ওঁ আসবেই ৩য় পর্ব
.
হঠাৎ করে আরিফ সাহেবের চোখের সামনেই থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মাইশি। আরিফ সাহেব আঁতকে উঠে তাকে ধরলেন। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। এইতো মেয়েটা সুস্থ ছিল। হঠাৎ ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। আবার কোন নারীর প্রবেশ এই বাড়িতে? কবে শেষ হবে এই রহস্যের? কেনই বা কোনো নারী এই বাড়িতে প্রবেশ করলে শাস্তি পাবে মাইশি?
.
মাইশিকে বিছানায় শুঁইয়ে আরিফ সাহেব গিয়ে দরজা খুললেন। দরজা খুলে বেশ অবাক হলেন। ডাক্তার নাসিমা আক্তার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি এই সময়ে এই বাড়িতে কেন এসেছেন আরিফ সাহেব বুঝতে পারছেন না। তাকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিলেন। আরিফ সাহেব ভাবলেন অপারেশনের বিষয়ে হয়তো কোনো কথা বলতে এসেছেন। কিন্তু তিনি চান না তার মেয়ের আর কোনো অপারেশন হোক। আরিফ সাহেব ডাক্তার নাসিমা আক্তারকে বললেন:
-আপনি কী অপারেশনের বিষয়ে আমার সাথে কোনো কথা বলতে এসেছেন? তাহলে চলে যেতে পারেন। আমার মেয়ের অপারেশন আমি করাব না।
-অপারেশন করিয়ে কোনো লাভও নেই মিস্টার আরিফ। আপনার মেয়ের “ফিটাস ইন ফিটু” বা এই ধরণের কোনো রোগ নেই। তার সমস্যা অন্য জায়গায়।
.
আরিফ সাহেব এতক্ষণ মহিলাটির কথায় বিরক্ত হলেও এই কথা শুনে উৎকন্ঠা হয়ে বলেন:
-তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
-আপনার মেয়ের গর্ভে একটা ভ্রুণ আছে এটা বাস্তব। কিন্তু সেই ভ্রুণের অস্তিত্ব তার পেটের বাহিরে জানান দিচ্ছে না। আমার ধারণা তার অপারেশন করেও তার গর্ভে কোনো ভ্রুণের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। কারণ তার গর্ভে যে ভ্রূণটি রয়েছে সে এই পৃথিবীর নয়। ওঁ অন্য কোনো দুনিয়ার।
.
একজন ডাক্তারের মুখে এই ধরণের কথাশুনে আরিফ সাহেব বেশ চমকে উঠলেন। তিনি ডাক্তার হয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না দিয়ে দিচ্ছেন অলৌকিক ব্যাখ্যা! আরিফ সাহেব কোনো কথা বলতে পারলেন না। নাসিমা আক্তার বলেই চললেন:
-দেখুন আল্ট্রাসোনোগ্রাফি এর মাধ্যমে পাওয়া আপনার মেয়ের গর্ভের সেই ভ্রুণের রিপোর্ট আমি এই কয়দিন ভালোমতো পরীক্ষা করেছি। ভ্রুণটা সম্পুর্ণ মানুষের মতো দেখতে হলেও এর হাত এবং পায়ের আঙুলের সংখ্যা ৪টি করে। যেখানে মানুষের থাকে পাঁচটি। এছাড়া তার হাতে একটা ছোট ক্রস চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এটা কোনো সাধারণ ক্রস না। এই চিহ্নটা কেবল শয়তানের প্রতীক।
-আপনি একজন ডাক্তার হয়ে এই ধরণের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। আমার মেয়েকে আমি আপনার আগে আরও ২ জন বড় ডাক্তার কে দেখিয়েছে। তারা আপনার চেয়ে অনেক জ্ঞানী ডাক্তার। তারাতো এই ধরণের কোনো অদ্ভুত অবাস্তবিক ব্যাখ্যা দেননি। আর একটা যমজ ভ্রুণের ভেতর আরেকটা যমজ ভ্রুণ বেড়ে উঠে। এটা মাইশির সাথে হতে পারে এমন কিছুও তারা বলেননি। আপনি এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা কী করে বলেন?
-দেখুন এটা যে “ফিটাস ইন ফিটু” রোগ না এই বিষয়ে আমার এখন কোনো সন্দেহই নেই। এই রোগের অনেকগুলো লক্ষণই আপনার মেয়ের সাথে যায় না। তাই হয়তো সেই ডাক্তারেরা এই বিষয়ে আপনাকে কিছুই জানান নি। এছাড়া অধিকাংশ ডাক্তারই প্যারানরমাল ঘটনায় বিশ্বাস করে না। আমিও এক সময় করতাম না। কিন্তু এখন করতে হয়। আমার জীবনে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটার পর থেকে আমি এটা বিশ্বাস করি। এই শক্তির যে কত ক্ষমতা তা আমি সেইদিনই টের পাই। এই বিষয়গুলো অবিশ্বাস করে হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার কারণে আমি আমার স্বামীকে হারাই। ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগের। তখন আমি নতুন বিয়ে করেছি। এই শহরের একটা পুরাতন একতলা বাড়িতে ভাড়া উঠি আমরা। একদিন . . . .
.
মহিলাটির কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বেশ বিরক্তি নিয়েই আরিফ সাহেব তাকে বলেন:
-দেখুন, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো ঘটনা জানতে আমি ইচ্ছুক না। আমার মেয়েকে সুস্থ, স্বাভাবিক করার কোনো উপায় জানা থাকলে সেটা আমায় বলুন।
-এর উপায় আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি এমন একজনকে চিনি যে আপনাকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আপনি যেহেতু অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন না। তাই আপনার উচিত আপনার মেয়ের অপারেশন করে এবিষয়ে একেবারে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া।
-আমার এক ডাক্তার বন্ধু এবং আরেকজন বড় ডাক্তার একবার তার অপারেশন করিয়েছে।
.
ডাক্তার নাসিমা আক্তার বেশ বিস্মিত কন্ঠে বলল:
-কই! আমি চেকাপ করার সময়তো অপারেশন হওয়ার কোনো আলামত পেলাম না! কোন ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করেছিলেন? তাদের ঠিকানাটা দিন প্লিজ। এদের সাথে এই বিষয়ে কথা বললে রহস্যটা আরও ভালোভাবে পরিষ্কার হবে।
.
হঠাৎ এক অজানা ভয় আরিফ সাহেবের মনকে গ্রাস করে ফেলে। আরিফ সাহেব মনে মনে এটা বিশ্বাস করেন যে, ডাক্তার ইমরান এবং ডাক্তার ইলিয়াসের হঠাৎ মৃত্যুর পেছনে তার মেয়ের সেই রাতে অপারেশনের কোনো সম্পর্ক রয়েছে। তাই তার ভয় হয় এই ডাক্তার যদি তাদের কথা জানতে পারেন তাহলে সেও বুঝে ফেলবে মাইশির জন্যই তাদের মৃত্যু ঘটেছে। সবার মাঝে এটা জানাজানি হলে এতে মাইশি এবং তিনি বিপদে পড়ে যাবেন। তাই প্রসঙ্গটা ঘুড়াতে তিনি ডাক্তার নাসিমা কে বলেন:
-মাইশির গর্ভে যে ভ্রুণটা রয়েছে সেটা যে শয়তানের তা আপনি এতটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে?
-আমার স্বামী এই শক্তির কবলে পড়ে মারা যাওয়ার পর এই শক্তি নিয়ে আমি ব্যাপক গবেষণা করেছি। সেই চিহ্নটা আমি চিনি। আপনার মেয়েকে আমি সাহায্য করতে চাই।
– তার পেটের ভ্রুণের হাতে যে সেই চিহ্নই রয়েছে এটা আপনি বুঝলেন কী করে? আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে তো এতটা স্পষ্ট করে হাতের চিহ্ন বোঝা যাওয়ার কথা না!
.
ডাক্তার নাসিমা আক্তার তার ব্যাগ হতে আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্টটা বের করে আরিফ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলেন। আরিফ সাহেব রিপোর্টে ভ্রুণের ছবিটা দেখলেন। ভ্রূণটার একহাতের উপর স্পষ্ট একটা ক্রসের চিহ্ন। ক্রসটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ক্রসটা সাধারণ কোনো ক্রসের মতো না। ভ্রুণের চেয়ে যেন স্পষ্ট ক্রসটাকে বোঝা যাচ্ছে! কেউ রিপোর্টটার ছবিটার উপরে এই ক্রশটা যেন একে দিয়েছে। আরিফ সাহেব আবার প্রশ্ন করেন:
-আপনার কী মনে হয়? এই শয়তানের ভ্রুণটা মাইশির পেটে আসল কী করে?
-যুগে যুগে অনেক শয়তান এই পৃথিবীতে আসে। তাদের এই পৃথিবীতে আগমনের অনেক গুলো উপায় রয়েছে। অধিকাংশ সময় শয়তানের উপাসকরা তাদের দেহ এবং আত্মাকে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করে এবং শয়তানকে আহ্বান করে। পরে শয়তান তাদের দেহে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বড় শয়তানেরা এ কাজটা করে না। এরা মানুষের রুপেই কোনো এক নারীর শরীর থেকে জন্মায়। পৃথিবীতে তারা শিশু রুপে আসে। ধীরে ধীরে এরা বড় হয় আর তাদের শয়তানী শক্তি ফিরে পেতে থাকে। এই বড় শয়তানগুলোর আত্মা প্রথমে পৃথিবীতে আসে দেহ ছাড়াই। পরে সে কোনো নারীর সাথে সঙ্গম করে আর সেই নারীর গর্ভ থেকেই সে আবার জন্ম নেয়।
-আপনি বোঝাতে চাইছেন আমার মেয়ের সাথে কোনো এক শয়তানের আত্মা সঙ্গম করেছে তাই তার গর্ভে শয়তানের ভ্রুণ?
-বিষয়টা অনেকটা এমনই।
-আপনি একটা পাগল ছাড়া আর কিছুই না! শয়তানের যদি পৃথিবীতে আসতে হতো তাহলে এত নারী থাকতে একটা বাচ্চা মেয়ের শরীরে আশ্রয় কেন নিবে?মাইশির বয়স যখন ৪ বছর তখন থেকেই সে এইরকম অসুস্থ। আর আপনি কী আজেবাজে কথা বলছেন?
-আমিও এটাই ভাবছি। শয়তানকে যদি আহ্বান না করা হয় তাহলে সে কখনও আসে না। আপনার মেয়ে কী করে তাকে আহ্বান করল!
.
আরিফ সাহেব এবার উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তার নাসিমা আক্তারকে বললেন:
-দেখুন আপনি একজন ডাক্তার হয়ে শয়তানী শক্তির অস্তিত্ব নিয়ে আমার সাথে তর্ক করছেন। বিষয়টা বেশ হাস্যকর। আপনি দয়া করে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।
.
ডাক্তার নাসিমা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, এই শক্তিকে তুচ্ছ করবেন না। যে কোনো সাহায্য লাগলে আমার কাছে আসবেন। আর আপনার বাড়িতে যে অলৌকিক কিছু আছে তা আমি নিশ্চিত। আমি যখন এই বাড়িতে ঢুকছিলাম কয়েকটা কালো ছায়া আমায় ভয় দেখাচ্ছিল।
.
মহিলাটি চলে গেল। আরিফ সাহেব বাড়ির গেট লাগিয়ে ড্রয়িং রুমে কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হয়ে বসে রইলেন। মাইশির সাথে এবং এই বাড়িতে অলৌকিক কিছু যে একটা আছে এটা তিনি অনুমান করতে পারছেন। তাই বলে এইসব হুজুগে আজেবাজে কথা বিশ্বাস করার কোনো মানে হয় না।
.
হায় খোদা! মাইশি না ঐ ঘরে অসুস্থ অবস্থায় রয়েছে। আরিফ সাহেব তার কথা ভাবতে ভাবতে তাকেই কী করে ভূলে গেল! আরিফ সাহেব দ্রুত উঠে মাইশির ঘরে গেলেন। ঘরে ঢুকেই তার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগাড় হলো। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। মাইশি বিছানা থেকে কয়েক ফুট উপরে উঠে শুন্যে ভাসছে। তার পুরো শরীরে জামা কাপড় নেই। চোখ ভয়ানক ক্রোধে লাল হয়ে তার দিকে চেয়ে রয়েছে। আরিফ সাহেব যেই মাইশির দিকে এগিয়ে যাবেন পুরো ঘর থরথর করে কাঁপতে লাগল। বুক সেলফ থেকে একটা একটা করে বই মেঝেতে পড়তে লাগল। আরিফ সাহেবকে অবাক করে দিয়ে কর্কশ একটা পুরুষ কন্ঠের শব্দ বেড়িয়ে এল মাইশির মুখ থেকে, ওঁ কারও পা ধরে না ওঁকে এই পৃথিবীতে আহ্বান করতে। তবে কেউ যদি ওঁকে আহ্বান করে একবার পৃথিবীতে আনতে চায় তাহলে কারও সাধ্য নেই যে ওঁকে আসা থেকে ফেরায়। যে হবে পথের কাঁটা, সেই হবে বলির পাঠা।
.
আরিফ সাহেবের বিস্ময় কাঁটার আগেই ঘরের একটা ফুলদানি একা একাই শুণ্যে ভেসে উঠে উড়ে এসে সজোরে তার মাথায় আঘাত করল। মুহুর্তেই তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।
.
যখন চোখ মেললেন দেখলেন পুরো ঘর অন্ধকার। তিনি মেঝেতে পড়ে আছেন। বিছানা থেকে মাইশির গুঙানোর আওয়াজ আসছে। তিনি ধীরে ধীরে উঠে ধারালেন। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পারলেন না। দেয়াল হাতড়ে সুইচ চেপে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করলেন। না সুইচ চালুই আছে, তাহলে বিদ্যুৎ নেই! দেয়াল হাতরে ঘর থেকে বারান্দায় গেলেন। বারান্দায় গিয়ে সুইচ চাপতেই আলো জ্বলে উঠল। আরিফ সাহেব বেশ অবাক হলেন। ঘরের লাইটে কী সমস্যা হলো!মোবাইল বা টর্চ কোথায় আছে
তার মনে পড়ছে না। তিনি রান্নাঘর থেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে আবার মাইশির ঘরে গেলেন। তার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। মোমের আলোতে স্পষ্ট পুরো ঘর দেখা যাচ্ছে। পুরো ঘর লন্ড-ভন্ড হয়ে গেছে, যেন কোনো বড় ঝড় এই ঘরের উপর দিয়ে কিছুক্ষণ আগে বয়ে গেছে। মাইশি বিছানায় শুয়ে গুঙাচ্ছে। পরনে একটা ফ্রক। মাইশির পাশেই বিছানায় সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়ে রয়েছে। ঘরের সব জিনিসপত্র ঘর জুরে এলেমোলো হয়ে পড়ে রয়েছে। বই ছড়িয়ে, ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে। বৈদ্যুতিক বাল্বটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্লাস্ট করেছে। ফুলদানিটাও টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। আরিফ তার মাথায় হাত দেয় যেখানে ফুলদানীটা আঘাত করেছিল। কিন্তু সে কোনো ক্ষত অনুভব করতে পারে না। সামনে এগিয়ে মাইশির কপালে হাত দিতেই বুঝতে পারে প্রচন্ড জ্বর। হঠাৎ মাইশির পেটের দিকে মোমের আলো পড়তেই তিনি আঁতকে উঠলেন। মাইশির ফ্রকটা আপনা-আপনি ছিরে যাচ্ছে আর তার পেটটা ফুলে উঠছে। পেট ফুলে একজন গর্ভবতী নারীর পেটের মতো আঁকার লাভ করল। আবার মাইশির নিঃশ্বাসের সাথে সাথে পেটটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। আবার নিঃশ্বাসের সাথে ফুলে উঠছে ভয়ংকর রকমের। ভয়ে আরিফ সাহেবের শরীর কাঁপতে থাকে। হঠাৎ তার পেছনে কোনো কিছুর উপস্হিতী অনুভব করতে পারেন তিনি। পেছনে ফিরতেই মোমের আলোতে স্পষ্ট ৩টা ছায়া দেখতে পেলেন তিনি দেয়ালে। মাঝখানের ছায়াটা একটা নারীর। তার দুই পাশের ছায়াগুলো দুজন পুরুষের। পাশের দুটো ছায়া যেন কালো ছায়ার গায়ে সাদা আলোর এপ্রোণ। ৩টা ছায়ার অবয়ব দেখেই যেন আরিফ সাহেব এদের চিনে ফেললেন। পুরুষ ছায়া দু’টি মুহুর্তের মধ্যে দেয়ালে মিলিয়ে গেল। নারী ছায়াটি ধীরে ধীরে আরিফ সাহেবের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। পাথরের মুর্তির মতো আরিফ সাহেব দাঁড়িয়ে রইলেন। মুহুর্তেই একটা ধমকা হাওয়া এসে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়ে গেল। বারান্দার বাল্বটার ফাটার শব্দও স্পষ্ট শুনা গেল। পুরো ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। আরিফ সাহেবকে অবাক করে দিয়ে সেই চিরচেনা একটা কন্ঠ মিহি আওয়াজে বলল:
-কেমন আছো আরিফ?
.
আরিফ কন্ঠটা শুনে চমকে উঠে বলে:
-শম্মী, তুমি! ওহ মাই গড! আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমিতো মারা গেছ। তুমি কোথা থেকে এলে?
-আমি কোথা থেকে আসব আবার! আমিতো ৫ বছর ধরে এই বাড়িতেই রয়েছি। যদিও ছায়া হয়ে। তাইতো দেখতে পাও না।
-শম্মী, তুমি দেখেছ আমাদের মেয়ের কী অবস্থা হয়েছে! আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না।
-মাইশির এই অবস্থার জন্যতো তুমিই দায়ী।
-আমি দায়ী?
-হ্যাঁ। তুমিই দায়ী। সবকিছুতো স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল। মাইশি অসুস্থ হচ্ছিল আবার সুস্থ হচ্ছিল। তুমি কেন শুধু শুধু তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে গেলে? তোমার জন্যই বেচারা ডাক্তার ২জন মারা গেল। অপারেশন করার বড় শখ ছিল। দিলও ওঁ শেষ করে। আর তোমার এই বাড়াবাড়ির কারণে মাইশি আরও বেশি শাস্তি পাচ্ছে। ওঁকে রাগাচ্ছো কেন তুমি?
-এই ওঁ টা কে?
-মাইশির গর্ভে যিনি রয়েছেন তিনি।
-হেয়ালি করো না শম্মী। তোমার রহস্য আমি কিছুই জানি না। জানতেও চাই না। অন্তত মেয়েটাকে কিভাবে সুস্থ স্বাভাবিক করতে পারব এই উপায়টাতো বলবে?
-তোমার মেয়ে তুমি উপায় খুঁজো।
-আমার মেয়ে! মাইশি তোমার মেয়ে না?
-আমি এখন কেউ না। আমার কেউ নেই। কেউ আমার কিছু না।
-শম্মী এমনটা বলো না প্লিজ। আমি বড্ড একা হয়ে গেছি। তুমি হয়তো আমার অবচেতন মনের কল্পনা। তাও কল্পনা হয়েই এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় আমায় বলে দাও।
-এই অলৌকিকতার উপর অবিশ্বাসই তোমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এবার বলো এই লন্ড-ভন্ড ঘরও তোমার অবেচতন মনের কল্পনা! মাইশি যখন মারা যাবে তখনও এটা তোমার অবচেতন মনের কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দিও।
-শম্মী!
-চেচিয়ে লাভ নেই। মেয়ের ভালো চাওতো আমার কথা শুনো। ওঁ যখন একবার পৃথিবীতে চলে এসেছে তার আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। যা হচ্ছে তাই হতে দাও। এই বাড়িতে মহিলা প্রবেশ নিষেধ করা দাও। মাইশির ওঁ কোনো ক্ষতি করবে না। মাইশিকে তুমি লালন করছ তাই ওঁ তোমারও কোনো ক্ষতি করবে না। মাইশির যখন সন্তান জন্মদানের বয়স হবে তখন ভ্রুণটা তার অস্তিত্ব জানান দিবে। ওঁ হবে মাইশির পুত্র। ততদিন পর্যন্ত ওঁকে মাইশির গর্ভে থাকতে দাও। ওঁ একবার জন্মালে তারপর মাইশি এবং তোমার মুক্তি। এর আগে ওঁকে রাগিও না। বিপদে পড়বে।
-এসব তুমি কী বলছ শম্মী! আর আমি বাবা হয়ে চুপচাপ এমনটা কী করে হতে দেই মাইশির সাথে।। আমার মেয়ে জন্ম দিবে একটা শয়তানকে? এই শয়তানের ভ্রুণটা মাইশির গর্ভে এল কী করে? ওতো শয়তানকে আহ্বান করেনি। তাহলে এই অভিশাপ তাকে কেন স্পর্শ করল?
-এই কথাটা শুনার পর হয়তো তুমি আমাকে ঘৃণা করবে। তাও শুনো। সন্তান হৃনতার যে একটা কত বড় কষ্ট তা তুমি আমার মতো অনুধাবন করতে পারতে না। যখন ডাক্তারী পরীক্ষায় জানতে পারলাম যে আমিই বন্ধা তখন আমার মনের ভেতর যে কী বড় একটা ঝড় গেল তা তোমাকে বোঝাতে পারব না! তুমি তখন প্রায় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলে। সেই সময়ে হঠাৎ একদিন এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক এসে আমার কাছে খাবার চাইলেন। আমি তাকে খাবার দিলাম। তিনি খাওয়ার পর আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, মা, তুই পুরোপুরি বন্ধা না।তোর চিকিৎসা করা যাবে। তোর ফুটফুটে সন্তান হবে। আমি বিস্মিত হলাম! তিনি একথা জানলেন কী করে! তিনি আর কোনো কথা না বলে একটা ঠিকানা আমায় দিয়ে চলে গেলেন। আমি তোমাকে না জানিয়ে সেই ঠিকানায় গেলাম। পুরানো একটা বাড়িতে তারা কালো যাদু চর্চা করেন। ভয়ংকর ভয়ংকর মুর্তি দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারা আমায় বললেন, একটা কাজ করলে আমার সন্তান হবে। আমার নিজেকে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করে দিতে হবে। আমার আত্মা বা দেহ শয়তান চায় না। সে শুধু আমার গর্ভের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসতে চায়। আমি শয়তানের পুজা করলে প্রথমে আমার গর্ভে একটা কণ্যা সন্তান আসবে। যে হবে আমার এবং তোমার মেয়ে। তার কয়েক বছর পর আমার গর্ভে আরেকটা সন্তান আসবে সেটা খোদ শয়তান! আমি তখন এতকিছু না ভেবে বাচ্চার লোভে রাজি হয়ে যাই।
.
আমাদের একটা কণ্যা সন্তান হলো মাইশি। আমরা বেশ আনন্দেই দিন কাঁটাতে লাগলাম। এরপর একদিন আবার আমি প্রেগনেন্ট হলাম। একটা শয়তানকে আমি পৃথিবীতে আনব! যে ধ্বংস করতে চাইবে পৃথিবীর সৌন্দর্য্য! মনের মধ্যে পাপবোধ জন্মালো আমার। ভুল বুঝতে পারলাম। সেই কালোযাদুর তান্ত্রীকেরাও তখন ভিক্ষুকের বেশে আমাকে প্রায়ই দেখে যেত। আমার ভয় লাগতে শুরু করে। তোমায় গর্ভপাতের কথা বললাম। তুমি রাজি হলে না। এই ঘটনাগুলো তোমায় খুলেও বলতে পারছিলাম না! ভাবলাম তোমরা সুখে থাক। আমার মৃত্যুর সাথেসাথে শয়তানটাও মরে যাবে।
আমার ধারণা ভুল হলো। আমি মরে হলাম অভিশপ্ত ছায়া। আর সেই শয়তানটার ভ্রুণ অদৃশ্য আকৃতি ধারণ করে মাইশির গর্ভে আশ্রয় নেয়। তাকেও করে অভিশপ্ত। সেই তান্ত্রিক গুলোও ভেবেছিল আমার মৃত্যুর সাথে সাথে শয়তানও চলে গিয়েছে। তাই তারা আর এ বাড়ি মুখো হয় না।
.
আরিফ সাহেব অন্ধঁকারে এক নিঃশ্বাসে শম্মীর কথাগুলো শুনছিলেন। এবার তিনি বললেন:
-সবই বুঝলাম। কিন্তু মাইশির হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা বুঝলাম না। মাইশি এমনিতে সুস্থ স্বাভাবিক থাকে কিন্তু কোনো নারী এই বাড়িতে প্রবেশ করলে সাথে সাথেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর পেছনের কারণটা কী? এর থেকে মুক্তি কি পাব না?
-তোমাকে যা বললাম তাই শুনো। এর বেশি কিছুই ঘাটাতে যেও না। তাহলে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হবে না। এই প্রশ্নটার উত্তরও খুঁজতে যেও না। তাহলেই সব শেষ! যেদিন এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পাবে সেইদিনই শেষ হবে সব সমস্যার। প্রথমে তুমি মরবে তারপর তোমার মেয়ে মাইশি। তাই ওঁকে নিয়ে এইসব ঘাটিয়ো না। যেটা যেভাবে চলছে চলতে দাও। সব প্রশ্নের উত্তর জানতে নেই। তুমি শুধু এই বাড়িতে নারীর প্রবেশ বন্ধ করে দাও। আমি চলে যাচ্ছি চিরোদিনের মতো। আমার বলা কথাগুলো শুধু মনে রেখ।
-চলে যাচ্ছ মানে?
-আমি এতদিন পর্যন্ত এই বাড়িতে শুধু মাইশির জন্য রয়ে গিয়েছিলাম। এখন তোমায় দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। এতেই আমার মুক্তি। ওঁকে আসতে দাও, ওঁ আসবেই। ওঁকে যে বাধা দিবে তারই হবে দুর্গতি।
.
মুহুর্তের মধ্যেই কণ্ঠটা শুণ্যে মিলিয়ে গেল। আরিফ সাহেব ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই তিনি আরও অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন।
.
সূর্যের আলো ঘরে প্রবেশের পর চোখ মেললেন তিনি। ঘর এখনও লন্ড-ভন্ড। মাইশি শুয়ে আছে বিছানায়। তার পেটের দিকের ফ্রক ছেরা। তাকে এখন দেখতে পুরো সুস্থ এবং স্বাভাবিক লাগছে। তিনি মাইশিকে ঘুম থেকে উঠালেন। ফ্রেশ হলেন দুজনে। একসাথে নাস্তা করলেন।
.
এখন রহস্যটা অনেকটাই যেন তার কাছে পরিষ্কার। তিনি কিছুতেই শয়তানকে এই পৃথিবীতে আসতে দিবেন না এবং নিজের মেয়েকেও তিনি এই বিপদ থেকে বাঁচাবেন। ডাক্তার নাসিমার অনেক কথার সাথেই গতরাতে শম্মীর বলা কথার মিল পাওয়া যায়। এখন ডাক্তার নাসিমাই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন।
.
মাইশিকে ঘরে রেখে বাড়ির বড় গেটে তালা দিলেন তিনি। যাতে কোনো নারী বা অন্য কেউ তার বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে। এরপর সোজা চলে গেলেন ডাক্তার নাসিমার চেম্বারে। সেখানে পৌছে আরেকবার স্তম্ভিত হলেন আরিফ সাহেব। জানতে পারলেন গতরাতে নাকি ডাক্তার নাসিমা আক্তার তার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন।…………………………………………………………………………….
.
.
. . . . . . চলবে . . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana
.
.
[গল্পটা মূলত টুইস্টধর্মী না। প্রতিটা পর্বের শেষে তাই বড় ধরণের কোনো টুইস্ট দেওয়া হচ্ছে না। লেখক একটা রহস্য সৃষ্টি করেছেন প্রথম পর্বে। সেই রহস্যের পেছনেই লেখক ছুটছেন। লেখক একা নয় আপনারাও তার সাথে ছুটছেন। গল্পের যত পর্ব আসতে থাকবে রহস্যটা তত পরিষ্কার হতে থাকবে। এটাই গল্পের নিয়ম। তাই ব্যথিত হওয়ার কিছু নেই।]