ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০৬

0
499

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

অনিক শিকদারের সাথে যে ডিল করেছিল সেটার জন্য পুনরায় মিটিং করতে হচ্ছে। মিটিংয়ে অনিক শিকদারের সাথে অনিল শিকদারকেও উপস্থিত থাকতে হবে। তারা বাপ ছেলে ইতিমধ্যে মিটিং রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। রুদ্র ব্যস্ত পায়ে এসে মিটিং রুমে প্রবেশ করলো৷ এখন অপেক্ষা ঐশ্বর্যের জন্য। অনল হাত ঘড়িতে সময় দেখলো, মিটিং শুরু হবে পুরো দশটার দিকে৷ এখন বাজে নয়টা আটান্ন। অর্থাৎ আরও দুমিনিট বাকি।

ঠিক দশটার সময় ঐশ্বর্য গটগট করে মিটিং রুমে প্রবেশ করলো। অফিসিয়াল ড্রেসে পাক্কা বিজনেস উইমেন্স লাগছে দেখতে। সবাইকে সালাম দিয়ে সে রুদ্রের বাম সাইটে বসে পড়লো।

মিটিং শুরু করলো রুদ্র। রুদ্র নিজের প্রজেক্ট দেখালো। জরুরি কথা বললো কিছু। তারপর অনিক শিকদার নিজেদের প্রজেক্ট দেখালেন। অনল নিজের মতামত বলল। সবশেষে রুদ্র তাকালো ঐশ্বর্যের দিকে। কিন্তু নির্লিপ্ত ঐশ্বর্য। রুদ্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বলার নেই আপনার মিস ঐশ্বর্য?’

ঐশ্বর্য হাত ঘড়িতে তাকালো। সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, ‘সাড়ে দশটা বাজতে আরও পাঁচ মিনিট বাকি। তারপরই আমি আমার প্রজেক্ট সহ সব প্লান বলবো। আপনারা প্লিজ অপেক্ষা করুন।

ঠিক সাড়ে দশটার সময় মিটিং রুমে প্রবেশ করলেন ঈশানী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির সিও তটিনী ইফফাত ঐশি! সবাই দাড়িয়ে গেলো। রুদ্র বুকে হাত চেপে ধরলো। তার সুন্দরী বউ আজ মিটিংয়ে উপস্থিত হবে অথচ সে নিজেই জানতো না! ঐশ্বর্য এগিয়ে এসে তটিণী-র হাত ধরলো। মেয়ের হাত ধরে তটিনী সিও’র চেয়ারে বসলো।

ঐশ্বর্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, সি ইজ মাই কোম্পানি সিও তটিনী ইফফাত ঐশি। মাই ওয়ান এন্ড অনলি মাম্মি।

রুদ্রের কোম্পানির ম্যানেজার থমথমে গলায় বললেন, ‘আগে তো কখনো বলেন নি!

ঐশ্বর্য ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল, ‘আগে বললে সবাই চমকে যেতে পারতেন না।’

সবার দিকে তাকিয়ে তটিনী নিজের কথা শুরু করলো। ঐশ্বর্য একের পর এক ফাইল প্রজেক্ট এগিয়ে দিলো। তটিনী সেগুলো কি নিখুঁত ভাবে প্রেজেন্ট করলো। রুদ্র অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। সাথে মারাত্মক খুশি হচ্ছে যে তার মেয়ে নিজের মাকে কতোবড় একটি সম্মানীয় স্থানে এনে দাড় করিয়েছে। রুদ্র মনে মনে বলল, ‘অনেক বড়ো হও মা, আরও বড়ো হও। মায়ের মতো হও।’

তটিণী-র পড়োনে জামদানী শাড়ি। গুছিয়ে পরিপাটি করে নিজেকে সাজিয়েছে আজ সে। কোথাও এক বিন্দুও খুত নেই। ঠোঁটে লেপ্টে থাকা লিপস্টিকও ভীষণ পারফেক্ট ভাবে দিয়েছে। রুদ্র বার-বার মিটিং থেকে মনোযোগ হারাচ্ছে। এমন সুন্দরী বউ সামনে থাকলে মিটিংয়ে মন দেওয়াটাই মুশকিল হবে তার জন্য।

মিটিং শেষ করে সবাই কনফারেন্সে রুম থেকে বের হলো। অনল শিকদার তটিণীর সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলে চলেছে। একটু দূরত্ব থেকে দাড়িয়ে দেখছে তারা বাবা মেয়ে। ঐশ্বর্য মনে মনে বলল, ‘আর সবার মতো এই নেতাও আমার মায়ের প্রতি ক্রাশ খায়নি তো?’

রুদ্র মনে মনে বলল, ‘এতো দেখছি মেয়েকে পটানোর আগে মেয়ের মাকে পটিয়ে নিচ্ছে!

অনিক শিকদার এসে রুদ্রের সাথে হাত মিলালেন। বিদায় নিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেলো।

অনল বিদায় নিয়ে বাবার পিছু পিছু চলে গেলো। তটিনী বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভীষণ ভালো ছেলে। তোমার চয়েস একদমই বাজে নয় ঐশ্বর্য। পটাতে পারলে পটিয়ে নাও।’

ঐশ্বর্য আড়চোখে নিজের বাবাকে দেখে নিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো। রুদ্র এগিয়ে এসে কোমড়ে হাত রেখে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আ’ম ইমপ্রেস সুন্দরী!’

তটিনী হেসে বলল, ‘এতোটুকুতেই?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আরও কিছু বাকি রেখেছো?’

তটিনী কাঁধে দু-হাত রেখে বলল, ‘এখনও কতো কিছু দেখা বাকি আপনার। জাস্ট অপেক্ষা করুন। বলেই তটিনী হাই-হিলের খটখট শব্দ তুলে চলে গেলো।

রুদ্র মাথা চুলকিয়ে হাসলো। সে অপেক্ষায় আছে বাকিসব দেখার জন্য।

*
শিকদার পরিবারের বর্তমান জেনারেশনের সবচেয়ে বড়ো ছেলে অনল শিকদার। ছোট বোন অনামিকা শিকদার ও মাকে নিয়ে তার পরিবার। পাশাপাশি রয়েছেন তার চাচা, ফুফুরা। যারা কি না তারই বাড়ির পাশে বাড়ি বানিয়ে স্থানীয় হয়ে বসে আছেন। মোটকথা তারা বলতে গেলে এক পরিবারের মতো।

অনলের বাবারা দুই ভাই ও দুই বোন। বড়ো হলেন অনিক শিকদার, ছোট হলেন অনন্ত শিকদার। বোন দুজন হলেন ‘অবন্তী শিকদার ও অতসী শিকদার। অনন্ত শিকদারের আবার দুই ছেলে, অন্তিম শিকদার ও অভিক শিকদার৷ অবন্তী শিকদারের স্বামীর নাম সাখাওয়াত হোসেন। তাদের দুই মেয়ে, ‘সাবিহা হোসেন ও সামিয়া হোসেন। অতসী শিকদারের স্বামীর নাম রবিন আহমেদ। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে, ‘রুপম আহমেদ ও রাখি আহমেদ।

এই হলো শিকদার বংশের ও তাদের ছেলেমেয়েদের ডিটেইলস৷ এবার আসি রুদ্র ইরফানের বংশে। রুদ্রের বাবারা দুই ভাই ছিলেন। তাহসিন ইরফান ও তাহের ইফফাত। তাহসিন ইরফানের স্ত্রীর নাম রুবা নাহার। তাদের দুই ছেলে ‘রুদ্র ইরফান ও রাজ ইরফান। রুদ্র ২০১৯ সালে ভালোবেসে বিয়ে করে ঘরে তুলে তটিনী ইফফাত ঐশি’কে। যে তার চাচা তাহের ইফফাতের একমাত্র মেয়ে ছিল। তাহের ইফফাতের স্ত্রীর নাম ঈশানী। তাহের মারা যান বউ-বাচ্চা রেখে। ঈশানী ছেলে মেয়ে নিয়ে তাহসিন ইরফানের পরিবারে ঠাঁই পান। যতোটা আপন হোক এক সময় না এক সময় দ্বন্দ্ব এসে যায়। ঈশানী সারাজীবন কষ্ট করলেন ছেলে মেয়েকে বড়ো করতে। তার মেয়ে তটিনী ইফফাত ঐশি বড়ো হলো। এইচএসসি পর বাবার রেখে যাওয়া ফ্ল্যাটে উঠলো তাদের নিয়ে। টিউশনি করে সংসারের হাল ধরলো। ভালোবাসার মানুষ তাহেরের আমানত রক্ষা করতে অনেক কষ্ট করেছেন ঈশানী। কিন্তু দিনশেষে শূন্যতা অনুভব হতো। একটা শক্ত হাতের অভাববোধ করতেন তিনি। তাহেরকে মনে করে কান্না করতেন।

তুরফান ইফফাত ঐক্য। তটিণী-র একমাত্র ছোট ভাই। আদরে বাঁদর হওয়া ছেলেটা যখন বুঝতে পেরেছিল এই জগৎ-সংসারে বাবা নামক ছায়াটা ঠিক কতোটা জরুরি ঠিক সেদিন থেকেই আহ্লাদীপনা বাদ দিলো। তারপর থেকে সে আর মায়ের কাছে এটা-ওটার বায়না করেনি। অবুঝ ছোট্ট ছেলেটি যেনো নিমিষেই বড়ো হয়ে গেছিল। বোন বিয়ে দেওয়ার পর মা আরও একা হয়ে গেলো। তুরফান তখন অথৈ সাগড়ে পড়লো। সারাদিন মেডিক্যাল দৌড়াদৌড়ি করে বাসায় এসে মায়ের বিষন্ন মুখ দেখতে একদম ভালো লাগতো না তার।

মাঝে মধ্যে তুরফান নিজের বাবার প্রতি অভিযোগ করতো। কেন এতো তাড়াতাড়ি আকাশের তারা হলো সে?’ মায়ের বিষন্নতা দূর করতে তুরফান ঠিক করলো বিয়ে করবে। কিন্তু তার জন্য আগে স্বাবলম্বী হতে হবে। তারজন্য আরও কতোবছর লাগবে। ততোদিন কি তার মা এমন বিষন্নতা নিয়েই থাকবে?

তুরফান ক্লাসের ফাঁকে যতোটুকু সময় পেতো টিউশনি করাতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আলাদা সময় বের করে নিজের মাকে দিলো। বিকেলের বিষন্ন সময়টা ছেলের হাতে হাত রেখে কাটতে লাগলো ঈশানীর। ছেলে বড়ো হতে থাকলো। এক সময় বিয়ে করলো। ছেলেমেয়ে হলো। কিন্তু ঈশানী রইলেন না। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

বাংলাদেশের আবহাওয়ায় শরৎকাল বিরাজমান। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাশফুলে বেড়াতে এসেছে তুরফান। কাশফুল ছুঁয়ে দেখতে দেখতে তার নিজের মাকে মনে পড়ে গেলো। বহু বছর আগে ২০২৪ সালে এমনই একটি শরৎের দিনে তারা বেড়াতে এসেছিল কাশফুলে। তুলা হয়েছিল বড়সড় একটি ফ্যামিলি ফটো। ফ্রেমে বাধিয়ে সেটা রাখা হয়েছে প্রত্যেকের কাছে। নিজের মুঠোফোন বের করে ডকুমেন্টস চেক করলো তুরফান। ঘেঁটে বের করলো অনেক পুরনো সেই ফটোফ্রেমের ডকুমেন্টস। ক্লিক করতেই স্কিনে ভেসে উঠলো হাসিখুশিতে ভরপুর একটি চমৎকার ফ্যামিলির মানুষদের। যারা আজ সময় ও যুগের তালে তাল মিলিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন শহরের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়!

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে