চুক্তির বউ ৪র্থ পর্ব
লেখা:তামান্না
হাসপাতালের সামনে এসে শ্রাবণ ব্রেক করতেই মেঘ ধাক্কা খায় সাথে সাথেই মেঘের ঘোর কাটে…
শ্রাবণঃনামো।
মেঘঃআপনি ভেতরে যাবেন না।
শ্রাবণঃনা আমার অফিসে কাজ আছে। তুমি অপেক্ষা করো আমি বিকেলে এসে তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো।
মেঘঃআপনি না বললেন মিটিং কেন্সেল করেছেন।
শ্রাবণঃহ্যা করেছি।
মেঘঃতাহলে কি কাজ অফিসে?
শ্রাবণঃনতুন যে আসবে তাকে সমস্ত কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে।
মেঘঃসেটা তো ম্যানেজার কে বলে দিলেই হয় আপনার যাওয়ার কি দরকার?
শ্রাবণঃজয়েন যে করবে সে একজন মেয়ে আর আমার খুব কাজের কেউ।
শ্রাবণের এমন কথায় মেঘ প্রথমে একটু কষ্ট পেলেও পরে আবার সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে…..
মেঘঃস্পেশাল কেউ হয়।
শ্রাবণঃহ্যা স্পেশাল।
মেঘ আর কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে যায়। একবার ও পিছন ফিরে তাকায়নি।এক রকম দৌড় দিয়ে হাসপাতালের ভেতর ডুকে যায়। শ্রাবণ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অফিসের দিকে গেলো।
মেঘ সারাদিন তার মায়ের সেবা করেছে মায়ের সাথে অনেক আড্ডা দিলো।
মেঘের মাঃমেঘ একটা কথা বলি।
মেঘঃহ্যা মা বলো কি বলবে?
মেঘের মাঃতুই শ্রাবণের সাথে ভালো আছিস তো।
মেঘঃমা এটা কেমন প্রশ্ন? ভালো না থাকলে কি আজ শ্রাবণ নিজে আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে যেত।
মেঘের মাঃআমি জানতাম শ্রাবণ তোকে বুঝবে।
মেঘঃহুম……..
শ্রাবণ অফিসের নতুন কর্মচারী কে কাজ বুঝিয়ে দিলো তারপর হাসপাতালে গেলো।
শ্রাবণঃএটা কি হলো মা?(ভেতরে ডুকতে ডুকতে)
মেঘের মাঃকেনো বাবা কি হয়েছে?
শ্রাবণঃমেয়েকে কাছে পেয়ে ছেলেকে ভুলে গেলেন এটা কিন্তু ঠিক হলো না।
মেঘের মাঃকে বলেছে ভুলে গেছি?
শ্রাবণঃতা নয়তো কি?মেয়েকে নিজের বুকে জড়িয়ে রাখলেন আর আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি।
মেঘের মাঃশোণ ছেলের কথা।এদিকে এসো তো।
শ্রাবণ একটা চেয়ার টেনে ওনার পাশে বসলো।মেঘ বার বার শ্রাবণের দিকে তাকাচ্ছে।মায়ের কাছে এলে ছেলেটা কেমন অন্যরকম হয়ে যায় আর বাসায় সবসময় গোমড়া মুখ নিয়ে থাকে।
কি আছে ওনার মনে?কেনো এমন অভিনয় করছেন?নিজেতো কষ্ট পাচ্ছেন সাথে আমাকেও একটা চুক্তির মাঝে আটকে রাখছেন।ওনি আসলেই চান টা কি?
শ্রাবণঃহ্যা মা বলুন।
মেঘের মাঃআমার না এইখানে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর পারছি না থাকতে।
মেঘঃকি বলছো মা?তুমি ঠিক আছো তো ডাঃ কে ডাকবো?
মেঘের মাঃনা রে মা আমি ভালো আছি।আমার না বাড়ি যেতে খুব ইচ্ছে করছে।আমাকে নিয়ে যা এখান থেকে।
মেঘ একবার শ্রাবণের দিকে তাকায় তারপর আবার মায়ের দিকে তাকায়।শ্রাবণ হয়তো বুঝতে পারছে মেঘের চোখের ভাষা। তাই শ্রাবণ নিজেই মুখ খুলে।
শ্রাবণঃমা আমি ডাঃ কে বলে দেখছি রিলিজ করে দেয় কি না?
