#ভালোবাসি_বলে(৬)
#Jannat_prema
আরহাম পুরো ভার্সিটিতে একবার চোখ বুলালো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে না পেয়ে কপাল কুঁচকালো। এদিকে আশরাফ আর তাদের বন্ধুরা নিজেদের মাঝে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ সামনে থেকে মেয়েলি ন্যাকামো স্বর কানে আসতে সবাই চকিতে তাকালো সামনের দিকে।
” আরহাম বেবি। তুমি এখানে? আর আমি কোথায় না কোথায় খুজছি তোমায়। তুমি জানো তোমাকে না পেয়ে আমার হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গিয়েছিলো। চেক মি বেবি! ”
বলেই নিজের বাম হাতটা বাড়িয়ে দুই কদম সামনে এগোলো স্নেহা। এ যেনো আরহামের একটুখানি ছোঁয়া পাওয়ার লোভ। আরহাম প্রচুর বিরক্তিতে এখনো কপাল কুঁচকে রয়েছে। স্নেহা দুই কদম যেমন সামনে এসেছে, আরহাম ঠিক তার দ্বিগুণ পিছিয়েছে। আশরাফ ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে স্নেহার দিকে । ওদের বন্ধু মহলের সবাই রেগে গেলেও চুপ করে আছে। স্নেহা আরেকটু ঘেষে দাড়ালো আরহামের পাশে। হালকা করে নাক টেনে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আরহামের গায়ের ঘ্রাণ যেনো তাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে। স্নেহার এমন নাক টানা দেখে আশরাফ মনে মনে রেগে বললো,
” ইচ্ছে করছে তোর ওই বোঁচা নাকটারে থেঁতলে দেই। পাবলিক টয়লেটের ভিতর তোর নাকটারে নিতে পারলে শান্তি লাগতো। শা*লি খচ্চর! ”
স্নেহার এমন বেয়াদবি দেখে আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে ব’লে উঠলো,
” তুমি কিন্তু লিমিট ক্রস করছো, স্নেহা। তুমি আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে বলে যে আমি কিছু করবো না তা ভুলেও ভাবতে যাবে না। তোমার এই ছ্যাচড়ামি আমি এক চড়েই দূর করে দিবো। আগের বারের করা অপমানটার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? ”
চমকে উঠলো স্নেহা। ঝটপট তার হাত দুটো চলে গেলো তার গালে। এখনো সেই দৃশ্য ভাবলে ভয়ে কুঁকড়ে উঠে। তবুও তার বেহায়া মন আরহাম ছাড়া কিছুই বুঝে না। স্নেহার রিয়াকশন দেখে ইতিমধ্যে সবাই হেসে কপোকাত। অপমানে গাল লাল হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে স্নেহা ব’লে উঠলো,
” তুমি আমাকে এভাবে অপমান করতে পারো না, আরহাম। তুনি যদি ভাবো আমি তোমাকে ভয় পাচ্ছি তাহলে সেটা ভুল। তুমি যত কিছুই করো না কেনো, আমার থেকে তোমার নিস্তার নেই। ”
কথাটা শেষ করেই হনহনিয়ে চলে গেলো স্নেহা। আরহামের করা একেকটা অপমান সে কখোনো ভুলবেনা। এই স্নেহা শেখকে অপমান করার মুল্য বুঝিয়ে দিবে শুধু একবার তাদের বিয়েটা হোক। তারপর দেখে নিবে সে।
রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে আরহামের। রক্ত লাল চোখে তাকিয়ে আছে স্নেহার যাওয়ার দিকে। তার বাবার বন্ধুর মেয়ে বলে, সে এখনো চুপ করে আছে৷ আশরাফ আরহামের কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
” শান্ত হ আরহাম। নিজেকে শান্ত কর। আমাদের কি কথা হয়েছিলো ভুলে গেছিস? ”
আরহাম চোখ বন্ধ করে ফোস করে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। তাকে এখন ঠান্ডা মাথায় সব করতে হবে। সে চাইলে এখনি স্নেহাকে উচিত শিক্ষা দিতে পারতো। কিন্ত স্নেহার বাবার জন্য সে নিজেকে যথাযথ শান্ত রাখছে। আরহাম ভেবেই পেলো না এমন বাবার ঘরে এমন মেয়ে কিভাবে! আচমকা আরহামের দৃষ্টি স্থীর হয়ে গেলো। অদূরে প্রাণ প্রেয়সীর হাসি মাখা মুখটা দেখে বক্ষে যেন শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। একটু আগে করা সকল চিন্তা যেনো ম্যাজিকের মতো ভ্যানিস হয়ে গেলো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আরহাম। তার প্রাণ প্রেয়সীর হাসি এতো সুন্দর যে তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। ফোনের রিংটোনে ধ্যান কেটে গেলো আরহামের। বিরক্তিতে মুখে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে ফোন বের করে দেখলো তার বাবা কল করেছে। অনিচ্ছা থাকা সত্বেও রিসিভ করে কানে ধরলো। মুহুর্তে আবারো তার মুখশ্রী লাল হয়ে গেলো। কিছু না বলে খট করে বাবার মুখের উপর কল কেটে দিলো।
.
