চুক্তির বউ ৩য় পর্ব

0
3371

চুক্তির বউ ৩য় পর্ব

লেখা:তামান্না
শ্রাবণ রুমে ডুকে মেঘকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কিছু না বলেই বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।ভাবতে থাকে আজকের দিনটার কথা।মেঘকে কতোটা কষ্ট দিলো একটা চুক্তির কাগজ দিয়ে,মেঘ জানেও না তার সাথে কি হলো।শ্রাবণ নিজেকে বার বার বকছে ওকে সত্যিটা বলতেই পারতো কিন্তু এতে যদি মেঘ দূরে সরে যায় সেই ভয়েই তো একটা চুক্তি।কিন্তু শ্রাবণ কি পারবে এই চুক্তির মাধ্যমে মেঘের মনে জায়গা করে নিতে নাকি মেয়েটা ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিবে।শ্রাবণ নিজের ডায়রীটা হাতে নিয়ে লেখা শুরু করে।
শ্রাবণের একটাই অভ্যাস এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব কিছুই এই ডায়রীতে লিখে রাখা।যত কষ্ট যত সুখ সব কিছুই এর মাঝে লেখা।লিখতে লিখতে শ্রাবণ চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ে।
মাঝরাতে মেঘের ঘুম ভেঙে যায়।রুমের লাইট অন দেখে মেঘ অবাক হয়। এতো রাতে লোকটা লাইট জ্বালিয়ে রাখলো কেনো?চারিদিক তাকিয়ে দেখে শ্রাবণ চেয়ারেই ঘুমিয়ে আছে।মেঘ উঠে শ্রাবণের পাশে যায়।হাতের নিচে একটা ডায়রী দেখে মেঘ সেটা ধরবে কি ধরবে না এই সব ভাবতে ভাবতে ডায়রীটা হাতে নিয়েও আবার টেবিলেই রেখে দিলো।কারো পারসোনাল জিনিসে অনুমতি ছাড়া হাত দেওয়া টা চরম অন্যায়।মেঘ সেই অন্যায় কিছুতেই করবে না।মেঘ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় শেষ এর দিকে।তাই ওয়াশরুম এ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পালটে অন্য একটা শাড়ি পরে নেয়।অজু করে তাহাজ্জুদ এর নামাজ আদায় করে নিলো
তারপর কোরঅান তেলাওয়াত করে।ফজরের আজান দিলে নামাজ আদায় করে নেয়।একটু পর চারিদিক টা আলোয় চিকচিক করবে।দেরী না করে মেঘ রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো।তখন ওর শ্বাশুড়ি মায়ের গলার আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল।ওনার ফুঁপানির কন্ঠ শুনে মেঘের বুঝতে বাকী রইলো না যে ওনি কান্না করছেন।কিন্তু এতো সকাল কেনো কাঁদছেন সেটা জানার বড্ড কৌতূহল হয় মেঘের।দরজার কান পেতে এমন কিছু কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
কিছু সময় পর নিজেকে সামলে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে আগায়।সকালের সব নাস্তা মেঘ নিজের হাতে করে।তারপর শ্রাবণের মায়ের রুমে ঠোকা দেয়,
মেঘঃমা দরজা টা কি খুলবেন?
শ্রাবণের মাঃকে বউমা?
মেঘঃহ্যা মা আমি মেঘ।
শ্রাবণের মাঃওখানেই থাকো আসছি মা।
ওনি উইল চেয়ার ঠেলে দরজা খুলে মেঘকে দেখে অবাক।এক্কেবারে ঘরের গিন্নি।হাতে চায়ের কাপ।চুলে খোপা শাড়ির আচল কোমরে গোজা।
মেঘঃমা আপনার চা,(চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে)
শ্রাবণের মাঃএকই মা এতো সকালে তুমি রান্না ঘরে ফুলি কোথায়?
মেঘঃফুলি অন্য কাজ করছে তাই আমি রান্নাটা করে নিলাম।
শ্রাবণের মাঃইশ প্রথম দিন ই রান্না ঘরে কেনো গেলে মা ফুলিই করে দিতো।
মেঘঃমা এতোদিন ফুলি সব করেছে আজ থেকে আমি করবো আপনি কিন্তু আপত্তি করতে পারবেন না।আর আপত্তি করলেও আমি শুনছিনা।আমি কিন্তু খুব বেয়াদব টাইপের মেয়ে কথা না শুনার অভ্যাস আমার আছে।
শ্রাবণের মাঃতোমার সাথে কথায় পারবো না।এসো ভিতরে এসো।
মেঘঃচা টা নিন।আর কি খাবেন বলুন আমি রান্না করে নিয়ে আসছি।
শ্রাবণের মাঃকিছু লাগবে না মা।এতোদিনে আমার ঘরে লক্ষি এসেছে আমার বাদর ছেলেটা এবার একটু ভালো থাকবে।
মেঘঃকেনো মা,ওনি কি ভালো থাকতেন না?
শ্রাবণের মাঃনা মা ঠিক তা না।তুমি ওর স্ত্রী।ওর সব কথা জানার অধিকার তোমার আছে তবে সেটা আজ না অন্যদিন তোমাকে বলবো।
মেঘঃমা আপনি কি কিছু লুকাচ্ছেন আমার থেকে?
শ্রাবণের মাঃতোমার থেকে কিছু লুকানোর অধিকার আমার নেই মা।এখানে বসো……(বিছানায় বসিয়ে)
মেঘঃতাহলে এইভাবে বলছেন কেনো?বলুন না মা কি হয়েছে আমি কি জানতে পারি না?
শ্রাবণের মাঃজানবে তবে সেটা শ্রাবণের থেকে আমি কিছু বললে শ্রাবণ কষ্ট পাবে।আমি চাই তুমি সেটা ওর থেকে জানো।আর ওর ভেতরের একটা গিল্টি ফিলিং আছে যে টা তোমাকেই দূর করতে হবে।ও বার বার নিজেকে দোষী ভাবছে কিন্তু আমি তো মা আমি জানি আমার ছেলেটার কোনো অন্যায় নেই।
মেঘঃআমি কিভাবে জানবো মা?
শ্রাবণের মাঃবোকা মেয়ে তুমি ওর বিবাহিতা স্ত্রী। এমন কিছু ব্যাপার নেই যে টা শ্রাবণ তোমার থেকে লুকাবে তবে কিছু একটা নিয়ে ও খুব কষ্ট পাচ্ছে সেটা আমি আজো জানতে পারছি না কিন্তু বুঝতে পারি আমার ছেলের কষ্ট।ও রোজ রাতে একটা ডায়রীতে কি যেন লিখে রাখে যে তা আমি রোজ ফলো করতাম কিন্তু কাল জানিনা ওর মনের মধ্যে কি ঝড় গেছে শুধু এইটুকু জানি আমার ছেলেটা ভালো নেই।মেঘ আজ থেকে তো তুই আমার বউ না আমার মেয়ে।পারবি না আমার ছেলেটাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে।পারবি না আমার ছেলের মনের সব গিল্টি ফিলিং গুলো দূর করতে, পারবি না ওকে তোর ভালোবাসা দিয়ে একটা সুন্দর জীবন গড়ে দিতে।(মেঘের হাতে হাত রেখে)
কি করবো মা আমি।আমি যে একটা চুক্তির ভেতর আটকে আছি যে টা এক বছর পর শেষ হয়ে যাবে তারপর তো দুজন দুপ্রান্তে ছিটকে পড়বো।এই বছরে কিভাবে পারবো আমি ওনার কষ্ট টা দূর করতে জানিনা কি আছে ওনার মনে তবে যাই থাকুক সেটা আমাকে জানতেই হবে।(মনে মনে)
শ্রাবণের মাঃকি রে মা রাখবি না আমার এই অনুরোধ?
মেঘঃছি ছি মা আপনি এভাবে বলবেন না।আমি চেষ্টা করবো ওনার কষ্ট গুলো দূর করার।
শ্রাবণের মাঃ যা গিয়ে দেখ ওর কি লাগে।আমি একটু রান্নাঘর এ দেখি ফুলি কি করছে?
