয়ে ছবি তুলে রাখবো।’মাঝে মাঝে উনি এতো সুন্দর সুন্দর কথা বলেন না চাইলেও আর রাগ করে থাকা যায় না।
স্বর্ণমন্দির ভালো করে ঘোরাঘুরির পর দুপুরের খাবার আগে আমরা আবার বান্দরবান শহরে হোটেলে পৌঁছে গেলাম।অভ্র গেছে গোসলে।আর আমি সোফায় বসে টি টেবিলের উপর পা তুলে আরামে ম্যাগাজিন পড়ছি।এমন সময় অভ্র খট করে ওয়াশরুমের দরজা মৃদু ফাঁক করে বললেন,

‘অরু,আমি টাওয়েলটা রেখে এসেছি।বিছানার উপরে আছে দেখো।একটু দাও তো।’

আমি উঠে টাওয়েল দেওয়ার জন্য বিছানার দিকে তাকাতেই আমার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি চেঁপে বসলো।বিরবির করে বললাম,
‘টাওয়েলও রেখে গেছে,জামা কাপড়ও রেখে গেছে।এবার দেবো উচিত শিক্ষা!’
উনি আবারো বলে উঠলেন,
‘কি হলো দিচ্ছো না কেনো?’
আমি সোফার উপর আবারো আরামে বসে টেবিলের উপরে থাকা চিপসের প্যাকেটা হাতে নিয়ে বললাম,
‘দেবো না।আপনি নিয়ে যান।’
‘কি!তোমার মাথা ঠিক আছে।আমি এই অবস্থায় আসবো?’
আমি ঠোঁট চেঁপে হাসি থামিয়ে একটা চিপস মুখে দিয়ে বললাম,
‘ঠিকাছে।আমি দিতে পারি তবে আমার কিছু শর্ত আছে।’
‘সামান্য একটা টাওয়েল দেওয়ার জন্য শর্ত!একদমই না।’
‘ঠিকাছে তাহলে ওখানেই সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকুন।আমি তো এখান থেকে এক পাও নড়ছি না।’
আমার পেছন বরাবর বাথরুমের দরজার ওপাশ থেকে তিনি চরম বিরক্তি নিয়ে বললেন,
‘বলো কি শর্ত?’
‘আপনি ঐ মিস সাবিহা না কাবিহার সাথে হেঁসে হেঁসে দাঁত বের করে কথা বলতে পারবেন না।’
‘ওকে।’
‘সে যদি সেধে সেধেও আসে তবেও না।’
অভ্র দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,
‘ওকে।’
‘তাকে ঘুরতে সাথে নিতে পারবেন না।তার ছবিও তুলে দিতে পারবেন না।’
‘হুম।’
‘শুধু সাবিহা কেনো দুনিয়ার কোনো মেয়ের সাথেই আপনি হেঁসে হেঁসে কথা বলতে পারবেন না।ওপস!স্যরি দুনিয়ার একটি মেয়ের সাথে শুধু কথা বলবেন আর সে হলো অরু।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে।করবো।এবার তো টাওয়েলটা দাও কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।’
আমি হাত মুঠ করে একটা রাজ্য জয়ের হাসি দিলাম।পরক্ষনে আবার গম্ভীর হয়ে বললাম,
‘দেবো।আগে একটা গান গেয়ে শোনান তো।’
‘কি!এই তোমার টাওয়েল দিতে হবে না।আমি বাইরে আসছি।তুমি যদি থাকতে পারো তাহলে থাকো।’

তার কথা শুনে আমি আতংকিত হয়ে তাড়াতাড়ি চোখ বড় করে দাঁড়িয়ে টাওয়েল নিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম।কি জানি!আবার যদি সত্যি সত্যিই বেরিয়ে আসতো।

দুপুরে বাইরের একটি ভালো হোটেল থেকে খাওয়া দাওয়ার পর বিকেলে আমরা বেরোলাম মেঘলার উদ্দেশ্যে।আমি রীতিমতো বেকুবের মতো একটা উদ্ভট কান্ড করে ফেলেছি।একটি কচুপাতা রঙের শাড়ি পড়ে এসেছি।জেলাসির বশবর্তী হয়েই মূলত নিজেকে একটু সুন্দর দেখাবার প্রচেষ্টায় এই কাজ করে এখন হাড়ে হাড়ে মজা টের পাচ্ছি।অভ্র তখনই দেখে বলেছিলো শাড়ি কেনো পড়েছি?শাড়ি পাল্টে অন্য কিছু পরতে।কিন্তু আমার জেদ আর সময় সাপেক্ষের কারণেই তিনি তার কথা খাটাতে পারেন নি।জীপগাড়িতে তো কোনো সমস্যা হয় নি কিন্তু এখন পাহাড়ের উঁচু নিচু রাস্তাগুলো পায়ে হেঁটে চলতে আমার বেশ অসুবিধা হচ্ছে।আমি ভেবেছিলাম আজও হয়তো সাবিহা আমাদের মাঝে এসে ঢুকে পরবে কিন্তু দেখলাম না সাবিহা নেই।সাবিহা হোটেলে থাকতে থাকতেই অভ্র আমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছে।যাতে সকালের মতো আবার রিকোয়েস্ট না করতে পারে।

বান্দরবান শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স।একটি কৃত্রিম লেককে ঘিরে জায়গাটি সাজানো হয়েছে।উঁচু নিচু পাহাড়ে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে এই সুন্দর লেকটি।আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।লেকের স্বচ্ছ পানি,আর চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।ঘন সবুজে জুড়ে যাচ্ছে চোখ।প্রকৃতির এই অপার সবুজে ঘেরা সৌন্দর্য্যে কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব লাগছে।কিছুক্ষণ প্রকৃতির এই শান্তি ভোগ করতেই আমার অশান্তি শুরু হয়ে গেলো।কারণ সাবিহা মেয়েটি দূর থেকে আমাদের দেখে মিস্টার অভ্র মিস্টার অভ্র করে ছুটে আসছে।একসময় আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘আপনারাও এখানে এসেছেন।আমি ভাবলাম বুঝি অন্য কোথাও গেছেন।আপনাদের দেখতে পেলাম ভালোই হলো।’

আমি মনে মনে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে অভ্র’র সাথে ঝুলন্ত ব্রিজে উঠে পড়লাম।এই আপদটা আর পিছু ছাড়ছে না।এখানেও ঠিকই চলে এসেছে।ইচ্ছে করছে ঝুলন্ত ব্রিজটা আরো বেশি করে নাড়িয়ে নাড়িয়ে একে এই লেকের পানিতেই ফেলে দেই।আমরা ব্রিজে কদম ফেলার সাথে সাথে কাঠের ব্রিজটি নড়তে লাগলো।আর সাবিহা বারবার ও মাই গড!ও মাই গড! করে লাফাতে লাগলো।অভ্র অভয় দিয়ে বলল,
‘ইট’স ওকে মিস সাবিহা,কিছুই হবে না।এটা এমনেই একটু নড়বে।আপনি পড়ে যাবেন না।’

পড়ে যাওয়ার এত্তো ভয় থাকলে উঠতে গেলো কেনো!যত্তসব ঢং!
আমি একটু পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পানি দেখতে লাগলাম।অভ্র আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘এতো সাইডে এসেছো!তোমার ভয় লাগে না?’
আমি মৃদু হেঁসে বললাম,
‘না।আপনি আছেন না!’
অভ্রও মৃদু হাসলো।আর বলল,
‘তোমাকে তখন তোমার অসুবিধার জন্যই শাড়ি পড়তে মানা করছিলাম।কিন্তু তোমাকে আজ,এখানে,এই মুহুর্তে কচুপাতা রঙের শাড়িটিতে দারুন লাগছে।তোমাকে এই সবুজ প্রকৃতি থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না।মনে হচ্ছে তুমি এই সবুজ প্রকৃতিরই একটা অংশ।সুন্দর অংশ।’
তার প্রশংসা শুনে আমি একটু লজ্জা মাখা হাসি দিতে না দিতেই ঐ মেয়েটি ন্যাকাতে ন্যাকাতে পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
‘মিস্টার অভ্র!’
আমি পুনরায় দাঁত খিচে রাগটা সংযত করলাম।
ব্রিজ থেকে নেমে আমরা একটা আঁকা বাঁকা রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলাম।সাবিহাও আমাদের সাথে সাথে চলতে লাগলো।মাটির একটি উঁচু ঢিবি সামনে পড়লো।আমি আর অভ্র পেরিয়ে গেলাম কিন্তু সাবিহা হাত বাড়িয়ে অভ্রকে ডাকতে লাগলো।যাকে বলে হাত ধরার ইশারা।তিনি হাত না ধরে উঠতে পারবেন না।আমার শরীরটা আবারো জ্বলে গেলো।দ্বিতীয়বার হাত ধরে ফেললো তো।নাহ!তখন শর্তের সময় হাত ধরার কথাটাও বলা উচিত ছিলো।আমি হঠাৎ ধপ করে বসে পায়ে হাত দিয়ে চেঁচাতে লাগলাম।অভ্র উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে এসে বলল,
‘কি হয়েছে?’
‘পা মচকে গেছে।’
‘পা মচকালো আবার কিভাবে?’
‘এখন কি আবার পড়ে দেখাবো কিভাবে?’
‘এখন কি হবে?’
‘কি হবে আবার আমাকে এখান থেকে তুলুন। তারপর অন্য কোথাও একটু নিয়ে বসান।আমার এখানে দমবন্ধ লাগছে।’
উনি আমাকে কোলে নিতে গেলেন।আমি বললাম,
‘কোলে না কাঁধে উঠবো।’
‘কাঁধে উঠবে!পা মচকে গেছে তার উপর পড়েছো শাড়ি।কাঁধে উঠবে কিভাবে?’
‘আমার কিসে সুবিধা লাগবে আমি বুঝি না!আমি ম্যানেজ করতে পারবো আমি তুলুন।’

অভ্র নিচু হয়ে ঝুঁকে আমাকে কাঁধে তুলে নিলো।আমিও তাকে পেয়ে খুশি হয়ে কাঁধে উঠে তার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।উনি বললেন,
‘আমাকে কি মেরে ফেলতে চাও।এতো শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরেছো কেনো?’
আমি ঈষৎ মুখ ফুলিয়ে হাতের বাঁধন আলগা করলাম।শাড়ি পড়ে কাঁধে উঠায় পা একসাথে করে পিছনে গুটিয়ে তুলে রেখেছি।এতে আমার একটু সমস্যা লাগছে তবে তার কাঁধে উঠতে পারার আনন্দের কাছে কিছুই না।তার কোলে তো একবার উঠেছিই কাঁধে তো আর কখনো উঠি নি।তাই কাঁধে চড়তে চাওয়া।তাছাড়াও পাহাড়ী রাস্তায় কোলের চেয়ে কাঁধে নিয়ে হাঁটাই বেশি সহজ।আমার ওজনও বেশি না।তার নিতে অতো অসুবিধা লাগছে না।আমি চোখ নিচু করে তাকিয়ে একবার তার মুখটি দেখলাম।ইশ!ভ্রু যুগল আবারো কেমন সেই অদ্ভুত ভাবে কুঁচকে রেখেছে।ইচ্ছে করছে গালে একটা টুস করে চুমু দিয়ে দেই।তবে অতিরিক্ত লোভ ভালো না।তাই নিজেকে সংযত করলাম।সাবিহার থেকে রেহাই পাবার জন্য কাঁধে চড়তে পেরেছি এই বেশি।উনি কিছুদূর এগিয়ে আমাকে একটা কাঠের বেদির উপর বসিয়ে দিলেন আর নিজেও পাশে বসে উদ্বিগ্ন মুখে আমার পা দেখতে লাগলেন।ঐ সাবিহার থেকে পিছু ছাড়াতে পেরেছি এই খুশিতে আমি হাসতে লাগলাম।অভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
‘তোমার পা মচকে যায় নি।’
আমি হাসতে হাসতে মাথা নাড়িয়ে না বললাম।
‘এসব কি অরু?জানো আমি কতটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।এই পাহাড়ি এলাকায় তোমার জন্য ডাক্তার কোথায় পাবো কি করবো ভেবে!’

উনি একটু বিরক্ত হয়ে উঠে যেতে লাগলেন।আমি তার হাত পেছন থেকে ধরে মিষ্টি করে হেঁসে গাইলাম,
মন আমার এক নতুন
মস্তানি শিখেছে।
আদরে আবদারে
চোখে সে লিখেছে,

আমিও উঠে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে দু হাত রাখতে রাখতে মুখটা আহ্লাদি করে গাইলাম,
তুমি যে আমার,তুমি
আর তো কারো নও
আমায় ভুলবে না….
এই কথা ভুলবে না।

অভ্র আমার গাল ধরে,নাক টেনে,মাথায় একটা টোকা দিয়ে নিজেও এই লাইনগুলো পুনরাবৃত্তি করলো।আমি ঈষৎ মুখ ফোলানোর ভাণ ধরে দুজনে একসাথে হেঁসে দিলাম।
মেঘলায় আমরা আর মানুষ আছে এমন জায়গায় ঘুরলাম না।সাফারি পার্ক,চিড়িয়াখানা এসবে না গিয়ে আমরা হাতে হাত রেখে ঘুরতে লাগলাম চা বাগান,ছোটো ছোটো পাহাড়,চূড়া এসবে।আর মাঝে মাঝেই গানের লাইনগুলো গুনগুনিয়ে উঠতে লাগলাম।আজ যেনো গানে,ছন্দে,আনন্দে আমরা দুজন বারবার প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলাম।

৪৩.
সূর্যটা কিছুক্ষণ আগেই সবুজ পাহাড়ের মধ্যে থেকে উঁকি দিয়েছে।পাহাড়গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে এরা খুব নিশ্চিন্তে কুয়াশার চাদরে নিজেদেরকে মুড়ে রেখেছে।আর আমি হিমশীতল আবেশ নিয়ে কম্বলের ভেতর না ঢুকে সকাল সকাল পাহাড় চড়ছি।কাল সন্ধ্যের একটু আগ আগ দিয়েই নিলাচলে পৌঁছাই আমরা।আমাদের থাকার জন্য সেখানের রিসোর্টের একটা কটেজ ভাড়া নেওয়া হয়েছে।কটেজে পৌঁছাবার সাথে সাথেই আমি ঘুম।কারণ ততক্ষণে চিম্বুক পর্বত,মিলনছড়ি সারাদিন ধরে ঘুরে ঘুরে আমি ক্লান্ত।তাই বিছানায় মাথা ঠেকাবার পরে এক ঘুমেই ভোর।আর ভোর হতে না হতেই অভ্র’র ঝাঁকুনি।এতো সকাল সকাল এই পাহাড় না চড়ে কি আমরা একটু পর আসতে পারতাম না।তার তাড়াহুড়োর জন্য আমি মাথার চুলও ঠিক মতো আঁচড়াতে পারি নি।এলোমেলো খোলা চুল নিয়েই বেরিয়ে পরতে হলো।এমনকি হাতের কাছে যেই সাধারণ সাদা রঙের সুতি কামিজ পেয়েছি তাই পড়ে আসতে হয়েছে।উনার গায়েও একটা আকাশি রঙের শার্ট।ভাবতেই অবাক লাগছে আমরা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এখন দুই হাজার ফুট উপড়ে আছি।নামটাও কি সুন্দর নীলাচল।ভাঙলে হয় নিল আঁচল।সত্যিই একে নিল আঁচল বলতে হয়।পাহাড়ের গায়ে কোনো এক অন্যন্যা রূপসী নারী যেনো তার শাড়ির মমতাময়ী নীল আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে সবুজ পাহাড়দের জন্য।পাহাড় সাবধানে চলতে গিয়ে আমার সমস্ত ধ্যান ধারণা পায়ের দিকেই আছে।আশেপাশের ঘুরে তাকানোর কোনো অবকাশ পাচ্ছি না।পাহাড়টি ছোটো তবুও বেশ ক্লান্তি লাগছে।
অবশেষে পাহাড়ের চূড়ায় পৌছে আমি কোমড়ে দু হাত রেখে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে লাগলাম।হাঁপাতে হাঁপাতেই আমার চোখ সামনে যেতেই হঠাৎ আটকে গেলো।কোমড়ে রাখা দু হাত অবশ হয়ে পড়ে গেলো।একি দেখছি আমি!এতো সমুদ্র!পাহাড়ের চূড়ায় সমুদ্র! মেঘের সমুদ্র।সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি করা এ কোন ভয়ংকর সৌন্দর্য্যের মুখোমুখি হয়ে পড়লাম আমি।আমার কম্পিত হাত আমি আমার দিকে ভেসে আসা মেঘের দিকে বাড়িয়ে দিলাম।মেঘ গলে গিয়ে আমার হাত ভিজে উঠলো।আমি অভ্র’র দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম,
‘আমার হাত ভিজে গেলো কেনো?কেনো ভিজে গেলো?এটাই কি মেঘ!’
আমার কথাগুলো জড়িয়ে আসছিলো।কথার মাঝে উত্তেজনা ভেঙে পড়ছিলো।উনি আমার কথায় মৃদু হাসলেন।আমি আবারো বললাম,
‘বলুন না অভ্র,এটাই কি মে…
আর বলতে পারলাম না।আমি থমকে গেলাম।উনার সাথে কথা বলতে বলতে মুখটা সামনে ঘুরতেই আরো কিছু মেঘ ভেসে এসে আমার মুখে লাগলো।আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।কেমন একটা অনুভূতি।মেঘেরা আমায় ছুঁয়ে দিলো!চারিপাশে শুধু মেঘ আর মেঘ।হাত বাড়ালেই মেঘেদের ছুঁয়ে দেওয়া যায়।মনে হচ্ছে পাহাড়ের উপরেও একটা সমুদ্র।শুভ্র মেঘের সমুদ্রে ছেয়ে গেছে সমগ্র পাহাড়।সেই সমুদ্রের মাঝে মাঝে আবার একটু ফাঁক হয়ে উঁকি দিচ্ছে সবুজ পাহাড়গুলো।আবার ঢেকে যাচ্ছে,আবার ভেসে উঠছে।এ যেন আকাশের গায়ে পাহাড় মেঘের লুকোচুরি।ভোরের সূর্যটাও ঠিক পাহাড়ের কোণ থেকে উঠে তার লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে সেই লুকোচুরি খেলায়।সেই মুহুর্তে একটা কান্ড ঘটলো।শুভ্র মেঘের সাথে ভেসে আসা মৃদু হিমেল হাওয়া আমার বুকের উপর পড়ে থাকা পাতলা নিল শিফনের ওড়নাটিকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো।অভ্র ধরতে গেলো কিন্তু তার আগেই পাহাড়ের চূড়া ছেড়ে নীলাচলে উড়ে গেলো আমার নিল আঁচল।অত দিকে আমার তখন হুঁশ নেই।আমি তখন থরথর করে কাঁপছি।নিজেকে প্রচন্ড হালকা মনে হচ্ছে।আমার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো আল্লাহ্ পৃথিবীটা এতো সুন্দর কেনো?এতো সুন্দর কেনো?কিন্তু বলতে পারলাম না।গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না।সবুজ পাহাড়,নিল আকাশ,সাদা মেঘ,সূর্যের লাল আভা সবমিলিয়ে আমার মনে হতে লাগলো আমি ঠিক এই দুনিয়াতেই নেই।আমি আছি অন্য পৃথিবীতে,অন্য দেশে।মেঘেদের দেশে।আমার চোখে হঠাৎ পানি চলে এলো।কেনো এলো জানি না তবে এলো।অভ্র আমার কাঁধে হাত রাখতেই আমি কেঁপে উঠলাম।
‘কেমন লাগছে?’
উনার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,
‘কাঁদতে ইচ্ছে করছে।’
উনি তার দু হাত প্রসারিত করে বললেন,
‘আসো কাঁদো।’
কি সুন্দর অদ্ভুত আহ্বান।’আসো কাঁদো’
কান্নার কারণ জানতে চাইলেন না।কাঁদতে মানা করলেন না।শুধু কাঁদবার জন্য একটি নিশ্চিত জায়গা দেখিয়ে দিলেন।আমিও আর কিছু না ভেবে আলতো আবেশে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।কিন্তু তার বুকে মাথা রাখতেই আমার আর কান্না পেলো না।চোখের পানি গুলো চোখের কোণাতেই চিকচিক করতে লাগলো।আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।শুধু অনুভব করলাম আমার ভালো লাগছে,খুব ভালো লাগছে।মেঘেরাও থেমে থেমে এসে আলতো আবেশে ছুঁয়ে যেতে লাগলো আমাকে।আমাদের।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে