#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
চিত্রলেখাদের বাসায় একটা ডাইনিং টেবিল আছে তবু আজ ড্রইং রুমের ফ্লোরে চাদর বিছানো হয়েছে খাওয়া দাওয়ার জন্য। চিত্রলেখা সপ্তাহে দু’দিন বাসায় দুপুরের খাবার খায়। তাই বন্ধের দু’টো দিন সে ভাইবোন খালাকে নিয়ে এভাবেই আয়োজন করে পিকনিকের মতো খাওয়া দাওয়া করে। টুকটাক ভালোমন্দ রান্না করার চেষ্টা করে, আজও তাই করেছে। চিত্রলেখা ফ্লোরে চাদর বিছাতেই তাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে লিখন বলে,
-আজ নাহয় ডাইনিং টেবিলেই খাবার দিতা।
-কেন?
আমতা আমতা করে লিখন। রওনকের উপস্থিতিতে ইতস্তত লাগে ওর। তা বুঝতে পেরে চিত্রলেখা বলে,
-সমস্যা নেই আমরা সবাই নিচে বসে পড়বো, উনার খাবার টেবিলেই দিয়ে দিবো।
রওনক বুঝতে পেরে বলে,
-আমি আলাদা বসবো কেন? আমার তো সবার সাথে একত্রে খাওয়ার কথা তাই না? তাহলে আমি আলাদা কেনো?
লিখন বলে,
-আসলে আপা যেদিন যেদিন বাসায় থাকে ঐদিনগুলো আমরা এভাবেই মাটিতে বসে খাই।
-ভালো কথা।
বলতে বলতেই রওনক উঠে এসে মাটিতে পাতা চাদরে বসে আরও বলে,
-আমিও এখানে বসেই খাবো, তোমাদের সাথে।
রওনকের আচরণ মুগ্ধ করে চিত্রলেখাকে। অজানা, অদেখা ভালো লাগায় ভেতরটা ছেয়ে যায় ওর। চিত্রলেখা আর চারু ব্যস্ত রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে। এর মধ্যেই কলিংবেল বেজে ওঠে। এই অসময়ে কে আসতে পারে ভেবে ওরা একে-অপরের মুখ চাওয়া চাই করে। চিত্রলেখার হাতে থাকা তরকারির বাটি নামিয়ে রেখে দরজা খোলার জন্য যেতে নিলে লিখন তাকে বাঁধা দিয়ে বলে,
-আমি দেখতেছি আপা।
লিখন দরজা খুলে ফিরে আসতেই তাকে দেখে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,
-কে রে?
লিখন জবাব দেয়ার আগে তার পেছন থেকে এগিয়ে আসে মামুন। এমন সময়ে এই লোকটাকে মোটেও আশা করেনি চিত্রলেখা। অবাক হয়ে জানতে চায়,
-মামুন ভাই আপনি এই সময়?
চিত্রলেখার মুখে মামুন নামটা শুনেই একবার মাথা তুলে তাকায় রওনক। আগেরদিন এই লোকটাকে দেখেছে সে। তার বলা কিছু কথাও মনে পড়ে যায়। এগিয়ে এসে মামুন বলে,
-অনেকদিন তোমার হাতের রান্না খাওয়া হয় নাই তাই ভাবলাম আজ তোমাদের বাড়িতেই খাবো।
অন্য কেউ কিছু বলার আগে চারু বলে,
-ভালো করছেন মামুন ভাই। আজকে আপা গরুর গোশত রান্না করছে আলু দিয়ে, মুরগী করছে বুটের ডাল দিয়ে আপনার পছন্দের আইটেম।
-না আসলে তো বিশাল মিস হয়ে যাইতো। (মামুন বলে)
ওদের কথোপকথন শুনে মনে মনে রওনক আওড়ায়, ❝বাহ! আমাকে খাওয়ানোর জন্য আরেকজনের পছন্দের আইটেম রান্না হয়েছে। কেন? আমি কি পছন্দ করি সেটা জিজ্ঞেস করে নেয়া যেতো না? খাবো না এসব আইটেম, লবণ দিয়ে ভাত খাবো আজ আমি। লবণই আমার প্রিয় আইটেম।❞
মামুন রওনককে দেখেও কিছু বলে না। সে আজ ইচ্ছা করেই এসেছে। বড় মসজিদ থেকে লিখন ও চয়নের সাথে রওনককে বের হতে দেখেছে সে। তখনই বুদ্ধি আটে দুপুরে আজ এবাড়ি খাওয়া দাওয়া করবে সে। মূলত ভেতরে কি চলছে সেটা দেখতেই আসা তার খাওয়া দাওয়া হচ্ছে বাহানা মাত্র।
চারু চিত্রলেখার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-দেখছো আপা আমি তোমাকে দিয়ে পোলাও টা রান্না করায় কত ভালো কাজ করছি।
চিত্রলেখা মুখে কিছু বলে না। আপতত সে মহা চিন্তায় আছে। মামুনের কথা বার্তার লাগাম নেই। রওনকের উপস্থিতিতে কি বলতে কি বলে ফেলবে তার নেই ঠিক। সে চায় না মামুন বা চারু কেউ উল্টাপাল্টা কিছু বলুন। চিত্রলেখার দম গলার কাছটায় আটকে আছে। যতক্ষণ না রওনক বিদায় হচ্ছে ততক্ষণ তার শান্তি হবে না। চারুর কথা শুনে যেটুকু চাল ছিল তা দিয়েই পোলাও করেছে সে। তা দিয়ে দু’জন ভরপেট খেতে পারলেও তিনজনের হবে না। বাকিদের জন্য সাদা ভাত। চিত্রলেখা নিজেই সবার ভাত বেড়ে দিয়েছে এমনকি রওনক ও মামুনকেও। রওনকের প্লেটে তরকারি দিতে নিলে সে বাঁধা দিয়ে বলে,
-আমার প্লেটে পোলাও ওদের প্লেটে ভাত কেনো?