মেঘঃকিন্তু মা কে নিয়ে যাবো কোথায়?
শ্রাবণঃকেনো?আমাদের বাড়ি আছে কি জন্য?
মেঘঃওখানে নেওয়া টা ঠিক হবে না।
শ্রাবণঃআমি তোমার কোনো কথাই শুনছি না।মা আজ আমাদের এইখানেই যাবে।আর এখন থেকে ওখানেই থাকবেন এটা আমার ডিসিশন। তুমি কোনো কথা বলবে না এটাই ফাইনাল।
আমি দেখি ডাঃ কি বলেন।
তারপর শ্রাবণ ডাঃ এর সাথে কথা বলতে গেলো…..
শ্রাবণঃডক্টর আসবো।(দরজার সামনে দাঁড়িয়ে)
ডাক্তারঃহ্যা শ্রাবণ এসো।কিছু বলবে।
শ্রাবণঃআসলে আমি চাইছিলাম মাকে আজকেই বাসায় নিয়ে যেতে এখানে থাকতে হয়তো ওনার অসুবিধা হচ্ছে।
ডক্টরঃসেটা ঠিক তবে শ্রাবণ ওনার ঠিক মতো যত্ন নিতে হবে যদি ও ওনার হাতে সময় খুব কম তাও যতদিন আছেন ততদিন তোমাদের একটু কষ্ট করতে হবে।
শ্রাবণঃএটা কোনো ব্যাপার না ডাঃ আমি আর মেঘ সব সামলে নিবো।ওনার সেবার কোনো ত্রুটি আমি রাখবো না।
ডক্টরঃসেটা আমি জানি শ্রাবণ তোমাকে তো আমি আজ থেকে জানিনা।তোমার মায়ের দিকটাই দেখো না আজ দুবছর ধরে ওনার এই অবস্থা অথচ তুমি ওনাকে সব রকম ভাবে সাহায্য করছো।
শ্রাবণঃমামনির এই অবস্থার জন্যতো আমিই দায়ী ডক্টর যদি একটু সেবা করে আমার পাপের বুঝা টা হাল্কা করতে পারি সেটাই বা কম কিসের।
ডক্টরঃদেখো আমি এভাবে বলিনি।তুমি আমার কথায় কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত শ্রাবণ।আসলে এ পর্যন্ত তোমার মায়ের সবরকম ট্রিটমেন্ট এই হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয় আর সেটা আমি ই হ্যান্ডেল করে আসছি। আমি তো সবই জানি তাই বললাম। I am sorry Shrabon.
শ্রাবণঃIt’s okay Doctor…..আমি কি মাকে নিয়ে যাবো।
ডক্টরঃতোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে।দাড়াও আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তুমি আজকেই ওনাকে নিয়ে যাবে।
শ্রাবণঃThank You Doctor.Thank You So Much…..
ডক্টরঃএটা আমার দায়িত্ব শ্রাবণ।আমি জানি ওনার কোনো অযত্ন হবে না।
শ্রাবণঃআসি তাহলে।
ডক্টরঃতুমি যাও আমি ওনার রিলিজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
শ্রাবণঃOkay….
তারপর শ্রাবণ কেবিনে ডোকে মেঘের মায়ের সাথে গল্প করতে লাগলো।ডক্টর ডিসচার্জ পেপারে সই করতে বলে মেঘের মাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেয়।
এরপর ওরা বাসায় চলে আসে।এখানে আসার পর মেঘকে সবদিকটাই সামলাতে হচ্ছে।একদিকে মায়ের সেবা অন্যদিকে শ্বাশুড়ি মায়ের যত্ন সব মিলিয়ে মেঘ একটু চাপে থাকলেও কাউকে কোনোপ্রকার কষ্টে ফেলতে চায় না নিজের হাতেই সব কাজ সামলে নেয় মেঘ।
শ্রাবণ ও অনেক হেল্প করে মেঘের কাজে।যতটা সময় বাসায় থাকে সেই সময় টুকু মেঘকে কাজে সাহায্য করে।
এভাবেই দিন কেটে যায় দেখতে দেখতে মেঘ আর শ্রাবণের বিয়ের প্রায় ৪ মাস কেটে যায়। মেঘ অনেকবার চেষ্টা করেছে শ্রাবণের ব্যাপারে সব জানতে কিন্তু বরাবরি মেঘকে হার মানতে হচ্ছে।একটা সময় ছিলো মেঘ শুধুমাত্র একজন স্টাফ ছিলো শ্রাবণের। আর আজ শ্রাবণের বউ।যদি ও এটা চুক্তির মাঝে সীমিত ছিলো তাও এই কয়েকমাসে শ্রাবণের প্রতি মেঘের একটা টান জন্মাতে শুরু করে।মেঘ নিজেও জানে না সে শ্রাবণের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে।অথচ এই সম্পর্ক টা আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো স্বাভাবিক না।মেঘ বার বার শ্রাবণের সমস্ত অতীত জানতে চায় শত চেষ্টার পরেও মেঘের জানা হয়ে উঠে না।
এই চার মাস ভালো কাটলেও বিপত্তি ঘটে পাঁচ মাসের মাথায়।মেঘের জীবন থেকে হারিয়ে যায় তার সবচাইতে কাছের মানুষ।বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।হ্যা সে আর কেউ না মেঘের মা।আজ সকালের ঘটনা……..
শ্রাবণ অফিসে যাওয়ার পর মেঘ,মেঘের মা,মেঘের শ্বাশুড়ি সবাই মিলে একটা গল্প করছিলেন।হঠাৎ করেই মেঘের মা বুকের ব্যথায় চটপট করতে থাকেন।মেঘ দ্রুত ডাঃ কে কল করে একটা এম্বুলেন্স এ করে ওর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শ্রাবণের মাকে বাসায় রেখে গেলো। মেঘ শ্রাবণ কে কল করে হাসপাতালে আসতে বলে। যখন শ্রাবণ হাসপাতালে যায় মেঘের মা শ্রাবণের হাত ধরে শুধু একটাই কথা বললেন……
মেঘের মাঃশ্রাবণ আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো।সব হারিয়েছে ও আজ আমি চলে যাচ্ছি। হয়তো আল্লাহ আমাকে এই পৃথিবীর সুখ থেকে বঞ্চিত করতে চান তাই তো আজ আমাকে ওপারে যাওয়ার জন্য ডাকছেন।আমি চলে যাওয়ার পর ওর আপন বলতে তুমি আর তোমার মা থাকবে।তুমি আমার মেয়েটাকে একটু ভালো রেখো বাবা।
শ্রাবণঃমা প্লিজ শান্ত হন।কিচ্ছু হবে না আপনার এক্ষুণি ঠিক হয়ে যাবেন।আমি ডক্টর কে ডাকছি।
শ্রাবণ ডাঃ কে ডাকলে গেলে মেঘ খুব জুরে একটা চিৎকার দেয়…..
মেঘঃমা……….ও মা কথা বলো না মা।প্লিজ কথা বলো।এভাবে আমাকে একা করে দিও না মা।আমি কিভাবে থাকবো তোমাকে ছাড়া ও মা কথা বলো না প্লিজ চুপ করে থেকো না।ও মা থাকাও না আমার দিকে।
মেঘের কান্না দেখে শ্রাবণ থমকে যায়। ডাঃ কে ডাক দিলে ওনি এসে পালস চেক করে ওনাকে মৃত ঘোষনা করেন।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত মেঘ একটাও কথা বলেনি।কেমন যেন হয়ে গেছে মেয়েটা। কারো সাথে কথা বলে না।শ্রাবণ জানাজা শেষ করে ওনাকে কবরস্থান এ দাফন করে এলো।
হাসপাতাল থেকে আসার পর মেঘ এখনো নিজের রুম থেকে বের হয় নি।শ্রাবণ ওর মায়ের সাথে কথা বলে মেঘের কাছে যায়।
মেঘ কেমন যেন ধুম মেরে বসে আছে।কোনো দিকে তাকাচ্ছেও না।শ্রাবণ এসে ওর কাছে বসলো।ওর হাতে হাত রেখে আলতো স্বরে ডাক দিলো।
শ্রাবণঃমেঘ কিছু খেয়ে নিবে এসো।
শ্রাবণের ছোঁয়া পেয়ে মেঘ যেন হোশ ফিরে পায়।ঝাপটে ধরে শ্রাবণ কে।সারাদিন ধরে কান্না করেছে তাও যেন কান্না থামার নাম নিচ্ছে না।শ্রাবণ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মেঘ।
শ্রাবণঃমেঘ প্লিজ শান্ত হও।দেখো এটা তো হওয়ারই ছিলো।কেউ তো সারাজীবন বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসেনি।আজ অথবা কাল আমাদের কেও যেতে হবে।পৃথিবী তে আমরা কেউই স্থায়ী না।আমাদের জন্য পরকাল বলেও একটা জীবন আছে।ইহকালীন জীবন ছেড়ে আমাদের সবাইকেই একদিন পরপারে আশ্রয় নিতে হবে।প্লিজ মেঘ একবার বুঝার চেষ্টা করো।তুমি তো জানোই তোমার মায়ের কতো বড় রোগ ছিলো।হার্টের ফুটো অপারেশন করেও রোগীকে বাঁচানো যায় না অথচ তুমি মাকে পাঁচ মাস নিজের কাছে পেয়েছো।এরকম রোগী তো অপারেশন থিয়েটারেই মারা যায়। আল্লাহ কতো মহান যে ওনি তোমার তোমার মাকে কিছুদিন বেঁচে থাকার সুখ দিয়েছেন।
মেঘঃ…………….অবিরাম পানি জড়ছে চোখ থেকে।
শ্রাবণঃপ্লিজ মেঘ একটু শান্ত হও।
মেঘঃডক্টর মিথ্যে বললো কেনো?ওনি তো ছয়মাস সময় দিয়েছিলেন তাহলে কেনো আজ মা আমাকে একা করে চলে গেলো কেনো এমন হলো।(গলাটা ধরে আসছে কথা বলার মতো শক্তি নেই তাও কান্নাভরা কন্ঠে বলতে থাকে)
শ্রাবণঃতুমি তো জানো মেঘ মায়ের কান্ডিশন কেমন ছিলো তাও বোকার মতো কথা কেনো বলছো।আর ডাক্তার কি মানুষ এর জীবন মরনের খবর জানে নাকি ওনারা শুধু নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে সামান্য কিছু বুঝার চেষ্টা করেন আর সেই অভিজ্ঞতা থেকে ওনি ছয়মাস সময় বলেছিলেন।
শ্রাবণ মেঘকে কোনোরকম বুঝিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে বসায়।মেঘ এক মনে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে খেতে ইচ্ছে করছে না।গলা দিয়ে খাবার নামছেই না।কিন্তু না খেলে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বে।
মেঘ খাচ্ছে না দেখে শ্রাবণ নিজেই মেঘের মুখে খাবার তুলে দিলো।শ্রাবণ খাবারটা মুখের সামনে তুলে দিতেই মেঘ আপনা থেকেই হা করে খেয়ে নেয়।হয়তো শ্রাবণ বকা দিবে ভেবে খেয়ে নিলো।
মেঘকে খাইয়ে দিয়ে শ্রাবণ ওকে রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে ঘুমোতে বললো।
মেঘঃকেনো এমন হলো?
মেঘ আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।শ্রাবণ ওর পাশে বসে ওর মাথাটা বালিশে রেখে মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
শ্রাবণঃপ্লিজ মেঘ আর কান্না করে নিজেকে কষ্ট দিও না।এতে তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে।
মেঘঃ………..
শ্রাবণঃবললাম না ঘুমিয়ে পড়তে।তুমি কেনো বুঝোনা মেঘ তোমার কিছু হলে আমি…….
মেঘঃচোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
শ্রাবণঃওইভাবে তাকাবে না ঘুমাও বলছি।(নিচু স্বরে ধমক দিলো)
মেঘ সাথ সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো।একটু পর মেঘ ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলো।শ্রাবণ উঠে মায়ের রুমে যাবে অমনি টান খেয়ে বিছানায় পড়ে যায়।
চলবে……..