মেঘঃমা আপনি বিশ্রাম নিন।তাছাড়া এখন তো আমি আছি আমি থাকতে আপনি কষ্ট করে রান্না ঘরে যাবেন সেটা কিভাবে হয় বলেন তো।
শ্রাবণের মাঃঠিক আছে রান্নাঘরে যাচ্ছি না আমাকে একটু সোফার কাছে নিয়ে চল।একটু বসি।
মেঘঃঠিক আছে আসুন।
মেঘ উইল চেয়ার টা ঠেলে ওনাকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।তারপর রুমে গিয়ে দেখে শ্রাবণ চেয়ারে নেই।ওয়াশরুম থেকে টেপ এর আওয়াজ আসছে তারমানে ওনি ওয়াশরুমে।
মেঘ রুমটা টিকটাক করে নিচে চলে আসে।
তারপর সব নাস্তা রেডি করে সবাইকে খাবার দিলো।সকালের নাস্তা শেষ করে শ্রাবণ রেডি হয় অফিস যাবে বলে।
মেঘঃএকই আপনি রেডি অনেক দেরী হয়ে গেলো তাইনা।ইশ কখন অফিস যাবো।(রুমে ডুকতে ডুকতে)
শ্রাবণঃকোথায় যাবে?(ভ্রু কুঁচকে)
মেঘঃকেনো অফিস যাবো আজ না একটা মিটিং আছে অফিসে।
শ্রাবণঃতো কি হয়েছে?
মেঘঃকি হয়েছে মানে অফিস যাবো।রেডি হবো এখন।
শ্রাবণঃতুমি কোথাও যাচ্ছ না?
মেঘঃমানে কি?
শ্রাবণঃমানে খুব সহজ তুমি অফিস যাচ্ছ না আমি একাই যাচ্ছি।
মেঘঃকিন্তু কেনো?
শ্রাবণঃতোমার পোস্টে আজ থেকে অন্য একজন জয়েন করবে।
মেঘঃমানে আমার জব।
শ্রাবণঃনেই।(টাই বাধবে বাধতে)
মেঘঃWhat?(মেঘ ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে)
শ্রাবণঃকি হলো টা কি তোমার?
মেঘঃএখন আমি কি করবো?মায়ের ট্রিটমেন্ট এর এতো টাকা কোথায় পাবো।কিভাবে মায়ের ওষুধের টাকা জোগাড় করবো কিভাবে মাকে বাসায় নিয়ে যাবো তাছাড়া এখনো বাড়িওয়ালার অনেক দেনা বাকি।এখন কি করবো আমি কিভাবে সবটা ম্যানেজ করবোম(মেঘ ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পরে)
শ্রাবণঃমেঘ কি হয়েছে কাঁদছো কেনো?
মেঘঃআমার চাকরী টা কেনো কেঁড়ে নিলেন জানতে পারি।
শ্রাবণঃতোমার আর চাকরীর কি দরকার ঘরের বউ হয়ে চাকরী করবে এটা কেমন যেন দেখায় তাছাড়া একই অফিসে স্বামী-স্ত্রী চাকরী করবে এটাতো বেমানান। আর আমি যেখানে তোমার স্বামী সেই অফিসে তুমি জব করতে Comfortable Feel করবে না তাই পোস্ট এ অন্য কাউকে জয়েন দিলাম।
মেঘঃওহহ ভালো ঘরের বউ হয়ে মায়ের দায়িত্ব নেয়া থেকে বঞ্চিত হলাম।
শ্রাবণঃমানে কি বলছো?
মেঘঃকিছু না।আপনি যান আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে।আজ তো জরুরী মিটিং আছে।
শ্রাবণঃমিটিং কেন্সেল করে দিয়েছি।
মেঘঃকেনো?