রওনকের প্রশ্নের জবাবে কি বলবে ভেবে পায় না চিত্রলেখা। বাসায় পোলাওয়ের চাল ছিল না কথাটা বলতে ভীষণ লজ্জা করছে তার। চিত্রলেখাকে বাঁচিয়ে দিয়ে লিখন বলে,
-আমরা কেউ আজ পোলাও খাবো না আপাকে আগেই বলেছি তাই শুধু আপনার জন্য পোলাও করা হয়েছে।
লিখনের কথা শুনে শুকনো কাশে পাশে বসা মামুন। নিজের উপস্থিতি জানানোর প্রচেষ্টা আর কি।
-আই সি।
বলেই রওনক নিজের প্লেটটা চারুকে দিয়ে ওর ভাতের প্লেটটা নিয়ে বলে,
-আমিও পোলাও খাবো না। রিচ ফুড একটু এভয়েড করছি।
চারু একবার বোনের দিকে তাকায় আরেকবার রওনকের দিকে। পোলাও করার বুদ্ধিটা তারই ছিল। যার জন্য করা সেই যদি না খায় তাহলে তো রান্না করে কোনো লাভ হলো না। ভাত, পোলাওয়ের বিষয়ে আর কেউ কোনো কথা বলে না। চিত্রলেখাই সবার প্লেটে খাবার তুলে দেয়। গরুর গোশতের বড় টুকরোগুলো বুঝি রওনকের প্লেটেই তুলে দিয়েছে। নিজের প্লেটে হাত দেয়ার আগে রওনক একবার সন্তপর্ণে আড় দৃষ্টিতে সবার প্লেটেই চোখ বুলায়। চিত্রলেখা সবার প্লেটে গোশত তুলে দিলেও নিজের প্লেটে নেয়নি।
এখনো চিত্রলেখা নিজের প্লেটের ভাতে হাত দেয়নি। যেই হাত বাড়ায় ওমনি আরও দু’টো হাত তার প্লেটের কাছে এসে পৌঁছায়। রওনক, মামুন দু’জনেই নিজের প্লেটের গোশতের টুকরো চিত্রলেখার প্লেটে তুলে দেয়। এমন কান্ডে উপস্থিত সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খায়। চিত্রলেখা পড়ে যায় মহামুশকিলে। জীবনে এর আগে এত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়েনি। আজকের দিনটা না এলেই বুঝি ভালো হতো। মুখ তুলে একে একে দু’জনের দিকেই তাকায় সে। মামুন তার হাতের গোশতের টুকরোটা চিত্রলেখার প্লেটে দিয়ে বলে,
-ভাগ করে খাইলে মহব্বত বাড়ে, খাও মায়া।
এতটুকু বলেই সে নিজের খাওয়ায় ব্যস্ত হয়। অন্যরা তাকিয়ে আছে রওনকের মুখের দিকে। সে কি বলে হয়ত তা শুনতে। পরিস্থিতি সামাল দিলে রওনক বলে,
-আমি মিট খাই না, এলার্জি আছে।
একথা বলে নিজের প্লেটের সবটুকু গোশতের তরকারি তুলে চিত্রলেখার প্লেটে দিয়ে দেয়। আর মনে মনে বলে, ❝বাহ! আমার সামনে বসে আরেকজনের মহব্বত বাড়ানো হচ্ছে। গা ধা কোথাকার! এই মেয়ের জীবনে এত গা ধার ছড়াছড়ি কেন? এক লাবিব তো কম ছিল না এখন আবার এই গা ধা টাও যুটেছে।❞
চিত্রলেখা রওনকের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আমাকে তো সবটাই দিয়ে দিলেন। আপনি খাবেন কি দিয়ে?
-কেন? এত কিছু রান্না করেছো একটা আইটেম না খেলে কম পড়বে না আমার।
-কি দিবো আপনাকে? মুরগী দেই?
মনে মনে চিত্রলেখা নিজের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য নিজেই নিজের প্রশংসা করে। ভাগ্যিস তখন মুরগীটা নামিয়ে রান্না করেছিল। ও তো জানেই না রওনকের এলার্জির কথা। মুরগী না করলে এখন কি শুধু ভর্তা, সবজি দিয়ে ভাত খেতো মানুষটা!
-না মুরগী না, ওটা কি?
চিত্রলেখার কাছাকাছি থাকা একটা বাটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে রওনক। জবাবে চিত্রলেখা বলে,
-এটা গুড়া কাঁচকি মাছের চচ্চড়ি।
-ওটা দাও আমায়।
-এটা আপনি খেতে পারবেন না।
-কেনো?
আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,
-বাসি তরকার, গতকাল রান্না করেছিলাম ফ্রিজে ছিল।
-এতে কি হয়েছে? পঁচে তো যায়নি।
-তবুও, বাসি তো।
-তুমি খেতে পারছো তাহলে আমি খেলে দোষ কোথায়? এদিকে দাও দেখি।
চিত্রলেখা বাধ্য হয়েই বাটিটা এগিয়ে দেয়। সবাইকে বিশেষ করে চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে রওনক আগের দিনের রান্না করা গুড়া কাঁচকি মাছের চচ্চড়ি ও ভর্তা, সবজি দিয়েই ভাত খেয়ে ফেলল। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে যথেষ্ট তৃপ্তি করেই খেয়েছে। হয়ত বহুদিন এভাবে আরাম করে ভাত খায়নি সে। খাওয়া দাওয়া শেষে শরীর টানছে তার। একটু বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া প্রয়োজন আলসি কাটানোর জন্য।
খাওয়া দাওয়ার পর লম্বা ঢেকুর তুলে মামুন বলে,
-তোমার হাতের রান্না বরাবরই চমৎকার হয় মায়া।
চিত্রলেখা চাইছে না মামুন আর এক মুহূর্ত এখানে থাকুক। এই লোক বিদায় হলেই ও বাঁচে। তাই ওকে বিদায় করতে বলে,
-আপনি কি আরও কিছুক্ষণ বসবেন মামুন ভাই?
