মাতাল হাওয়া পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
593

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আনমনে হেটে আসছিল চিত্রলেখা। দৃষ্টি রাস্তায় থাকলেও মস্তিষ্ক সঙ্গে ছিল না। তাই আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা মামুনকে দেখতে পায়নি।

-কেমন আছো মায়া?

আচমকা মামুনের কন্ঠ শুনতে পেয়ে হদিস হয় চিত্রলেখার। মুখ তুলে তাকায় সে। মামুনকে দেখে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছেন আপনি মামুন ভাই?

-তুমি যেমন রাখছো।

মামুনের কথা কেমন যেন রহস্য রহস্য শুনায় চিত্রলেখার কানে। তার কথা ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

-বুঝলাম না মামুন ভাই।

-কয়দিন হয় তোমারে ঠিকঠাক দেখি না। তোমারে না দেখলে তো আমি ভালো থাকি না তা তুমি জানোই।

-ওহ!

বলে এক কদম পিছ পা হয় চিত্রলেখা নিজের জায়গা থেকে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে। আজ ওর ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাই আপাতত মামুনকে এড়িয়ে যেতে বলে,

-অনেক দেরি হয়ে গেছে মামুন ভাই আজ আসি। অন্য একদিন কথা বলবো।

-মাত্রই দেখলাম তোমারে। এখনই চইলা যাবা?

-দেরি হয়ে গেছে আজ। এর বেশি দেরি হলে খালা চিন্তা করবে।

-আচ্ছা যাও তাইলে। তবে তুমি চাইলে বাকি পথটা আমি তোমারে আমার বাইকে করে আগায় দিতে পারি।

-এর কোনো প্রয়োজন নেই মামুন ভাই। সামান্য একটুই তো পথ বাকি আমি পায়ে হেটেই যেতে পারবো।

পথ ছেড়ে দিয়ে মামুন বলে,

-আচ্ছা যাও তাইলে।

দ্রুত কদম ফেলে চিত্রলেখা মামুনকে অতিক্রম করতেই সে পেছন থেকে আবার ডাক দেয়,

-মায়া শুনো।

মামুনের ডাকে দাঁড়িয়ে পড়ে পেছন ফিরে তাকায় চিত্রলেখা। জিজ্ঞেস করে,

-আরও কিছু বলবেন মামুন ভাই?

-অনেকদিন হয় তোমার হাতের চা খাওয়া হয় না।

-অফিসে কাজের অনেক চাপ যাচ্ছে। এই সপ্তাহে বন্ধের দিন বিকালে বাসায় আসবেন সেদিন আপনাকে চা খাওয়াবো কেমন?

-আচ্ছা আসবোঁ, এবার বাসায় যাও দেরি হইতেছে তোমার।

-আসি মামুন ভাই।

-সাবধানে যাও মায়া।

চিত্রলেখা সামনের দিকে হাঁটা ধরে। ওর গন্তব্য দ্রুত বাসায় পৌঁছানো তাই সে আর পেছন ফিরে তাকায় না। পেছন ফিরলে দেখতে পেতো মামুন তার দৃষ্টি জুড়ে অশেষ ভালোবাসা নিয়ে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে৷ অবশ্য মামুনের অনুভূূতিদের সম্পর্কে চিত্রলেখা সম্পূর্ণই অবগত। এবং মনে প্রাণে এই অনুভূতিদের সম্মানও করে। মামুনের প্রতি চিত্রলেখার কোনো অভিযোগ কখনই ছিল না। সমস্যা ওর নিজের। নিজের জীবনের টানাপোড়েনের জন্যই কখনো মামুনকে নিয়ে সেভাবে ভাবেনি, ভাবার সুযোগ পায়নি। ভাবলে হয়ত আজ ওদের বিষয়টা অন্যরকমও হতে পারতো। কিন্তু চিত্রলেখার জীবনের বাস্তবতা তাকে এই অনুমতি কখনই দেয়নি। হয়ত কখনো দিবেও না।

দিলারা জামানের মাথায় বরফ ধরে দাঁড়িয়ে আছে জাহানারা। এর মধ্যেই বিশাল ক্যাচ্ছা কাহিনি হয়ে গেছে বাড়িতে। সবেই বাসায় ফিরেছে রওনক। বিকালের মিটিংটা লম্বা চলায় দেরি হয়ে গেছে তার। এদিকে তানিয়া বাসায় ফিরেই শাশুড়ির মাথায় এ ট ম বো ম ফাটিয়েছে। ঘটনাটা এই রকম ঘটেছে,

তানিয়া বাসায় ফিরতেই দেখতে পায় তার শাশুড়ি দিলারা জামানা ড্রইং রুমের সোফায় আয়েশ করে বসে ড্রাই ফ্রুটস খাচ্ছেন আর মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রোল করছেন। তানিয়া সময় নষ্ট না করে সরাসরি শাশুড়ির মুখের সামনে এসে বলে,

-মা আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।

দিলারা জামান ফোন দেখতে দেখতেই বলেন,

-বলো শুনছি।

-আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

-বলো শুনি তোমার কঠিন সিদ্ধান্ত।

তখনই তিনি আন্দাজ করতে পারেননি কয়েক মুহূর্ত বাদেই তারউপর একটা বো ম ফাটবে। এর আগেও তানিয়া বহুবার বলেছে সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তানিয়ার মতে তার নেয়া সব সিদ্ধান্তই কঠিন সিদ্ধান্ত সেটা যদি হয় রাতের ডিনারের মেনু তৈরি করা তার মতে সেটাও কঠিন সিদ্ধান্ত। বউকে চিনে বলেই ওমন কথা শুনেও তেমন একটা ভাবান্তর দেখা যায় না দিলারা জামানের ভেতর। কিন্তু উনাকে চমকে দিয়ে তানিয়া বলে,

