ঘুমন্ত রাজপরী_পর্ব(০৫)
ফিরােজ কাজে লেগে পড়ল। মতিনের ডিজাইন রাখল না। সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পনা। পছন্দ হলে হবে, না হলে হবে না। এক সপ্তাহ সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত কাজ। এর মধ্যে অপালাকে একটি বারের জন্যেও নিচে নামতে দেখা গেল না। এক বার কিছু সময়ের জন্যে বারান্দায় এসেছিল, ফিরােজের দিকে চোখ পড়তেই চট করে সরে গেল। অপমানিত হবার মতাে ঘটনা, কিন্তু ফিরােজকে তা স্পর্শ করল না। এক বার কাজে ডুবে গেলে অন্য কিছু তার মনে থাকে না। দেয়ালের ডিসটেম্পার বদলাতে গিয়ে মনে-মনে ভাবল—এই অহঙ্কারী মেয়ে থাকুক তার অহঙ্কার নিয়ে, আমার কিছুই যায় আসে না। ডিসটেম্পারের রঙ কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। তার প্রয়ােজন আকাশি রঙ, কিন্তু সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। হয় বেশি গাঢ় হয়ে যাচ্ছে কিংবা বেশি হালকা। কড়া হলুদ এক বার দিয়ে দেখলে হয়। এতে রােদের এফেক্ট চলে আসতে পারে। হলুদ সবার অপছন্দের রঙ। ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে ম্যাজিকের মতাে এফেক্ট সৃষ্টি হতে পারে। সে চতুর্থ বার ডিসটেম্পার বদলে আবার আগের নীল রঙে ফিরে গেল। গৃহসজ্জায় দেয়াল খুবই জরুরি। এই দেয়ালের রঙ ঘরকে বন্দি করে ফেলবে কিংবা মুক্তি দেবে।
কাজ শেষ হবার পরও অপালা দেখতে গেল না। রমিলাকে বলল, ‘চলে যেতে বল। আর ম্যানেজারবাবুকে বল টাকাপয়সা মিটিয়ে দিতে।
দাড়িওয়ালা লােকটা আফনের পছন্দ হয়েছে কি না জানতে চায়। পছন্দ হয়েছে। বেশ পছন্দ হয়েছে। দেখলেন না তাে আফা! দেখতে ইচ্ছা করছে না।
অপালা তার দু’ দিন পর নিশানাথবাবুর সঙ্গে ঘর দেখতে গেল। তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! কি-রকম ফাঁকা-ফাঁকা শান্তি-শান্তি ভাব। মেঝেতে এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত কার্পেটের মতাে শীতল পাটি। ছােট-ছােট বেতের চেয়ারে হালকা নীল রঙের গদি। চেয়ারগুলি একটি গােল সেন্ট্রাল টেবিলের চারপাশে এমনভাবে সাজান, যেন পদ্মফুল ফুটে আছে। শীতল পাটিটিকে লাগছে। দিঘির কালাে জলের মতাে। দেয়ালে একটিমাত্র জলরঙ ছবি। ঘন বন, মাঝখানে ছােট্ট একটি জলা। সেই জলার পানিতে আকাশের নীল রঙের ছায়া পড়েছে। একটি ছােট্ট মেয়ে সেই পানিতে ভাসছে। সমস্ত ঘরটায় একটা স্বপ্ন-স্বপ্ন ভাব চলে এসেছে। অপালার বিস্ময় কাটতে দীর্ঘ সময় লাগল।
‘ম্যানেজারকাকু, কেমন লাগছে আপনার কাছে?
৩২
‘ভালােই তাে’ ‘শুধু ভালােই তাে! আরাে কিছু বলুন।
‘ছােকরা এলেমদার, তবে বিরাট ফক্কড়। যত টাকা নিয়েছে এই ঘর করতে, এর সিকি টাকাও লাগে না। ছাের্করা বিরাট ফোরটোয়েন্টি।
অপালা খিলখিল করে হেসে উঠল। এ-রকম শব্দ করে সে কখনাে হাসে না। নিশানাথবাবু এই মেয়েটির হঠাৎ এই উচ্ছ্বাসের কারণ বুঝতে পারলেন না।।
‘ম্যানেজারকাকু। ‘বল মা।
‘আপনি ফিরােজ সাবেহকে জানিয়ে দেবেন যে তাঁর সাজানাে ঘর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাবেন।
‘দরকার কী? কাজ করেছে পয়সা নিয়েছে।
‘না, আপনি লিখবেন। আজই লিখবেন। কী লিখলেন, সেটা আমাকে দেখিয়ে নেবেন।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।
‘ম্যানেজারকাকু, ঐ ছবিটার দিকে দেখুন। একটা ছােট্ট মেয়ে পানিতে ভাসছে। আচ্ছা, মেয়েটা কি সাঁতার কাটছে, না পানিতে ডুবে মারা গেছে?
হবে একটা কিছু। ‘ছবিটার মধ্যে একটা গল্প আছে। ভালাে করে তাকিয়ে দেখুন, আপনার মধ্যে একটা কষ্টের ভাব হবে।’
নিশানাথবাবু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে বললেন, ‘কই, আমার তাে কিছু হচ্ছে না!
অপালা আবার খিলখিল করে হেসে ফেলল।
ফখরুদ্দিন সাহেবের মেজাজ অল্পতেই খারাপ হয়। দেশের মাটিতে সেই মেজাজ প্রকাশের যথেষ্ট পথ থাকলেও বিদেশে সম্ভব হয় না। আজ একের পর এক যে-সব কাণ্ড ঘটেছে, তাতে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেলেও দোষের ছিল না। কিন্তু তিনি মাথা ঠাণ্ডা রেখেছেন। প্লেনে তাঁর পাশের সহযাত্রিণী অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হড়-হড় করে বমি করল, তার খানিকটা এসে পড়ল তাঁর গায়ে। তিনি মুখ বিকৃত করে বললেন, ‘ইটস অলরাইট।’ এয়ার হােস্টেস সাবান-পানি দিয়ে তাঁর কোট কয়েকবার মুছে দিল। তবু বমির উৎকট গন্ধ গেল না। টয়লেটে গিয়ে কাপড় বদলানাে যেত। কিন্তু তাঁর সঙ্গে একটিমাত্র ব্রিফকেস। বড় স্যুটকেস দু’টি লাগেজ-কেবিনে।।
| প্লেন থেকে নামার সময়ও ছােট্ট দুর্ঘটনা ঘটল। সিঁড়িতে বেকায়দায় পা পড়ে পা মচকে গেল।
ইমিগ্রেশন অফিসারের সঙ্গেও কিছু কথা-কাটাকাটি হল। অফিসারটি বলল, তুমি লণ্ডনে কী জন্যে যাচ্ছ।?
তিনি বললেন, ‘তা দিয়ে তােমার কী দরকার? আমার পাসপাের্টে ভিসা দেয়া আছে। সেই ভিসায় আমি ঢুকব।
‘তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। কেন যাচ্ছ, বিজনেস ট্রিপ, না প্লেজার ট্রিপ?
ফখরুদ্দিন সাহেব বিরস গলায় বললেন, ‘সর্দি ঝাড়ার জন্যে যাচ্ছি। তােমার এই দেশ নাকের সর্দি ফেলার জন্যে অতি উত্তম।
‘তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করবার চেষ্টা করছ? ‘হা, করছি।’
তােমার ব্রিফকেস খােল, ত্যাণ্ডব্যাগ খােল। চেকিং হবে।’ এক বার হয়েছে। ‘আরাে দশ বার হবে। তােমার সঙ্গে টাকাপয়সা কী পরিমাণ আছে?
যথেষ্টই আছে।’ ‘পরিমাণটা বল।
‘পরিমাণ তােমাকে বলার প্রয়ােজন দেখছি না। লিখিতভাবে আগেই এক বার বলা হয়েছে।
‘সুবােধ বালকের মতাে আরাে এক বার বল।’ ‘যদি বলতে না চাই? ‘তুমি এস আমার সঙ্গে। ‘কোথায়? ‘তােমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ ‘অতি উত্তম প্রস্তাব। চল, যাওয়া যাক।
ফখরুদ্দিন সাহেবকে তিন ঘন্টা বসিয়ে রাখা হল। যখন ছাড়া পেলেন, তখন তাঁর শরীর অবসন্ন। একটু পর পর বমি আসছে। বমির বেগ সামলাতে হচ্ছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা।
| হােটেলে পৌছেই বাংলাদেশে কল বুক করতে চাইলেন। বলা হল—স্যাটেলাইটে ডিসটারবেন্স আছে, ওভারসিজ কল ছ’ ঘন্টার আগে করা যাবে না।
. হেলেনার খোঁজে তাঁর নার্সিং হােমে টেলিফোন করলেন। এ্যাটেনডেন্ট নার্স বলল, ‘পেসেন্ট ঘুমুচ্ছে।
ফখরুদ্দিন সাহেব বললেন, আমি ওর স্বামী।
নার্স মধুর হেসে বলল, তুমি পেসেন্টের স্বামীই হও বা প্রেমিকই হও, হার্টের রুগীকে ঘুম থেকে ডেকে তােলা যাবে না। সকাল আটটায় টেলিফোন করাে, কেমন? এখন শান্ত হয়ে ঘুমাও। রাত কত হয়েছে সেটা বােধহয় তুমি জান না। গুড নাইট।
রুম-সার্ভিসকে কফি দিতে বলেছিলেন। সেই কফি এল এক ঘন্টা পর। চুমুক দিয়ে তাঁর মনে হল, তিনি কুইনাইন-গােলা গরম পানি খাচ্ছেন। | সারা রাত তাঁর ঘুম হল না। ছটফট করতে লাগলেন। শেষরাতের দিকে প্রবল জ্বরে সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে এল। তাঁর মনে হল এই হােটেলে তাঁকে মরতে হবে। আত্মীয়-পরিজনহীন নির্জন একটি ঘরে। শেষ মুহুর্তে পানি-পানি করে চেচাবেন কেউ শুনবে না। কোনাে প্রিয় মানুষের মুখ দেখতে চাইবেন, দেখতে পারবেন না।
প্রিয় মুখ এই সংসারে তাঁর নেই। বাবার মুখ আবছাভাবে মনে পড়লেও মা’র মুখ।
৩৪
মনে পড়ে না। বাবার মুখও অস্পষ্ট, তাঁর মুখে বসন্তের দাগ ছিল। মাথায় চুলগুলি ছিল লালচে ধরনের কোঁকড়ানাে। স্মৃতি বলতে এই। অবশ্যি এ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা কোনােকালেই ছিল না। যা চলে গিয়েছে, তা নিয়ে বুক চাপড়ানাে এক ধরনের বিলাসিতা। এই বিলাসিতা কবি এবং শিল্পীর জন্যে ঠিক আছে। তার জন্যে ঠিক নয়।
তাঁর চোখ পিছনের দিকে নয়, সামনের দিকে। | তিনি রুম-সার্ভিসের বােম টিপলেন। লাল বাতি জ্বলে জ্বলে উঠছে। কেউ আসছে
। অসম্ভব ক্ষমতাবান লােকেরা প্রায় সময়ই নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যায়।
দরজায় নক হচ্ছে। কেউ বােধহয় এসেছে। ফখরুদ্দিন সাহেব বহু কষ্ট্রে বললেন, ‘কাম ইন। | লালচুলের বেঁটেখাটো এক জন মহিলা উকি দিল। ভয়-পাওয়া গলায় বলল, তােমার কী হয়েছে?
ফখরুদ্দিন সাহেব জবাব দিতে পারলেন না। শূন্যদৃষ্টিতে তাকালেন।
মনে হচ্ছে ফিরােজের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। | বি. করিম সহেবের বন্ধু তাঁকে সহকারী ডিজাইনার হিসেবে নিয়েছেন। ভদ্রলােক ছােটখাটো। মাগুর মাছের মতাে কালােরও। ফিটফাট বা ধূ সেজে থাকেন। প্রীর কাছে গেলেই আফটার শেভ লােশনের কড়া গন্ধে মাথা ধরে যায়। তাঁর নাম মন্তাজ মিয়া। ছবির লাইনে পনের বছর ধরে আছেন। এখন পর্যন্ত কোনাে ছবি হিট করে নি। তার ধারণা, এবারের ছবিটি করবে। ছবির নাম ‘নয়া জিন্দেগি’—ইংরেজিতে ফ্রেশ লাইফ, নিউ লাইফ নয়।
এই ছবি হিট করবে, এ-রকম আশা করার সঙ্গত কারণ আছে। ছবিতে তিন জন হিরােইন। দু’ জন মারা যায়। শেষ পর্যন্ত এক জন টিকে থাকে। হিরাে এবং হিরােইন নয়া জিন্দেগি শুরু করে। ছটা গান আছে। প্রতিটি গানই কোলকাতার আর্টিস্টদের দিয়ে গাওয়ানাে। ব্যালে ড্যান্স আছে, যা রেকর্ড করা হয়েছে কোলকাতার এক ক্যাবারেতে। প্রিন্সেস সুরাইয়া এমন এক ড্যান্স দিয়েছে, যা দেখে এই বুড়াে বয়সেও মন্তাজ মিয়ার বুক ধরফড় করে। সেন্সর এই জিনিস কেটে দিলে সর্বনাশ হবে। ছবির অর্ধেক কাজ বিদেশে হয়েছে, বাকি অর্ধেক দেশে হবে। বেশির ভাগই আউটডােরে। ইনডােরে হিরাের বসার ঘর এবং বারান্দা। এমন সেট করতে হবে, যাতে রিকশাওয়ালা শ্রেণীর দর্শকদের চোখ কোটর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসে। ক্রমাগত সিটি বাজাতে থাকে।
মন্তাজ মিয়ার সঙ্গে ফিরােজের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল ; “তুমি করে বললে আপত্তি আছে?” ‘জ্বি-না।
‘গুড। সবাইকে আমি তুমি করে বলি। এ-দেশের যে টপ নায়িকা, যার সাইনিং মানি পচিশ হাজার টাকা, তাকেও তুমি করে বলি।
ফিরােজ তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না।
‘তুমি কাজে লেগে পড়। কীভাবে কী করতে হয়, আগে শেখ। আমি যা চাই সেটা হচ্ছে গ্ল্যামার। জি এল এ এম ও ইউ আর। বুঝলে?
‘জি, বুঝলাম। ‘বােম্বের ছবিগুলি দেখ। দেখে কাজ শেখ। ‘হ্যা, তাই করব।’ ‘বি করিম সাহেব বলেছেন, তুমি প্রতিভাবান লােক। সত্যি নাকি? ‘জি-না, সত্যি না।
‘গুড। ভেরি গুড। জি ও ও ডি। প্রতিভাবান লােকদের দিয়ে কিছু হয় না। আমি চাই কাজ। ওয়ার্ক। ডাবলিউ ও আর কে। বুঝলে?
‘জ্বি, বুঝলাম। ‘মদ্যপানের অভ্যাস আছে? ‘না।
‘অল্পসল্প খেতে পার। এতে দোষ নেই। অল্প খেলে মেডিসিনের মতাে কাজ করে। ব্রেইন শার্প হয়। ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলি যে এতদুর এগিয়ে গেছে জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে—এর পিছনে অ্যালকোহলের একটা ভূমিকা আছে বলে আমার ধারণা।
‘আপনার ধারণা সত্যি হবারই সম্ভাবনা। | ‘নায়িকাদের সঙ্গে খাতির জমাবার চেষ্ট করবে না। দূর থেকে ম্যাডাম বলে স্নামালিকুম দেবে। তারপর ভ্যানিশ হয়ে যাবে। ফিল্ম লাইনে তােমার হবে বলে আমার ধারণা।’
‘তাই নাকি?
‘হা। আমার ই এম পি ক্ষমতা আছে। আগেভাগে বলে ফেলতে পারি। মন্দিরা যখন প্রথম ফিল্ম লাইনে আসে, তাকে দেখেই আমি বললাম, তােমার হবে।’
হয়েছে?
হয়েছে মানে! দু’ লক্ষ টাকার আর্টিস্ট এখন। শিডিউল নিতে হয় এক বছর আগে। আমাকে এখনাে খুব মানে। সেদিন এক পত্রিকার ইন্টারভুতে আমার নাম বলেছে।
‘মন্দিরা কাজ করছে নাকি আপনার ছবিতে?
‘তুমি এখন ফিল্ম লাইনের লােক। নায়িকাদের নাম ধরে কথা বলবে না। এখন থেকে প্রাকটিস কর। বল—মন্দিরা ম্যাডাম।’
ফিরােজ হেসে বলল, মন্দিরা ম্যাডাম।’
‘হাসবে না। ফিল্ম লাইনে দাঁত বের করতে নেই। আচ্ছা, এখন যাও। কাল দু’ নম্বর স্টুডিওতে চলে আসবে।
ফিরােজ সেট তৈরি করে দিল। মন্তাজ মিয়া চোখ-মুখ কুঁচকে দীর্ঘ সময় সেই সেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ফিরােজ বলল, মনে হচ্ছে আপনার মনমতাে হয় নি? মন্তাজ মিয়া তারও জবাব দিলেন না। ‘পছন্দ না হলে অদলবদল করে দেব। হাতে তাে সময় আছে। ‘পছন্দ হয়েছে। ছােকরা, তােমার হবে।
| সেই সপ্তাহেই মধুমিতা মুভিজ-এর ব্যানারে নতুন যে-ছবিটি হবে, তার চীফ ডিজাইনার পদের অফার ফিরােজের কাছে চলে এল। ফিরােজ বলল, ‘ভেবে দেখি।”
মধুমিতা মুভিজ-এর মালিক বললেন, ‘ক’দিন লাগবে ভাবতে? ‘সপ্তাহখানেক লাগবে।’
‘বেশ, ভাবুন। সপ্তাহখানেক পর আবার যােগাযােগ করব। আপনার টেলিফোন আছে?
একটা টেলিফোন নিয়ে নিন। ছবির লাইনে টেলিফোনটা খুবই দরকারি। | ‘নিয়ে নেব। শিগগিরই নিয়ে নেব। তারপর একটা গাড়ি কিনব। লাল রঙের। টু ডাের। গাড়ি সম্পর্কে আপনার কোনাে ধারণা আছে? মানে কোনটা ভালাে, কোনটা মন্দ?
পর-পর দু’ দিন ফিরােজ ঘুমিয়ে কাটাল।
এ-রকম সে করে। তার ভাষায়, দুঃসময়ের জন্যে ঘুম স্টক করে রাখা। সেই স্টক-করা ঘুমের কারণে ভবিষ্যতে কোনাে রকম আলস্য ছাড়াই নাঘুমিয়ে থাকতে পারে। উট যেমন দুঃসময়ের জন্যে পানি জমা করে রাখে, অনেকটা সে-রকম। শুধু দুপুরে খাবার সময় পাশের ‘ইরাবতী’ হােটেলে খেতে গেছে। বাংলাদেশ হওয়ায় এই একটি লাভ ; সুন্দর-সুন্দর নামের ছড়াছড়ি। পানের দোকানের নাম ‘ময়ূরাক্ষী; জুতাের দোকানের নাম সােহাগ পাদুকা’।।
ইরাবতী রেস্টুরেন্টের নাম হওয়া উচিত ছিল- ‘নালাবতী’। পাশ দিয়ে কর্পোরেশনের নর্দমা গিয়েছে। নর্দমাগুলি বানানাের কায়দা এমন যে, পানি চলে যায়, কিন্তু ময়লা জমা হয়ে থাকে। সেই পূতিগন্ধময় নরকের পাশে খাবার ব্যবস্থা। তবে রান্না ভালাে। পচা মাছও এমন করে বেঁধে দেয় যে দ্বিতীয় বার যেতে ইচ্ছে করে। ইরাবতী রেস্টুরেন্টে ফিরােজের তিন শ’ টাকার মতাে বাকি ছিল। সে বাকি মিটিয়ে আরাে দু’ শ’ টাকা অ্যাডভান্স ধরে দিল। দিনকাল পাল্টে গেছে। অ্যাডভান্স পেয়েও লােকজন খুশি হয় না। ম্যানেজার এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগে একটি জ্যান্ত ইদুর গিলে ফেলেছে। সেই ইদুর হজম হয় নি, পেটে নড়াচড়া করছে।
ফিরােজ বলল, ‘আছেন কেমন ভাইসাব ? ‘ভালােই। আপনারে তাে দেখি না। ‘সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। সিনেমায় নেমে পড়েছি, বুঝলেন? ম্যানেজার ফুস করে বলল, “ভালােই।
‘আপাতত হিরােইনের বড় ভাইয়ের রােল করছি। মােটামুটি একটা সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার। বই রিলিজ হলে দেখবেন। পাস দিয়ে দেব।’
‘নাম কী বইয়ের?
নয়া জিন্দেগি। হিট বই হবে।’ ফিরােজ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে মিষ্টি পান কিনল। রাতে আর খেতে আসবে । ঘরেই যা হােক কিছু খেয়ে নেবে, কাজেই পাউরুটি, কলা এবং এক কৌটা মাখন কিনল। বাজারে নতুন বরই উঠেছে, খেতে ইচ্ছা করছে। ভাংতি টাকা সব শেষ। একটা
৩৭
পাঁচ শ টাকার নোেট আছে, সেটা ভাঙাতে ইচ্ছা করছে না। বরই না-কিনেই সে ফিরে এল। ছেলেমানুষি একটা আফসােস মনে জেগে রইল।
হাজি সাহেব বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে আছেন। ফিরােজ হাসিমুখে এগিয়ে গেল।
চলবে….