-তুমি বললে অবশ্যই বসবো। আমার জীবনে তো তোমার উর্ধ্বে কিচ্ছু নাই।
-আজকে তো ছুটির দিন বাসায় খালাম্মা হয়ত আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ নাহয় আপনি বাড়ি যান।
-চলে যাইতে বলতেছো? এক কাপ চা খাওয়াও তারপর নাহয় যাই।
মনে মনে ফস করে একটা শ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখা বলে,
-বাসায় চায়ের পাতি নাই মামুন ভাই। নাহলে অবশ্যই আপনাকে চা বানায় খাওয়াতাম। আরেকদিন নাহয় খাওয়াবো।
-ওহ!
পেছন থেকে চারু এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
-আপা চা পাতি আছে তো।
পেছন ঘুরে চারুকে চোখ গরম দিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-ওগুলো চা পাতি না কালোজিরা।
চারু বেচারী চোখের ধমক খেয়েই চুপসে যায়। মামুন বলে,
-আমি নাহয় চা পাতি নিয়ে আসি?
-আজ চা বানাতে পারব না মামুন ভাই। আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, বিশ্রাম করবো।
মামুন আর গা করে না। সে নিজেও বুঝতে পারে চিত্রলেখা তাকে বিদায় করতে চাইছে। সে আচমকা চলে আসায় যে বেচারী বিব্রত হয়েছে সেটা টের পেয়েই আপাতত খ্যন্ত দেয়। বলে,
-আচ্ছা আজ তাহলে আসি। আজকের চা-টা পাওনা থাকলো। আরেকদিন দু’কাপ চা খাবো।
-আরেকদিন আপনাকে চা না খাইয়ে আমিও যেতে দিবো না মামুন ভাই।
আর কথা না বাড়িয়ে আপাতত বিদায় হয় মামুন। এতে করে হাফ ছেড়ে বাঁচে চিত্রলেখা। মামুন বেরিয়ে যেতেই রওনকও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-আমি আজ যাই তাহলে।
অন্য কেউ কিছু বলার আগে চিত্রলেখাই বলে,
-আপনি বসুন প্লিজ, আমাদের সাথে এক কাপ চা খাবেন তারপর না হয় যাবেন।
-তোমার ক্লান্ত লাগছে।
-এতক্ষণ লাগছিল, এখন আর লাগছে না।
পাশ থেকে চয়ন বলে,
-বসুন, আপা আপনাকে চা না খেয়ে যেতে দিবে না, আমরাও দিবো না। আমরা সবাই দুপুরে খাওয়ার পর আপার হাতের এক কাপ চা খাই বন্ধের দিনে। বাকি দিন তো আপা বাসায় থাকে না।
চিত্রলেখা চা বানাতে রান্নাঘরে এলে চারুও তার পেছন পেছন আসে। এসে বলে,
-তুমি না বললা বাসায় চা পাতি নাই।
-মামুন ভাইয়ের জন্য বলছি।
-এটা কি ঠিক কাজ হইলো আপা? মানুষটা এক কাপ চা খাইতে চাইলো তুমি তাকে এক কাপ চা খাওয়াইলা না?
পেছন ঘুরে চারুর দিকে তাকায় চিত্রলেখা। বড়বোনের চাহনি দেখে চারু বলে,
-এক কাপ চা-ই তো চাইছিল মানুষটা।
-এক কাপ চায়ের সাথে সে আমার মাথাটাও চাবায় খেয়ে ফেলতো যদি বিদায় না করতাম।
-তুমি মামুন ভাইকে দুই চোক্ষে দেখতে পারো না আপা।
-দেখতে পারার মতো কোনো কাজ সে করে নাই।
-মানুষটা কত ভালো।
-তুই আজকাল একটু বেশিই মামুন মামুন করিস ঘটনা কি চারু?
-কোনো ঘটনা নাই আপা। সহজ সরল একজন মানুষ তোমাকে কত ভালোবাসে তাই বড় মায়া হয়।
-তুই এখান থেকে বিদায় হ তো। আমাকে শান্তিতে চা বানাইতে দে। তোর কথা শুনতে বিরক্ত লাগতেছে। এক্ষণ বিদায় হ।
চারু আর কিছু বলে না। চুপচাপ বিদায় হয়ে যায়।
চা খাওয়ার পর আর বসেনি রওনক। একটু দেখতে এসে অনেকটা সময় থাকা হয়ে গেছে তার। এর বেশি চিত্রলেখাকে বিরক্ত করতে চায় না সে। অন্যরা ঘরের ভেতর থেকে বিদায় দিয়ে দিলেও চিত্রলেখা বারান্দার গেইট পর্যন্ত এসে আঙিনায় চলে এসেছে দু’জনে। বিদায় নেয়ার জন্য পেছন ঘুরে চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ায় রওনক। এতক্ষণ থাকার জন্য মনে মনে লজ্জা লাগছে তার আবার এই মুহূর্তে চলে যেতে হচ্ছে ভেবেও কেমন যেন লাগছে। অনুভূতিদের এমন আমূল-পরিবর্তন ভাবায় রওনককে। কিন্তু এসব ভাবনার কূলকিনারা খুঁজে পায় না সে। বিদায় নেয়ার ভঙ্গিতে বলে,
-গুড়া মাছের চচ্চড়িটা মজা ছিল।
-আপনি বাসি তরকারি খাবেন আমি ভাবিনি।
-কেন আমাকে কি মানুষ মনে হয় না?
-না তা নয়, আসলে…
চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,
-সবার জন্য করতে করতে নিজেকে ভুলে যেও না। একটু বিশ্রাম নিও, নিজের খেয়াল রেখো।
চিত্রলেখা মুখ তুলে তাকায়। রওনকের চোখে চোখ পড়ে তার। আজ আর রওনক নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়নি। চিত্রলেখার ভেতরে ভাঙচুর হয়। পেটর ভেতর সব গুলিয়ে আসে। মাথার ভেতর ভনভন করে। এভাবে কেউ কখনো তাকে নিজের খেয়াল রাখতে বলেনি। তাহলে কি চারুই ঠিক! সত্যিই কি সে রওনকের জন্য বিশেষ কেউ? কিন্তু কীভাবে? অফিসের একজন সাধারণ এমপ্লই কেন বসের জন্য বিশেষ হবে?
চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক নিজেই বলে,
-ফোনটা ইউজ করো, ফেলে রেখো না। আসছি।
আর অপেক্ষা করে না সে বেড়িয়ে যেতে কদম বাড়ায়। চিত্রলেখা আপন ভাবনাতে হারিয়ে গেছে। সে কিছুতেই কোনো কিছুর হিসাব মিলাতে পারছে না। মনে মনে ভাবে একবার চারু ওকে বলেছি কেউ যদি সত্যি কাউকে চায় তাহলে যাওয়ার পথে বারবার ফিরে তাকায় ততক্ষণ যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। চিত্রলেখা মনে মনে ভাবলো, আমি যদি সত্যি বিশেষ হয়ে থাকি তাহলে উনি পিছন ফিরে তাকাবে। চিত্রলেখার কথাটা ভাবতে দেরি হলো কিন্তু রওনকের পেছন ফিরতে সময় লাগলো না। ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওকে অবাক করে দিয়ে নীল লোহার গেইটটার কাছে গিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে পেছন ফিরে তাকায় রওনক। তৎক্ষনাৎই চিত্রলেখার বুকের ভেতর বিকট শব্দ হলো। রওনক হাত উঁচু করে নেড়ে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল। চিত্রলেখা কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। মাথার ভেতর সব ডালে চালে খিচুড়ি হয়ে গেছে তার। এমন একটা বিষয় ভাবাই ওর উচিত হয়নি। না ও ভাবতো আর না রওনক পেছন ফিরে তাকাতো। এখন নিজেকে স্টুপিট ব ল দ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না চিত্রলেখার।
চিত্রলেখার বাড়ি থেকে বের হতেই গেইটের বাহিরে রওনকের আবার দেখা হয় মামুনের সঙ্গে। তার গাড়ি আসেনি এখনো। বেরিয়েই আগে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের বক্স বের করে একটা সিগারেট জ্বালায় সে। তাতে লম্বা করে টান দেয়। এগিয়ে এসে মামুন রওনকের পাশে দাঁড়ায়। জিনিস করে,
-অনেক দেরি হয়ে গেল আপনার বের হতে। একেবারে বিশ্রাম করেই বের হলেন বুঝি।
সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে রওনক বলে,
-বিশ্রাম করা হয়নি বাসায় গিয়েই করব।
রওনক বুঝতে পারে মামুনের মনে কৌতূহল তার এতক্ষণ পর বের হওয়ার কারণ জানতে চাওয়ার। এর মধ্যেই তার গাড়িটা চলে এসেছে। মামুনের কৌতূহলে আ গু ন জ্বালিয়ে দিয়ে রওনক বলে,
-একেবারে চা খেয়ে বের হলাম।
এতটুকু বলেই রওনক গাড়িতে উঠে যায়। পেছনে মামুনের মস্তিষ্কের ভেতরের কৌতূহল বেড়ে যায় চা কোথা থেকে এলো জানতে। গাড়িতে উঠে বসে গ্লাস নামিয়ে রওনক আরও বলে,
-চিত্রলেখা ও সরি আপনি তো মায়া বলে ডাকেন। মায়াই চা বানিয়েছে আমার জন্য।
এতটুকু বলে আর অপেক্ষা করে না রওনক, মামুনকে কিছুর বলারও সুযোগ দেয় না। তার গাড়িটা মামুনের চোখের সামনে দিয়ে সাই করে টান দিয়ে বেরিয়ে যায়। পেছনে মামুনের মুখটা হয়েছে দেখার মতো চায়ের কথা শুনে। লিকার ঠিক না হলে চা যেমন পানসে লাগে মামুনের মুখটাও এই মুহূর্তে সেরকম পানসে দেখাচ্ছে।
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
সেদিন সাবার বাবার সাথে ওভাবে কথা বলার পর ঐ বিষয়ে রওনক আর মায়ের মুখোমুখি হয়নি। তার করা ব্যবহার যে মা সহজ ভাবে নিবে না সেটা রওনক খুব ভালো করেই জানে। মাকে এক্সপ্লেইন করার মতো কিছু নেই তার কাছে সেজন্য ইচ্ছা করেই মাকে এড়িয়ে গেছে সে। কিন্তু তানিয়ার জন্য এই কাজটা আর কন্টিনিউ করতে পারছে না। দিনরাত তানিয়া তার কানের কাছে একটা প্যাঁচালই পারছে সে যেন মায়ের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু কি কথা বলবে সেটা বুঝে পায় না রওনক। কারণ মা তার কাছে যা চায় সেটা রওনক করতে পারবে না। তার ভাগ্যে যদি আবার বিয়ে করা লেখা থাকে তাহলে সেটা সে কেন কেউ ঠেকাতে পারবে না কিন্তু এই মুহূর্তে না তো মানসিকভাবে আর না মন থেকে কোনোভাবেই সে আবার বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। তাছাড়া সবচাইতে বড় কথা সাবাকে রওনক কখনই বিয়ে করার কথা ভাবেনি হয়ত কখনো ভাবতেও পারবে না। এই সহজ বিষয়টা রওনক তার মা দিলারা জামানকে বুঝাতে পারছে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে কেউ নিজে থেকে বুঝতে না চাইলে সহজে কেউ কাউকে বুঝাতে পারে না।
রওনক বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে নিয়েছে একেবারে। আসতে আসতে ভেবেছিল এসেই একটু ঘুমিয়ে নিবে কিন্তু আসার পর আর ঘুমাতে মন চায়নি। বরং শাওয়ার দিয়ে এক কাপ কড়া কফি খেতে পারলে ভালো হয়। মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্য নিজের ঘর থেকে বের হতেই রওনকের দেখায় হয় জাহানারার সঙ্গে। তাকে দেখেই রওনক দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-মা কোথায় খালা?
-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় হলো তাহলে?
জাহানারার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রওনক বলে,
-আমার জন্য মায়ের ঘরে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিবে প্লিজ?
-তুমি যাও আমি নিয়ে আসছি।
দিলারা জামানের দরজা খোলাই ছিল। নবে হাত ঘুরাতেই দরজাটা খুলে যায়। একবার দরজায় নক করে ভেতরে উঁকি দিয়ে রওনক বলে,
-ভেতরে আসছি মা।
ছেলের কন্ঠ শুনতে পেলেও জবাব করেন না দিলারা জামান৷ ছেলের উপর থেকে এখনো উনার রাগ পরেনি। পরবেই বা কীভাবে? ছেলে তো তার মান ভাঙাতেই আসেনি। তবে ভালো খবর হচ্ছে দেরিতে হলেও ছেলের মায়ের মান ভাঙানোর কথা মনে পড়েছে। অভিমানে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছেন দিলারা জামান। রওনক এগিয়ে এসে মায়ের পাশেই বসে। তার একটা হাতে নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কেমন আছো মা?
মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে দিলারা জামান বলেন,
-আমার থাকা না থাকায় তোদের কারো কিছু যায় আসে নাকি?
-এভাবে বলছো কেনো?
-তো আর কীভাবে বলবো? আমার মান-সম্মানের কোনো মূল্য আছে তোর কাছে?
-নেই বলছো?
-থাকলে তুই লোক ভর্তি ঘরে আমাকে ওভাবে ছোট করতে পারতি না। তাও আবার আমার দাওয়াত কথা মেহমানের সামনে।
-আমি কখন তোমাকে ছোট করলাম?
-ছোট করিসনি বলছিস?
-আমি কি তোমাকে কখনো কারো সামনে ছোট করতে পারি?
-দেখ রওনক আমার সঙ্গে হেয়ালি করবি না। আমি হেয়ালি পছন্দ করি না।
-আর তুমিও ভালো করেই জানো আমি হেয়ালি করি না। যেটা আমার কাছে ভ্যালিড আমি সেটাই করি। তোমার এত রাগ করার কারণটা কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না আমি। এদিকে তুমি রাগ করে মুখ ফুলিয়ে রেখেছো আর ওদিকে তোমার টেনশনে ভাবী, খালা দু’জনের প্রেসার হাই হয়ে আছে। আমাকে সারাদিন অফিসের হাজারটা সমস্যা দেখতে হয়, ডিল করতে হয়। এখন যদি ঘরের সমস্যাও আমাকেই দেখতে হয় তাহলে কীভাবে হবে বলো তো?
-সেজন্যই তো বলছি বিয়েটা করে ফেল। সাবা বউ হয়ে এসে নাহয় ঘরের সমস্যাগুলো দেখবে। তোকে আর ঘর নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
-আমাদের বাড়িতে বউ আছে মা।
-তানিয়া নিজেও তো অফিস নিয়ে বিজি। অফিসের পর দুইটা বাচ্চাও আছে ওর দেখাশুনার। এরপর আর কতদিক সামলাবে বেচারি? ওরও তো সাপোর্টের জন্য কাউকে চাই।
-ভাবির সাপোর্ট লাগলে এসিস্ট্যান্ট হায়ার করে দিবো।
-এসিস্ট্যান্ট দিয়ে কি ঘর সংসারের কাজ হয় নাকি?
-তুমি কি চাও মা?
-তুই বিয়ে কর। আমি সাবার বাবা মাকে খবর দিচ্ছি।
-এক মিনিট মা, শান্ত হয়ে বসো তো প্লিজ। তুমি তো দেখছি আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো।
-তো উঠে পড়ে লাগবো না? তোর কি নষ্ট করার মতো সময় বা বয়স আছে? এখন বিয়ে না করলে আর কবে করবি?
-আবার কেন বিয়ে করতে হবে আমায়? তুমিই বলো মানুষ জেনেশুনে একই ভুল কয়বার করে?
-তুই বিয়ের মতো পবিত্র ফরজ কাজকে ভুল বলে আখ্যা দিচ্ছিস কেন?
-কারণ আমার ক্ষেত্রে ভুল। আর যেটা ভুল আমি সেটাকে ভুলই বলবো তা যত পবিত্র কাজই হোক। ফরজ আমার আদায় করা হয়ে গেছে। তাই আবার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
-ইচ্ছে নেই বললে তো হবে না। তোর অতীতে যা হয়েছে ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। একটা এক্সিডেন্টের জন্য তুই বিয়ে করবি না তা হয়?
-তোমরা যেটাকে জাস্ট এক্সিডেন্ট বলে খুব সহজেই উড়িয়ে দিচ্ছো আমার জন্য কিন্তু তিলত্তমা কেবল একটা এক্সিডেন্ট ছিল না। আই ইউজড টু লাভ হার। শি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। আমাদের নসিবে সংসার করা লেখা ছিল না তাই হয়নি। যেটা ভাগ্যে ছিল না সেই দোষ তো কাউকে দিয়ে লাভ নেই। ও যেমনই ছিল, যাই ছিল আর যাই করেছে সেজন্য আমি ওকে অসম্মান করতে পারি না। ও নিজে নিজের সম্মান হারিয়েছে তাই বলে তো আমি ওকে অসম্মান করতে পারবো না, করা উচিতও না। ভুলে গেলে হবে না শি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। ওয়ান অব দ্যা মোস্ট রেসপেক্টেড লেডি ইন মাই লাইফ আফটার ইউ। এটা ঠিক এখন আর ওকে ভালোবাসি না তাই বলে অসম্মানও তো করতে পারবো না। তোমাদের মতো জাস্ট এক্সিডেন্ট বলে জীবনের এত বড় একটা চ্যাপ্টার আমি চাপা দিয়ে ফেলতে পারব না মা সরি, আই এম রিয়েলি ভেরি সরি ফর দ্যাট।
-যেটা হয়ে গেছে সেটা হয়ে গেছে রওনক। ওসব অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলবে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে।
-তোমাদের সবার সেই ঘুরে ফিরে একই কথা। তেমাদের কেন মনে হয় আমি অতীত আঁকড়ে পড়ে আছি। আই এম হ্যাপি ইন মাই লাইফ রাইট নাও। আই এম লিভিং মাই লাইফ ইন মাই ওয়ে।
-এটাকে লিভিং বলে না রওনক।
-তাহলে কোনটাকে বলে? কি করব আমি বলো তো?
-সাবাকে বিয়ে কর।
রওনক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে চায় কিন্তু ছাড়ে না, চেপে যায়। দিলারা জামানের কথার সুই ঘুরে ফিরে ঐ বিয়েতেই আটকে আছে।
-একটা কথা বলো তো। তুমি কি চাও? আই মিন কোনটা চাও? আমি বিয়ে করি নাকি সাবাকেই বিয়ে করি। কোনটা?
দিলারা জামান তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারেন না। উনি চান উনার ছেলে বিয়ে করুক। তবে সাবাকেও উনার ভীষণ পছন্দ। মেয়ে উনার ভীষণ বাধ্যগত। এই মুহূর্তে উনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ছেলেকে কি জবাব দিবেন। উনি কি বলবেন তুই সাবাকেই বিয়ে কর নাকি ছেলেকে বলবেন তোর কানা, ল্যাংরা, বোবা যা ভালো লাগে তুই তাকেই বিয়ে কর, তাও বিয়েটা অন্তত কর। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দিলারা জামান। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রওনক বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
-তুমি আগে নিজে সিদ্ধান্ত নাও আসলে তুমি কোনটা চাও। তারপর নাহয় আমাকে জানাবে।
বেরিয়ে যাওয়ার আগে রওনক আরও বলে,
-আরেকটা কথা, প্লিজ আর এভাবে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখো না। ভাবী, খালা দু’জনেরই তোমার টেনশনে প্রেসার হাই হয়ে আছে। তাছাড়া তুমি ঘরবন্দী হয়ে বসে থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধানের জন্য ইউ হেভ টু ফাইট। ইউ হেভ টু কনভেন্স মি। ভাবো, ভালো মতো ভাবো আসলে তুমি কি চাও। তারপর নাহয় আমাকে জানাও। তবে যাই ভাবো একটু ভেবে চিন্তে ভেবো কেমন! হতেই পারে তোমার ভাবনার উপর আমার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।
দিলারা জামানকে কথার প্যাঁচে ফেলে বেরিয়ে যায় রওনক। মায়ের ঘরের বাইরেই তার দেখা হয় ভাবীর সঙ্গে। তানিয়ার হাতে কফির মগ। তা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কথা হলো মায়ের সঙ্গে?
ভাবীর হাত থেকে কফি নিয়ে রওনক তাতে একটা চুমুক দিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে বলে,
-হলো হলো, বেশ কথা হলো।
-তা কি বললে? মান ভাঙাতে পারলে? কে হারলো মা না তুমি?
কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে রওনক বলে,
-হার জিত আপাতত পেন্ডিং আছে। তুমি বরং ভেতরে যাও, গিয়ে তোমার শাশুড়িকে উদ্ধার করো। সে এই মুহূর্তে গভীর চিন্তা ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তুমি গিয়ে আমার বেচারি মাকে চিন্তার সাগরে ডোবা থেকে বাঁচাও।
-কি এমন বললে তুমি?
-যাকে বলেছি তার থেকেই শুনো নাহয়।
-আচ্ছা আমি দেখছি।
তানিয়া শাশুড়ির ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে রওনক তার পথ আগলে বলে,
-থ্যাংকিউ, কফিটা সবসময়ের মতো ভালো হয়েছে। তবে কেউ একজন আছে যার হাতের বানানো চা এই পৃথিবীর সবচাইতে বেস্ট চা। তোমার এই বেস্ট কফির চাইতেও হাজারগুন বেস্ট।
এতটুকু বলেই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় রওনক। তানিয়াকেও একটা গোলকধাঁধা ধরিয়ে দিয়ে গেল সে। জানতে চাইলেও সে তানিয়াকে এই বিষয়ে আর কিচ্ছু বলবে না। আচমকা সবার সঙ্গে এমন লুকোচুরি খেলতে ভালোই লাগছে রওনকের। জীবন হরহামেশাই আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। তাই সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে জীবনের সঙ্গেও লুকোচুরি খেলা উচিত।
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
সেদিন সাবার বাবার সাথে ওভাবে কথা বলার পর ঐ বিষয়ে রওনক আর মায়ের মুখোমুখি হয়নি। তার করা ব্যবহার যে মা সহজ ভাবে নিবে না সেটা রওনক খুব ভালো করেই জানে। মাকে এক্সপ্লেইন করার মতো কিছু নেই তার কাছে সেজন্য ইচ্ছা করেই মাকে এড়িয়ে গেছে সে। কিন্তু তানিয়ার জন্য এই কাজটা আর কন্টিনিউ করতে পারছে না। দিনরাত তানিয়া তার কানের কাছে একটা প্যাঁচালই পারছে সে যেন মায়ের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু কি কথা বলবে সেটা বুঝে পায় না রওনক। কারণ মা তার কাছে যা চায় সেটা রওনক করতে পারবে না। তার ভাগ্যে যদি আবার বিয়ে করা লেখা থাকে তাহলে সেটা সে কেন কেউ ঠেকাতে পারবে না কিন্তু এই মুহূর্তে না তো মানসিকভাবে আর না মন থেকে কোনোভাবেই সে আবার বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। তাছাড়া সবচাইতে বড় কথা সাবাকে রওনক কখনই বিয়ে করার কথা ভাবেনি হয়ত কখনো ভাবতেও পারবে না। এই সহজ বিষয়টা রওনক তার মা দিলারা জামানকে বুঝাতে পারছে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে কেউ নিজে থেকে বুঝতে না চাইলে সহজে কেউ কাউকে বুঝাতে পারে না।
রওনক বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে নিয়েছে একেবারে। আসতে আসতে ভেবেছিল এসেই একটু ঘুমিয়ে নিবে কিন্তু আসার পর আর ঘুমাতে মন চায়নি। বরং শাওয়ার দিয়ে এক কাপ কড়া কফি খেতে পারলে ভালো হয়। মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্য নিজের ঘর থেকে বের হতেই রওনকের দেখায় হয় জাহানারার সঙ্গে। তাকে দেখেই রওনক দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-মা কোথায় খালা?
-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় হলো তাহলে?
জাহানারার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রওনক বলে,
-আমার জন্য মায়ের ঘরে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিবে প্লিজ?
-তুমি যাও আমি নিয়ে আসছি।
দিলারা জামানের দরজা খোলাই ছিল। নবে হাত ঘুরাতেই দরজাটা খুলে যায়। একবার দরজায় নক করে ভেতরে উঁকি দিয়ে রওনক বলে,
-ভেতরে আসছি মা।
ছেলের কন্ঠ শুনতে পেলেও জবাব করেন না দিলারা জামান। রওনক এগিয়ে এসে মায়ের পাশেই বসে। তার একটা হাতে নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কেমন আছো মা?
মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে দিলারা জামান বলেন,
-আমার থাকা না থাকায় তোদের কারো কিছু যায় আসে নাকি?
-এভাবে বলছো কেনো?
-তো আর কীভাবে বলবো? আমার মান-সম্মানের কোনো মূল্য আছে তোর কাছে?
-নেই বলছো?
-থাকলে তুই লোক ভর্তি ঘরে আমাকে ওভাবে ছোট করতে পারতি না। তাও আবার আমার দাওয়াত কথা মেহমানের সামনে।
-আমি কখন তোমাকে ছোট করলাম?
-ছোট করিসনি বলছিস?
-আমি কি তোমাকে কখনো কারো সামনে ছোট করতে পারি?
-দেখ রওনক আমার সঙ্গে হেয়ালি করবি না। আমি হেয়ালি পছন্দ করি না।
-আর তুমিও ভালো করেই জানো আমি হেয়ালি করি না। যেটা আমার কাছে ভ্যালিড আমি সেটাই করি। তোমার এত রাগ করার কারণটা কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না আমি। এদিকে তুমি রাগ করে মুখ ফুলিয়ে রেখেছো আর ওদিকে তোমার টেনশনে ভাবী, খালা দু’জনের প্রেসার হাই হয়ে আছে। আমাকে সারাদিন অফিসের হাজারটা সমস্যা দেখতে হয়, ডিল করতে হয়। এখন যদি ঘরের সমস্যাও আমাকেই দেখতে হয় তাহলে কীভাবে হবে বলো তো?
-সেজন্যই তো বলছি বিয়েটা করে ফেল। সাবা বউ হয়ে এসে নাহয় ঘরের সমস্যাগুলো দেখবে। তোকে আর ঘর নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
-আমাদের বাড়িতে বউ আছে মা।
-তানিয়া নিজেও তো অফিস নিয়ে বিজি। অফিসের পর দুইটা বাচ্চাও আছে ওর দেখাশুনার। এরপর আর কতদিক সামলাবে বেচারি? ওরও তো সাপোর্টের জন্য কাউকে চাই।
-ভাবির সাপোর্ট লাগলে এসিস্ট্যান্ট হায়ার করে দিবো।
-এসিস্ট্যান্ট দিয়ে কি ঘর সংসারের কাজ হয় নাকি?
-তুমি কি চাও মা?
-তুই বিয়ে কর। আমি সাবার বাবা মাকে খবর দিচ্ছি।
-এক মিনিট মা, শান্ত হয়ে বসো তো প্লিজ। তুমি তো দেখছি আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো।
-তো উঠে পড়ে লাগবো না? তোর কি নষ্ট করার মতো সময় বা বয়স আছে? এখন বিয়ে না করলে আর কবে করবি?
-আবার কেন বিয়ে করতে হবে আমায়? তুমিই বলো মানুষ জেনেশুনে একই ভুল কয়বার করে?
-তুই বিয়ের মতো পবিত্র ফরজ কাজকে ভুল বলে আখ্যা দিচ্ছিস কেন?
-কারণ আমার ক্ষেত্রে ভুল। আর যেটা ভুল আমি সেটাকে ভুলই বলবো তা যত পবিত্র কাজই হোক। ফরজ আমার আদায় করা হয়ে গেছে। তাই আবার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
-ইচ্ছে নেই বললে তো হবে না। তোর অতীতে যা হয়েছে ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। একটা এক্সিডেন্টের জন্য তুই বিয়ে করবি না তা হয়?
-তোমরা যেটাকে জাস্ট এক্সিডেন্ট বলে খুব সহজেই উড়িয়ে দিচ্ছো আমার জন্য কিন্তু তিলত্তমা কেবল একটা এক্সিডেন্ট ছিল না। আই ইউজড টু লাভ হার। শি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। আমাদের নসিবে সংসার করা লেখা ছিল না তাই হয়নি। যেটা ভাগ্যে ছিল না সেই দোষ তো কাউকে দিয়ে লাভ নেই। ও যেমনই ছিল, যাই ছিল আর যাই করেছে সেজন্য আমি ওকে অসম্মান করতে পারি না। ও নিজে নিজের সম্মান হারিয়েছে তাই বলে তো আমি ওকে অসম্মান করতে পারবো না, করা উচিতও না। ভুলে গেলে হবে না শি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। ওয়ান অব দ্যা মোস্ট রেসপেক্টেড লেডি ইন মাই লাইফ আফটার ইউ। এটা ঠিক এখন আর ওকে ভালোবাসি না তাই বলে অসম্মানও তো করতে পারবো না। তোমাদের মতো জাস্ট এক্সিডেন্ট বলে জীবনের এত বড় একটা চ্যাপ্টার আমি চাপা দিয়ে ফেলতে পারব না মা সরি, আই এম রিয়েলি ভেরি সরি ফর দ্যাট।
-যেটা হয়ে গেছে সেটা হয়ে গেছে রওনক। ওসব অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলবে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে।
-তোমাদের সবার সেই ঘুরে ফিরে একই কথা। তেমাদের কেন মনে হয় আমি অতীত আঁকড়ে পড়ে আছি। আই এম হ্যাপি ইন মাই লাইফ রাইট নাও। আই এম লিভিং মাই লাইফ ইন মাই ওয়ে।
-এটাকে লিভিং বলে না রওনক।
-তাহলে কোনটাকে বলে? কি করব আমি বলো তো?
-সাবাকে বিয়ে কর।
রওনক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে চায় কিন্তু ছাড়ে না, চেপে যায়। দিলারা জামানের কথার সুই ঘুরে ফিরে ঐ বিয়েতেই আটকে আছে।
-একটা কথা বলো তো। তুমি কি চাও? আই মিন কোনটা চাও? আমি বিয়ে করি নাকি সাবাকেই বিয়ে করি। কোনটা?
রওনক বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
-তুমি আগে নিজে সিদ্ধান্ত নাও আসলে তুমি কোনটা চাও। তারপর নাহয় আমাকে জানাবে।
বেরিয়ে যাওয়ার আগে রওনক আরও বলে,
-আরেকটা কথা, প্লিজ আর এভাবে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখো না। ভাবী, খালা দু’জনেরই তোমার টেনশনে প্রেসার হাই হয়ে আছে। তাছাড়া তুমি ঘরবন্দী হয়ে বসে থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধানের জন্য ইউ হেভ টু ফাইট। ইউ হেভ টু কনভেন্স মি। ভাবো, ভালো মতো ভাবো আসলে তুমি কি চাও। তারপর নাহয় আমাকে জানাও। তবে যাই ভাবো একটু ভেবে চিন্তে ভেবো কেমন! হতেই পারে তোমার ভাবনার উপর আমার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।
দিলারা জামানকে কথার প্যাঁচে ফেলে বেরিয়ে যায় রওনক। মায়ের ঘরের বাইরেই তার দেখা হয় ভাবীর সঙ্গে। তানিয়ার হাতে কফির মগ। তা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কথা হলো মায়ের সঙ্গে?
ভাবীর হাত থেকে কফি নিয়ে রওনক তাতে একটা চুমুক দিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে বলে,
-হলো হলো, বেশ কথা হলো।
-তা কি বললে? মান ভাঙাতে পারলে? কে হারলো মা না তুমি?
কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে রওনক বলে,
-হার জিত আপাতত পেন্ডিং আছে। তুমি বরং ভেতরে যাও, গিয়ে তোমার শাশুড়িকে উদ্ধার করো। সে এই মুহূর্তে গভীর চিন্তা ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তুমি গিয়ে আমার বেচারি মাকে চিন্তার সাগরে ডোবা থেকে বাঁচাও।
-কি এমন বললে তুমি?
-যাকে বলেছি তার থেকেই শুনো নাহয়।
-আচ্ছা আমি দেখছি।
তানিয়া শাশুড়ির ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে রওনক তার পথ আগলে বলে,
-থ্যাংকিউ, কফিটা সবসময়ের মতো ভালো হয়েছে। তবে কেউ একজন আছে যার হাতের বানানো চা এই পৃথিবীর সবচাইতে বেস্ট চা। তোমার এই বেস্ট কফির চাইতেও হাজারগুন বেস্ট।
চলবে…