ক্লাসে যাওয়ার সময় আমার চোখ আরহাম ভাইয়ের উপর থেমে গেলো। উনার চোহারাটা কোমন লাল লাল লাগছে। চোখের শিরাগুলো লাল হয়ে আছে। তারমানে আরহাম ভাই রেগে আছেন। কিন্তু কেনো রেগে আছে সেটা বোধগম্য হলো না।
” কিরে দাড়িয়ে আছিস কেনো? ”
শশির ডাক কানে আসতেই চোখ সরিয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে হাটা ধরলাম৷ আড় চোখে আবারো আরহাম ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আমি তাকাতেই আমাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো। আমি ঝট করে সামনে তাকালাম। লজ্জায় গাল গরম হয়ে গেলো আমার। আ
ক্লাস শেষ হতেই সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম মার্কেটে যাওয়ার। শশি আর আরিফা কিছু কেনাকাটা করবে। গেটের কাছে আসতে একবার আশেপাশে চোখ বুলালাম। ভাইয়াদের কাউকে দেখতে পেলাম না। প্রতিদিন তো এখানে দাড়িয়ে ওরা সব বন্ধুরা আড্ডা দেয়। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ভাইয়াকে কল দিলাম। দুই তিনটা রিং যেতে রিসিভ করলো। আমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” ভাইয়া তুই কোথায় আছিস? ”
ওপাশ থেকে ভাইয়া আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
” আমি আমি তো একটু বন্ধুদের সাথে চা খেতে বের হয়েছি। কোনো দরকার? ”
” আমি একটু ফ্রেন্ডদের সাথে মার্কেটে যাচ্ছি। আম্মু ফোন দিলে বলে দিস৷ আমার ফোনের ব্যালেন্স তো এখন তুই শেষ করে দিলি। রাখছি আল্লাহ হাফেজ। ”
.
প্রায় অনেকক্ষণ যাবত শপিং করে আমরা রওয়ানা দিলাম রেস্টুরেন্টের দিকে৷ রিকশা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় থামতেই আমরা নেমে পড়লাম। রাইহান আর আরিফার কাহিনি দেখে আমি আর শশি এদিকে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি। দুটোর ভালোবাসা দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ হই ক্ষনে ক্ষনে। ইশ! যদি আমার আর আরহাম ভাইয়ের এমন একটা প্রেম হতো। উনি আমার যত্ন করতেন আর বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
” আইরিশ দেখ তো ওটা আরহাম ভাইয়া না? ”
আরিফার কথায় রেস্টুরেন্টের ভিতরে তাকাতেই আমার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। মুহুর্তে আমার মনের ভিতর এক অদৃষ্ট কিছু ভেঙ্গে পড়লো। নিজেকে কেমন দুর্বল লাগছে। মনে হচ্ছে আমি এখনি বসে পড়বো। আমার চোখের সামনে স্নেহা আপু আরহাম ভাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরে বসে বসে হাসছেন। আরহাম ভাই কিছু বলছেন না তাতে৷ এতে যেনো আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। হুট করে আরহাম ভাইয়ের দৃষ্টি আমাদের উপর পড়তে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো। শশি ব্যাস্ত কন্ঠে ব’লে উঠলো,
” আইরিশ তুই কাঁদছিস কেনো? ”
শশির কথায় কেউ আর ভিতরে না গিয়ে আমাকে নিয়ে এক পাশে দাড়িয়ে আছে। সবাই অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করছে কিন্তু কানে গেলেও মস্তিষ্কে কিছুই গেলো না। বারবার আমার চোখে খালি আরহাম ভাইয়ের হাত কেউ জড়িয়ে ধরে আছে সেটা ভাসছে। বুকের কোথাও খুব করে জ্বলছে আমার। বিষয়টা সহজ হলেও আমার কাছে মোটেও সহজ লাগছে না। নিজের ভালোবাসার মানুষের নজর অন্য নারীর দিকে থাকলেও তা সহ্য করা যায় না আর সেখানে তো। চোখের অশ্রুকণা মুছে ব’লে উঠলাম,
” তোরা যা। আমার ভালো লাগছে না। আমি আসছি। ”
বলেই হনহনিয়ে হাটা শুরু করলাম। আমি জানি ওরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়ত ওরাও এখন আর খাবে না। একটা রিকশা ডেকে উঠে বসতেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম৷ আটকানো অশ্রুগুলো অবাধ্য ধারায় পরতে লাগলো। আরহাম ভাইকে যে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। উনাকে কারো পাশে কল্পনা করাটা যে আমার কাছে মৃত্যু সমতুল্য।
বাসার সামনে আসতে রিকশা ভাড়াটা দিয়ে চোখটাকে ভালো করে মুছে নিলাম। আবার চোখটা ভিজে উঠছে আমার। নিজেকে কোনোভাবে সামলে দরজার কলিং বেলে চাপ দেওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই আম্মু দরজা খুলে যেই কিছু একটা বলবে আমি দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম৷ কাঁধের ব্যাগটাকে ছুড়ে মেরে বিছানায় বসে কেঁদে দিলাম। আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ কেমন এক অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের বা’পাশে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। আর সহ্য হচ্ছে না আমার। বালিসে মুখ গুজে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। ওপাশ থেকে আম্মু দরজা ধাকাচ্ছে আর চেচিয়ে ব’লে যাচ্ছেন,
” আইরিশ এই আইরিশ। দরজা খোল! কি হয়েছে তোর । শুনতে পাচ্ছিস, আইরিশ। আমার টেনশন হচ্ছে। ”
আমি শুকনো ঢোগ গিলে আম্মুকে বলে উঠলাম,
” আমি একটু ঘুমাবো এখন। মাথা ব্যাথা করছে৷ আপনি চিন্তা করবেন না। ”
আম্মু আচ্ছা বলে চলে গেলেন।
.
“আমি আপনাকে প্রচুর ভালোবাসি, আরহাম! আরহাম জানেন, আমি আগে জানতাম না ভালোবাসা কি, কিন্তু আপনাকে দেখার পর ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারলাম। আপনার বুকের এই যে, এই প্রসস্ত জায়গাটা আছে না? ঠিক এখানে মাথা ঠেকিয়ে আপনার হৃদস্পন্দন শুনতে চাই। আপনার বাহুডোরে সারাজীবন আবদ্ধ হতে চাই।”
আরহাম ভাই স্তব্ধ হয়ে আছেন মনে হয় আমার কথা শুনে। আমি চোখ মুছে উনার স্তব্ধ হওয়া মুখপানে তাকিয়ে, আরেকটু কাছে গিয়ে বললাম,
” আমাকে কি আপনার জীবন সঙ্গী বানানো যায় না, আরহাম? আপনার পাশে থাকার এই ছোট্ট ইচ্ছাটুকু কি পুরন করা যায় না? আমাকে ছেড়ে যাবেন না , আরহাম। প্লিজ! ”
চলবে!