অতঃপর_তুমি পর্ব-২২

0
5092

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

দুলাভাইয়ের হাত থেকে ছাড়া পেতে অভ্রকে অনেক কলকব্জা নাড়াতে হলো।অবশেষে আমার ফার্স্ট সেমিস্টারের ইনকোর্স পরীক্ষার বাহানা দিয়েই হানিমুনটাকে কিছু দিনের জন্য পোস্ট পেন্ডিং করা সম্ভব হলো।
ও বাড়ি থেকে আমরা বের হলাম শেষ বিকেলের দিকে।আরিশা আপু অনেক করে থেকে যেতে বলেছিলেন।মূলত অভ্র দুলাভাইয়ের হানিমুন শব্দটার জ্বালায় পড়েই বাহানা কাটিয়ে থেকে যাওয়া ব্যাপারে নাকচ করে দিলেন।থেকে যাওয়া মানেই রাত অব্দি দুলাভাইয়ের হানিমুন নিয়ে জোর জবরদস্তি সহ্য করা।ও মাই গড!অসম্ভব!
আমি তো তবুও শালকের বউ হিসেবে তার উদ্ভট মজার থেকে যতটুকু ছাড় পাই কিন্তু অভ্রকে তো সারাদিন কানের কাছে পুরোটাই শুনতে হয়।
সোজাসাপ্টা যে কিছু বলে দিবে তাও সম্ভব না।’কেনো যাবি না?’,’কি সমস্যা?’
একশো একটা প্রশ্নের বাহার সবাই খুলে বসবে।

গাড়ি চালিয়ে আমরা একটি দীঘির পাড়ের দিকে এসে পড়লাম।দীঘির স্বচ্ছ পানিতেও পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।মাঝে মাঝে কম্পিত মান পানিতে নড়ে উঠা সেই লাল খন্ডের প্রতিফলন দেখতে ভারী সুন্দর লাগছে।আমি মুগ্ধ চোখে গাড়ির জানালা দিয়ে সেই সৌন্দর্য্য দেখতে লাগলাম।জানালা গলিয়ে চলে আসা ঠান্ডা হাওয়া আমার সম্মুখের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিতে লাগলো।উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম এতো সব সৌন্দর্য্যের কোনো দিকেই তার খেয়াল নেই।উনি সামনে তাকিয়ে নিজের সমস্ত ধ্যান মগ্ন লাগিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন।তার এই “কুছ পরোয়া নেহি” ভাবটা দেখে আমি একটু নাক ফুলালাম।কানের কাছে গিয়ে জোরে একটা ডাক দিয়ে বললাম,
‘শুনছেন!’

অভ্র কানে হাত দিয়ে বললেন,
‘এতো জোরে ডাকছো কেনো?আমি কি কানে শুনি না?’
‘গাড়িটা একটু থামান না!’
‘কেনো?’
‘কেনো আবার জিজ্ঞাসা করতে হয়?দেখছেন না বাইরেটা কতো সুন্দর!এমন সুন্দর জায়গায় এসে কেউ না থেমে আবার যেতে পারে!’
‘কেউ না পারলেও আমাদের পারতে হবে।এখানে এখন থামলে পৌছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে।তার উপর যদি আবার জ্যামের কবলে পরি তবে তো আর কথাই নেই।’
‘রাত হয়ে গেলে হবে।এর জন্য এতো সুন্দর একটি জায়গা না দেখেই চলে যাবো!’
উনি আমার কথাটাকে বিকৃত করে বললেন,
‘রাত হয়ে গেলে হবে!তারপর অনেক রাতে গিয়ে পড়া লেখা করবেটা কে শুনি?অরু,তোমার মাথায় কোনো চিন্তা নেই কয়দিন পর যে তোমার এক্সাম!’
‘এক্সামের আরো দেঢ়মাস বাকি।এখন থেকে এতো সিরিয়াস হবার কি দরকার।আমার রেজাল্ট তো মোটামুটি খারাপ হয় না।’
‘এখন থেকেই যদি ভালো মতো পড়াশোনা করো তবে যেই রেজাল্ট পাও তার থেকেও ভালো রেজাল্ট পাবে।’
উনি গাড়ি না থামিয়ে পড়ালেখা নিয়ে পড়ে গেলেন বলে আমি একটু মুখ ভার করে বললাম,
‘এতো ভালো রেজাল্ট দিয়ে করবো কি?গিনিস বুকে তো আর নাম লেখাতে যাবো না।’
‘গিনিস বুকে নাম লেখাতে হবে না।নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলেই চলবে।অরু তোমাকে অনেক পড়ালেখা করে নিজের একটা পরিচয় বানাতে হবে।মেয়েদের সেলফ ডিপেন্ড হওয়াটা খুব প্রয়োজন।’
আমি একটু দুষ্টুমির ছলে বললাম,
‘কেনো,আপনি বুঝি হাঁপিয়ে উঠেছেন?’
‘আমি যতদিন আছি তোমার কোনো অসুবিধা আমি হতে দিবো না।এই বিশ্বাস রাখো।কিন্তু ধরো আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়।আমি চাই না তখনও তোমার কোনো অসুবিধা হোক।তুমি যেনো নিজের উপর ডিপেন্ড থাকো।’

মেয়েদের সেল্ফ ডিপেন্ড হওয়া নিয়ে তার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছিলো কিন্তু তার শেষোক্ত কথাগুলো শুনে আমার চোখ আংশিক ছল ছল করে উঠলো।হঠাৎ যেনো মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।উনি যেনো বুঝতে না পারেন তাই চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
তখনই গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ টের পেলাম।অবাক হয়ে উনার দিকে তাকানোর আগেই উনি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে আমার পাশের দরজাটি খুলে বের হতে বললেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘গাড়ি থামালেন কেনো?বাসায় চলুন।’
‘আই থিংক পাঁচ মিনিট ঘুরলে কিছু হবে না।’
‘না থাক,চলুন তো বাসায় চলে যাই।’
অভ্র আর কিছু না বলে আমার হাত ধরে গাড়ি থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসলো।আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
জায়গাটা আসলেই সুন্দর।দীঘিটা অনেক বড়।মাঝ বরাবর আবার একটি কাঠের চওড়া পুল আছে।দীঘির আশেপাশে বিভিন্ন খাবারের ভ্যানগাড়ি এসে বসে আছে।অনেকেই ঘুরতে এসেছেন।সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরছেন।দু চারটে কাপলদেরও দেখতে পাওয়া গেলো।হাত ধরাধরি করে দীঘির পাড় ঘেঁষে হাঁটছে,কেউ বা আবার বসে বসে গুটুর গুটুর করে গল্প করছে।আমরা দীঘির উপর কাঠের পুলের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে রইলাম।

‘কিছু খাবে?’
‘না।’
‘ফুচকা?’
‘না।’
আমার দিকে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অভ্র ঝট করে আমার হাত ধরে পুলটার কিনার ঘেঁষে দাঁড়া করিয়ে দিলো।উনি হাতটা ছেড়ে দিলেই আমি শেষ।এই স্বচ্ছ পানিতে মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে না।সুন্দর হলেও দীঘির পানির গভীরতা অনেক।
তার উপর আমি সাঁতার পারি না।আমি আতংকে চমকে উঠে চোখ বড়বড় করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম।

‘একি কি করছেন!আমি পড়ে যাবো তো।এক সেকেন্ড,আমাকে মেরে টেরে ফেলার প্লান করছেন না তো!’

‘শাট আপ।স্টুপিড!’

‘আমাকে সোজা টেনে তুলুন।সত্যি পড়ে যাবো।আমি কিন্তু সাঁতার পারি না।প্লিজ টেনে তুলুন।’

‘তুলবো।কিন্তু মুখ গোমরা করা অবস্থায় তুলবো না।আগে হাসো তারপর তুলবো।’

তার কথা শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না।উনি ভেবেছেন তার গাড়ি না থামানোয় আমি মন খারাপ করে আছি।তাই এখন আমাকে হাসানোর জন্য এরকম করছেন ভালো কথা,তাই বলে এভাবে!থ্রেট দিয়ে!
আমি হতবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বললাম,
‘আমি না হাসলে আপনি আমাকে পানিতে ফেলে দিবেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘যদি ডুবে যাই?’
‘যাবে।’
নাক ফুলিয়ে জোরে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
‘কেউ মন খারাপ করলে তাকে পারসুয়েড করতে হয়।হাসাতে হয়।সবাই তাই করে।আর আপনি এভাবে আমাকে হাসতে বলছেন!’
‘অভ্র আহমেদ সবার মতো করে কিছু করে না।এবার তাড়াতাড়ি হাসো।’
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘না।হাসবো না আমি।’
উনি ব্যাপক ভাব নিয়ে বললেন,
‘ওকে।’
কথাটা বলে অভ্র হাতের বাঁধনটা একটু হালকা করে দিতেই আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠে একবার পেছনে পানির দিকে তাকানোর চেষ্টা করে চেঁচিয়ে বললাম,
‘না না প্লিজ ছাড়বেন না।যা বলবেন তাই করবো।’
‘হাসবে তো।’
আমি ভয়ার্ত মুখে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
‘হুম।’
‘তাহলে হাসো।’

আমি আতংকিত মুখেই ঠোঁট টেনে হাসি দিলাম।
অভ্র বললেন,
‘এভাবে না।আরো একটু হাসো।’
আমি বোকার মতো মুখ টেনে আরো বেশি করে হাসলাম।
‘গুড।’

অভ্র হাত টেনে আমাকে সোজা করে দাঁড় করাতেই আমি বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে লাগলাম।কি ভয়ানক লোক রে বাবা!
হাঁপানোর এক ফাঁকে তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।আমি জোর করে দাঁত কেলিয়ে তাকে আবারো হাসি দেখাতে লাগলাম।
‘কিছু খাবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি?’
‘আইসক্রিম।’

সোজা সামনে তাকিয়ে আমি রোবটের মতো তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলাম।তিনি একটু মুচকি হেঁসে আইসক্রিম আনতে চলে গেলেন।কিছুদূর যেতেই আমি পেছন থেকে ডেকে বললাম,
‘শুনুন!আইসক্রিম কিন্তু দুইটা আনবেন।’
উনি একটু থেমে আবার দু পা এগোতেই বললাম,
‘আমাট জন্যই দুইটা।’

গাড়ির উপর উঠে বসে দুই হাতে একটা ভ্যানিলা কোণ আইসক্রিম আর একটা চকলেট কোণ আইসক্রিম নিয়ে মজা করে খাচ্ছি।একবার বাম হাতের টায় কামড় বসাচ্ছি আবার আরেকবার ডান হাতের টায়।অভ্র আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘ভাত খাওয়ার সময় মুরগীর মতো খুঁটে খুঁটে খাও আর এখন একেবারে একসাথে দুইটা আইসক্রিম!’
‘আপনি কি ইনডিরেক্টলি আমার খাওয়া নিয়ে খোটা দিচ্ছেন।’
‘আমি ইনডিরেক্টলি কিছু বলি না।বলতে হলে ডিরক্টই বলবো।আর একদিন যদি এক চামচ ভাত খাওয়ার পরই ‘পেট ভরে গেছে’,পেট ভরে গেছে’ কীর্তন শুনি তাহলে জাস্ট এই মুহুর্তটাকেই রিমাইন্ড করে দিবো।’
কথাটা বলে উনি আমার নাকে লেগে যাওয়া আইসক্রিম একটি টিস্যু দিয়ে মুছে দিলেন।
আমি তাকে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে পুনরায় আমার খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।
হঠাৎ আমার চোখে পড়লো দীঘির ও পাড়ে সবুজ ঘাসে উপর একটি ছেলে আর মেয়ে বসে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে।তাদের দেখেও মনে হচ্ছে তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে।ছেলেটি একবার মেয়েটিকে আইসক্রিম খাইয়ে দিচ্ছে আবার পরক্ষনেই মেয়েটিও লাজুক ভঙ্গিতে ছেলেটিকে আইসক্রিম খাইয়ে দিচ্ছে।

তাদের দিকে পুরো ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকায় আমার নাকে আবারো আইসক্রিম লেগে গেলো। সেদিকে আমার কোনো খেয়ালই নেই।
দেখতেই কি ভালো লাগছে।আহা!জুটি টা কতো রোমান্টিক।
হঠাৎ অভ্র আমার নাক পুনরায় টিস্যু দিয়ে মুছে দেওয়ায় আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম।গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে উনি পুনরায় ভ্রু কুঁচকে ফোন টিপছেন।আমার মুখ ফুলে গেলো।হ্যাঁ! এই তো হবে!সবার বর কতো রোমান্টিক ভাবে তাদের বউকে আইসক্রিম খাইয়ে দিবে আর আমার বর আমাকে বাচ্চাদের মতো টিস্যু দিয়ে নাকে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছে দিবে।সারাজীবন ‘রোমান্টিক বর’ ‘রোমান্টিক বর’ করে করে মরলাম।আর শেষে কিনা কপালে এই জুটলো।অরু রে!তোর ভাগ্য দেখে তো সব রোমান্টিসিজিম মেয়েরা গলায় কলসি বেঁধে এই দীঘির জলেই ডুবে মরবে!’

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে