আমার সে আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে! আমি প্রথম দিকে খুব অবাক হতাম। বিশ্বাসই হতোনা সে আমাকে ভালোবাসতে পারে? এতো অসুন্দর মেয়েকে এতোটা তীব্রভাবে কেউ ভালোবাসতে পারেনা। কিন্তু আমার সেই বিশ্বাস সে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে! তার সাথে প্রতিদিন নিয়ম করে কথা না বললে মুখ ফুলিয়ে থাকে। ম্যাসেজের রিপ্লাই না দিলে তো কথাই নাই। পাগলের মতো বিহেভ করে।
– এই তুমি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছো না কেনো? কিছু হয়েছে? আমি কিছু করেছি?
সুন্দরী মেয়েদের ভাগ্যে এরকম পুরুষ থাকে। আমার মতো মেয়েদের ভাগ্যে থাকে রাগী, রুক্ষমূর্তি, রুক্ষভাষী পুরুষ। যে পুরুষ আমার মতো মেয়েদের বিয়ে করে আইবুড়ো নামক শব্দটার হাত থেকে রেহাই দিয়েছে। সেই পুরুষ তো রাগ দেখাবেই।
আমি তার সাথে দেখা করতে চাইতামই না। নিজের অসৌন্দর্যো টাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। সে বুঝতো। বুঝেই বলতো
– এই স্কার্ফের নেকাব টা একটু খুলো না।
– নাহ।
– মাত্র ৫ মিনিটের জন্য। শুধু দেখবো, মাত্র ৫ মিনিট।
আমি বাধ্য হতাম নিষাদের কথা মানতে।
আমরা সবাই চাই কেউ একজন থাকুক যার আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা থাকবেনা। আমি পেয়েছিলাম এমন কাউকে। পেয়েছিলাম বলে ভুল হবে, পেয়েছি।
আমার জন্য তার রাজ্যের চিন্তা।
একবার হলো কী আমি আর ও ক্যাম্পাসে বসে গল্প করছিলাম। ওর ওইদিন মন বেশ ভালো ছিলো।
ওইসময় খুব সুন্দরী একটা মেয়ে এসে নিষাদকে উদ্দেশ্য করে বললো
– এই মেয়েটার জন্য আমাকে ইগ্নোর করছো?
বেশ তাচ্ছিল্যের সাথেই কথাটা বলেছিলো। আমার অবশ্য খারাপ লাগেনি কারণ এরকমই কথা শুনতে অভ্যস্ত আমি। কিন্তু নিষাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। একটু আগেও হাসছিলো কিন্তু ওই কথাটা শোনার পরে ওর হাসি থেমে গেলো।
নিষাদ কোনো কথা না বলে উঠে চলে গেলো। আমিও ওর পিছু পিছু উঠে চলে এলাম। মেয়েটা ওখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
সন্ধ্যায় ওকে আমিই ফোন দিলাম। ওই ঘটনার পর সারাদিন আমাকে ফোন দেয়নি, ম্যাসেজও দেয়নি।
– কী করছো?
আমি বেশ ভালো আছি বোঝানোর চেষ্টা করেই একটু হাসি হাসি মুখে কথাটা বলেছিলাম।
ও শুকনো কণ্ঠে বললো
– কিছুনা।
– দুপুরে খেয়েছিলে?
– হ্যাঁ।
– আমার মনে হয় তুমি মিথ্যা বলছো।
– আমার কিছুই ভালো লাগছেনা। এখন একটু দেখা করতে পারবে?
আমি কিছু বলতে যাবো তখন ফোনের ওপাশ থেকে অনেক গুলো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম হাসি ঠাট্টা করছে।
আমি ফোন কেটে না দিয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলাম।
কেউ একজন বললো
– নিষাদ তুই শেষ মেষ ৪ ফুটের প্রেমে পড়লি? ক্যাম্পাসের সবচেয়ে কিউট ছেলে তুই। আর তুই কিনা?
আরেকজন বললো
– আমি তো জানতাম ওই মেয়ের সাথে নোট আর সাজেশন এর জন্য মিশিস। তলে তলে এতো কিছু?
এরকম আরো বাজে কথা, টিটকিরি করছে। ও সম্ভবতঃ চুপচাপ আছে। কোনো কথা বলছেনা। আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম, আমার জন্য না। ওর জন্য। আমার জন্য কতো কথা ওকে শুনতে হচ্ছে।
নিজের উপরই রাগ জমছে।
আমি মেধাবী না হয়ে সুন্দরী হতাম তাহলে মনে হয় খুব বেশি ভালো হতো।
নিষাদ আসলেই খুব সুন্দর। এতো সুন্দরের পাশে আমাকে ঠিক মানায় না।
ওই রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ওকে ছেড়ে দিবো। ও না চাইলেও।
কিছু ভালোবাসার গল্প এভাবেই অসমাপ্ত থেকে যাওয়াই ভালো।
তারপর প্রায় ১ সপ্তাহ আমি ওকে ইগ্নোর করার চেষ্টা করবো তাতেই ও সরে যাবে।
রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত শুধু ভেবেছি ও ঠিক আছে তো? দুপুরে খায়নি রাতেও কি একই কাজ করেছে?
খুব সকালে হোস্টেলের বাইরে একটু হাঁটতে বের হলাম। রাতে ঘুম না হলে খুব খারাপ কাটে দিনের সিংহভাগ সময়। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। মন বলে ছেড়ে দিতে আবার সেই মনই বলে না, পারবো না।
মহাবিপদ !
হোস্টেলের বাইরে একটু দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ওকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলাম। ও কখনোই আমার হোস্টেলের সামনে আসেনা।
আমি দূর থেকেই বুঝতে পারলাম ও রাতে ঘুমাতে পারেনি। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। চুল গুলো কেমন এলোমেলো।
আমি ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম
– রাতে ঘুম হয়নি?
– হুম।
– রাতে খাওনি তাই না?
– হুম।
– নিষাদ, ছেলেমানুষী কেনো করো? আমি তো আছিই! যে যাই বলুক।
– রূপন্তী ওদের কথা গুলো তুমি শুনেছো তাই না?
– হ্যাঁ, তাতে কী?
– তোমার খারাপ লাগেনি?
– আমার ওসব এখন গায়ে লাগেনা। এই চার ফুট আট ইঞ্চি শরীর, বোচা নাক, শ্যামবর্ণা মেয়েকে প্রতিনিয়ত এসব কথা শুনতে হয়েছে এবং সে অভ্যস্ত।
– আমি মনে হয় তোমাকে কথাগুলো আবার মনে করিয়ে দিলাম।
– বাদ দাও। চলো কিছু খাবে। তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছেনা আর কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকতে পারবে।
– হোস্টেলে গিয়েই খাবো।
– না, তা হবেনা। চলো বলছি।
– জানো রূপন্তী ওদের আমি কিছু বলতে পারিনি।
– থাক বলতে হবেনা। আমাদের একসাথে দেখলেই ওরা উত্তর পেয়ে যাবে।
সেদিনের সেই ঘটনা আমাদের সম্পর্ক টাকে আরো শক্ত করে দিয়েছিলো।
ওর রুমমেটরাও হাবিজাবি বলতে বলতে একসময় চুপ হয়ে গিয়েছিলো। সেই সন্ধ্যার কথাগুলো আজও আমার কানে ভাসে। মানুষ আসলে বলবেই কিন্তু সেগুলো কানে দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাওয়াটা ভুল।
ওইদিন যদি আমি নিষাদকে ছেড়ে দিতাম তাহলে ওকে পেতাম না।
আমাদের ছোট্ট সংসারে দুই মেয়ে। যেদিন আমাদের বিয়ে হলো সেই সুন্দরী মেয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাতে এসে কানেকানে বলেছিলো
– নিষাদ ওর প্রাক্তন প্রেমিক।
আমি কথাটা শুনে হেসেছিলাম। ইচ্ছে করছিলো, উচ্চস্বরে হেসে বলি
– প্রেমিক শব্দের অর্থ জানো মেয়ে? প্রেমিক কখন হয়?
প্রেমিক তখন হয় যখন তুমি প্রেমিকার ন্যায় আচরণ করো। মেয়ে তুমি যদি তাকে ভাঙিয়ে খেয়ে তাকে প্রেমিক বলতে চাও আর নিজেকে প্রেমিকা! তাহলে আমি শুধু হাসবো।
ওই সুন্দরী, নিষাদের প্রথম প্রেমিকা ছিলো। নিষাদ মানতে নারাজ। প্রেমিকা কি প্রেম করলেই হয় নাকি? প্রেম না করেও প্রেমিকা হওয়া যায়। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট ছেলের প্রেমিকা – এমনটার জন্যই সে,আমাকে চেয়েছিলো। ভালোবাসতে পারেনি। আমিও একই নেশায় ছুটেছিলাম। পরে দেখি সব ফাঁকা।
আমি চেয়েছিলাম কাউকে প্রেম শিখাবো, ভালোবাসা শিখাবো তারপর তাকে প্রেমিকা বানাবো। যেটা রূপন্তী তোমার দ্বারাই হয়েছে। তুমিই প্রেমিকা, তুমিই প্রেয়সী।
সম্পর্কে থাকা অবস্থায় ওর প্রথম সম্পর্কে জড়ানো, প্রথম প্রেমিকা ( যদিও তার মতে প্রেমিকা না) সম্পর্কে এটুকুই বলেছিলো। আমার অবশ্য খারাপ লাগেনি। কারণ ওই মেয়ের কথা বলার সময় ওর চোখে ঘৃণা স্পষ্ট দেখতে পাই আমি।
নিষাদ এর মতো পুরুষের অপেক্ষায় থাকে হাজারো অসুন্দর মেয়ে। সেই হাজারো অসুন্দর মেয়ের মধ্যে আমার মতো ২/১ জন নিষাদকে পায়।
নিষাদের ছোঁয়ায় নিজের উপরই ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সকল নিষাদকে অজস্র ধন্যবাদ আর ভালোবাসা দিলেও তাদের জন্য সামান্যই হবে।
_ নিষাদ… ❤
সত্য ঘটনা অবলম্বনে ❤
© Maria Kabir