-আমি আপনার ছেলেকে ডিভোর্স দিচ্ছি। আর এই সিন্ধান্তের কোনো নড়চড় হবে না। আই উইল ডেফিনিয়েটলি ডিভোর্স হিম।

ছেলের বউয়ের মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে হকচকিয়ে উঠেন দিলারা জামান। মুহূর্তেই উনার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে যায়। মুখ তুলে উপরে তাকান তিনি। মুহূর্তেই মুখটা ফেঁকাসে হয়ে গেছে উনার। চমকিত কন্ঠে প্রশ্ন করেন,

-কি বললা তুমি? আমি কি ভুল শুনলাম?

-না মা আপনি ভুল শুনেননি। একদম ঠিক শুনেছেন। আমি আপনার ছেলেকে ডিভোর্স দিচ্ছি। এডভোকেটের সঙ্গে কথা বলা হয়ে গেছে। কালকের মধ্যেই কাগজপত্র সব তৈরি করে পাঠিয়ে দিবে।

দিলারা জামানা চিন্তা করে পান না কি বলবেন। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকেন। তানিয়া নিজেই বলে,

-এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানতে চাইলে আপনি রওনককে জিজ্ঞেস করে নিয়েন। আমার মনে হলো আপনাকে ডিভোর্সের বিষয়টা জানানো উচিত তাই আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম। বাকিটা বলতে মন চাইছে না। তবে আপনি জানতে চাইলে রওনককে জিজ্ঞেস করবেন। ও সব জানে। আমি ঘরে যাচ্ছি মা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বিশ্রাম করবো।

যাওয়ার আগে তানিয়া জাহানারাকে বলে যায় কাউকে দিয়ে তার ঘরে এককাপ কফি পাঠাতে। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই একদম আচমকাই ডিভোর্স নামক বো ম টা শাশুড়ির মাথায় ফাটায় তানিয়া। তারপর থেকে প্রেসার হাই হয়ে গেছে দিলারা জামানের। কম করে হলেও একশ ফোন কল করেছেন তিনি রওনককে। অনেকগুলো ফোন করার পর যখন রওনককে লাইনে পাওয়া যায় তখন সে জানায় মিটিংয়ে ব্যস্ত আছে। ফোনে কিছুই বলতে পারবে না। বাসায় ফিরে বিস্তারিত জানাবে। জাহানারা, দিলারা জামানকে হাই প্রেসারের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে তবে ঔষধেও প্রেসার খুব একটা কমেনি। রাগে ফসফস করলেও মুখে কিছু বলতে পারেননি এতক্ষণ তিনি। রওনক আসতেই ছেলেকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠেন। জিজ্ঞেস করেন,

-এসব কি হচ্ছে আমার সংসারে?

-কি হচ্ছে?

-তুই জানিস না কিছু?

-আমি তো সবই জানি। তুমি কোন বিষয়ে কথা বলছো সেটা বুঝতে পারছি না। খুলে বললে হয়ত বুঝতে পারতাম। তোমাকেও জবাব দিতে পারতাম।

-তোর ভাইয়ের বউয়ের মাথায় ভূত চেপেছে। সে নাকি এখন ডিভোর্স নিবে।

-তার যদি মনে হয় এই সম্পর্ক সে আর টানতে পারবে না, এই সম্পর্ক তার জন্য নয়। সে যদি বেরিয়ে আসতে চায় তাহলে তো ডিভোর্সই একমাত্র সলিউশান তাই না?

-এসব তুই কি বলছিস রওনক!

চেঁচিয়ে ওঠেন দিলারা জামান। কিন্তু এতে রওনক একটু হকচকায় না। সে শান্ত কন্ঠেই বলে,

-চেঁচামেচি করে লাভ নেই মা। সম্পর্ক ওদের। তাই ওরা একসাথে থাকবে কি থাকবে না সেই সিদ্ধান্তটাও ওরাই নিবে। ভাইয়া-ভাবীর টা ওদেরকেই বুঝতে দাও। লেট দেম ডিসাইড।

-রাদিন কোথায় রওনক?

-সেই খবর কি আমার রাখার কথা?

-তুই জানিস না বলতে চাচ্ছিস?

-জানি না এমন নয় তবে তোমাকে বলতে চাচ্ছি না।

-হঠাৎ কি এমন হলো যে তানিয়া ডিভোর্স পর্যন্ত চলে গেলো?

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রওনক বলে,

-তোমার বড় ছেলে অন্য একজন মহিলার সঙ্গে এফেয়ারে জড়িয়েছে। এই মুহূর্তে ভাইয়া ঐ মহিলার সঙ্গেই আছে। এমনকি ঐ মহিলাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর সেটেল্ড হওয়ার পরিকল্পনাও করছে। কিন্তু আনফর্চুনেটলি আমি বিষয়টা জেনে গেছি। এমনকি ভাবীও জানে। আর সব কিছু জেনে ভাবী আর ভাইয়ার সঙ্গে থাকতে চায় না।

ছোট ছেলের মুখে বড় ছেলের এমন অধঃপতনের কথা শুনে থম ধরে যান দিলারা জামান। মা হিসেবে লজ্জায় উনার মাথা নুইয়ে আসছে। রওনক এগিয়ে এসে মায়ের পাশে বসে তার একটা হাত ধরে বলে,

-ওদেরটা ওদেরকে বুঝতে দাও। আমার ভাই যে অন্যায়টা করেছে এরপর ভাবীর মতো এত ভালো একজন মানুষ সে ডিজার্ভ করে না। ভাবী যদিও ভাইয়াকে মাফ করে দিয়ে থেকে যায়ও এর কোনো গ্যারান্টি নেই ভাইয়া আবার তাকে ঠকাবে না। একজন মেয়ে সব মানতে পারলে স্বামীর প্রতারণা নিশ্চয়ই মেনে নিবে না। তুমি নিজেকে তার জায়গায় রেখে চিন্তা করে দেখো তো। আজ ভাইয়ার জায়গায় বাবা থাকলে তুমি কি তাকে মাফ করে দিতে? পারতে এত বড় মনের পরিচয় দিতে? তাছাড়া যে মানুষটা এতগুলো বছর সংসার করার পরেও নিজের স্ত্রীকে ঠকাতে পারে তাকে কি আসলেই মাফ করা উচিত? আমি বা তুমি হয়ত বলতে পারি ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও কিন্তু ভাবীর জায়গা থেকে ভেবে দেখো তো। তার তো একটাই আপনজন। আমরা তো তার কেউ নই। আমাদের সাথে সম্পর্ক হলো যে মানুষটার হাত ধরে সেই মানুষটাই যখন বেঈমানী করে তখন সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এবারে যদি মাফ করেও দেয় এরপর যদি ভাইয়া আবার একই কাজ করে তখন ভাবী কীভাবে নিজেকে সামলাবে? তাই বলছি রিকুয়েষ্ট করছি তোমায়। তুমি ওদের মাঝে কোনো কথা বলো না। ভাবীর সিদ্ধান্তটা ভাবীকেই নিতে দাও। ভাইয়া ভুল করেনি কঠিন অন্যায় করেছে। ওর শাস্তি হওয়াটা প্রয়োজন। আর এইক্ষেত্রে আমি ভাবীকে সম্পূর্ণ সাপোর্ট করবো তুমি আপত্তি করলেও করবো।

মাকে নিজের মতো রেখে উঠে পড়ে রওনক। যাওয়ার সময় কেবল জাহানারাকে ইশারা করে যায় যেন মায়ের খেয়াল রাখে। দিলারা জামাম কিচ্ছু বলতে পারেন না কেবল চুপচাপ বসে থাকেন। তার আসলে বলার মতো মুখ অবশিষ্ট নেই। কীভাবে থাকবে? অপরাধ তো তার নিজের ছেলেই করেছে। তাও কোনো ছোটখাটো অপরাধ নয়। স্বামীর বেঈমানীর মতো অন্যায়, অপরাধের এই পৃথিনীর আইনে কঠিন কোনো শাস্তি নেই। অথচ কঠিন একটা শাস্তি থাকা দরকার ছিল। যে স্বামী স্ত্রী থাকা অবস্থায় পর নারীতে আসক্ত হবে তার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল মৃ ত্যু দ ন্ড। কারণ প্রতারণা করা স্বামীর কিছু না গেলে আসলেও প্রতারিত হওয়া স্ত্রী তো বাকিটা জীবন ভেতরে ভেতরে ম রে ই যায়। জীবিত লা শ হয়েই জীবন কাটায় মৃ ত্যু পর্যন্ত। ওসব অবশ্য অন্যরা টের পায় না। বিভৎস ভয়ংকর একটা কষ্ট বুকের ভেতর নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় প্রতারিত হওয়া নারীকে। অথচ এসব প্রতারকদের পৃথিবীর আইনে কোনো শাস্তি নেই। মৃ ত্যু দ ন্ড পাওয়ার মতো কঠিন অন্যায় করেও এরা দিব্যি হাসি-খুশি ভাবেই বেঁচে থাকে। একজন নারীকে ভেতরে ভেতরে সম্পূর্ণ মে রে ফেলার পরেও এরা বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করে না। এদের বেঁচে থাকাটাও অন্যায়। অথচ আফসোস পৃথিবীতে এদের কোনো শাস্তি নেই। এদের শাস্তি দেয়ার কোনো আইন নেই।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখা বাড়িতে পা রাখতেই টের পেলো পরিবেশ আজ যথেষ্ট থমথমে। একদম তুফান আসার আগমুহূর্তের মতো৷ আবার এমনও হতে পারে এটা তুফানের পরবর্তী থমথমে পরিবেশ। কিছু হয়েছে কিনা না জানা অব্দি কোনো কিছু সিওর হওয়া যাচ্ছে না আর কি। চিত্রলেখা যখন বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে তখন তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই লিখন ও চয়ন নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে কানাকানিও করেছে। আবার লিখন যে চারুকে ইশারায় কিছু একটা বলল সেটাও চিত্রলেখার নজর এড়ায়নি। তবে এই মুহূর্তে এসব বিষয়ে কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে যায় সে। এমনিতেই আজ তার মস্তিষ্কের ভেতর সবকিছু আউল লেগে আছে। রওনকের বলা কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না৷ গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ বেসিনের সাথে লাগোয়া ছোট আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকেই তাকিয়ে রয়েছে ভাবলেশহীন ভাবে। রওনক আচমকা ওকে কেনোই বা এমন একটা কথা বলল এর কোনো কারণ খুঁজে পায় না চিত্রলেখা। অনেক চিন্তা ভাবনা করেও যখন কোনো কারণ খুঁজে পায় না তখন নিজেকে বুঝ দিয়ে বলে,

-উনার সম্ভবত জ্বর এসেছিল তাই উল্টাপাল্টা বকেছেন। অনেকেরই জ্বর এলে উল্টাপাল্টা বলে। চারুর এই রোগ আছে। জ্বর আসতে না আসতেই ওর উল্টাপাল্টা বলা শুরু হয়ে যায়। আর সবচাইতে বেশি যে কথাটা বলে চারু তা হচ্ছে ও নাকি বাবা-মাকে দেখতে পায়। উনারা নাকি দু’জনে এসে ওর মাথার কাছে বসে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। অথচ বাবা-মা যখন মারা যায় তখন চারু এই এতটুকু বাচ্চা। উনাদের চেহারা ওর ঠিকঠাক মনেই নেই। ছবিতে দেখেছে সেটাই ওর চোখে ভাসে আর জ্বরের ঘোরে ও ভাবে বাবা-মা এসে ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রওনকেরও এমনই কিছু একটা হয়েছিল হয়ত। তারও হয়ত জ্বর হয়েছে সেজন্য এমন একটা উদ্ভট, অসম্ভব কথা বলে ফেলেছেন। জ্বর সেরে গেলে ঠিকই সব ভুলে যাবেন।

এসব হাবিজাবি বলে নিজেকে বুঝ দিলেও চিত্রলেখার মস্তিষ্কে ফের ভাবনার উদয় হয়। ও নিজেই কপালে হাত দিয়ে দেখেছিল রওনকের জ্বর ছিল না কপালে। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকই ছিল। তবুও চিত্রলেখা নিজেকে বুঝ দেয় বলে,

-উনার হয়ত চোরা জ্বর হয়েছে। ভেতরে ভেতরে ঠিকই জ্বর আছে কিন্তু বাইরে বুঝা যায় না। এটাই হবে। এই কারণেই উল্টাপাল্টা বলছেন।

মানুষ যখন কোনো শক্ত কারণ খুঁজে না পায় তখন নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এমন উদ্ভট ব্যাখ্যা দাঁড় করায় এমনকি এটাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করার আপ্রাণ চেষ্টাও করে। এসব অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে মনকে বোকা বানানো গেলেও মস্তিষ্ককে বোকা বানানো যায় না। বিবেক যুক্তি ছাড়া কথা মানতেই চায় না। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এসব হাবিজিবি ভাবার পর গা ঝাড়া দেয় চিত্রলেখা। তাকে রাতের রান্নাও সারতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ভট সব কথা ভাবলে তার চলবে না। রওনক হয়ত নিছকই মজার ছলে কথাটা বলেছে কিন্তু এই কথা ভেবে ভেবে সময় অপচয় করলে তার চলবে না। আবার ঐ মুহূর্তটা চোখে ভাসলে চিত্রলেখার একটুও মনে হয় না রওনক নিছকই মজার ছলে ওত বড় একটা কথা বলে ফেলেছে। বরং তাকে যথেষ্টই সিরিয়াস মনে হয়েছে। রওনকের দৃষ্টি চিত্রলেখাকে বলেছে সে একটুও মজা করে কথাটা বলেনি। যা বলেছে মন থেকেই বলেছে। এসব ভেবে ভেবে নিজের মাথার চুল চিত্রলেখার নিজেরই ছিড়তে মন চাইছে। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সে জানে না। এসব জানতেও চায় না। ওর জীবনটা এমনিই কাটায় ভরপুর। এই জটিল জীবনটায় আরও বেশি জটিলতা ওর চাই না। ও যেমন আছে ভালো আছে। আর কোনো উটকো ঝামেলা ওর চাই না। তাই রওনক ও রওনকের বলা কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের কাজে মনকে ফোকাস করার চেষ্টায় মত্ত্ব হয় চিত্রলেখা।

তানিয়াকে যথেষ্ট ফুরফুরে দেখাচ্ছে আজ। শেষ কবে তাকে এতখানি রিল্যাক্স দেখেছিল রওনকের ঠিক মনে পরছে না। এই মুহূর্তে ওরা দাঁড়িয়ে আছে রওনকের ঘরের বারান্দায়। তানিয়া আধা খোলা বারান্দার গ্রীল ঘেঁষে চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আর রওনক বারান্দার দেয়াল ঘেঁষে অনেকটা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে থাকা চায়ের কাপে এখন পর্যন্ত একটি চুমুকও বসায়নি সে। তানিয়া এতক্ষণ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও এবারে পেছন ঘুরে দেবরের মুখোমুখি দাঁড়ায় তবে দূরত্ব কমায় না। যেখানে ছিল ওখানেই থাকে। চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে তানিয়া রিল্যাক্স ও শান্ত ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করে,

-আজকাল কি বিশেষ একজন ছাড়া অন্য সবার হাতের চা খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছো নাকি?

-কই না তো।

-হাতে খাচ্ছো না যে। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তুমি তো ঠান্ডা চা পছন্দ করো না।

-চোখের সামনে নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করছি তো তাই চায়ে কনসেনট্রেট করতে পারি।

-তা কি আবিষ্কার করলে নতুন, আমাকে?

এবারে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া পানসে চায়েই চুমুক বসায় রওনক। ঠান্ডা চা খেতে একদম বিশ্রী লাগে তার। তবুও মুখে নেয়া চা টুকু কষ্ট করে হলেও গিলে ফেলে সে। তারপর তানিয়ার কথার জবাবে বলে,

-বলতে পারো তাই। তোমাকে কখনো এভাবে আয়েশ করে চা খেতে দেখিনি। সবসময় তুমি কফিটাই প্রেফার করেছো। অথচ আজ দিব্যি চা ইনজয় করছো যেনো তোমার ভীষণ পছন্দের জিনিস।

-আর?

-তুমি আজ আচমকাই তোমার জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছো অথচ সেটা নিয়ে তুমি একটুও বিচলিত নও। তোমার ফেইস দেখে বুঝা যাচ্ছে তুমি তোমার নেয়া সিন্ধান্তে হ্যাপি। ইউ আর হ্যাপি ফর ইউরসেলফ।

-আর কিছু?

-উঁহু, আপাতত এতটুকুই।

-প্রথমটা দিয়েই শুরু করি। আমার শুরু থেকেই চা ভীষণ পছন্দের। কিন্তু কি জানো মানুষের পছন্দ পরিবর্তনশীল। সঙ্গ, পরিবেশ, ওঠা-বসা, চলা-ফেরা সব কিছুর প্রভাবে পছন্দটা পরিবর্তন হয়ে যায় কোনো না কোনো ভাবে। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে দেখতাম রাদিন কফি খায় সবসময় যদিও ওর প্রয়োজন হতো। সে রাত জেগে কাজ করে স্ট্রং কফি ছাড়া তার চলতো না। ওকে সঙ্গ দিতে গিয়েই আমি চা বাদ দিয়ে কফি ধরলাম। রাদিন কিন্তু তা কখনই টের পায়নি। হয়ত কখনো জানার চেষ্টাও করেনি। ওর কেবল নিজের কফির মগটা হলেই চলেছে। সে কখনো জানতে চেষ্টা করেনি তাকে সঙ্গ দেয়া নারী নিজের পছন্দের চা বাদ দিয়ে তার পছন্দের কফিটাকে আপন করে নিয়েছে। সেটা কখনই রাদিনের মাথা ব্যথা ছিল না। আমি গোটা মানুষটাই কখনো তার মাথা ব্যথা ছিলাম না। কারণ আমি অন্য আর দশটা বউয়ের মতো করে কখনো আবদার করে বা অভিমান করে বলিনি আজ আমায় ঘুরতে নিয়ে যাও, বা শপিং করতে নিয়ে যাও, আমাকে আলাদা করে সময় দাও। আমার জন্য সবসময় ও, ওর কাজ, ওর পেইন্টিং, ওর এচিভমেন্ট সবকিছুর উর্ধ্বে ছিল। তখন যদি বুঝতে পারতাম খানিকটা টিপিক্যাল বউদের মতো ওকে যন্ত্রণা দিলে ভালো হতো হয়ত তাহলে ও আমায় নিয়ে ভাবতো, হয়ত তাহলে আমি ওর জীবনের প্রায়োরিটি লিস্টে থাকতাম। আমায় খুশি করতে ও ব্যস্ত হয়ে পড়তে। তাহলে আজ হয়ত সব কিছু অন্যরকম হলেও হতে পারতো। তবে সেসব নিয়ে আর আফসোস নেই। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষগুলো কখনই সামনের বা পাশে থাকা মানুষটার সেক্রিফাইজ দেখতে পায় না। বরং নিজের মতো ভেবে নেয়। ওরা ভাবে আমরা যা করি নিজের স্বার্থে করি। অথচ আমার কাছে যে সবকিছুর উর্ধ্বে ওর স্বার্থ সেটা হয়ত সে কখনই টের পায়নি। না পাক, আর চাইও না ও কিছু জানুক বা বুঝুক। আরও বললে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও আমি বিচলিত নয়ই। ভুল বললে, এই সিদ্ধান্তটা তো আমি আজ নেইনি রওনক। আজ নিলে আমায় তুমি ঠিকই বিচলিত দেখতে, নার্ভাস দেখতে। কত রাত আমি ঘুমাইমি শুধু আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনা করে কাটিয়েছি। কি হলে কি করবো কত শত প্রস্তুতি নিয়েছি মনে মনে। এমন একটা দিন যদি কখনো আসে তখন কি করবো তা যে কত হাজারবার চিন্তা করেছি তা তুমি হয়ত কল্পনাও করতে পারবে না। বেসিক্যালি এই সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই আমি মনে মনে নিয়ে ফেলেছিলাম। কখনো এমন কিছু হলে, আমাকে চরমভাবে ঠকে যেতে হলে কি করবো তা আমি আগেই ভেবে ফেলে ছিলাম। শুধু মাত্র আমি হুটহাট তা প্রকাশ না করে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি তোমার ভাইয়ার সিদ্ধান্তের। তার সিদ্ধান্ত জানলাম তারপর আমি আমার সিদ্ধান্তটা নিলাম। এক্ষেত্রেও কিন্তু আমি তাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছি জীবন বেছে নেয়ার।

এতটুকু বলে অদ্ভুত করে হাসে তানিয়া। তা মুগ্ধ হয়ে দেখে রওনক। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে সে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। তানিয়ার হাস্যজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ভাইয়া কি কখনো তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করেছিল?

-তার তো সে প্রয়োজনই পরেনি।

-তোমরা একে-অপরকে না বুঝে এতগুলো বছর একত্রে থাকলে কীভাবে? সংসার করলে কীভাবে?

-একসাথে থাকলেই বুঝি সংসার করা হয়ে যায়? আর একত্রে থাকার জন্য জরুরী নয় অপরজনকে বুঝতে হবে। যদিও আমি প্রতি মুহূর্ত তোমার ভাইয়াকে বুঝতে চেয়েছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি। এমনকি শেষ পর্যন্ত বিফল হইনি অবশ্য। তার সবকিছু আমি বুঝি। শুধু সেই আমাকে বুঝে না আর না কখনো বুঝার চেষ্টা করেছে। তোমার ভাইয়ার মতে আমি লেখাপড়া জানা অতি শিক্ষিত নারী যার জন্য নিজের ক্যারিয়ার সবার আগে। অথচ সে কখনো জানতেই পারেনি আমি সবসময় ঘরকুনো হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। সকাল শুরু হবে তার বাহুডোরে, তারপর সবাইকে নাস্তা করিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে যাবো স্কুলে, রান্নার দায়িত্বটা আমার হাতেই থাকবে। আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকে বেশ ভালো রান্না জানি। বিয়ের পরপর কয়েকবারই এটা সেটা রান্নাও করেছিলাম। কিন্তু কখনো তোমার ভাইয়া এপ্রিশিয়েট করা তো বাদ দাও জানারও চেষ্টা করেনি রান্নাটা কে করেছে। বলতে পারো বাহবার অভাবে আমার রান্নার শখটা কবে জানি ম রা গাছের মতো শুকিয়ে গেল। আমিও পরে আর পানি দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করিনি। কোনো কিছু করতে অনুপ্রেরণা লাগে রওনক যা আমি কখনই তোমার ভাইয়ার কাছে পাইনি। উল্টো আমি যখন অফিস জয়েন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম তোমার ভাইয়া আমায় বাহবা দিলো। আমিও বোকা ভাবলাম ও হয়ত এমন একজনই পার্টনার চায় যে ঘরে বসে না থেকে তার কাঁধে কাঁধ মিলে হাটবে। আমি হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর আসার পর টের পেলাম যার জন্য আমার এতদূর আসা সে তো অনেক আগেই মোড় বদলে নিয়েছে। আর আমি একলাই এতটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে এসেছি। তোমার ভাইয়া আমার জীবনে থাকলেও এই পথ আমায় একলাই চলতে হতো এর চাইতে সে নেই এটা বেশি ভালো হলো না বলো?

তানিয়া থামতেই রওনক বলে,

-আই এমন রিয়েলি হ্যাপি ফর ইউ। অলসো ভেরি প্রাউড অফ ইউ।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর তানিয়া নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-তা তোমার চাওয়ালীর কি খবর?

-চাওয়ালী!

রওনক তৎক্ষনাৎই ধরতে পারে না তানিয়া কার কথা বলছে। কিন্তু তাকে রহস্য করে হাতে দেখলে তার বুঝতে সুবিধা হয় না। কিন্তু এতক্ষণে তার কপালে চিন্তার দাগ দেখা দিয়েছে। নিজের চেহারা আদলে গম্ভীর ভাব তুলে এনে রওনক বলে,

-নিজের স্বার্থে কাউকে কাছে টানা বা নিজের সাথে জড়ানোটা ভুল তাই না ভাবী?

-অবশ্যই ভুল। যেকোনো সম্পর্কে দু’দিকের স্বার্থ থাকতে হয় নয়ত মনের মিল থাকতে হয়। একপাক্ষিক কোনো কিছুই ভালো নয়।

হুম বলেই ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রওনক। মনে মনে ভাবে তার ভুল হয়ে গেছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখা রান্না করতে ব্যস্থ। তার পেছনে এসে দাঁড়ায় চারু তাও নিঃশব্দে। ভাইবোন তিনটাই চিত্রলেখার ভীষণ আপন, কলিজার একদম কাছের মানুষ। ওরা নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেও সে টের পায়। চারুর উপস্থিতি টের পেয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তেই চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-এতক্ষণ কই ছিলি?

-পড়তেছিলাম আপা।

-কাল তো তোর কোনো পরীক্ষা নাই হঠাৎ কি মনে করে এই সময় পড়তে বসলি?

-এমনি আপা, কাল না থাকুক সামনে তো পরীক্ষা আছে সিলেবাস শেষ হয় নাই তো সেজন্য পড়া আগায়তেছিলাম।

-তোর সিলেবাস শেষ হয় নাই?

-না।

চিত্রলেখা জানে চারু বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছে। ওর তিনটা ভাইবোনই পড়ালেখায় অনেক সিনসিয়ার। কিছু একটা ঘটেছে তা চিত্রলেখা বাসায় পা রাখতেই টের পেয়েছিল। কিন্তু এই বিষয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। চারু চুপচাপ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকায় চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলবি?

-না।

-খুদা লাগছে?

-না।

-তাইলে গরমের মধ্যে দাঁড়ায় না থেকে ঘরে যা।

চারু তবুও দাঁড়িয়ে রয়। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর এগিয়ে গিয়ে বোনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চিত্রলেখা বাঁধা দেয় না। বরং সময় দেয় ছোট বোনকে নিজেকে সামলে নেয়ার। মিনিট খানিক অতিক্রম হওয়ার পর চিত্রলেখা চুলার আগুন নিভিয়ে দিয়ে চারুকে ছাড়িয়ে পেছন ফিরে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়। ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে বল তো।

-কিছু হয় নাই আপা।

-বলবি না তাই তো? লিখন না করছে বলতে?

-সত্যি কিছু হয় নাই আপা।

-খালা কই?

-উনার ঘরে আছেন।

-এই সময়ে ঘরে কি করে?

-শুয়ে রইছে।

-কেন! শরীর খারাপ।

এবারে চুপ করে রয় চারু। চিত্রলেখা আগেই বুঝতে পেরেছিল বাড়িতে আজ কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু এতক্ষণে বুঝতে পারছে ভয়ংকর কিছু একটা হয়েছে। চারুকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখেই চিত্রলেখা খালার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে পেছন থেকে চারু বলে,

-খালু আজ খালাকে অনেক কথা শুনাইছে আপা।

চিত্রলেখার বাড়ন্ত কদম থমকে যায়। বোনের মুখের দিকে তাকায় সে। চারুর চোখে পানি টলমল করছে কিন্তু কান্নার কোনো শব্দ নেই। চিত্রলেখা এগিয়ে এসে ছোট বোনের বাহু ধরে আবারও জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে চারু?

-খালু চায় না আমরা আর উনার বাড়িতে থাকি।

-খালাকে কি বলছে?

-১ মাসের মধ্যে আমরা বিদায় না হলে খালাকে উনি তালাক দিবে।

সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকায় চিত্রলেখা। চারুকে বলে,

-তরকারিটা আরেকু জাল হবে। ওটা জাল দিয়ে টেবিলে ভাত দে আমি আসতেছি।

-কই যাও আপা?

-খালা নিশ্চয়ই সারাদিন কিছু খায় নাই। ডেকে নিয়ে আসি ভাত খাওয়াবো।

চিত্রলেখা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য আবার কদম বাড়ালে চারুর ডাকে ফের থমকে দাঁড়ায়। অসহায় কন্ঠে চারু জিজ্ঞেস করে,

-আমাদের কি আর যাওয়ার কোনো জায়গা নাই?

-যাদের কেউ নাই, যাওয়ার কোনো জায়গা নাই তাদের আল্লাহ আছে। একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। আল্লাহর দুনিয়াটা অনেক বড়। তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি এখনো বেঁচে আছি ভাবার জন্য।

আর অপেক্ষা না করে চিত্রলেখা বেরিয়ে যায়। পেছনে চারুর চোখে টলমল করতে থাকা পানি গাল বেয়ে পড়ে। সারাদিন নিজেকে আটকে রাখলেও আর এই মুহূর্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না বেচারী। মানুষ এত অসহায় কেনো হয়? আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই ওদের এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না। চিত্রলেখাকে দিনরাত এত চিন্তার মধ্যে থাকতে হতো না। অল্প বয়স থেকে সবার জন্য করতে করতে ম রে যেতে হচ্ছে কিন্তু দেখার কেউ নেই, সঙ্গ দেয়ার কেউ নেই।

নারগিস বেগম নিজের ঘরেই শুয়ে আছেন। চিত্রলেখা সহজেই আন্দাজ করতে পারছে সারাদিনে উনার কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নারগিস বেগম ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু আর কেউ না জানলেও চিত্রলেখা বেশ ভালো ভাবেই জানে তার খালা ঘুমায়নি। এমনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। এগিয়ে এসে খালার মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর খালার কানের কাছ মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-আমি থাকতে তোমার এত কিসের চিন্তা খালা? আল্লাহ তো আমাকে পাঠাইছেসই তোমাদের সবার জন্য।

চোখ খোলেন না নারগিস বেগম। তার বন্ধ চোখের পাতা গলে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সারাদিন কাঁদেননি তিনি। অল্পে কেঁদে ফেলার স্বভাব উনার নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে আর পারলেন না নিজেকে ধরে রাখতে। চিত্রলেখা খালাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পাশেই শুয়ে পড়ে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

-এত কেন ভাবতেছো তুমি? আমি কি ম রে গেছি? এইসব ভাবাভাবি তো আমার দায়িত্ব। আর কাদের জন্য ভাবতেছো তুমি? আমাদের জন্য তো কম করো নাই সারাজীবন। আর কত করবা বলো তো? তাছাড়া এবার এমনিও সময় হয়েছে তুমি নিজের কথা ভাবো, নিজের সংসারের কথা ভালো। আমরা তো এমনিও তোমার কাছে চিরকাল থাকবো না খালা। টাকা পয়সার ব্যবস্থা হলে বছর খানিকের মধ্যে লিখন বাইরে চলে যাবে। ওর পরে হয়ত চয়নও চলে যাবে। এরপর চারুকে বিয়ে দিয়ে দিবো। ওরা তো সবাই চলেই যাবে। বাকি থাকলাম আমি। আমি নাহয় তোমার ঘরের একটা কোণায় পড়ে রইলাম। তাও যদি নাহয় দূরেই থাকলাম বেশি একটা দূরে না এই আশপাশ দিয়েই থাকবো। দুইবেলা করে দেখা হবে আমাদের। সব তো হয়েই যাবে। তাইলে এত চিন্তা কেন বলো তো?

চিত্রলেখার হাত ছাড়িয়ে পেছন ফিরে বুকে জড়িয়ে নেন মেয়েকে নারগিস বেগম। কথা বলতে নিয়ে গলা ধরে আসে উনার। ধরা গলায়ই বলেন,

-সবার জীবন গুছিয়ে দিবি আর তোর জীবনটা বানের জলে ভেসে যাবে?

মেকি হেসে চিত্রলেখা বলে,

-ভাইবোনদের জন্য যদি বানের জলে ভাসতে হয় তা নাহয় ভাসলাম। এতে মন্দ কই?

-তোকে কেন সবার জন্য করতে হবে? তুই কি ঠেকা নিয়ে রাখছিস সবার জন্য করার?

-ঠেকাই তো খালা। আমারই তো ঠেকা। আমি না করলে কে করবে? আমি বাঁইচা থাকতে ওদের তো আমি ভেসে যাইতে দিতে পারি না। আর ওরা তো আছেই। ওরা তিনজন ঠিক আমাকে আগলায় রাখবে তুমি দেইখো।

-জীবন বড় কঠিন জিনিস রে মা। বাস্তবতার কাছে সম্পর্কগুলো একসময় ঠুনকো হয়ে যায়।

-আমার ভাইবোনেরা কখনো এমন হবে না খালা। ওরা আমাকে অনেক ভালোবাসে। তুমি দেখে নিও একদিন ওরাই আমার মাথার ছায়া হবে। তিন তিনটা বটবৃক্ষ হবে। শেষ বয়সে আমাকে আর কোনো কষ্ট করা লাগবে না।

-ওদের জীবন গুছায় দিবি, সংসার গুছায় দিবি। আর তুই? তোর জীবন কে গুছাবে? তোর সংসার কে সাজায় দিবে?

-সবার কপালে সব থাকে না খালা। ঘর-সংসার করার ওত শখও আমার নাই। কোনোমতে ওদের জীবন গুছায় দিতে পারলেই হয়। আমার নিজের জন্য তোমরা আছো আলাদা করে কিচ্ছু চাই না।

-এমনে বললে হয় না রে মা।

-এমনে বললে হয় না কেমনে বললে হয় সেটা পরেরটা পরে দেখা যাবে। তুমি আপাতত উঠো চলো ভাত খাবা।

চিত্রলেখা বিছানা থেকে নেমে খালাকে তুলে বসায়। হাত ধরে টানে নামানোর জন্য। আরেক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার হাত ধরে নারগিস বেগম বলেন,

-তোদের সঙ্গে নিবি আমারে?

-তুমি আমাদের সঙ্গে কই যাবা নিজের ঘর-সংসার ফালায়?

-এই ঘর-সংসার আর আমার নাই।

-মানে!

-তোর খালু আবার বিয়ে করবে।

খালার মুখে এমন কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় চিত্রলেখা। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

-তুমি অনুমতি দিয়ে দিলা?

-আর না দিয়ে উপায় কই বল? তার নিজের রক্ত চাই। আমি তো তারে কোনো বাচ্চা দিতে পারলাম না।

-তোমার তো কোনো সমস্যা নাই খালা।

-সমস্যা নাই কিন্তু বাচ্চাও তো হইলো না। বাজাই তো রয়ে গেলাম।

-আমরা চার ভাইবোন থাকতে তুমি কোনোদিন বাজা না।

-তোর খালু কোনোদিন তোদেরকে নিজের সন্তানের মতো দেখে নাই। আর কোনোদিন দেখবেও না। এই আশা আমি অনেক আগেই ছেড়ে দিছি। বহুত হাত-পা ধরছি আর সম্ভব না। তার সন্তান চাই তাই বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে দিছি। তুই আমাকে তোদের সাথে নিয়ে যাইস মা। এই বয়সে আমি সতীনের সংসার করতে চাই না।

বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন নারগিস বেগম। চিত্রলেখা খালার মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

-আমি যেখানেই যাই তুমি আমার সঙ্গেই থাকবা। যা আছে কপালে। আল্লাহ মা র বে না আমাদের তুমি দেইখো।

নারগিস বেগমের কান্নার গতি বাড়ে। এভাবে কাঁদতে চাননি তিনি, ভেঙে পড়তেও চাননি। দীর্ঘ সময় বুকের ভেতর দুঃখ চাপ দিতে দিতে আজ আর ভেতরে জায়গা অবশিষ্ট নেই দুঃখ চাপা দেয়ার। এতকাল আড়াল করে রাখা দুঃখ সব চোখের পানি হয়ে ঝড়তে শুরু করেছে সুযোগ পেয়ে। চিত্রলেখাও বাঁধা দেয় না। বরং খালাকে কাঁদতে দেয়। কাঁদলে মন হালকা হবে। এতদিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট মুছে যাবে না তবুও সহনীয় হবে। ও তো আছেই সামলে নেয়ার জন্য, চিন্তা করার জন্য। সময় মতো ঠিক সব সামলে নিবে। আল্লাহ তায়া’লা ওকে সব সামলে নেয়ার অসম্ভব ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সবাইকে সামলে রাখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওর কিন্তু ওকে সামলাবে কে? আল্লাহ কি এমন কাউকে পৃথিবীতে পাঠায়নি যে ওকে সামলাবে? পাঠিয়ে থাকলে সেই মানুষটা কোথায়? কত দূরে আছে? কবে আসবে সে চিত্রলেখার জীবনে? নাকি এমন কাউকে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠায়নি?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে