#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩২
#আদওয়া_ইবশার
দুপুর থেকেই রক্তিমের অপেক্ষায় সদর দরজা খুলে পথ চেয়ে রেহানা বেগম। এখন মধ্য রাত। তবুও অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ছেলে আসছেনা। মনটা বারবার কেন জানি কু ডাকছে। না চাইতেও আজেবাজে চিন্তারা মন-মস্তিষ্ক ঘিরে ধরেছে। মায়ের সাথে ইতিও ভাইয়ের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। এতো রাত হবার পরও বাবা, ভাই, ভাবি কাওকে বাড়ি আসতে না দেখে তার মনটাও অস্থির হয়ে আছে। দুশ্চিন্তায় শীতের মাঝেও ঘাম ছুটে যাচ্ছে। একে একে প্রতিটা মানুষের নাম্বারে লাগাতার কল করার পরও কেউ ফোন তুলছেনা। মেহেদীটাও কেমন দায়িত্বহীনের পরিচয় দিচ্ছে! সকালে তারা যখন কোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিল তখন রেহানা বেগম, ইতি তারাও যেতে চেয়েছিল।মেহেদী নিতে রাজি থাকলেও আজীজ শিকদার বাঁধা দেয়। তারা দুজন আদালতে উপস্থিত থাকলে তাদেরকেও সাক্ষী হিসেবে জেরা করতে পারে। মহিলা মানুষ যদি কোনো কথার প্যাঁচে পরে যায়! তখন সব শেষ হবে। তাছাড়া রক্তিম তো নির্দোষ প্রমাণ হবেই। আজ কেউ পারবেনা রক্তিমকে জেলে আটকে রাখতে। এমন হাজারটা যৌক্তিক, অযৌক্তিক কথার জালে ফাঁসিয়ে দুজনকেই বাড়িতে রেখে যায় আজীজ শিকদার। রেহানা বেগমও বাধ্য স্ত্রীর মতো স্বামীর কথা মেনে নেয় তখন। যার কারণে এখন আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে তখন অবাধ্যতা করে সাথে গেলেই হয়তো ভালো হতো। কি ঘটেছে, ছেলেটা কোথায় আছে আর তারাই বা কোথায় আছে অন্তত এগুলো জানতে পারত।
হাট করে খুলে রাখা সদর দরজা দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে আজীজ শিকদারকে প্রবেশ করতে দেখে মা-মেয়ে দুজনেই বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায়। ক্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায়। আজীজ শিকদারকে একা দেখে উৎসুক হয়ে রেহানা বেগম জানতে চায়,
“কি ব্যাপার! আপনি একা কেন? রক্তিম, বউমা, মেহেদী ওরা কোথায়?”
প্রশ্নটা করে কতক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবে। পরমুহূর্তে আৎকে ওঠা কন্ঠে বলে,
“রক্তিম ছাড়া পায়নি? আপনি না বলেছেন ওকে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন! এখন একা এসেছেন কেন?”
দুই সন্তানের ভালোর কথা ভেবে আড়াই বছর আগের এক মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে যে ভুল আজীজ শিকদার করেছে,সেই ভুলের মাসুলই মনে হয় মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত দিতে হবে। এখন নতুন করে আবার কিছু গোপন রেখে পাপের বোঝা আর ভাড়ী চায়না। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে অসহায় কন্ঠে জানিয়ে দেয় রক্তিমের অসুস্থতার কথা। অবাক নেত্রে রেহানা বেগম কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্বামীর মুখের দিকে। পর পরই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। মা-মেয়ে দুজন সেই মাঝ রাতেই ছুটে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রাস্তা ফাঁকা থাকায় আজীজ শিকদারের ব্যক্তিগত গাড়িটা পনেরো মিনিটের মাথায় দুজনকে হাসপাতালের সামনে রেখে যায়। অশান্ত মনে মা-মেয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটে যায় চতুর্থ ফ্লোরে রক্তিমকে রাখা ৪০৪ নাম্বার কেবিনের সামনে। দৃষ্টি, মেহেদী,রাকিব, জাবির চারজনেই কেবিনের সামনে বসেছিল। দুজনকে পাগলের মতো ছুটে আসতে দেখে সকলেই ওঠে দাঁড়ায়। মেহেদী ছুটে যায় ইতির কাছে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ইতি কান্নারত অবস্থায় বলে,
“ভাইয়া কোথায়?”
উপস্থিত প্রত্যেকে বোঝার বুঝে যায়। নিশ্চয়ই আজীজ শিকদার বাড়ি গিয়ে খবরটা জানিয়ে দিয়েছে। ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেহেদী বলে,
“ঘুমাচ্ছে এখন। একটু আগে অস্থির হয়ে গেছিল। অবস্থা খারাপ দেখে ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। কেবিনে কাওকে যাবার অনুমতি দেয়নি।”
মেহেদীর কথায় রেহানা বেগম বিলাপ জুড়ে দেয়। বলতে থাকে,
“আমি একটু দেখব। দূর থেকে শুধু একটু দেখে চলে আসব। আমাকে কেবিনে ঢুকতে দিতে বলো। শুধু এক নজর ছেলেটাকে আমি দেখব।”
ডাক্তার কোনোক্রমেই ভিতরে যাবার অনুমতি দিচ্ছেনা। সাফ সাফ জানিয়ে দেয় বারো ঘন্টা পার হবার আগে কেউ যদি এক নজর দেখার আফসোস নিয়ে মরেও যায় তবুও আর অনুমতি দিবেনা। তাদের কাছে গার্ডিয়ানের দুঃখ-কষ্ট, আবেগের থেকেও পেশেন্টকে সেইফ রাখা অতিব জরুরি। অনুমতি ব্যতিত তবুও যদি কেউ ভিতরে যায় তবে এই মাঝ রাতেই হাসপাতাল থেকে রোগী নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞার পর আর কারো সাহস হয়নি ভিতরে পা বাড়ানোর। একজন মায়ের হাহাকার দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন নার্সের হয়তো একটু মায়া হয়। চুপিচুপি দরজা অর্ধ ফাক করে দূর থেকে দেখতে দেয় এক নজর। নিস্তেজ হয়ে সাদা বেডে পরে থাকা ছেলেকে এক পলক দেখে শান্ত হবার পরিবর্তে আরও অশান্ত হয় মায়ের মন। ছটফট করে ছেলেকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু পারেনা। পরিস্থিতির কাছে হার মেনে মুখে আঁচল গুজে শুধু কাঁদে গুণগুণ করে। দূরে দাঁড়িয়ে নিরবে সব দেখে যায় দৃষ্টি। আজীজ শিকদারের মতো একজন মানুষের এতো বড় জালিয়াতির কথা শোনার পর ঐ বাড়ির আর কোনো সদস্যকে বিশ্বাস হয়না। যেখানে আজীজ শিকদার দৃষ্টিসম্মুখে ছেলেকে ভালো রাখার প্রচেষ্টা করে একজন ভালো বাবার পরিচয় দিয়ে সেই লোকটাই ভিতরে ভিতরে এতো বড় একটা চাল চালতে পারল, সেখানে রেহানা বেগম তো এমনিতেই ছোট ছেলের শোকে পাগল হয়ে বড় ছেলেকে শারীরিক, মানসিক সব দিক থেকে আঘাত করেছে সর্বক্ষণ। তবে এই মানুষটার কান্না দেখে আজ কিভাবে মায়া হবে দৃষ্টির? কিভাবে বিশ্বাস করবে সে, রক্তিমের জন্য মায়ের সত্যিই দুঃখ হচ্ছে? একজন মানুষের কর্মে ঐ বাড়ির প্রতিটা মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস ওঠে গেছে। মা’কে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে ইতি এগিয়ে যায় মেহেদীর কাছে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে কঠোর স্বরে বলে,
“তোমাকে বিশ্বাস করে চুপচাপ বসে থাকাটাই আমার সবথেকে বড় ভুল হয়েছে। বিশ্বাসের যোগ্য তুমি না, এটা আমার বোঝা উচিৎ ছিল। যদি যোগ্যই হতে তবে এতো বড় একটা ঘটনা এভাবে লুকিয়ে রাখতে না। আমার ভাইটা সেই সকালে স্ট্রোক করে প্যারাইলজড হয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে। আর আমরা জানতে পারলাম এই মাঝ রাতে। এতো বড় একটা ঘটনা আমাদের থেকে গোপন রাখার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?”
গত একটা সপ্তাহ যাবৎ রক্তিমকে ছাড়ানোর চিন্তায় অস্থির থেকেছে। নাওখা, খাওয়া ভুলে আজীজ শিকদার যখন যেখানে যেতে বলেছে কুত্তার মতো সেখানেই ছুটেছে। এরপর আজ কোর্টে যা হলো তা তো একেবারে বাধিয়ে রাখার মতো। একের পর এক ধকল সইতে সইতে মেহেদীর মন-মেজাজ ও বিক্ষিপ্ত। ইতির এটুকু কথাতেই চটে যায়। এই প্রথম চোখ পাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
“একদম চিৎকার করবেনা। আমি বিশ্বাসের যোগ্য না, তাই না! আর তোমার বাপ খুব বিশ্বাসী! একদম পীর আউলিয়া। এতোটাই সৎ আর বিশ্বাস যোগ্য যে বিশ্বাসের প্রতিদান হিসেবে নিজের ছেলেকেই আজ পঙ্গু বানিয়ে রেখেছে।”
মেহেদীর এমন রূঢ় আচরণে অবাক হয় ইতি। কিছোটা ব্যথিত হয়ে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থেকে জানতে চায়,
“কি করেছে বাবা?”
শ্রেষাত্মক হেসে মেহেদী বলে,
“চোখে দেখতে পাওনা? কি করেছে চোখের সামনে তার জলন্ত প্রমাণ হিসেবে প্যারালাইজড ভাইকে দেখার পরও আমার মুখ থেকে জানতে চাও!”
এমন ঠেসপূর্ণ কথার কিছুই বুঝতে পারেনা ইতি। তিতি-বিরক্ত হয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে,
“ওফ! ঘুরিয়ে-প্যাচিয়ে মাথা নষ্ট না করে সরাসরি বলবে কি হয়েছে?”
ইতির বিরক্ত মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে হাত টেনে রেহানা বেগমের সামনে নিয়ে দাড় করায়। দুজনকে উদ্দেশ্য করেই ফরফর করে বলে দেয় শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত যা যা ঘেটেছে সমস্তটা। বিস্ময়ে মাথা ঘুরে ওঠে মা-মেয়ে দুজনেরই। চোখ দুটো বৃহৎ আকৃতি ধারণ করে। অসাঢ় মস্তিষ্ক ব্যর্থ হয় কোনো প্রকার অনুভূতির যোগান দিতে। নির্বাক দৃষ্টিতে এক ধ্যানে তাকিয়ে কতক্ষণ পর রেহানা বেগম শুধু এটুকুই বলে,
“সংগ্রাম বেঁচে আছে!”
****
রক্তিমের অচল হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরে অবিরাম ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে রেহানা বেগম। অস্ফুট স্বরে বারবার বলছে, “ক্ষমা করিস না আমাকে। কখনো ক্ষমা করিস না। আমি ক্ষমার যোগ্য না। কোনো অপরাধ ছাড়াই মা হয়েও অপরাধী বানিয়ে এতো গুলো বছর একের পর এক আঘাত করেছি। চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে থেকেছি। মা হবার কোনো যোগ্যতা নেই আমার। কোনো যোগ্যতা নেই।”
রক্তিম নির্বাক। মায়ের আহাজারি কিছুই যেন তার কান পযর্ন্ত পৌঁছাতে পারছেনা। এক ধ্যানে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নিজ ভাবনায় মজে আছে। ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে ইতি। মা-বোন কারো কান্নায় রক্তিমের মাঝে উদ্যেগ সৃষ্টি করতে পারছেনা। সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই কেমন নির্জীব হয়ে পরে আছে বিছানায়। এক বিন্দু পানিও খাওয়াতে পারেনি কেউ এখনো। না পেরেছে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করাতে। নিজ ভাবনায় বিভোর থেকে হয়তো জীবনের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। যতবার হিসেবে ব্যর্থ হচ্ছে ততবারই বুক চিরে শুধু দীর্ঘশ্বাসের ক্ষীণ আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। শেষ পযর্ন্ত হিসাব মিলাতে ব্যর্থ হয়ে অস্ফুট শব্দ করে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকায় রক্তিম। ক্ষীণ স্বরে বলে,
“কেঁদো না।”
পর পর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“কোন কোন মেডিসিন খেতে হবে?”
একটু সময় নিয়ে রক্তিমের দিকে এগিয়ে যায় দৃষ্টি। রেহানা বেগমের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলে,
“খালি পেটে খাওয়াতে ডাক্তার নিষেধ করে দিয়ে গেছে। একটু স্যুপ দেই?”
কোনো দ্বিরূক্তি করেনা রক্তিম। জবাবের আশায় কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশ হয়ে দৃষ্টি নিজ উদ্যোগেই উষ্ণ গরম স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে এক চামচ বাড়িয়ে দেয় রক্তিমের মুখের দিকে। জ্বিভের ডগায় শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজানোর চেষ্টা করে রক্তিম। কিন্তু মুখ বেকে যাওয়ায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেনা। জ্বিভটাও কেমন ভাড়ী ভাঢ়ী মনে হয়। হতাশ হয়ে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“একটু ধর। বসব।”
তড়িৎ মেহেদী, রাকিব দুজনেই এগিয়ে আসে। দুইপাশ থেকে দুজন ধরে আধশোয়া করে পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে বসিয়ে দেয়। রক্তিম নিরবে দৃষ্টিকে চোখের ইশারায় খাইয়ে দিতে বলে। বহুক্ষণ কাঠফাটা রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার পর হুট করেই যেন কোথা থেকে অল্প শীতল হাওয়া এসে দৃষ্টির গাঁ ছুঁয়ে গেল। তৎপর এগিয়ে এসে স্ব-যত্নে খাইয়ে দিতে থাকে। ভালোবাসার কাঙ্গাল স্বার্থপর মনটা বলে, “সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আজ যদি রক্তিম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে না থাকতো, নিজ হাতে খাওয়ার শক্তি যদি থাকত, তবে হয়তো কখনো তাকে খাইয়ে দেবার ভাগ্য দৃষ্টির হতনা।
অল্প একটু খেয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয় রক্তিম। মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় আর খাবেনা। দৃষ্টিও কোনো প্রকার জোর করেনা। এটুকুই যে খেয়েছে এতেই শুকরিয়া। একে একে মেডিসিন খাইয়ে সোজা করে শুইয়ে দেয়। হাপিয়ে যাবার ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলে,
“যা হয়েছে সব আমার ভাগ্য দোষে হয়েছে। আমি কখনো এসবের জন্য তোমাকে দায়ী করিনি আর করবোও না। তুমি আমার মা। পৃথিবী উল্টে গেলেও তোমার থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবনা। তুমি চাইলে তোমার ছোট ছেলের সাথেও যোগাযোগ রাখতে পারো। আমি কোনো অভিযোগ করবনা। ইচ্ছে হলে নিজ বাড়িতে এনেও রাখতে পারো। আমি আর ঐ বাড়ি ফিরবনা। শেষবারের মতো সবার কাছে আমার শুধু একটাই অনুরোধ, আমি মরলেও যেন আমার লাশটাকেও কখনো ঐ বাড়ির আঙ্গিনায় না নেওয়া হয়। শিকদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান ব্যতিত অন্য কোথাও যদি আমাকে কবর দেবার মতো কোনো জায়গা না পাওয়া যায়, তবে আমাকে নদীতে ভাসিয়ে দিও। তবুও আমাকে ঐ মাটিতে কবর দিয়ে আমার মৃত আত্মাকে অভিশপ্ত করে রেখোনা। আর শিকদার সাহেবের আগেই যদি আমার মরন হয়,তবে ওনি যেন আমার মৃত মুখটাও দেখতে না পারে। মসজিদের মাইকে যেন শিকদার সাহেবের ছেলে হিসেবে আমার মৃত্যু খবর ঘোষণা না হয়। আর কারো দয়া-করুনা চাইনা আমার। তোমরা যে আমাকে জন্ম দিয়েছো, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আলো দেখিয়েছো এই ঋণ’ই তো শোধ করতে পারবনা। নতুন করে আর কারো দয়া নিয়ে নিজেকে যেমন ঋণী করতে চাইনা। তেমন কিছু বিশ্বাস ঘাতকের কারণে নিজের জীবনটাও আর শেষ করতে চাইনা। অর্ধেক জীবন মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাস ঘাতকদের চিনতে চিনতেই শেষ। বাকী যে অর্ধেক জীবনটা আছে, এই জীবনটা এখন একটু শান্তিতে কাটাতে চাই। চরিত্রহীনদের যদি এই পৃথিবীর বুকে বুক ফুলিয়ে সংসার করার অধিকার থাকে, তবে সেটা আমারও আছে। কোনো দোষ না করেও কেন পুরোটা জীবন দোষের বোঝা নিয়ে কাটিয়ে দিব? আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো আমিও নিজের স্ত্রীকে নিয়ে সুখে থাকব। টিনের চালার যে ঘরটাতে আমার এক একটা অভিশপ্ত রাত কেটেছে, সেই ঘরেই এক বিন্দু সুখের সন্ধান করে শান্তিপূর্ণ রাত কাটাতে চাই। তুমি তোমার সংসারে ফিরে যাও। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো থাকো। কখনো যদি এই পাপি, অযোগ্য সন্তানকে দেখতে ইচ্ছে হয়, নির্দ্ধিধায় আমার শান্তির ঠিকানায় চলে যেয়ো।”
উপস্থিত প্রতিটা মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে প্রতিটা কথা শুনে গেছে। কথা গুলো শোনার পর প্রতিটা মানুষের মনের কোণে উদিত হয় একটাই ভাবনা, একটা মানুষ ঠিক কতটা আঘাত পাওয়ার পর এমন ভাবনা-চিন্তা করতে পারে! রেহানা বেগম আঁচলে মুখ লুকিয়ে কান্নাবিজড়িত কন্ঠে ছেলের কথায় সাই জানিয়ে বলে,
“আমিও চাইনা তুই ঐ বাড়ি যা। এতোদিন চাইতাম না তোর প্রতি সৃষ্টি হওয়া ক্ষোভের কারণে। সর্বক্ষণ চেয়েছি আপন মানুষদের থেকে দূরে থেকে উপলব্ধি কর প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রণা কতটা প্রগাঢ়। কিন্তু এখন চাই ঐ অভিশপ্ত বাড়ির ছায়া থেকে দূরে গিয়ে বেঁচে থাক। কাল সাপের সাথে এক ছাঁদের নিচে থেকে কখনো ভালো থাকবিনা। ঐ অভিশাপে ঘেরা অভিশপ্ত বাড়ি শুধু তোর মৃত্যুই ডেকে আনবে। কখনো এক বিন্দু স্বস্তি দিবেনা। আমিও পারবনা। ঐ বাড়িতে ঐ মানুষটার সাথে এক ছাদের নিচে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। আমি জানি আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি। তোর জীবনটাকে এলোমেলো করে দেওয়াই আমি মা হয়েও অনেক বড় অবদান রেখেছি। তবুও তোকে জন্ম দেওয়ার প্রতিদান হিসেবেই চাইছি, তুই যেখানেই থাকিস ঘরের এক কোণে না পারলেও বাইরে হলেও এই অভাগী মা’কে একটু জায়গা দিস। তোর এক বিন্দু সুখ নিজের চোখে দেখতে না পারলে যে মরে গিয়েও শান্তি পাবনা। তোকে জন্মের পর একটু একটু করে বড় হতে দেখে চোখ জুড়িয়েছি। আবার একটু একটু করে নিঃশেষ হতে দেখে রাক্ষসী মনের জ্বালা মিটিয়েছি। এখন আবার তোর জীবনটাকে নতুন রূপে সাজতে দেখে অপরাধ বোধের ভারটা হালকা করতে দিস।”
চলবে……
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৩
#আদওয়া_ইবশার
দীর্ঘ পনেরো দিন অবজার্বেশনে রেখে দুদিন আগে হাসপাতাল থেকে রক্তিমকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। সেই টিনের চালার কুড়ে ঘরটাতেই ঠাই নিয়েছে দৃষ্টি-রক্তিম। ছোট্ট ঘরটাতে সদস্য বেড়েছে আরও একজন। রেহানা বেগম হাজার বারণ সত্বেও ছেলের পিছু ছাড়েনি। রক্তিম যখন মা’কে প্রাসাদ তুল্য শিকদার মঞ্জিল রেখে নিজের কুড়েঘরে রাখতে একেবারেই দ্বিমত পোষণ করে, তখন রেহানা বেগম পরাজিত এক সৈনিকের মতো ছেলের পায়ের কাছে বসে নত মস্তকে বলেছিল,
“আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য যদি তোর পায়ে ধরতে হয়, তাতেও আমি রাজি আছি। তবুও তুই আমাকে আর শাস্তি দিসনা। একটু দয়া করে তোর ঘরের এক কোণে ঠাই দে আমাকে। না খেয়ে থাকতে রাজি আছি আমি। তবুও আমাকে একটু ঠাই দে।”
এভাবে সন্তানের পায়ের কাছে পরে মা যদি কোনো আবদার রাখে তবে হয়তো কোনো সন্তানেই পারেনা ফিরিয়ে দিতে। অতীতে মা যত যায় বলে থাকুক, যতই আঘাত দিয়ে থাকুক। তবুও তো মা! পুরো পৃথিবী ধ্বংস হলেও কখনো এই সত্যটা মিথ্যে হবেনা। যে মায়ের রক্ত, মাংস খেয়ে একটু একটু করে বেড়ে ওঠেছে তার পেটের ভিতর। পৃথিবীতে আসতে গিয়ে সহ্য করিয়েছে মৃত্যু সম যন্ত্রণা, সেই মা যতই আঘাত করুক কিভাবে পারবে কোনো সন্তান তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে! রক্তিমও পারেনি। নিজের কাছে নিজেই আরও একবার পরাজিত হয়ে জয়ী বানিয়ে দেয় গর্ভধারিনী মা’কে। রক্তিমের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে দৃষ্টি মনে মনে রুষ্ট হলেও মুখে কিছু বলেনি। রেহানা বেগমের সাথেও এখন পযর্ন্ত স্বাভাবিক কোনো কথা-বার্তাও বলেনি। যখনই যায় একটু স্বাভাবিক ভাবে মিশতে তখনই মনে পরে যায় এই মানুষটাও তার স্বামীকে কম কষ্ট দেয়নি। রক্তিমের আজকের এই পরিস্থিতির জন্য আজীজ শিকদারের পাশাপাশি রেহানা বেগমের অবদানও কোনো অংশে কম না।
আজ-কাল দৃষ্টির দিন গুলো ভিষণ ব্যস্ততায় কাটছে। মনে হচ্ছে রাত নামতে না নামতেই চোখের পলকেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঝলমলে প্রতিটা সকাল শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুরু হচ্ছে দৃষ্টির যুদ্ধ। যে যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্যই হলো স্বামীকে সুস্থ্য করে তোলা। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন নিয়ম করে শারীরিক ব্যায়াম, ম্যাসাজ, খাবার খাওয়ানো,মেডিসিন খাওয়ানো। কখন কি লাগবে না লাগবে এসব ভেবে সর্বক্ষণ কাছাকাছি থাকা। আবার নিয়ম করে ফিজিওথেরাপির জন্য ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া। এর মাঝে নিজের জন্য এক বিন্দু সময় অবশিষ্ট থাকেনা। সকালের নাস্তা খেতে হয় দুপুরে, দুপুরের খাবার খেতে হয় রাতে। আবার কোনো কোনো দিন তিন বেলার খাবার এক বেলাতেই খেতে হয়। তবুও একটুও আফসোস নেই দৃষ্টির। নেই চোখে-মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ। হাসি মুখে পালন করে যাচ্ছে নিজের সবটা দায়িত্ব। সেবা-যত্নের পাশাপাশি বিভিন্ন কথায় ভুলিয়ে রাখতে চাচ্ছে অসুস্থ মস্তিষ্কটাকে। কখনো বলে চলে নিজের ছোট্ট বেলার গল্প, কখনো বা স্কুল-কলেজের কাহিনী। রক্তিম দৃষ্টির মন ভুলানো গল্প গুলো এড়িয়ে যেতে চেয়েও পারেনা। কিভাবে কিভাবে যেন মাঝে মাঝে ডুবে যায় দৃষ্টির আলাপনে। অপলক তাকিয়ে দেখতে থাকে স্বহাস্যে গল্প বলে যাওয়া অষ্টাদশীকে। এর মাঝে আবার রক্তিমের এমন দুর্দশার খবর শুনে দৃষ্টির মা-বাবা বুকে অল্প আশা নিয়ে রাগ-ক্ষোব ভুলে ছুটে এসেছিল। ভেবেছিল এবার অন্তত মেয়েটাকে নির্মম বাস্তবতা দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু প্রতিবারের মতোই দৃষ্টি বাবা-মা’কে ব্যর্থতায় ডুবিয়ে দেয়। রক্তিমকে ছেড়ে যাবার জন্য মায়ের দেখানো হাজারটা যুক্তি ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে স্বাভাবিক কথা দিয়েই হারিয়ে দেয় প্রতিবার,
“আমি ভালো আছি মা। তোমরা আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করোনা তো। যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসি তার অসুস্থতাকেও আমি ভালোবাসি। তার ভালো-খারাপ সমস্তটা ভালোবাসি বলেই আমি তাকে ভালোবাসি। আর কাওকে ভালোবাসলে কখনো তার খারাপ দিন দেখে তাকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। আমি যদি শুধু তার মোহে অন্ধ হয়ে তার কাছে ছুটে আসতাম বা তার বাঃহিক দিক দেখে ভালো লাগার অনুভূতি জন্ম হলে সেটাকে ভালোবাসা হিসেবে দাবী করতাম, তবে হয়তো ছেড়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি তো শুধু তার বাহিরটাকেই ভালোবাসিনি মা। হ্যাঁ এটা ঠিক, প্রথম তাকে দেখেই আমার ভালো লাগার সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর একটু একটু করে যতই তার মনটাকে চিনতে পেরেছি, ততই তার প্রতি আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করেছি। বুঝে গিয়েছি শুধু মন বা শরীর আলাদা ভাবে এসব কোনো এক দিক না, পুরো মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি। তার ভালোটাকেও ভালোবাসি তার খারাপটাকেও ভালোবাসি। সে যদি সত্যি সত্যিই কোনো খুনি হতো, সেদিন কোর্টে যদি তার ফাঁসি,বা যাবৎজীবন কারাদণ্ডও হতো তবুও আমি এই মানুষটার স্মৃতির ছায়া সঙ্গী করে তার নামেই বেঁচে থাকতাম। তার নামে কবুল পড়েছি, তাকে স্বামী হিসেবে মেনেছি আজীবনের জন্য। সাময়িক সময়ের জন্য না। আশা করি বাবা-মা হিসেবে আমার অনুভূতি গুলোকে তোমরা একটু হলেও সম্মান দিবে। তোমাদের মেয়ে বিপথে গিয়ে কারো সাথে অবৈধ কোনো সম্পর্ক স্থাপন করেনি। আল্লাহর কালাম সাক্ষী রেখে ভালোবাসাকে পবিত্রতা দিয়েই বরণ করেছে। এতে তোমাদের লজ্জাবোধ বা আফসোস করার তো কোনো কারণ দেখছিনা। তবে কেন এতো আমাদের আলাদা করার ব্যস্ততা তোমাদের? কি লাভ আমাকে জীবন্ত মেরে ফেলে?”
দৃষ্টির বাবা-মা আসার খবর শুনেই মেহেদী ছুটে এসেছিল, আবার কোনো অঘটন যদি ঘটে যায় এই শঙ্কায়। ভাইকে দেখতে ইতি সেই সকালেই চলে এসেছিল। বলা চলে মোটামুটি পরিচিত রক্তিমের আপনজন সকলেই উপস্থিত। উঠোন
ভরা মানুষের সামনে দৃষ্টির এতো গুলো কথার পৃষ্ঠে কোনো জবাব দিতে পারেনা দিলশান আরা। অবাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। ভাবে, সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ বুঝি সত্যিই বড় হয়ে গেল! মা-বাবার কাছে নিজের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে শিখে গেছে। ভালোবাসার জন্য বাবা-মায়ের সাথে লড়তেও পিছুপা হচ্ছেনা। আজ থেকে ঊনিশ বছর আগে ভালোবাসা যেমন ওনাকে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছিল, নিজের পরিবারের কথা না ভেবে সাদেক সাহেবের হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিল। আজ সেভাবেই নিজের মেয়েটাও ভালোবাসার কাছে অন্ধ হয়ে গেছে। তবে তার আর তার মেয়ের পরিস্থিতি তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাদেক সাহেবের হাত ধরে বেরিয়ে আসার পর থেকে তো কখনো কোনো অভাব-অনটন বুঝতে পারেনি দিলশান আরা। সাদেক সাহেব সবসময় স্ত্রী-সন্তানের প্রতিটা চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেছে। স্বামী ঘরে সুখে থেকে দিলশান আরা কখনো সেইভাবে বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হয়ে দুঃখ অনুভব করতে পারেনি। কিন্তু মেয়েটার কপাল তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে মেয়ের করুণ পরিস্থিতি। কতক্ষণ বিমূঢ় হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে দিলশান আরা একসময় বলে ওঠি,
“যার স্বামী পঙ্গুত্ব বরণ করে বিছানায় পরে আছে, সে কিভাবে সুখে থাকে সেটা আমারও দেখার আছে। মা হয়ে আমি চাইনি আমার মেয়ের জীবনটা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যাক। সবসময় চেয়েছিলাম আমার মতোই স্বামী, সংসারে সুখে থাকবে আমার মেয়ে। রানীর হালে জীবন পাড় করবে। কিন্তু আফসোস! ভালোবাসা তোমাকে এতোটাই অন্ধ করে দিয়েছে যে চোখের সামনে নিজের করুক পরিণতিটাও দেখতে পাচ্ছোনা। তবে ভেবোনা। খুব শিগ্রই সব কিছুই দেখতেও পারবে বুঝতেও পারবে। একদিন, দুইদিন মনে আনন্দ নিয়ে ঠিকই পতিভক্ত স্ত্রী হয়ে স্বামীর সেবা করে যাবে। কিন্তু তিনদিনের মাথায় ঠিক মনে মনে হলেও ভাববে যে, আমার মতো একটা মেয়ে কি আসলেই এমন জীবন ডিজার্ভ করে! নিজের চাহিদা আর অভাবের কাছে যেদিন ভালোবাসা হেরে যাবে সেদিন কপাল চাপড়িওনা আবার। আফসোস করোনা জীবন নিয়ে।”
“তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি মা। আমি এখন নিয়মিত নামাজ আদায় করার পুরো চেষ্টা করি। নির্ঘুম প্রতিটা রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে সিজদায় আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে দুটো জিনিস চাই। একটা হলো আমার স্বামীর সুস্থ্যতা, দ্বিতীয়টা হলো কখনো যদি আমার স্বামীর প্রতি আমার মাঝে বিরক্ত বা অনিহা আসার প্রবনতা থেকে থাকে,তবে যেন তার আগেই আমার মৃত্যু হয়। শুনেছি আল্লাহর কাছে মন থেকে কিছু চাইলে না কি আল্লাহ কখনো তার বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়না। আমি বিশ্বাস করি, আমার আল্লাহ’ও আমাকে খালি হাতে ফিরাবেনা। দুটো চাওয়া থেকে যেকোন একটা হলেও পূরণ করবেন ইন শ আল্লাহ। তুমিও একটু দোয়া করো, আমার দুটো চাওয়া থেকে একটা হলেও যেন খুব শিগ্রই পূর্ণতা পায়। সন্তানের জন্য বাবা-মা দোয়া করলে সেই দোয়া তো সবথেকে বেশি কাজে লাগে।”
ঘরের বাইরে মা-মেয়ের তর্ক চললেও টিনের ঘর হওয়াই ভিতরে শুয়ে থেকেও রক্তিম প্রতিটা কথা শুনতে পায়।দিলশান আরার মুখে নিজেকে নিয়ে বারবার পঙ্গু ,অক্ষম এমন হাজারটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা শুনে যতটা হীনমন্যতা কাজ করছিল,মনে তার থেকেও বেশি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে দৃষ্টির বলা এক একটা কথা। খরাপ্রবণ উত্তপ্ত হৃদয়ে ছেয়ে যায় শীতলতা। বিষাদীত অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে ভাসতে হুট করে এক টুকরো শান্তির খোঁজ পেয়ে আবেশে দু-চোখ বুজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। মন বলে, আরও একবার না হয় ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস এনে দেখ। “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু” কথাটা স্বরণে রেখে মেয়েটাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখো। হতে এই একটা সুযোগ তোমাকে এই নশ্বর পৃথিবীতেই স্বর্গ সুখ উপলব্ধি করাতে পারে। বুক ফুলিয়ে গলা ছেড়ে তুমিও বলতে পারো, আমি সুখী। সুখ আমার জীবনে ধরা দিয়েছে।, তোমার একটু উষ্ণ ছোঁয়ায় মেয়েটাও পেতে পারে তার ভালোবাসার পূর্ণতা। ঠকতে ঠকতেই মানুষ জিতে যায়। তুমিও জিতবে। আর সময় নষ্ট করোনা। আকড়ে ধরো মেয়েটার হাত।
মা-বাবা’কে বাইরে থেকেই বিদায় দিয়ে বিক্ষিপ্ত মনে দৃষ্টি ঘরে এসে দেখে রক্তিম চোখ বুজে শুয়ে আছে। মনে করে হয়তো ঘুমাচ্ছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে এই ভেবে, রক্তিম বোধহয় ঘুমিয়ে থাকাই তাদের কথা কিছুই শুনেনি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যাচ্ছে। একের পর এক ঝামেলায় মজে এখনো গোসল করা হয়নি। এদিকে গোসল না করেও থাকতে পারবেনা। শরীর এখনই কেমন চুলকাচ্ছে। রক্তিম ঘুম থেকে ওঠার আগেই গোসলটা সেড়ে নেওয়া যাক।ভেবেই আলনা থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে দরজার সামনে যেতেই শুনতে পায় রক্তিমের কথা,
“ওনাদের সাথে চলে গেলেই পারতে।”
সহসা থমকে যায় দৃষ্টি। লোকটা ঘুমায়নি তবে! সব শুনেছে তাদের কথা।ফিরে তাকায় রক্তিমের দিকে দৃষ্টি । ফোস একটা ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“চলে যাবার জন্য আসিনি। মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত আপনার পিছু ছাড়ছিনা। তাই বলছি, এসব বাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।”
মাথা কাত করে দৃষ্টির দিকে ঘুরে তাকায় রক্তিম। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কতক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“একটা গুন্ডা-মাস্তানের কি দেখে ভালোবাসলে? আমার জানা মতে মেয়েরা সবসময় ছেলেদের চেহারা, টাকা-পয়সা, চাকরি এসব দেখেই প্রেমে পরে। এসবের একটাও তো আমার নেই। তবে কেন ভালোবাসলে?”
একটু আগেই বাবা-মায়ের সাথে একই টপিকে কথা বলে মাথা ব্যথা করে ফেলেছে। এখন আবার এই বান্দা একই টপিক নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছে। বিষয়টা একদম ভালো লাগেনা দৃষ্টির। ত্যাড়া ভাবে জবাব দেয়,
“আপনার সুন্দর মুখ নিঃসৃত তিতা তিতা কথার প্রেমে বাজে ভাবে পিছলে পরেছিলাম। করলার থেকেও তিতা কথার প্রেমে এতোটাই মজে গেছিলাম যে, লোভ সামলাতে না পেরে আজীবন শোনার আশায় আপনার ঘাড়ে ঝুলেছি।”
এমন ত্যাছড়া জবাবে চোখ পাকিয়ে তাকায় রক্তিম। কন্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে ধমকের সুরে বলে,
“খুব বেশি সাহস হয়ে গেছে না!নিজের ইচ্ছে স্বাধীন মনে যা আসছে তাই বলতে পারছো। আপাতত কিছু করতে অক্ষম দেখে ভেবোনা চোখের মাথা খেয়েছি। সব কিছুই দেখছি। একটু সুস্থ্য হয়ে নেই। একে একে সব হিসাব চুকাবো।থাপড়িয়ে যখন চাপার দাঁত সব পেটে চালান করব, তখন দেখব মুখ দিয়ে কথার খই কিভাবে ফোটে।”
স্মিত হাস্যে বিছানার দিকে এগিয়ে যায় দৃষ্টি। রক্তিমের মাথার কাছে বসে হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে। নিয়মিত থেরাপি আর ব্যায়ামের ফলে ক্রেনিয়াল নার্ভ অনেকটাই সচল হয়েছে। মুখের বাকা ভাবনা এখন আর কাছ থেকে ধ্যান ধরে না দেখতে বোঝা যায়না। কথাও আগের মতো এতো জড়িয়ে যায়না। যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েছে আগের তুলনায়। মন দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে একটা সময় বলে,
“প্রথম যেদিন এই মুখটা দেখেছিলাম সেদিনই মায়ায় পরেছিলাম। রাতের পর রাত নিজের প্রতি নিজেই অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, ঐ রাগের পারদে ভাড়ী হওয়া মুখের আদলটা এতো টানছে কিভাবে আমাকে! যে মুখের সর্বত্রই মায়ার বদলে কাঠিন্যতায় ঘেরা সেই মুখ দেখে কিভাবে মায়ার সৃষ্টি হতে পারে! দ্বিতীয়বার অনেকটা চমকে গিয়ে এই কঠোর মুখটাতে অল্পস্বল্প মায়া দেখেছিলাম। সেটাও ছোট্ট এক কুকুর ছানার জন্য। বকুল মিয়ার স্টলের সামনে একটা কুকুরের ছানাকে রুটি খেতে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আপনি হয়তো নিজেও জানেন না, সেই মুহুর্তে আপনার চোখে-মুখে ঠিক কতটা মায়া ভর করেছিল। যে মায়া সর্বনাশ ডেকে এনেছিল আমার। বুঝে গিয়েছিলাম কাঠিন্যতার মুখোশের আড়ালে ঐ মুখে যে মায়া লেপ্টে আছে সেটা আমার মনের চোখ প্রথম দিনই দেখে নিয়েছিল। তাইতো এক দেখাতেই এমন ছটফট করছিল। মনের চোখ যে মুখের মায়া দেখে নিজেও মায়ায় পরেছে, সে কিভাবে এই মায়ার মানুষটাকে ছেড়ে যেতে পারে! পৃথিবী ধ্বংস হোক। তবুও কখনো আমাদের বিচ্ছেদ না হোক।ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ায় সৃষ্টি হওয়া বন্ধন আখিরাতেও অটুট থাকুক।”
চোখে মুগ্ধতা নিয়ে অপলকে দৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রক্তিম। পাষাণ পুরুষের তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আজ কোনো কঠোরতা দেখতে না পেয়ে নির্মল হাসে দৃষ্টি। মন বলে, অবশেষে পাষাণ বোধহয় একটু একটু করে গলছে। একই ভাবে দৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টিকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য রক্তিম ধীরকন্ঠে বলে ওঠে,
“তার মানে আমার চেহারা দেখে প্রথম মায়ার সৃষ্টি, এরপর ভালোবাসা! তাহলে তো বলাই যায় ঐ ভালোবাসা শুধু শরীরের প্রতি। বয়সের সাথে সাথে চেহারা ম্লান হয়ে গেলে ভালোবাসাও ফুরিয়ে যাবে।”
জনম ত্যারা, এক রোখা, বদ মানুষ কি কখনো এতো সহজে ভালো হবে! আদা মরলেও আদার ঝাঝ যায়নি। আর এ তো দৃষ্টির পাষাণ শিকদার। এর তিতা তিতা কথায় এতো সহজে কিভাবে মধুরতার সৃষ্টি হবে! এখনই মধু মিশ্রিত কথা আশা করলেও দৃষ্টির বোকামি হবে। শরীরটাই শুধু ঠুসঠাস গাল চেপে ধরে কান গরম করা থাপ্পড় দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু মুখটা তো ঠিকই আছে। তাই এর মুখের কথা এতো সহজে পরিবর্তন হবার আশা বৃথা। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি কতক্ষণ রক্তিমের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসে। অল্প ঝুকে প্রথমবারের মতো সাহস করে প্রণয় পুরুষের কপালে এঁকে দেয় ভালোবাসার শুন্ধতম পরশ। মেয়েলি চিকন ওষ্ঠদ্বয় কয়েক সেকেন্ড স্থির থাকে রক্তিমের কপালের মধ্যিখানে। হুট করে এমন ছোঁয়ায় জমে যায় রক্তিম। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে খ্যায় হারিয়ে। কপালে ঠোঁট ঠেকিয়েই দৃষ্টি ফিসফিসিয়ে বলে,
“ভালোবাসা শরীর থেকেই মন ছুঁয়ে যা, আবার মন থেকেই শরীর। ভালোবাসতে শরীর, মন দুটোই লাগে। নারী-পুরুষ যেমন একে অপরকে ছাড়া অসম্পূর্ণ, তেমন শরীর, মন দুইয়ের যেকোন একটা ছাড়াই ভালোবাসা অসম্পূর্ণ। এই চিরন্তন সত্যটা সবাই মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ঠিকই জানে।”
চলবে….