শ্রাবণঃঅন্য একটা কাজ আছে।
মেঘঃওহ তাহলে যান দেরী হয়ে যাবে।
শ্রাবণঃতুমি রেডি হও।একসাথে বের হবো।
মেঘঃকেনো?আমি কোথাও যাবো না।
শ্রাবণঃএতো প্রশ্ন করার অধিকার আমি তোমাকে দেইনি।তুমি আমার স্ত্রী তাই এখন থেকে আমি যা বলবো তাই করতে হবে।যাও গিয়ে রেডি হও।(ধমক দিয়ে)
মেঘঃআমি তো ভুলেই গেছিলাম আমি আপনার #চুক্তির_বউ আপনি যা বলবেন আমাকে তো তাই করতে হবে।সেই অধিকার থেকেই একটা কথা জানতে চাইবো বলবেন।
শ্রাবণঃকি জানতে চাও বলো?(হাটু গেড়ে বসে অনুর হাতে হাত রাখে)
মেঘঃআপনি তো একজনকে ভালোবাসেন তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেনো?তাও একটা এগ্রিমেন্ট পেপারে সই করিয়ে।আমি কি খুব বড় ক্ষতি করেছি আপনার যার জন্য এতো বড় সাজা টা আপনি আমায় দিলেন।আজ অব্দি কোন কথাটা শুনিনি আপনার অফিসের সব কাজ ঠিক মতো করে নিজের মাকে নিয়ে যে দুনিয়া টা ছিলো এখন তো সেটাও শেষ হয়ে গেলো।কেনো করলেন এমন টা আমার সাথে।
শ্রাবণঃআমি তোমার সব কথার জবাব দিতে বাধ্য নই।শুধু একটা কথা জেনে রাখো শ্রাবণ মাহমুদ আজ অব্দি যা যা চেয়েছে তার মা বাবা তাকে সেটাই এনে দিয়েছে আর আজ তার মায়ের চাওয়ার গুরুত্ব সে দেবেনা এটা তো হতে পারে না।আমার মামনিকে আমি খুশি দেখতে চাই আমার মামনি আমার সব চাওয়া পূরণ করেছে তাই আমি তার একটু হলেও মামনিকে ফিরিয়ে দিতে চাই।আর হ্যা আজ থেকে আমি তোমাকে যতটুকু জানার অধিকার দিবো ঠিক ততটুকুই জানবে।এর থেকে বেশি কিছু প্রশ্ন করবে না আমার পছন্দ না এখন চুপচাপ গিয়ে রেডি হও।মাকে দেখতে যাবো।তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে আবার অফিস যেতে হবে।
মেঘঃআপনি কেনো এমন করছেন।যে টা জানতে চাইলাম উত্তত দিন না প্লিজ।কেনো আমার জীবনটা নিয়ে খেলছেন আপনি।কি অধিকারে।
শ্রাবণঃআমি তোমার জীবন নিয়ে খেলছি এটা তুমি ভাবলে কিভাবে মেঘ।তোমার মুখে একবার
ও আটকালো না এইরকম কথা বলতে তুমি এতোটা পাষাণ কিভাবে হও বলোতো?(শ্রাবণে চোখে জল টলমল করছে)
মেঘঃঅন্যায় আপনি করলেন আর অপরাধী আমি বাহ মি.শ্রাবণ মাহমুদ বাহ কি সুন্দর কথা বললেন আপনি।যাই হোক আমি একা যেতে পারবো আপনার আর দরকার হবে না আপনি অফিসে যান।
শ্রাবণঃবেশি বকবক না করে তাড়াতাড়ি রেডি হও।আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
শ্রাবণ আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুম থেকে বের হয়ে গেলো।মেঘ রেডি হয়ে নিচে নামে তারপর কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসে।মেঘ বার বার শ্রাবণের দিকে তাকায়।শ্রাবণ একটা কথাও বলে না।চুপচাপ ড্রাইভ করে যাচ্ছে।শ্রাবণের চোখে এখন জল এর চিহ্ন বুঝা যাচ্ছে। অনু ভাবতে থাকে…..
কি এমন কষ্ট ওনার যার জন্য ওনি এখনো এতো কষ্ট পান।আমার সাথেই বা এমন এগ্রিমেন্ট কেনো করলেন।কিভাবে বুঝবো আমি?কিভাবে জানবো সব সত্যি?কি এমন গোপন তথ্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে যার জন্য আমাকেই ওনার #চুক্তির_বউ হতে হলো।এতো কিসের কষ্ট ওনার।সব জানতে হবে আমাকে সব জানতে হবে।যেভাবেই হোক মায়ের কথা আমাকে রাখতেই হবে।আমি মাকে কথা দিয়েছি ওনার সব কষ্ট দূর করে ওনার মুখের হাসি টা আবার ফিরিয়ে আনবো।আমাকে যে পারতেই হবে মা।পারতেই হবে।শত হলেও আমি ওনার এগ্রিমেন্ট করা বউ। আর একবছর তো অনেক সময় আমি এই একটা বছরকেই কাজে লাগাবো।
চলবে………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে