গল্পটা নিশ্চুপ বালিকা’র
১ম অংশ)
রচনাঃ- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’
অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তির সমস্ত কার্যক্রম শেষে আগত নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের বরণ তথা নবীন বরণের আয়োজন করা হয়। আয়োজন করে উক্ত ভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র’রা। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে একজন করে নেতা থাকবে। আর সেই নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী নবীন বরণের সমস্ত কার্য সম্পূর্ণ হবে। আর সে নিয়মানুসারেই প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের নেতা’রা তাদের নিজ নিজ দল নিয়ে ভাগ হয়ে যায়। শুভ্র…! অনার্স চতুর্থ বর্ষের অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের একজন মেধাবী ছাত্র। স্বীয় মেধা, অমায়িক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুনে ভার্সিটির সকল শিক্ষকদের কাছে শুভ্র স্নেহের পাত্র। অন্যদিকে পড়াশুনা’র পাশাপাশি সাংস্কৃতিক নানা কার্যক্রমে নিয়মিত অংশগ্রহন তথা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদে ভার্সিটির ছোট বড় সকলের কাছে শুভ্র একটি প্রিয় নাম। সর্বোপরি, ভার্সিটির বড় ভাই হিসেবেও শুভ্র বেশ পরিচিত নাম। ভার্সিটির যে কোন সমস্যা সমাধানে ছাত্র-ছাত্রী’রা সবার আগে বড় ভাই তথা শুভ্রর’র কাছে’ই এগিয়ে আসে। আর সেই শুভ্র’ই হলো অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের প্রধান নেতা। শুভ্র যেহেতু অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের নেতা তাই ওর কাজ হলো এ বছর অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়া সকল ছাত্র ছাত্রীদের বরণ। আর সে অনুযায়ী’ই একটা সুন্দর সাজানো গোছানো রুমে বরণ চলছিল। বরণের একদম শেষ পর্যায়ে রুমে এসে হাজির হয় নীলিমা। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একটু দেরীতে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হওয়ায় শ্রেণীকক্ষের পেছনের দরজা দিয়ে একদম পিছনের বেঞ্চে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে সে। নীলিমা! যেন এক ডানাকাটা পরী ভুল করে স্বর্গ ছেড়ে মর্তলোকে নেমে এসেছে। যার রূপ-লাবণ্য প্রতিটি মেয়ের ঈর্ষার কারণ। কিন্তু নীলিমা?!! ওর মধ্যে নেই কোন রূপের গরিমা। ভিষণ সাধাসিধে আর চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে ‘ও’। ওড়নার একাংশ সবসময় ওর মাথা’য় ঘোমটা’কারে দেয়া থাকবে’ই। সবাই যেখানে বরণের আনন্দে মেতে উঠেছে। সহপাঠীদের সাথে হাসি আনন্দ আর সেল্ফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পরেছে। নীলিমা সেখানে একা একটা বেঞ্চে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। যেন সে কোন জায়গায় আছে সেটাই অজানা। হাতে ফুল, ফাইল কিংবা মিষ্টান্ন কিছুই নেই। অনুষ্ঠানেও মন নেই মেয়েটির। নজর এড়ায় না শুভ্র’র। চোখে মুখে রাগের আভা ফুটে উঠে ওর। ভ্রু-জোড়া কিঞ্চিৎ বাকা করে কাছে যায়। কিছুটা রাগী স্বরে ডাক দেয়- ‘ এই মেয়ে! এই…’ পুরো কথা বলতে পারেনি তার আগে’ই মাথা তুলে তাকায় নীলিমা। নীলিমা’র শান্ত-স্নিগ্ধ মায়ামাখা মুখ দেখে চুপসে যায় শুভ্র। সমস্ত রাগ উবে যায় ওর। স্তব্ধ হয়ে গেছে সে। মুখ থেকে কোন কথা’য় সরছে। যেন সে কথা বলা’র শক্তি হারিয়েছে। শুভ্র যখন অনেক’টা ঘোরের মধ্যে ডুবে যায় বন্ধু’রা তখন পাশে এসে দাঁড়ায়। শরীরে কিছুটা ধাক্কার সাথে প্রশ্ন করে, ‘কিরে? চল। বরণ কাজ তো সম্পূর্ণ’ই হলো।’ ঘোর কাটে শুভ্র’র! মৃদু হাসি দিয়ে বন্ধুদের দিকে ফিরে তাকায়। ‘আমাদের আরো একটা নবাগত অতিথি বরণের বাকি রয়ে গেছে। টেবিল থেকে ফুল, ফাইল আর স্কেল, কলম আর মিষ্টান্ন এদিকে এগিয়ে দে তো। বন্ধু আতিক দ্রুত টেবিলের কাছে যায়। আর টেবিল থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসে এগিয়ে দেয় শুভ্র’র দিকে। শুভ্র সেটা এগিয়ে দেয় নীলিমা’র দিকে। আগামী দিনগুলো অনেক অনেক সুন্দর হোক। শুভকামনা নিরন্তর। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় নীলিমা। সম্মানের সহিত সেগুলো গ্রহন করে। তারপর স্মিতহাস্যে জানায়, ধন্যবাদ। ‘কই? এবার তো চল..’ বন্ধু আতিকের দিকে তাকিয়ে শুভ্র’র জবাব, হু! চল…. ক্লাস শেষে সবাই যখন বন্ধু বান্ধবদের সাথে হৈ-হুল্লুর আর আনন্দ উচ্ছ্বাসে মগ্ন, নীলিমা তখন ক্যাম্পাসের অদুরে বকুলতলায় চুপটি করে বসে। ক্লাস রুমের বাহিরে মাঠে দাঁড়িয়ে শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে একজোড়া চোখ নীলিমা’কে’ই খুঁজছিল গভীর সংগোপনে। খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত দু’চোখ সেখানেই থেমে যায় যেখানে চুপটি করে নীলিমা বসে। দ্রুত পায়ে বন্ধুদের সাথে নিয়ে সেখানে হাজির হয় শুভ্র। চোখে চশমা, হাঁটুতে খুলে রাখা ডায়েরী। চেহারা’য় শান্ত-স্নিগ্ধ ভাব, গভীর মনোযোগের সহিত ডায়েরী’তে লিখালিখি করছে নীলিমা। আবারো মুগ্ধ শুভ্র ভাবনা’র অতলে ডুবে যায়। ঘোর কাটে বন্ধু আতিকের ডাকে। ক্ষাণিক ধাক্কার সাথে টানা গলায় প্রশ্ন করে, কিরে? এভাবে ‘থ’ হয়ে গেলি যে? বন্ধুদের দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় নীলিমা’র দিকে। জোর গলায় ডাক দেয় – ‘এই যে মিস ? এদিকে…’ ডায়েরী থেকে ইতস্তত দৃষ্টি ফিরিয়ে ডানে ফিরে তাকায় নীলিমা। ক্যাম্পাসের সেই বড় ভাইগুলোকে চিনে নিতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি ও’র। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। মাথা’য় ওড়না’টা আরো ভালো ভাবে টেনে দিয়ে কাছে আসে শুভ্র’র। সালাম দিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করে- জ্বী, ভাইয়া! আমাকে বলছেন? টানা টানা কন্ঠে শুভ্র’র জবাব, জ্বী! আপনাকে’ই বলছি। ক্লাস শেষের বিরতি চলছে। সবাই মাঠে আড্ডা দিচ্ছে। আপনি এখানে একা একা কি করছেন? আমতাআমতা স্বরে নীলিমা’র জবাব, ইয়ে না মানে এমনি, ভালো লাগছিল না… কথা কেড়ে নেয় শুভ্র। যান, ঐ যে মাঠে আপনাদের ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা বসে আছে। সেখানে আড্ডা দেন গিয়ে। ভালো লাগবে… প্রতি উত্তরে এবার আর কোন কথা বলেনি নীলিমা। চুপচাপ বই আর ডায়েরী হাতে বাধ্য বালিকা’র ন্যায় মাঠের দিকে চলে যায়…. ক্যাম্পাস থেকে বাসা’য় ফিরছিল নীলিমা। কলেজ গেইটের সামনে যেতে’ই পিছন থেকে কারো ডাক শুনতে পায়। ডাকটা বড্ড চেনা চেনা লাগছিল ওর। থমকে দাঁড়ায় নীলিমা। সামনে এসে দাঁড়ায় শুভ্র। জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে নীলিমা ফিরে তাকায় শুভ্র’র মুখপানে। জবাবে মাথা চুলকানো ছাড়া কিচ্ছু বলেনি শুভ্র। মুখ খুলে নীলিমা। সালাম দিয়ে বিনয়ের সহিত প্রশ্ন করে, কিছু বলবেন ভাইয়া? সালামের জবাব দিয়ে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে শুভ্র। ঢোক গিলে জানায়- ‘ আমি শুভ্র। অনার্স ৪র্থ বর্ষ। অর্থনীতি ডিপার্টমেন্ট। এই এলাকা’রই স্থানীয় বাসিন্দা। আপনি?’ ধীর কিন্তু স্পষ্ট ভাষা’য় নীলিমা’র জবাব, আমি নীলিমা। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী। আর পড়াশুনা’র তাগিদে সুদুরের সেই নরসিংদী থেকেই এ শহরে এসেছি। ঢাকা শহরে আপন বলতে আমার তেমন কেউ নেই। আপাতত মায়ের দুর সম্পর্কের একটা বোনের বাসা’য় উঠেছি। বাকি পরিচয়টুকু মনে হয় আপনি জানেন! নীচু স্বরে শুভ্র’র জবাব, ওহ, আচ্ছা! ঠিক আছে… এই রিক্সা, এদিকে! আসি। আসসালামু আলাইকুম…. চোখের সামনে দিয়ে রিক্সা’য় উঠে নীলিমা চলে যায়। পিছনে সালামের জবাব দিয়ে হা করে শুভ্র তাকিয়ে নীলিমা’র চলে যাওয়া পথে’র পানে…
নিশ্চুপ_বালিকা(১ম অংশ) রচনাঃ- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’